॥ ইকতেদার আহমেদ ॥
পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে স্বশাসিত সরকারব্যবস'া প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করছে। তবে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস'া শুরুতেই হোঁচট খায়। আমাদের দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পারস্পরিক আস'া ও শ্রদ্ধাবোধ না থাকায় এ দেশে এখনো গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। সে কারণে বড় দু’টি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থাকা অবস'ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার বিপক্ষে অপর দিকে ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস'ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার পক্ষে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটি দলীয় সরকারের, একটি অস'ায়ী সরকারের এবং তিনটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন ছিল। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সর্বসাকুল্যে সাতটি আসন লাভ করে। সে সময় কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জামায়াত ও মুসলিম লীগসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের নিরঙ্কুশ সমর্থন বিকল্প ব্যবস'ার অনুপসি'তিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই জাসদের প্রতি ঝুঁকে ছিল। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জনমতের যে অবস'ান ছিল তাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর আসনপ্রাপ্তি নিশ্চিত থাকলেও ক্ষমতাসীনদের অনেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নবসৃষ্ট বিরোধী দল জাসদকে সম্মানজনক আসন প্রদানে কুণ্ঠিত ছিল। এ কুণ্ঠার বহিঃপ্রকাশে জাসদ নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদকে ব্যালট জালিয়াতির মাধ্যমে পরাজিত দেখিয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের বিজয় হাসিল করা সম্ভব হয়েছিল। এভাবে তৎকালীন বিরোধীদলীয় প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে মেজর আবদুল জলিল, ড. আলিম আল-রাজি, মমতাজ বেগম, মঈনুদ্দিন মানিক প্রমুখের বিজয়কে পর্যুদস্ত করে বিরোধী দলকে সে সময়ের জনসমর্থনের তুলনায় গ্লানিময় ও অবমাননাকরসংখ্যক আসন প্রদান করা হয়েছিল। সে দিন জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের পরাজয় মেনে নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদের বিজয়কে ছিনিয়ে নেয়া না হলে ’৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনাটি ঘটত কি না এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে এ দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস'া চালু ছিল। সে সময়কার রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সে নির্বাচনে মুসলিম লীগসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল। সে নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৪০টি আসন পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের এ আসন প্রাপ্তি তৎকালীন জনমত বিবেচনায় পর্যাপ্ত ছিল না। তা ছাড়া সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ উদ্দেশ্যমূলক ছিল। পরে দেখা গেছে, আরেক বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ মাঝপথেই বিলুপ্ত হয়।
সামরিক শাসক এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকাকালীন ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও পরে কোনো এক অজানা কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আশাহতভাবে শ’খানেক আসন পায়। সে নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে ফলাফল ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেত। এ নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ উদ্দেশ্যমূলক ছিল। আওয়ামী লীগ পরে তৃতীয় জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনুপসি'তিতে ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে জাসদের আ স ম আবদুুর রবকে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ করান। ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলে এ সংসদ অবলুপ্ত হয়।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী ১৯৯১ সালে অস'ায়ী সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। সে নির্বাচনে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাধ্যমে জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছিল। যদিও ধারণা করা হয় এরশাদকে মুক্তভাবে নির্বাচন করার সুযোগ দিলে সে নির্বাচনে হয়তো জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যার আরো কিছু বাড়ত।
আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সম্মিলিতভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'ার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে এবং সে দাবি বাস্তবায়ন না করে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনু্ষ্িঠত হলে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বিএনপি তিন-চতুর্থাংশের অধিকসংখ্যক আসন নিয়ে ফ্রিডম পার্টিকে বিরোধী দলের ভূমিকায় পদার্পণ করিয়ে সামনে চলার পথ সুগম করতে পারেনি। এ সংসদ তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে এক মাসেরও কম সময়ের স'ায়িত্বে শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধিবিধান সন্নিবেশন করে অবলুপ্ত হয়।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার রূপরেখা দেয়া হয়েছিল তাতে বলা ছিল প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টা এবং অপর অনধিক ১০ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে যারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
এ ব্যবস'ায় প্রধান উপদেষ্টা বিষয়ে বলা ছিল রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যিনি উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। ওই রূপ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি পাওয়া না গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে অসম্মত হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে অসম্মত হন সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যিনি উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। ওই রূপ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক না পাওয়া গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে অসম্মত হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত অনুরূপ বিচারকের অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। আপিল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারক পাওয়া না গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যতদূর সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনাক্রমে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। উপরি উক্ত কোনো বিধানাবলি কার্যকর করা না গেলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি এ সংবিধানের অধীন তার স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া সংক্রান্ত উপরি উক্ত বিধানাবলি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে ছয়টি বিকল্প রয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী প্রথম বিকল্পটি নিঃশেষিত না করে দ্বিতীয়টিতে যাওয়ার অবকাশ নেই এবং অনুরূপভাবে পরের বিকল্পগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে নিঃশেষিত না করে সর্বশেষ বিকল্পে পৌঁছানোর সুযোগ অনুপসি'ত।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালে সপ্তম এবং ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম বিকল্প অনুসরণের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সম্ভব হয়েছিল। উভয় নির্বাচনে দেখা গেছে, অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন দল পরাভূত হয়ে অব্যবহিত আগের বিরোধী দল বিজয়ী হয়েছে। যদিও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া প্রবর্তন করা হয়েছিল কিন' সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী দেখা গেছে, বিজিত দল বিজয়ী দলের প্রধানকে অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে পরাজয়ের গ্লানি প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আরোপে সচেষ্ট ছিল। এর পর থেকে অদ্যাবধি সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজিত দলের কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টারা অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান পরবর্তী রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক বিকল্পগুলো নিঃশেষিত না করে স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানরূপে আবির্ভূত হলে সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনসমর্থনের অনুপসি'তিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিকে অদ্যাবধি সাংবিধানিক অনুমোদন দেয়নি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বিলুপ্ত করা হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া প্রশ্নে দেশের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস'ান স্পষ্টতই ভিন্ন মেরুতে। আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনা বর্তমান সংসদের মেয়াদ অবসান ৯০ দিন পূর্ববর্তী তারা ক্ষমতাসীন থাকাবস'ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন। আর সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়েছে। অপর দিকে বিএনপি কিছুতেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অপারগ। বিএনপির দাবি নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী নয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনরা নির্বাচিত বা পুন:নির্বাচিত হয়েছে। পক্ষান্তরে অস'ায়ী ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত প্রতিটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা দেয়া হয়েছিল, আজ সময়ের বিবর্তনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে সে রূপরেখা গ্রহণযোগ্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে এ রূপরেখা গ্রহণযোগ্য নয় এ বিবেচনায় তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার বিলোপ ঘটিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার বিষয়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন করেছে।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস'ায় নিজ দলের আদর্শের প্রতি অনুগত ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা কারার মানসে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭-তে বৃদ্ধি করেছিল। যদিও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া প্রবর্তন পরবর্তী সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে প্রথম বিকল্প ফলপ্রদ ছিল কিন' অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী দেখা গেল সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় প্রথম বিকল্প অনুসরণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সম্ভব হয়নি। এ বাস্তবতায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় তারা এ ব্যবস'ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে অনড়। এহেন পরিসি'তিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার মতো যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে তা অষ্টম জাতীয় সংসদ অবসান-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিগত দিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেটি হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত। অপর দিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় নিশ্চিত। এ বাস্তবতায় সরকারি বা বিরোধী দলের জনসভায় জনসমাগম যা-ই হোক না কেন দলীয় অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ফলাফল কী হবে তা বোধ করি রাজনীতি সচেতন সবাই অনুধাবন করতে সক্ষম।
যদিও রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা স্পিকারের নেতৃত্বে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল থেকে সমসংখ্যক মন্ত্রী নিয়োগের মাধ্যমে অন্তবর্তী সরকার গঠনের কথা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে কিন' আমাদের রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা স্পিকার নিজেদের দলীয় আবরণ পরিহার করে সর্বজনগ্রহণযোগ্য হতে পেরেছেন কি?
১৯৯০-পরবর্তী বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ে দু’বার করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার সুফল ভোগ করে ক্ষমতাসীন হয়েছে। বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ের রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশ এবং জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণ হয়ে থাকলে উভয় দলের উচিত হবে সাংবিধানিক বা সরকারি পদে আসীন নয় এমন একজন যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা যিনি নবম জাতীয় সংসদ মেয়াদ অবসান-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে আসীন হবেন। ১৬ কোটি জনগণের দেশে এমন দু-চার ১০ জন যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মোটেও দুরূহ নয়। প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন-পরবর্তী তিনি দেশের দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে উভয় দল থেকে সমসংখ্যক উপদেষ্টা নিয়োগ দিলে উভয় দলের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকারই কথা।
আমরা যখন দলমত নির্বিশেষে আমাদের দেশের সুসন্তানকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান হিসেবে উপযুক্ত ভাবছি, তখন ওই ব্যক্তি বা অনুরূপ বা কাছাকাছি যোগ্যতাসম্পন্ন অপর কোনো ব্যক্তিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ভাবতে বাধা কোথায়? ওই ব্যক্তির অপারগতায় সম্ভাব্য যাদের কথা ভাবা যায় তারা হচ্ছেন নাইট উপাধিপ্রাপ্ত এনজিও ব্যক্তিত্ব, স্বেচ্ছায় পদত্যাগী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও সাবেক অর্থসচিব, ছিপছিপে গড়নের প্রথিতযশা দেশবরণ্য আইনজ্ঞ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান বিচারপতি পদে অতিক্রান্ত স্বেচ্ছায় পদত্যাগী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ও সাবেক কেবিনেট সচিব, টিআইবির সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান ও সাবেক উপদেষ্টা প্রমুখ। আর যদি বাধা না-ই থাকে তবে আমাদের সামনের দিনগুলো হবে সুষমমণ্ডিত অন্যথায় কণ্টকাকীর্ণ। সুতরাং একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'ার সঙ্কট নিরসন না করে যে ঘনীভূত করবে তাতে কোনো ধরনের দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই বললেই চলে।
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিম কোর্ট
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে স্বশাসিত সরকারব্যবস'া প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করছে। তবে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস'া শুরুতেই হোঁচট খায়। আমাদের দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পারস্পরিক আস'া ও শ্রদ্ধাবোধ না থাকায় এ দেশে এখনো গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। সে কারণে বড় দু’টি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থাকা অবস'ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার বিপক্ষে অপর দিকে ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস'ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার পক্ষে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটি দলীয় সরকারের, একটি অস'ায়ী সরকারের এবং তিনটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন ছিল। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সর্বসাকুল্যে সাতটি আসন লাভ করে। সে সময় কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জামায়াত ও মুসলিম লীগসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের নিরঙ্কুশ সমর্থন বিকল্প ব্যবস'ার অনুপসি'তিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই জাসদের প্রতি ঝুঁকে ছিল। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জনমতের যে অবস'ান ছিল তাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর আসনপ্রাপ্তি নিশ্চিত থাকলেও ক্ষমতাসীনদের অনেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নবসৃষ্ট বিরোধী দল জাসদকে সম্মানজনক আসন প্রদানে কুণ্ঠিত ছিল। এ কুণ্ঠার বহিঃপ্রকাশে জাসদ নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদকে ব্যালট জালিয়াতির মাধ্যমে পরাজিত দেখিয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের বিজয় হাসিল করা সম্ভব হয়েছিল। এভাবে তৎকালীন বিরোধীদলীয় প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে মেজর আবদুল জলিল, ড. আলিম আল-রাজি, মমতাজ বেগম, মঈনুদ্দিন মানিক প্রমুখের বিজয়কে পর্যুদস্ত করে বিরোধী দলকে সে সময়ের জনসমর্থনের তুলনায় গ্লানিময় ও অবমাননাকরসংখ্যক আসন প্রদান করা হয়েছিল। সে দিন জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের পরাজয় মেনে নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদের বিজয়কে ছিনিয়ে নেয়া না হলে ’৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনাটি ঘটত কি না এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে এ দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস'া চালু ছিল। সে সময়কার রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সে নির্বাচনে মুসলিম লীগসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল। সে নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৪০টি আসন পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের এ আসন প্রাপ্তি তৎকালীন জনমত বিবেচনায় পর্যাপ্ত ছিল না। তা ছাড়া সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ উদ্দেশ্যমূলক ছিল। পরে দেখা গেছে, আরেক বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ মাঝপথেই বিলুপ্ত হয়।
সামরিক শাসক এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকাকালীন ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও পরে কোনো এক অজানা কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আশাহতভাবে শ’খানেক আসন পায়। সে নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে ফলাফল ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেত। এ নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ উদ্দেশ্যমূলক ছিল। আওয়ামী লীগ পরে তৃতীয় জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনুপসি'তিতে ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে জাসদের আ স ম আবদুুর রবকে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ করান। ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলে এ সংসদ অবলুপ্ত হয়।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী ১৯৯১ সালে অস'ায়ী সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। সে নির্বাচনে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাধ্যমে জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছিল। যদিও ধারণা করা হয় এরশাদকে মুক্তভাবে নির্বাচন করার সুযোগ দিলে সে নির্বাচনে হয়তো জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যার আরো কিছু বাড়ত।
আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সম্মিলিতভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'ার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে এবং সে দাবি বাস্তবায়ন না করে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনু্ষ্িঠত হলে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বিএনপি তিন-চতুর্থাংশের অধিকসংখ্যক আসন নিয়ে ফ্রিডম পার্টিকে বিরোধী দলের ভূমিকায় পদার্পণ করিয়ে সামনে চলার পথ সুগম করতে পারেনি। এ সংসদ তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে এক মাসেরও কম সময়ের স'ায়িত্বে শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধিবিধান সন্নিবেশন করে অবলুপ্ত হয়।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার রূপরেখা দেয়া হয়েছিল তাতে বলা ছিল প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টা এবং অপর অনধিক ১০ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে যারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
এ ব্যবস'ায় প্রধান উপদেষ্টা বিষয়ে বলা ছিল রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যিনি উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। ওই রূপ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি পাওয়া না গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে অসম্মত হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে অসম্মত হন সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যিনি উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। ওই রূপ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক না পাওয়া গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে অসম্মত হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত অনুরূপ বিচারকের অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। আপিল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারক পাওয়া না গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যতদূর সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনাক্রমে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। উপরি উক্ত কোনো বিধানাবলি কার্যকর করা না গেলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি এ সংবিধানের অধীন তার স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া সংক্রান্ত উপরি উক্ত বিধানাবলি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে ছয়টি বিকল্প রয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী প্রথম বিকল্পটি নিঃশেষিত না করে দ্বিতীয়টিতে যাওয়ার অবকাশ নেই এবং অনুরূপভাবে পরের বিকল্পগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে নিঃশেষিত না করে সর্বশেষ বিকল্পে পৌঁছানোর সুযোগ অনুপসি'ত।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালে সপ্তম এবং ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম বিকল্প অনুসরণের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সম্ভব হয়েছিল। উভয় নির্বাচনে দেখা গেছে, অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন দল পরাভূত হয়ে অব্যবহিত আগের বিরোধী দল বিজয়ী হয়েছে। যদিও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া প্রবর্তন করা হয়েছিল কিন' সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী দেখা গেছে, বিজিত দল বিজয়ী দলের প্রধানকে অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে পরাজয়ের গ্লানি প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আরোপে সচেষ্ট ছিল। এর পর থেকে অদ্যাবধি সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজিত দলের কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টারা অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান পরবর্তী রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক বিকল্পগুলো নিঃশেষিত না করে স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানরূপে আবির্ভূত হলে সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনসমর্থনের অনুপসি'তিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিকে অদ্যাবধি সাংবিধানিক অনুমোদন দেয়নি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বিলুপ্ত করা হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া প্রশ্নে দেশের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস'ান স্পষ্টতই ভিন্ন মেরুতে। আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনা বর্তমান সংসদের মেয়াদ অবসান ৯০ দিন পূর্ববর্তী তারা ক্ষমতাসীন থাকাবস'ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন। আর সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়েছে। অপর দিকে বিএনপি কিছুতেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অপারগ। বিএনপির দাবি নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী নয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনরা নির্বাচিত বা পুন:নির্বাচিত হয়েছে। পক্ষান্তরে অস'ায়ী ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত প্রতিটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা দেয়া হয়েছিল, আজ সময়ের বিবর্তনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে সে রূপরেখা গ্রহণযোগ্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে এ রূপরেখা গ্রহণযোগ্য নয় এ বিবেচনায় তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার বিলোপ ঘটিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার বিষয়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন করেছে।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস'ায় নিজ দলের আদর্শের প্রতি অনুগত ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা কারার মানসে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭-তে বৃদ্ধি করেছিল। যদিও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া প্রবর্তন পরবর্তী সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে প্রথম বিকল্প ফলপ্রদ ছিল কিন' অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী দেখা গেল সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় প্রথম বিকল্প অনুসরণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সম্ভব হয়নি। এ বাস্তবতায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় তারা এ ব্যবস'ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে অনড়। এহেন পরিসি'তিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার মতো যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে তা অষ্টম জাতীয় সংসদ অবসান-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিগত দিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেটি হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত। অপর দিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় নিশ্চিত। এ বাস্তবতায় সরকারি বা বিরোধী দলের জনসভায় জনসমাগম যা-ই হোক না কেন দলীয় অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ফলাফল কী হবে তা বোধ করি রাজনীতি সচেতন সবাই অনুধাবন করতে সক্ষম।
যদিও রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা স্পিকারের নেতৃত্বে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল থেকে সমসংখ্যক মন্ত্রী নিয়োগের মাধ্যমে অন্তবর্তী সরকার গঠনের কথা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে কিন' আমাদের রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা স্পিকার নিজেদের দলীয় আবরণ পরিহার করে সর্বজনগ্রহণযোগ্য হতে পেরেছেন কি?
১৯৯০-পরবর্তী বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ে দু’বার করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'ার সুফল ভোগ করে ক্ষমতাসীন হয়েছে। বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ের রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশ এবং জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণ হয়ে থাকলে উভয় দলের উচিত হবে সাংবিধানিক বা সরকারি পদে আসীন নয় এমন একজন যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা যিনি নবম জাতীয় সংসদ মেয়াদ অবসান-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে আসীন হবেন। ১৬ কোটি জনগণের দেশে এমন দু-চার ১০ জন যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মোটেও দুরূহ নয়। প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন-পরবর্তী তিনি দেশের দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে উভয় দল থেকে সমসংখ্যক উপদেষ্টা নিয়োগ দিলে উভয় দলের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকারই কথা।
আমরা যখন দলমত নির্বিশেষে আমাদের দেশের সুসন্তানকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান হিসেবে উপযুক্ত ভাবছি, তখন ওই ব্যক্তি বা অনুরূপ বা কাছাকাছি যোগ্যতাসম্পন্ন অপর কোনো ব্যক্তিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ভাবতে বাধা কোথায়? ওই ব্যক্তির অপারগতায় সম্ভাব্য যাদের কথা ভাবা যায় তারা হচ্ছেন নাইট উপাধিপ্রাপ্ত এনজিও ব্যক্তিত্ব, স্বেচ্ছায় পদত্যাগী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও সাবেক অর্থসচিব, ছিপছিপে গড়নের প্রথিতযশা দেশবরণ্য আইনজ্ঞ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান বিচারপতি পদে অতিক্রান্ত স্বেচ্ছায় পদত্যাগী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ও সাবেক কেবিনেট সচিব, টিআইবির সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান ও সাবেক উপদেষ্টা প্রমুখ। আর যদি বাধা না-ই থাকে তবে আমাদের সামনের দিনগুলো হবে সুষমমণ্ডিত অন্যথায় কণ্টকাকীর্ণ। সুতরাং একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'ার সঙ্কট নিরসন না করে যে ঘনীভূত করবে তাতে কোনো ধরনের দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই বললেই চলে।
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিম কোর্ট
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন