বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

অর্থ কেলেঙ্কারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: যে গল্পের শেষ নেই


আলী রীয়াজ | তারিখ: ২০-০৪-২০১২

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্ত্রিত্ব নিয়ে নাটক মনে হচ্ছে ছোটগল্পে পরিণত হয়েছে—শেষ হয়েও শেষ হয় না। স্বেচ্ছায়ই হোক কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই হোক, রেলমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়েছে, কিন্তু মন্ত্রিত্ব যায়নি তাঁর, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মনে হয়, এ ঘটনার আরও অনেক কিছুই এখনো বাকি আছে। কিন্তু ইতিমধ্যে যা ঘটেছে, তাকে কেন্দ্র করে দুটো বিষয় আমার চোখে পড়েছে, যা বলা খুব জরুরি। সে জন্যই এই লেখা।
২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের যে চারজন শীর্ষস্থানীয় নেতা দলের সংস্কার এবং নেতৃত্বে পরিবর্তনের দাবি তুলে পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁদের একজন। অন্যরা হলেন তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক ও আমির হোসেন আমু। তখন থেকে তাঁদের সংস্কারবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। দলে হাসিনা-সমর্থকেরা তাঁদের দলে ‘সেনাবাহিনীর চর’ বলে প্রচার করেন এবং সে সময় এই চার নেতা ইংরেজিতে তাঁদের নামের সংক্ষেপিত ভাষ্য দিয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন। দলের একাংশের কাছে তাঁরা ছিলেন র‌্যাটস (RATS), অন্যদের কাছে তাঁরা ছিলেন তারকা (STAR)। ইংরেজিতে র‌্যাট কথাটির অর্থ কর্তৃপক্ষের কাছে বলে দেওয়া, সহজ ভাষায় বিশ্বাস ভঙ্গকারী। তার পর পদ্মায় অনেক জল গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কথিত সংস্কারবাদীদের জন্য নেমে আসে দুর্দিন। এই চারজনসমেত অন্য অনেকেই ছিটকে পড়েন নেতৃত্বের আসন থেকে। বঞ্চিত হন, অপমানিতও। আবদুর রাজ্জাক প্রচণ্ড অবহেলার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। অন্য দুজন নেতা সুবিধা করতে না পারলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হাসিনার ঘনিষ্ঠজনে পরিণত হন। অনেকের ধারণা, সংবিধান সংশোধনের জন্য দরকার বলেই হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কাছে টেনে নেন। সুরঞ্জিত মন্ত্রিসভার বাইরে থেকে সমালোচনার তির ছুড়তে থাকলে শেষ পর্যন্ত তাঁর জায়গা মেলে মন্ত্রিসভায়। পাঁচ মাস না যেতেই তাঁর মন্ত্রিত্ব নড়ে ওঠে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা, তার সঙ্গে মন্ত্রীর যোগাযোগের সম্ভাবনা, রেলওয়েতে ব্যাপক দুর্নীতি এসবই তার এই অবস্থার কারণ। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য হলো, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। সেটা যে একেবারে অসম্ভব, তা নয়। যাঁরা তাঁকে অতীতে র‌্যাটস বলেছেন, তাঁরা যে চাননি তিনি ক্ষমতায় থাকুন, সেটা অনুমান করা যায়। কাজ ফুরিয়েছে বলে তাঁকে বাদ দেওয়ার কথাও কেউ কেউ বলছেন, দুর্নীতিবাজেরা তাঁকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে এমন কথাও অনেকের বক্তব্যে প্রকাশিত হয়েছে। 
কিন্তু ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছে, বিশেষত এপিএসের পক্ষে সাফাইয়ের চেষ্টা, পদত্যাগে অস্বীকার, কার্যকর পদক্ষেপে বিলম্ব—সবই অন্য রকম ইঙ্গিত দিয়েছে। তদুপরি ঠিক এই সময় তাঁর ছেলের টেলিকম লাইসেন্স পাওয়া থেকেও সন্দেহ বেড়েছে যে আগেও হয়তো নয়ছয় হয়েছে, একই সময় তাঁর মালিকানাধীন একটি মার্কেট উদ্বোধন এই সন্দেহকে আরও ভিত্তি দিয়েছে। রেলওয়ের দুর্নীতির কথা তো জানাই ছিল, হোতাদের নামধাম এখন সবার আলোচনার বিষয়। তদুপরি এই কেলেঙ্কারির রহস্য ভেদ করার জন্য যিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন, সেই ব্যক্তি গাড়ির চালক আলী আজম খানের ব্যাপারে মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। তাঁর নিজের স্বার্থেই উচিত ছিল এ নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া। বিশেষত, গাড়ির চালক আলী আজম খানের পরিবার যখন তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। পুলিশ, সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশনের যখন কোনো মাথাব্যথা নেই, মানবাধিকার কমিশন কথা পর্যন্ত বলছে না, তখন মন্ত্রীও সেই পথ নিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছেন, তখন তিনি ভরসা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ওপর। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে হতাশ করেননি, ‘দপ্তরবিহীন’ হলেও মন্ত্রিত্ব তাঁর রক্ষা হয়েছে। অতীতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরও অনেকে বহাল তবিয়তে মন্ত্রিসভায় আছেন, এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। 
কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিত্বের নৈতিক ভিত্তি নির্ভর করেছে তাঁর আচরণের ওপর, সে জায়গায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগের অনেক আগেই তাঁর অবস্থান হারিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ায় সেটা ফিরে পেয়েছেন, এমন মনে করার কারণ নেই। 
এই কেলেঙ্কারির বিষয়ে দেরিতে হলেও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপে নেওয়া হয়েছে, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে বরখাস্ত করা ও তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত; এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তাঁর স্ত্রী মারজিয়া ফারজানার সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দেরিতে পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে এগুলো কাজে দেবে কি না সেটাই এখন প্রশ্ন। যাঁকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁর ব্যাপারে যেহেতু প্রশ্ন রয়েছে, অনেকেই একে ধামাচাপা দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ বলছেন। তদুপরি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মন্ত্রী রেখে প্রধানমন্ত্রী যে বার্তা দিলেন, সেটা তদন্তের জন্য খুব ইতিবাচক নয়।
এই কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে সংঘটিত ঘটনাবলিতে দুটো বিষয় আমার চোখে পড়েছে এবং যা বলা খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়েছে। প্রথমত, কেউ কেউ এর একটা সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা দ্বিধাহীনভাবে বলে চলেছেন যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জায়গা বাংলাদেশে নয়, ভারতে; কারণটা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। বিদ্বেষমূলক নানা শব্দও বেশ সহজেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ। এর থেকে যাঁরা সাম্প্রদায়িক সুবিধা নিতে চাইছেন, তাঁদের লক্ষ্য সুশাসন নয়। দুর্নীতি উপলক্ষ মাত্র। এটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণের সংগ্রামে মোটেই সহায়ক নয়। দুর্নীতি দুর্নীতিই, যে-ই করুন না কেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। 
দ্বিতীয়ত, ‘হুইসেল ব্লোয়ার’য়ের বিষয়। গাড়ির চালক আলী আজম খানের আচরণের কারণেই আমরা এখন এত কিছু জানতে পারছি। তিনি ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ হতে চেয়েছিলেন কি না সেটা অন্য প্রশ্ন, কিন্তু এ ধরনের অবস্থায় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব কার? কেউ স্বেচ্ছায় ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ হতে চাইলে কার কাছে যাবে? এ বিষয়ে ফেসবুকে আমার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমার তরুণ বন্ধু ও গবেষক রিয়াজ উদ্দিনের বক্তব্যটি খুব জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ: ‘এখন পর্যন্ত যতটা বোঝা যাচ্ছে, সেটার ভিত্তিতে গাড়িচালক আজমকে হুইসেল ব্লোয়ার ভাবাটাই যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে। এমন সাহসী একটি কাজের জন্য তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি এখন মুখ্য। সাংবাদিকদের কাছ থেকে আশা করব, তাঁরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। রাষ্ট্রের কর্তব্য হুইসেল ব্লোয়িংকে উৎসাহিত করা। এখন সাংবাদিকেরা যদি বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন—বিশ্লেষকেরা আজমের ভূমিকার বিশ্লেষণ করেন—প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসের ব্যাপারে আলোচনা আনেন, সেটা আমাদের সামনে এগোনোর জন্য দরকারি একটা ধাপ হতে পারে। দুর্নীতির তদন্ত বা গণকৌতূহল নিবৃত্তির চেয়ে অনেক গুণে গুরুত্বপূর্ণ এখন হুইসেল ব্লোয়িং বিষয়টি নিয়ে একটা পাবলিক ডিসকোর্স।’ 
আমার ধারণা প্রথমত, আজম খানের ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের উদ্যোগী হওয়া দরকার; দ্বিতীয়ত, হুইসেল ব্লোয়ার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আরও তৎপর হওয়া দরকার; যদিও তারা তদন্তকাজ শুরু করেছেন। কিন্তু নাটকের শেষ হতে এখনো অনেক বাকি, ছোটগল্পের তো শেষই নেই।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন