আবদুল মান্নান | তারিখ: ১৮-০৪-২০১২
বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মহাজোট সরকারের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫১ বছরের রাজনৈতিক জীবনের একটি বেদনাদায়ক সমাপ্তি হলো। তিনি সোমবার রেলমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন। যে ঘটনার প্রেক্ষাপটে এটি ঘটেছে তা শুধু ব্যক্তি সুরঞ্জিতের জন্যই বেদনাদায়ক নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের জন্যও বিব্রতকর এবং ঘটনাটির জন্য দলকে চড়া মূল্যও দিতে হতে পারে। পুরো বিষয়টির সমাপ্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে। দেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে ছোট থেকে বড় সমস্যা বা সংকট সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে সবাইকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে কারণে পদত্যাগ করলেন, তা মোটামুটি দেশের সব মানুষ জানে। তিনি সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, বর্তমানে তিনি যে শুধু বিপদে আছেন তা-ই নয়, এই বিপদ গণতন্ত্রের জন্যও বটে। পাঠকদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৮১ সালের কথা। তখন বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি। জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিচারপতি সাত্তার শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল ছিলেন। সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ১৯৮২ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে যুববিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সন্ত্রাসী ইমদুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর কদিন পরই ২৪ মার্চ এরশাদ বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে টিভি ও বেতারে এক ভাষণ দিয়ে তাঁর পদক্ষেপ জায়েজ করার চেষ্টা করলেন এবং সবাইকে মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না, যে সরকারের একজন মন্ত্রীর বাসা থেকে একজন বড় মাপের সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সে সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না। অতএব, তিনি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৯ এপ্রিল রাত ১১টায় রেলমন্ত্রীর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির হাতে তাদের সদর দপ্তর পিলখানায় ধরা পড়েন। এ সময় তাঁরা একটি মাইক্রোবাসে ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক এবং গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালক আজম খান।
৭০ লাখ টাকা (টাকার অঙ্ক নিয়ে একাধিক মত আছে), চারজন লোক, সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাহিনী আর অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন। প্রথমত, টাকাগুলো কার? এত রাতে যাচ্ছিল কোথায়? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর পিলখানায় সাধারণ মানুষ বা তাদের যানবাহন প্রবেশ সহজ নয়। সন্ধ্যার পর প্রধান ফটক বন্ধ থাকে। প্রয়োজনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা তা খোলেন। গাড়ির চালক আজম খান তাঁর গাড়ি নিয়ে এত সহজে সেখানে প্রবেশ করলেন কীভাবে? বলা হয়েছিল, ওই গাড়ির চারজনকেই বিজিবি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। চারজনকেই সকালে ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনজনের হদিস পাওয়া গেলেও চালকের এই অবধি কোনো হদিস মিলছে না। তিনি কোথায় গেলেন? রাত ১১টায় ঘটনার সূত্রপাত। এত দ্রুত সংবাদমাধ্যম কীভাবে খবর পেল? যে টাকার বস্তা নিয়ে এত তোলপাড়, সে টাকার বস্তা কার হেফাজতে আছে? অন্য কেউ যদি এ রকম একটি ঘটনায় আটক হতো তাকে বা তাদের কি এভাবে ছাড়া হতো? পরদিন রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। বললেন, বাংলা নতুন বছরে ঢাকা-সিলেট রুটে যে এক জোড়া নতুন ট্রেন চালু হওয়ার কথা, তা ওই দিন চালু হচ্ছে না, সেই সংবাদ জানানোর জন্য এই সংবাদ সম্মেলন।
আসলে কি তাই? সেটা তো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েই জানানো যেত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এত বোকা নন যে তিনি মনে করবেন, সাংবাদিকেরা আগের রাতের ৭০ লাখ টাকা সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না। প্রশ্ন তাঁরা ঠিকই করেছেন। তিনি প্রথমে পুরো ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পরে বললেন, ওই টাকা তাঁর সহকারী একান্ত সচিবের হতে পারে। বললেন, কারও কাছে ব্যক্তিগত ৭০ লাখ টাকা থাকতেই পারে। তা অবশ্যই পারে। কিন্তু রাত ১১টায় অত টাকা নিয়ে সাংসদের স্টিকার লাগানো গাড়িতে চারজন মানুষের ঘোরাফেরা যেকোনো বিচারেই সন্দেহজনক। পরদিন একান্ত সচিব ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই টাকা তাঁর শ্যালক লন্ডন থেকে পাঠিয়েছেন। কীভাবে পাঠালেন? বৈধ উপায়ে পাঠালে তার নিশ্চয় রেকর্ড থাকবে। আছে কি ও রকম কোনো রেকর্ড? আটক সবাই বলেছেন, তাঁরা গাড়ি নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যাচ্ছিলেন। রেলমন্ত্রী বলেছেন, তিনি রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়েন। জিএম সাহেব বলেছেন, তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই যাচ্ছিলেন। এখানে কেউ একজন অসত্য বলেছেন। তিনি কে? গোয়েন্দা বাহিনী তো মোবাইল ফোনের কল ট্রাক করে কললিস্ট বের করে থাকে। চেষ্টা করে দেখবে নাকি ওই চারজন কার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন? আবার মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ওমর ফারুক তাঁর বাসা মোহাম্মদপুরে যাচ্ছিলেন। কথাটা যদি সত্যও হয় তাহলে বাকি দুজন কোথায় যাচ্ছিলেন? তাঁরা কি একসঙ্গে ওমর ফারুকের বাসায় যাচ্ছিলেন? কেন এবং কী উদ্দেশ্যে? জিএম রেলের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাঁর নিজের গাড়ির কী হলো? যে মাইক্রোবাসটিতে তাঁরা সে রাতে যাচ্ছিলেন, সেটি ওমর ফারুকের বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। জিএম সাহেব তাঁর নিজের গাড়ি ব্যবহার না করে কেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের মতো একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার গাড়ি ব্যবহার করতে গেলেন? তা-ও আবার তাঁকে টেলিফোনে ডেকে নিয়ে তিনি গাড়িতে ওঠেন!
জিএম ইউসুফ হোসেন মৃধা মাদারীপুরের ‘কৃতী সন্তান’। সৈয়দ আবুল হোসেন যখন যোগাযোগমন্ত্রী তখন তিনি পাঁচজনকে ডিঙিয়ে জিএম পদটিতে অভিষিক্ত হন। তিনি প্রশাসনের অন্য অনেকের মতো রাতারাতি আওয়ামী লীগ সমর্থক। রেলের সবাই বলে, মৃধা জেনারেল জিয়া আর বিএনপির একজন বড় অনুসারী। ঘটনাচক্রে সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়িও মাদারীপুর। বাংলাদেশের রাজনীতি, চাকরি, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে আঞ্চলিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। গোপালগঞ্জে যার জন্ম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের অনেকের জন্য ঈদের চাঁদ ওঠে। সবাই নিজেকে একেকজন বঙ্গবন্ধু মনে করে। ২০০১ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদের বাড়িও গোপালগঞ্জ ছিল। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টাকারী মুফতি আবদুল হান্নানের বাড়িও কিন্তু গোপালগঞ্জে। আর যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে দুটি জেলার মানুষের জন্য সব সময় ঈদের চাঁদ আকাশে থাকে—একটি বগুড়া আর অন্যটি ফেনী।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওই রাতের ৭০ লাখ টাকা (?) নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্লগে কদিন ধরে বেশ রমরমা আসর বসছে। এই আসরে দুঃখজনকভাবে আবার সাম্প্রদায়িকতাও উঁকিঝুঁকি মারছে। কয়েকজন ইতিমধ্য তাঁকে ভারত চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছে, এত দিনে বোঝা গেল কেন তাঁর মন্ত্রী হওয়ার জন্য এত খায়েশ ছিল। এখানে আবার ষড়যন্ত্রতত্ত্বও আছে, যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছি। আমার এক বন্ধু যে একজন ঘোরতর আওয়ামী লীগ সমর্থক, এই ঘটনার ফল বছরের শেষে মিলবে বলে আমাকে জানাল। তবে সে পরিষ্কার করে বলেনি সেটা কীভাবে ঘটবে। ১২ তারিখে শ্রীলঙ্কা থেকে প্রকাশিত শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান এ বিষয়ে বেশ উপাদেয় মসলা দিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে সরকারের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির নাম দিয়ে একটি দীর্ঘ কাহিনি প্রকাশ করেছে। সেটি এখন অনেকগুলো ব্লগে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে।
আসলে ওই টাকাগুলো যে অবৈধ তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে তদন্তে অন্য কিছুও বের হতে পারে। কথায় বলে, ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।’ বাংলাদেশে বাণিজ্যের অভাব নেই। ভর্তি-বাণিজ্য, হলে সিট-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস-বাণিজ্য, জিম্মি-বাণিজ্য, মনোনয়ন-বাণিজ্য, পদায়ন-বাণিজ্য, পদোন্নতি-বাণিজ্য আর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য নিয়োগ-বাণিজ্য। ১৫ কোটি মানুষের দেশে চাকরি এমনিতেই মহার্ঘ্য। সেখানে তো বাণিজ্যের পরিমাণ একটু বেশি হবেই। সরকারের এমন কোনো বিভাগ কি আছে, যেখানে বণিজ্য হয় না? গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, প্রভৃতি অভিজাত এলাকায় যাঁদের বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট আছে, তাঁর মালিকানার ওপর যদি একটি জরিপ চালানো যেত, তাহলে বোঝা যেত বাংলাদেশে মৃধা বা ওমর ফারুকদের সংখ্যা কত। কাদের বাচ্চারা দেশের ভেতরে মাসে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে স্কুলে পড়ে, কাদের ছেলেমেয়ে নিয়মিত বিদেশে লেখাপড়া করতে যায়, কারা ঈদে বা ছেলেমেয়ের বিয়ের বাজার করতে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যায়, কাদের মালয়েশিয়ায় বা দুবাইতে দ্বিতীয় আবাস আছে। এসব নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন করুক না একটা জরিপ। দেশের মানুষ দেখুক তাদের বুকের পাটা আছে।
মানুষের যথার্থ প্রশ্ন ছিল, সুরঞ্জিত বিষয়ে জটিলতার সুরাহা কেমন করে হবে? আদৌ কি হবে? হলে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু থাকবে? তবে অধিকাংশ মানুষের মতো তিনি পা পিছলে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলার আগে নিজে পদ থেকে ইস্তফা দিলে কিছু সম্মান হলেও বাঁচত। তা হয়নি। বুঝতে হবে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতির একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, নিজের ভুলে তাঁর পতন হয়েছে। রাজনীতিতে এমনটি হওয়া বিচিত্র নয়। তবে দেশের মানুষ দেখতে চায় এই টাকা-রহস্যের সঠিক সমাধান এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই ছাড়া না পায়। মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালো বিড়াল খুঁজছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি নিজেই যেন হয়ে গেলেন সেই কালো বিড়াল। তার পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অভিনন্দন যে তিনি পদত্যাগ করার মতো সাহস দেখিয়েছেন। আর বিএনপির এই ঘটনায় উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই, কারণ তাদের আমলের দুর্নীতির কথা এখনো মানুষ ভুলে যায়নি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মহাজোট সরকারের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫১ বছরের রাজনৈতিক জীবনের একটি বেদনাদায়ক সমাপ্তি হলো। তিনি সোমবার রেলমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন। যে ঘটনার প্রেক্ষাপটে এটি ঘটেছে তা শুধু ব্যক্তি সুরঞ্জিতের জন্যই বেদনাদায়ক নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের জন্যও বিব্রতকর এবং ঘটনাটির জন্য দলকে চড়া মূল্যও দিতে হতে পারে। পুরো বিষয়টির সমাপ্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে। দেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে ছোট থেকে বড় সমস্যা বা সংকট সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে সবাইকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে কারণে পদত্যাগ করলেন, তা মোটামুটি দেশের সব মানুষ জানে। তিনি সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, বর্তমানে তিনি যে শুধু বিপদে আছেন তা-ই নয়, এই বিপদ গণতন্ত্রের জন্যও বটে। পাঠকদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৮১ সালের কথা। তখন বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি। জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিচারপতি সাত্তার শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল ছিলেন। সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ১৯৮২ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে যুববিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সন্ত্রাসী ইমদুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর কদিন পরই ২৪ মার্চ এরশাদ বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে টিভি ও বেতারে এক ভাষণ দিয়ে তাঁর পদক্ষেপ জায়েজ করার চেষ্টা করলেন এবং সবাইকে মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না, যে সরকারের একজন মন্ত্রীর বাসা থেকে একজন বড় মাপের সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সে সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না। অতএব, তিনি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৯ এপ্রিল রাত ১১টায় রেলমন্ত্রীর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির হাতে তাদের সদর দপ্তর পিলখানায় ধরা পড়েন। এ সময় তাঁরা একটি মাইক্রোবাসে ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক এবং গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালক আজম খান।
৭০ লাখ টাকা (টাকার অঙ্ক নিয়ে একাধিক মত আছে), চারজন লোক, সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাহিনী আর অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন। প্রথমত, টাকাগুলো কার? এত রাতে যাচ্ছিল কোথায়? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর পিলখানায় সাধারণ মানুষ বা তাদের যানবাহন প্রবেশ সহজ নয়। সন্ধ্যার পর প্রধান ফটক বন্ধ থাকে। প্রয়োজনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা তা খোলেন। গাড়ির চালক আজম খান তাঁর গাড়ি নিয়ে এত সহজে সেখানে প্রবেশ করলেন কীভাবে? বলা হয়েছিল, ওই গাড়ির চারজনকেই বিজিবি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। চারজনকেই সকালে ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনজনের হদিস পাওয়া গেলেও চালকের এই অবধি কোনো হদিস মিলছে না। তিনি কোথায় গেলেন? রাত ১১টায় ঘটনার সূত্রপাত। এত দ্রুত সংবাদমাধ্যম কীভাবে খবর পেল? যে টাকার বস্তা নিয়ে এত তোলপাড়, সে টাকার বস্তা কার হেফাজতে আছে? অন্য কেউ যদি এ রকম একটি ঘটনায় আটক হতো তাকে বা তাদের কি এভাবে ছাড়া হতো? পরদিন রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। বললেন, বাংলা নতুন বছরে ঢাকা-সিলেট রুটে যে এক জোড়া নতুন ট্রেন চালু হওয়ার কথা, তা ওই দিন চালু হচ্ছে না, সেই সংবাদ জানানোর জন্য এই সংবাদ সম্মেলন।
আসলে কি তাই? সেটা তো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েই জানানো যেত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এত বোকা নন যে তিনি মনে করবেন, সাংবাদিকেরা আগের রাতের ৭০ লাখ টাকা সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না। প্রশ্ন তাঁরা ঠিকই করেছেন। তিনি প্রথমে পুরো ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পরে বললেন, ওই টাকা তাঁর সহকারী একান্ত সচিবের হতে পারে। বললেন, কারও কাছে ব্যক্তিগত ৭০ লাখ টাকা থাকতেই পারে। তা অবশ্যই পারে। কিন্তু রাত ১১টায় অত টাকা নিয়ে সাংসদের স্টিকার লাগানো গাড়িতে চারজন মানুষের ঘোরাফেরা যেকোনো বিচারেই সন্দেহজনক। পরদিন একান্ত সচিব ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই টাকা তাঁর শ্যালক লন্ডন থেকে পাঠিয়েছেন। কীভাবে পাঠালেন? বৈধ উপায়ে পাঠালে তার নিশ্চয় রেকর্ড থাকবে। আছে কি ও রকম কোনো রেকর্ড? আটক সবাই বলেছেন, তাঁরা গাড়ি নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যাচ্ছিলেন। রেলমন্ত্রী বলেছেন, তিনি রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়েন। জিএম সাহেব বলেছেন, তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই যাচ্ছিলেন। এখানে কেউ একজন অসত্য বলেছেন। তিনি কে? গোয়েন্দা বাহিনী তো মোবাইল ফোনের কল ট্রাক করে কললিস্ট বের করে থাকে। চেষ্টা করে দেখবে নাকি ওই চারজন কার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন? আবার মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ওমর ফারুক তাঁর বাসা মোহাম্মদপুরে যাচ্ছিলেন। কথাটা যদি সত্যও হয় তাহলে বাকি দুজন কোথায় যাচ্ছিলেন? তাঁরা কি একসঙ্গে ওমর ফারুকের বাসায় যাচ্ছিলেন? কেন এবং কী উদ্দেশ্যে? জিএম রেলের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাঁর নিজের গাড়ির কী হলো? যে মাইক্রোবাসটিতে তাঁরা সে রাতে যাচ্ছিলেন, সেটি ওমর ফারুকের বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। জিএম সাহেব তাঁর নিজের গাড়ি ব্যবহার না করে কেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের মতো একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার গাড়ি ব্যবহার করতে গেলেন? তা-ও আবার তাঁকে টেলিফোনে ডেকে নিয়ে তিনি গাড়িতে ওঠেন!
জিএম ইউসুফ হোসেন মৃধা মাদারীপুরের ‘কৃতী সন্তান’। সৈয়দ আবুল হোসেন যখন যোগাযোগমন্ত্রী তখন তিনি পাঁচজনকে ডিঙিয়ে জিএম পদটিতে অভিষিক্ত হন। তিনি প্রশাসনের অন্য অনেকের মতো রাতারাতি আওয়ামী লীগ সমর্থক। রেলের সবাই বলে, মৃধা জেনারেল জিয়া আর বিএনপির একজন বড় অনুসারী। ঘটনাচক্রে সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়িও মাদারীপুর। বাংলাদেশের রাজনীতি, চাকরি, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে আঞ্চলিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। গোপালগঞ্জে যার জন্ম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের অনেকের জন্য ঈদের চাঁদ ওঠে। সবাই নিজেকে একেকজন বঙ্গবন্ধু মনে করে। ২০০১ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদের বাড়িও গোপালগঞ্জ ছিল। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টাকারী মুফতি আবদুল হান্নানের বাড়িও কিন্তু গোপালগঞ্জে। আর যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে দুটি জেলার মানুষের জন্য সব সময় ঈদের চাঁদ আকাশে থাকে—একটি বগুড়া আর অন্যটি ফেনী।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওই রাতের ৭০ লাখ টাকা (?) নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্লগে কদিন ধরে বেশ রমরমা আসর বসছে। এই আসরে দুঃখজনকভাবে আবার সাম্প্রদায়িকতাও উঁকিঝুঁকি মারছে। কয়েকজন ইতিমধ্য তাঁকে ভারত চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছে, এত দিনে বোঝা গেল কেন তাঁর মন্ত্রী হওয়ার জন্য এত খায়েশ ছিল। এখানে আবার ষড়যন্ত্রতত্ত্বও আছে, যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছি। আমার এক বন্ধু যে একজন ঘোরতর আওয়ামী লীগ সমর্থক, এই ঘটনার ফল বছরের শেষে মিলবে বলে আমাকে জানাল। তবে সে পরিষ্কার করে বলেনি সেটা কীভাবে ঘটবে। ১২ তারিখে শ্রীলঙ্কা থেকে প্রকাশিত শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান এ বিষয়ে বেশ উপাদেয় মসলা দিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে সরকারের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির নাম দিয়ে একটি দীর্ঘ কাহিনি প্রকাশ করেছে। সেটি এখন অনেকগুলো ব্লগে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে।
আসলে ওই টাকাগুলো যে অবৈধ তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে তদন্তে অন্য কিছুও বের হতে পারে। কথায় বলে, ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।’ বাংলাদেশে বাণিজ্যের অভাব নেই। ভর্তি-বাণিজ্য, হলে সিট-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস-বাণিজ্য, জিম্মি-বাণিজ্য, মনোনয়ন-বাণিজ্য, পদায়ন-বাণিজ্য, পদোন্নতি-বাণিজ্য আর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য নিয়োগ-বাণিজ্য। ১৫ কোটি মানুষের দেশে চাকরি এমনিতেই মহার্ঘ্য। সেখানে তো বাণিজ্যের পরিমাণ একটু বেশি হবেই। সরকারের এমন কোনো বিভাগ কি আছে, যেখানে বণিজ্য হয় না? গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, প্রভৃতি অভিজাত এলাকায় যাঁদের বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট আছে, তাঁর মালিকানার ওপর যদি একটি জরিপ চালানো যেত, তাহলে বোঝা যেত বাংলাদেশে মৃধা বা ওমর ফারুকদের সংখ্যা কত। কাদের বাচ্চারা দেশের ভেতরে মাসে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে স্কুলে পড়ে, কাদের ছেলেমেয়ে নিয়মিত বিদেশে লেখাপড়া করতে যায়, কারা ঈদে বা ছেলেমেয়ের বিয়ের বাজার করতে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যায়, কাদের মালয়েশিয়ায় বা দুবাইতে দ্বিতীয় আবাস আছে। এসব নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন করুক না একটা জরিপ। দেশের মানুষ দেখুক তাদের বুকের পাটা আছে।
মানুষের যথার্থ প্রশ্ন ছিল, সুরঞ্জিত বিষয়ে জটিলতার সুরাহা কেমন করে হবে? আদৌ কি হবে? হলে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু থাকবে? তবে অধিকাংশ মানুষের মতো তিনি পা পিছলে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলার আগে নিজে পদ থেকে ইস্তফা দিলে কিছু সম্মান হলেও বাঁচত। তা হয়নি। বুঝতে হবে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতির একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, নিজের ভুলে তাঁর পতন হয়েছে। রাজনীতিতে এমনটি হওয়া বিচিত্র নয়। তবে দেশের মানুষ দেখতে চায় এই টাকা-রহস্যের সঠিক সমাধান এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই ছাড়া না পায়। মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালো বিড়াল খুঁজছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি নিজেই যেন হয়ে গেলেন সেই কালো বিড়াল। তার পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অভিনন্দন যে তিনি পদত্যাগ করার মতো সাহস দেখিয়েছেন। আর বিএনপির এই ঘটনায় উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই, কারণ তাদের আমলের দুর্নীতির কথা এখনো মানুষ ভুলে যায়নি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন