বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১২

সোহেল তাজের ভাগিনাই তো বঙ্গতাজের নাতি

সোহেল তাজের ভাগিনাই তো বঙ্গতাজের নাতি


॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
গত ৬ ফাল্গুন ১৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার ‘সোহেল তাজের ভাগিনাই তো বঙ্গতাজের নাতি’ শিরোনামে নয়া দিগনে- লিখেছিলাম। সত্যিকার অর্থে আমি কোনো লেখক নই। মাথা থেকে পা পর্যন- একজন রাজনীতি করা মানুষ। রাস-াঘাটে ঘামে ভেজা ছেঁড়া-ফাড়া কাপড়চোপড় পরা মানুষের সাথে ওঠাবসায় আগা-গোড়াই বড় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। লিখে হাত পাকাইনি কোনো দিন। লেখার কলাকৌশলও কোনো দিন জানা হয়নি। সারা জীবন বলেছি বেশি, লিখেছি কম। লেখারও যে একটা নিয়ম-কানুন আছে তা রপ্ত করার চেষ্টা করিনি কোনো দিন। সাধু-চলতির মিশ্রণ নিয়ে দশ-পনেরো বছর আগেও তেমন ভাবিনি। কথ্য আর লেখ্যর পার্থক্যও ভাবনার মধ্যে তেমন আসেনি। বহতা নদীর মতো জীবন যেমন চলে তেমনি চলে গেছে। ’৭৫-এর আগে সাজিয়ে-গুছিয়ে তেমন খুব একটা লেখালেখি করিনি। লিখতে গিয়ে ভুল করলে সে ভুল ধরা পড়েনি। এসব দুর্বলতার মূল ছিল আমার গুরুহীন চলা শুরু। না শিক্ষাদীক্ষায়, না রাজনীতিতে, না জীবনচর্চায় কোথাও তেমন গুরু পাইনি। গুরুহীন শুরুর শেষ পর্যায়ে এখন আর গুরু খুঁজে লাভ কী। আগে এমন ছিল কোনো বই পড়তে গিয়ে হাজার পৃষ্ঠা আগে কোথায় কী ফেলে এসেছি মনে থাকত। এখন অনেক কিছুই মনে থাকে না। তাই এখন আর নতুন করে চেষ্টার সুযোগ কোথায়? তবুও যখন দু’কথা লিখি অন-র দিয়েই লেখার চেষ্টা করি। অন-রাত্মা ছাড়া আমার আর কী-ই বা আছে। গ্রামের স্বভাব কবিরা যা ভাবেন তাই কবিতা হয়ে বেরিয়ে আসে। বাউলের গান হয়। আমার লেখাও অনেকটাই সে রকম। তবে এটা বুঝি ক্ষোভ, দুঃখ, আবেগ নিয়ে কোনো লেখার গাঁথুনি শক্ত হয় না। গত পর্বের ‘সোহেল তাজের ভাগিনাই তো বঙ্গতাজের নাতি!’ লেখাটিতে বড় বেশি আবেগ কাজ করায় দু-একটি জায়গায় পাঠকের ছোটখাটো প্রশ্নের উত্তর দিইনি অথবা খেয়াল করিনি। লেখাটি প্রকাশের সাথে সাথে বেশ কয়েকজন টেলিফোনে প্রশ্ন করেছিলেন আপনি ওই জায়গাটি ওইভাবে ছেড়ে দিলেন কেন? বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের নাতি না হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাতিপুতি হলে পুলিশি পিটুনি তো দূরের কথা আদরযত্ন করে রাস-াঘাটে মারাত্মক যানজট সৃষ্টি করে ফেলত। আসলে আমি লিখেছিলাম, ‘তাজউদ্দীন আহমদের নাতি সে আজ পুলিশ দ্বারা লাঞ্ছিত কিন' ওখানেই যদি বঙ্গবন্ধুর কোনো নাতি যেত সেও কি লাঞ্ছিত হতো? জয়-পুতুলরা দেশের বাইরে থাকে, শেখ রেহেনার পুত্র-কন্যা ববি-টিউলিপ ওরাও বাইরে থাকে। এদের মধ্যে কেউ যদি সে দিন ওই গাড়ির চালক হতো পুলিশ কি তাদের সাথেও একই আচরণ করত? মোটেই তা করত না। জাতির প্রশ্নটা কিন' এখানেই। কেন সবাই এমন অসহিষ্ণু? এর প্রতিকার কোথায়?’ জয়-পুতুল-ববি-টিউলিপ এদের কেউ যদি সে দিন গাড়ির চালক হতো পুলিশ কি তাদের সাথে একই আচরণ করত? মোটেই তা করত না। কেন যেন আবেগের তাড়নায় ওরা হলে যে চা-নাশতা, পিজা-বার্গার দিয়ে আদর-আপ্যায়ন করতে করতে গুলশানের রাস-ায় এক মহাযানজট লাগিয়ে ফেলত। বিষয়টা ভেবেও কেন যেন শর্টকাটে বাদ দিয়ে গেছি। লিখতে গিয়ে পাঠকদের মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে লেখার সার্থকতা কোথায়? তাই আমার চিন-া-চৈতন্য অত দূর প্রসারিত না হওয়ায় ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।

ঘটনাটা ছিল ১১ তারিখের। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় এত দিনে অনেক পানি গড়িয়েছে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, তার কন্যা তানিয়া আমীর ও প্রাতঃস্মরণীয় ড. কামাল হোসেনের মধ্যে হাইকোর্টে আইনি লড়াই চলছে। দোষীদের কাউকে সাসপেন্ড, কাউকে আবার ভালো জায়গায় বদলি করা হয়েছে। আসলে সাসপেন্ড আর বদলিই কি এসব ঔদ্ধত্যের প্রতিকার? দেখা যাক মহামান্য হাইকোর্ট কী করেন। বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের নাতিকে নির্যাতন করার কারণে প্রায় আট-দশ বছর পর অসুস' বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের সাথে টেলিফোনে কথা হয়। সেই আগের মতোই আছে তার আন-রিকতা। বাংলাদেশের বহু আন্দোলনের সাক্ষী জিগাতলার মোহসীন বুলবুল ভাই বেঁচে থাকতে কতবার বেগম তাজউদ্দীনের বাড়ি গেছি। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও তিনি আমার সাথে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। দাওয়াত করে তার বাড়িতে অনেকবার খাইয়েছেন। একবার আমার স্ত্রী নাসরিনকে নিয়ে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। খাবার টেবিলে বলেছিলেন, ‘ভাই কাদের, খাবার সবাই খায়। প্রতিদিন খায়। কিন' সবাই সুস্বাদু করে তৈরী খাবার খেতে পারে না।’ কথাটা আজো আমার প্রতিটি তন্ত্রীতে বাজে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার সুবেহ সাদেকে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদপুরুষ বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সরকারের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হলেও তাকেও এক বা দু’দিন পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সাথে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলে পোরা হয়। সেখানেই ৩ নভেম্বর ঘাতকের বুলেটে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের সাথে নিউ সেলে নির্মমভাবে নিহত হন। আমি তখন প্রতিরোধ সংগ্রামে। বেগম জোহরা তাজউদ্দীন স্বামীহারা অসহায়। আওয়ামী লীগের নৌকা তখন ডুবুডুবু। সেই নৌকাকে পানি সেচে জাগিয়ে রাখতে জোহরা তাজউদ্দীন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের এমন কোনো প্রত্যন- অঞ্চল ছিল না যেখানে তিনি স্বাধীনতার ঝাণ্ডা নিয়ে যাননি। এমনিতে আজীবন আর্থারাইটিসের রোগী। রোগশোক উপেক্ষা করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা চিন-া না করে জাতির দুঃসময়ে কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই জোহরা তাজউদ্দীন আজ অনাদ্রিত-অবহেলিত। নাতি রাকিব হোসেনের নির্যাতন। নিয়ে সমবেদনা জানানোর সাথে সাথে বলেছিলেন, ‘তবুও তো দোষী পুলিশদের বিরুদ্ধে একটা কিছু ব্যবস'া নেয়া হচ্ছে। কোনো কিছু না করলেই বা আমরা কী করতাম। ভাই, আপনিই বলেন।’ বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের সহধর্মিণীর কণ্ঠ বড় অসহায় মনে হয়েছিল। ত্যাগী নেতৃত্বের সাথে যদি এমন আচরণ করা হয় এমনিতেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত বিশ-পঁচিশ বছর ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়ায় যোগ্য নেতৃত্বের বড় আকাল চলছে। তার ওপর এ ধরনের ত্যাগী নেতাদের এমন নিদারুণ অবমূল্যায়ন হলে কেউ আর দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে চাইবে না। বেগম তাজউদ্দীনের কন্যা সিম্মির সাথেও কথা হয়। সন-ানের জন্য উদ্বিগ্ন অন্য দশটি মায়ের মতো তার ব্যাকুলতা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আমরা কি এমন অসভ্যতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারি না। নাকি কোনো চেষ্টাই করি না। ১৭-১৮-১৯ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ব্যক্তিত্ব জাফরউল্লাহ চৌধুরীর সাভারের গণস্বাস'্য কেন্দ্রে উন্নয়ন কর্মীদের নিয়ে বার্ষিক মিলনমেলার আয়োজন করেছিলেন। স্বাধীনতার ৪০ বছরে অনন্য অবদানের জন্য ৪০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা দিলেন। আমার নামও তালিকায় ছিল। যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আমি সে সম্মাননা নিইনি। তবে তাদের অনুষ্ঠানে গেছি। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের পাশে বসেছিলাম। চা পানের সময় কথা প্রসঙ্গে আলোচনায় এসেছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে সম্মাননা কেন? তিনি যুদ্ধের সময় কী করেছেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিগত সচিব। আর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ব্যক্তিগত সচিব। কান টানলে মাথা আসার মতো। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের অসি-ত্ব তাজউদ্দীন আহমদ। আর মওদুদ আহমদের অসি-ত্ব ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। আমরা এখন সবাই বড়সড় হয়ে অনেক ক্ষেত্রে গুরু মারা শিষ্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। বঙ্গবন্ধুকে মানবেন না অথচ মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখবেন এ কখনো হয়? কোনো মতেই হয় না।

বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের নাতি লাঞ্ছিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের এই প্রবাদ পুরুষটির সম্পর্কে দু’কথা লিখলাম। স্বাধীনতার পরপরই তার সাথে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। আর তখন তো বেশ ছোট ছিলাম। চিন-া-চৈতন্যের দিক থেকে একেবারে পশ্চাৎপদ। স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে নিয়ে দু’টি ব্যক্তিগত ছোট্ট ঘটনা তুলে ধরছি। এক. স্বাধীনতার পরপর জুলাই-আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর একখানা পত্র নিয়ে প্রথম দিল্লি যাই। দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। তখন দিল্লিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সম্মান ছিল ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাকের চেয়েও শত গুণ বেশি। প্রথম ভারত যাবো কিছুই জানি না, চিনি না। বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা দেয়ায় বড় কড়াকড়ি। ডলারের দাম ছয়-সাড়ে ছয় টাকা। আমরা তিনজন শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার, বাবুল হক ও আমি। বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল আমার খোলা দরজা। আর দিল্লিও যাচ্ছি আধাসরকারি, আধাবেসরকারি কাজে। শুনলাম দুইশ’ ডলার করে বৈদেশিক মুদ্রা দেয়া হয়। তিনজনে পাব ছয় শ’ ডলার। তাতে আর কত হবে সাড়ে তিন-চার হাজার টাকা। বঙ্গবন্ধুকে বললে তিনি বললেন, ‘তোরা দু’হাজার ডলার করে নিয়ে যা।’ আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে দু’হাজার ডলার করে চাইলাম। পরদিন ব্যাংকে ডলার আনতে গিয়ে দেখা গেল অনুমতি মেলেনি। খবর নিয়ে জানলাম, ব্যাংকের গভর্নরকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দু’হাজার করে দিতে। যেই অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন অমনি তিনি না করে দিয়ে বলেন, ‘কাদের জানতে চাইলে ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও।’ বিরক্তি ভরা মন নিয়েই গিয়েছিলাম অর্থমন্ত্রী বঙ্গতাজের দফতরে। আমাকে দেখেই তিনি বলেছিলেন, ‘কী, টাকা পাওনি?’ ‘আপনি না দিলে পাই কী করে? বঙ্গবন্ধু বললেন, প্রতিজনকে দু’হাজার দিতে আর আপনি বলেছেন দুইশ’। আসলে আপনি যে আমাকে দেখতে পারেন না এটা তারই প্রমাণ। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে টাকা-পয়সা ছাড়া কিভাবে চলব? সেখানে কাউকে তো চিনিও না।’ বড় আন-রিকভাবেই তিনি বলেছিলেন, ‘আরে কাদের, তুমি না চিনলেও মুক্তিযুদ্ধ তোমাকে সারা পৃথিবীর কাছে চিনিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধে তুমি আর বঙ্গবন্ধুই তো বেশি পরিচিতি পেয়েছ। আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কিন' তোমার কোনো পরিচয় লাগবে না। দিল্লি গিয়ে দেখ না কতজন তোমার জন্য হাঁ করে বসে আছে। আর তোমার নেতা তো মল্লিক সাহেবকে ফোন করে বলেই দিয়েছেন। আর বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে যাচ্ছো ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। তুমি কি মনে করো ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোনে কথা হবে না? নিশ্চয়ই হবে। দু’চার-দশ বছর পরের কথা বলতে পারব না এখন ভারতে তোমার কোনো টাকা-পয়সা লাগবে না। যা নিয়ে যাবে সবই পকেটে থাকবে। তাই কোনো মতেই দু’হাজার ডলার নিও না। তোমার শত্রুর শেষ নেই। ব্যাপক সমালোচনা হবে। সবাই যেমন দুইশ’ ডলার পায় তুমিও সেই দুইশ’ নিয়ে যাও।’ ঠিক সেই সময় তার কথা আমার ভালো লাগেনি। সন্ধ্যায় তিনি আমায় আবার ফোন করেছিলেন, ‘কী রাগ কমেছে? জনপ্রতি দুইশ’ ডলারই নিও। আমি বলে দিয়েছি।’ ততক্ষণে সত্যিই রাগ পড়ে গিয়েছিল।

হাজার দুই বাংলাদেশীর টাকা এক শ’ ডলার এবং তিনজনে ছয় শ’ ডলারের ব্যাংকের কাগজ নিয়ে জীবনে প্রথম দিল্লি গিয়েছিলাম। সেটা ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন। দু’ঘণ্টা দশ মিনিটের যাত্রা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কেন যেন ড. কামাল হোসেন একই বিমানে দিল্লি গিয়েছিলেন। তখন এখনকার মতো কোনো কড়াকড়ি ছিল না। আমাদের যাওয়ার সময় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ছিল। যে কারণে বিমানবন্দরে আমাদের জন্য গাড়ি যায়নি। কিন' এম্বেসির গাড়িতেই পালাম থেকে নিজামউদ্দিনের লোদী হোটেলে গিয়ে উঠেছিলাম। পরদিন সকালে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. এ আর মল্লিক এসেছিলেন। এসেই বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু চারবার ট্যালেক্স করেছেন। আজ সকাল থেকে পালাম গাড়ি বসে আছে। এইমাত্র শুনলাম তোমরা কাল চলে এসেছ।’ সেখানে থাকতে থাকতেই ত্রিপুরার চিফ সেক্রেটারি এলেন তাদের ত্রিপুরা স্টেট গেস্ট হাউজে থাকলে নাকি সম্মান বাড়ে। বড় যত্ন করে তারা সেখানে রাখলেন। তাদের গেস্ট হাউজের পাশেই কে. কে. বিড়লার বাড়ি। এখন অনেকে শিল্পপতি হলেও ’৭২ সালে টাটা আর বিড়লা ছাড়া অন্য কারো নাম শোনা যেত না। পরদিন দেখা করলাম শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। সে এক অভাবনীয় মুহূর্ত। এক নম্বর সফদর জং রোডের বাড়ির বারান্দায় এসে তিনি আমাদের গ্রহণ করলেন। এর আগে প্রথম তাকে আমি ঢাকায় দেখি। তিনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন, ঢাকায় দেখার সব স্মৃতি তার মনে ছিল। বঙ্গবন্ধুর খাদ্য চাওয়ার চিঠি দিয়ে অনেক আলাপ করে চলে এসেছিলাম। এত বছর হয়ে গেছে নিশ্চিত মনে নেই। দিল্লি এম্বেসিতে ইকোনমিক কাউন্সিলর অথবা ফার্স্ট সেক্রেটারি খুব সম্ভবত মোখলেসুর রহমান নাম তার। তিনি সাত হাজার টাকা দিলেন। তখন পর্যন- আমাদের নিয়ে যাওয়া টাকার মনে হয় তিন শ’ খরচ করেছি। আরো সাত হাজার পেলাম। দিল্লি থেকে আজমীর প্রথম শ্রেণীতে ভাড়া ছিল একুশ টাকা। এখন শতাব্দী এক্সপ্রেসে এয়ার কন্ডিশন প্রথম শ্রেণীতে মনে হয় সাত শ’ টাকা। আজমীরে গিয়ে প্রথম উঠলাম নাজমুদ্দিন চিশতির বেঙ্গল লজে। দরগা শরিফের একেবারে পূবের গেটে বেঙ্গল লজ। একটু পরে নিয়ে তোলা হলো আজমীর সার্কিট হাউজে। বিশাল বাড়ি। বিশ ফুট উঁচু ছাদ। ঘরও পঁচিশ বাই ত্রিশ ফুটের মতো। দরগাহ শরিফে খাজাবাবার মাজারে চাদর চড়ানো হলো। সব কিছু করলেন মুয়াল্লেম নাজমুদ্দিন চিশতি। আসার পথে আমি তার হাতে কিছু টাকা দিতে যাবো এমন সময় পাঁচ হাজার টাকা আমার হাতে তুলে দিলেন। ভীষণ অবাক হলাম। পরদিন ফিরলাম দিল্লি, সন্ধ্যায় কলকাতা। সেখানেও ওই একই অবস'া। কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে নামতেই ডেপুটি হাইকমিশনার গাড়ি নিয়ে হাজির। পরদিন চুয়াডাঙ্গা এক মাড়োয়ারি ওম প্রকাশ বিশ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। ওম প্রকাশ পরে সঞ্জয় গান্ধীর সাথে মারুতি কার নির্মাণে অংশীদার হয়েছিলেন। ছয়-সাত দিন কলকাতায় থেকে রংপুরের সুনীল কুমার গুহর ভাতিজা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর বাড়ি ও বাগানবাড়িতে ঘোরাফেরা করে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে দু’বার খাবার খেয়ে বড় বড় অনেক সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, নেতাদের সাথে দেখা করে বহু বাজারঘাট করে ঢাকায় ফেরার পথে দেখি তখনো পকেটভর্তি টাকা। অত টাকা দিয়ে কী করি। কাস্টমসে যদি ধরে। ভিআইপি লাউঞ্জ পেরুতে তখন বাংলাদেশ হাইকমিশনে চাকরি করত আমার ছোট বোনের বান্ধবীর জামাই মজনু, তার হাতে ঠুসে দিয়ে এলাম। বিমান আকাশে উড়তেই বারবার মনে হতে লাগল অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমেদ যথার্থই বলেছিলেন। আমি কাউকে চিনি বা না চিনি, আমাকে অনেকেই চেনে। আর টাকার জন্য চিন-া করতে হবে না- টাকা-পয়সাই আমার জন্য চিন-া করবে তার এ কথা শত ভাগ সত্য।

গত পর্বে এক জায়গায় লিখেছিলাম বঙ্গতাজের ওপর যেমন বঙ্গবন্ধুর ক্ষুব্ধতা দেখেছি, তেমনি তার প্রতি অপার ভালোবাসাও দেখেছি। আজ কথাটি খোলাসা করতে চাই। তাজউদ্দীন আহমদ যে দিন পদত্যাগ করেন এটি সে দিনের ঘটনা। এখন যে গণভবনে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাস করেন এখান থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করতে পাঠানো হয়েছিল। কী কারণে আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। পদত্যাগপত্রের বিন্দুবিসর্গও জানতাম না। হঠাৎ একবার বেল টিপে কারো নাম করে জিজ্ঞেস করলেন সে এসেছে? একজন ছুটে এসে বলল, ‘না, এখনো আসেনি।’ এখনকার মতো তখন অত ভিড় ছিল না। গণভবন থেকে হেয়ার রোডে যেতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগত না। সময়টা মনে হয় খুবই বেশি হয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধুকে বিচলিত দেখাচ্ছিল। এর মধ্যে কে কে যেন এসে তাল দিলেন। দু-একজন বলে বসলেন, ‘মনে হয় তিনি পদত্যাগ করবেন না। তাই দেরি হচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু ফায়ার হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ভালোভাবে পদত্যাগ না করলে আমি তাকে বরখাস- করব।’ এর কয়েক মিনিট পরই পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে দূত ছুটে এলো। বঙ্গবন্ধু রাগতস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত দেরি হলো কেন?’ স্বাক্ষর গ্রহণকারী দূত বললেন, ‘স্যারের বাসায় ঠিক সময়ই গিয়েছিলাম। বিদেশী ডেলিগেটসের সাথে কথা বলছিলেন। কথা শেষ করেই আমাকে ডাকেন। পদত্যাগপত্রটি সামনে দিলে শুধু জিজ্ঞেস করেন, বঙ্গবন্ধু এটা জানেন?’ জানেন বলতেই তিনি স্বাক্ষর করে দেন। এক মুহূর্তও দেরি করেননি।’ ‘বঙ্গবন্ধু খুবই আত্মবিশ্বাসে বলেছিলেন, ‘আমি তাজউদ্দীনকে জানি। সে এক মুহূর্তও দেরি করেনি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে।’ সে দিন অত কিছু বুঝিনি। পরে বুঝেছি সেটাই ছিল আমাদের নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানায় নিজেদের স্বাক্ষর। সেই তাজউদ্দীন আহমদের নাতি অপমানিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হলে কিছুটা আবেগ তো তাড়া করেই। তাই আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কিছুই সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখতে পারিনি। সোহেল তাজের ভাগিনা বঙ্গতাজ এবং বেগম তাজউদ্দীনের নাতির ওপর এই নির্যাতনই যদি পুলিশের শেষ নির্যাতন হয় তাহলে নিশ্চয় পরপার থেকে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন সান-্বনা পাবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন