মিজানুর রহমান খান
বাংলাদেশের সমুদ্রজয়কে কাল্পনিক ব্লক হাতছাড়া হওয়া না-হওয়ার সঙ্গে তুলনা করে বিএনপি ও কিছু বিশেষজ্ঞ চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন। বিরোধী দলের নেতা সংসদে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানোর পর বিএনপিরই কিছু নেতার যেন গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।
ড. মোশাররফ হোসেন প্রেসক্লাবে মিয়ানমারের কাছে ‘ঠকে আসার’ অভিনব তত্ত্ব হাজির করেন। এর পরই মির্জা ফখরুল ইসলাম, যিনি এর আগে ‘সরকারকে বাদ দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে’ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি এখন ‘শুভংকরের ফাঁকি’ আবিষ্কার ও ‘বিসর্জনের’ তালিকা প্রকাশের দাবি করেছেন। রায় প্রকাশের মতো হাস্যকর দাবিও তুলছেন। কারণ, ইটলস ওয়েবসাইটে মূল রায়, এমনকি উভয় পক্ষের শুনানি, কে কী দাবি করেছে, তার সবকিছু দেওয়া আছে।
তবে বিশেষজ্ঞ মহলের অযাচিত আক্রমণ দুঃখজনক। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা রায় না পড়ার কথা স্বীকার করেও ‘মিথ্যাচার’ ও ‘জাতিকে লজ্জা’ দেওয়ার কথা বলতে দ্বিধাহীন। প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক জয়-পরাজয় নিয়ে প্রথম আলোয় গত ৩০ মার্চ যা লিখেছেন, তা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর, অসত্য এবং উদ্ভট বটে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. শাহ আলম তাঁর রচনার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দিগ্ধ। এই লেখকের সঙ্গে আলোচনায় লেখাটি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম। তাঁর মন্তব্য, ‘ইনামুল সাহেব নদী নিয়ে কাজ করেন। লেখা পড়ে মনে হয়, সাগরের অথৈ জলে পড়ে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছেন।’
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ড. মোশাররফ ২০০১ সালে জাতিসংঘে কী দাখিল করেছেন, সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অজানা। তিনি ইয়াঙ্গুনে বিজয়োল্লাসের তথ্য দেন। কিন্তু সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
খালেদা জিয়ার উচিত তাঁর কাছে একটি কৈফিয়ত চাওয়া। বিএনপির নেত্রীর সভাপতিত্বে ৯ ডিসেম্বর ২০০২ অনুষ্ঠিত বৈঠকে মহীসোপানের দাবি ২০০৪ সালের মধ্যে জাতিসংঘে পেশ করার (যা ২০১১ সালে আওয়ামী লীগকে করতে হয়েছে) সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নইলে স্থলভাগের দুই-তৃতীয়াংশের সমান সমুদ্রসীমা ‘হাতছাড়া’ হতে পারে—এ কথা সাফ বলে দিয়ে ড. মোশাররফকে আহ্বায়ক করে তিনি ১৫ সদস্যের কমিটি করে দিয়েছিলেন। আজ যদি মির্জা ফখরুলের দাবি অনুযায়ী ‘শুভংকরের ফাঁকি’ ঘটে, তাহলে তার দায় কে নেবে? সাগরে ‘দুই-তৃতীয়াংশ’ জলভাগ হাতছাড়া হওয়ার জন্য তো খালেদা জিয়ার শর্তেই ড. মোশাররফকেই আগে কাঠগড়ায় তুলতে হবে। বিএনপিকে মায়াকান্না করতে হলে মরিচের গুঁড়া সরবরাহের খরচটা তাঁর কাছ থেকেই উসুল করতে হবে।
নৌবাহিনী ও সরকারের অন্য সংস্থা যে দুটি জরিপ ২০১০ সালে ঝঞ্ঝার বেগে করল, সেই জরিপ ২০০৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার দায়িত্বও ওই কমিটির কার্যপরিধিতে ছিল। কিন্তু ব্যর্থ ড. মোশাররফ ও তাঁর কমিটি সম্ভবত এরপর কোনো বৈঠকেই বসেনি।
আজকের লেখায় আমি অবশ্য সেই সব বন্ধুদেশকে ধন্যবাদ জানাব, যাঁরা ৩৫ বছর আগে বাংলাদেশের সমুদ্রনীতির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিল।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল জিয়া-জমানায় অ্যাডভোকেট (অ্যাটর্নি) জেনারেল ছিলেন। ১৯৮২ সালের যে আইনটির অধীনে আমরা রায় পেলাম, সেটি তৈরির পর্বে বাংলাদেশ তাতে ন্যায়পরায়ণতা নীতি সংযোজনে ব্রতী হয়। কারণ, সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ সাগরে ‘তালাবদ্ধ’ হয়ে পড়ে। তাই জিয়াউর রহমান সরকার সমুদ্রে তালা খোলার কূটনীতিতে যথার্থই মনোনিবেশ করেছিল।
১৯৭৭ সালের ২৩ মে থেকে ১৫ জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সমুদ্র আইনবিষয়ক একটি সম্মেলন শেষ হয়েছিল। ব্যারিস্টার মোস্তাফা কামাল এর সঙ্গে গোড়া থেকেই যুক্ত হন। এ বিষয়ে তাঁর একটি রিপোর্ট অন্তত ১২ বছর আগে তাঁর কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশ তখনই ন্যায়পরায়ণতার সংশোধনী আনে এবং এর সপক্ষে লবি শুরু করে। ওই সম্মেলনে ২৩ জুন ১৯৭৭ আমাদের প্রস্তাবের ওপর ২৮টি দেশ আলোচনায় অংশ নেয়। প্রথম বক্তা সৌদি আরব বলেছিল, বাংলাদেশের উপকূলের যে অনন্য বৈশিষ্ট্য, সেটা বিশ্বের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তার প্রস্তাব ন্যায্য ও যুক্তিসংগত। ইরান, বাহরাইন, তুরস্ক, সিরিয়া, বেলজিয়াম, রোমানিয়া, সোমালিয়া, মরক্কো, কাতার, সেনেগাল, আলজেরিয়া, ইয়েমেন, যুগোস্লাভিয়া ও ফিলিপাইন সমর্থন দেয়।
পাকিস্তান বলেছিল, বাংলাদেশের প্রস্তাব সুষ্ঠু ও ন্যায্য। ৫০টি দেশ তা সমর্থন করেছে, তাই সমুদ্র আইনে এর ঠাঁই পাওয়া উচিত। মিসর বলেছিল, এটা আইনানুগ ও ন্যায্য। গাদ্দাফির লিবিয়া ‘উষ্ণ সমর্থন’ দেয়। আফগানিস্তান বলেছিল, বাংলাদেশের সমস্যা ব্যতিক্রমী। তাদের সংশোধনী প্রস্তাব আইনে অন্তর্ভুক্ত হোক।
১৪তম বক্তা ছিল ভারত। ভারতীয় প্রতিনিধি বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সামুদ্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাদের প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখব। তবে ভারতের এ মুহূর্তে দুটি আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের শর্তে বেজলাইন স্থির করা হলে তা সমুদ্রসীমা ও ইইজেড নির্ধারণে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু মিয়ানমার নীরব থাকে।
এই সম্মেলনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো বেশি সরব ছিল। বার্বাডোজ বলেছিল, বাংলাদেশ অবিরাম পাললিক ক্ষয়সাধন সমস্যায় ভুগছে। তাদের প্রস্তাব আইনকে আরও উন্নত করবে। মালটা, বাহামা ও সেনেগাল শুধু সমর্থনই নয়, তারা আমাদের পক্ষে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও তুলে ধরেছিল। ইন্দোনেশীয় প্রতিনিধি হাস্যরস সঞ্চার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় চেয়ারম্যান, বাংলাদেশের সংশোধনী বিশাল সমর্থন লাভ করেছে। আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন। তাদের প্রস্তাব ইতিমধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি করেছে।’ এর পরই হাসির রোল। আমাদের রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সার সম্মেলনে বলেছিলেন, অন্যের স্বার্থ ক্ষতি করে নয়, বাংলাদেশের চাওয়া হলো, তাকে যেন প্রকৃতির কারণে খেসারত দিতে না হয়। ‘তালাবদ্ধ’ হতে না হয়।
সেদিন সম্মেলনকক্ষে কেউ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, জাতিসংঘের দ্বিতীয় কমিটির ওই অধিবেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ভেনেজুয়েলীয় আইনবিদ ও কূটনীতিক আন্দ্রেজ আগিয়্যার। পরে তিনি আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস আইসিজের বিচারক হন। তিনি যেন আমাদের প্রতি নারাজ ছিলেন। রাষ্ট্রদূত কায়সারকে পরে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য সমুদ্ররাষ্ট্রও বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি।’ তখন তাঁকে বলা হয়, কেউ কিন্তু বিরোধিতাও করেনি। এ সময় আগিয়্যার বলেন, বৈঠক শেষে ফ্রান্সের প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং একান্তভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি, ফরাসি প্রতিনিধি তাঁকে বলেছেন, প্রকাশ্যে তাঁরা আপত্তি তোলেননি। কারণ, বাংলাদেশকে তাঁরা বিব্রত করতে চান না। বাংলাদেশ এমন দাবি করেছে, যা মেনে নেওয়া হলে বহু দেশ তাদের অনন্য উপকূলীয় বৈশিষ্ট্যের কথা বলে সমুদ্র গলাধঃকরণের মওকা পাবে।
আগিয়্যার আরও বলেছিলেন, সমর্থক দেশগুলোর ১৬টিই ইসলামি। আর তাদের সমর্থন অনেকটা রাজনৈতিক ধাঁচের। তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূতকে এমনও বলেছিলেন, স্পেন যখন প্রস্তাব নিয়ে এল, তখন লাতিন আমেরিকান দেশগুলো সমর্থন দিতে দ্বিধা করল না।
আগিয়্যার বলেছিলেন, ‘ভারতীয় আপত্তি অগ্রাহ্য করা যায় না। সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রিয়া যদিও বলেছে তারা প্রস্তাব সমর্থন করবে, কিন্তু একই সঙ্গে তারা বলেছে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থ সুরক্ষা বিবেচনায় নিতে হবে। সুতরাং, তারা শর্তযুক্ত সমর্থন দিয়েছে। উপরন্তু চীন তার “নীতিগত সমর্থন” বলতে কী বুঝিয়েছে, তা তারা ব্যাখ্যা করেনি। একইভাবে বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো তাদের সমর্থনের পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ দেখায়নি।’
মোস্তাফা কামাল লিখেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আগিয়্যার বাংলাদেশের জন্য ঝামেলা পাকাতে পণ করেছেন।’ আগিয়্যার অবশ্য দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর একটি হচ্ছে, শীর্ষ সমুদ্ররাষ্ট্র ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশকে বৈঠকে বসা। দ্বিতীয়ত, খসড়া আইনে ভারতীয় আপত্তিসহ বাংলাদেশের সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করা। এর একটিতেও বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এরপর যখন খসড়া প্রকাশ পেল, তখন দেখা গেল, সেখানে বাংলাদেশের সংশোধনী অনুপস্থিত। মোস্তাফা কামাল লিখেছিলেন, ‘এটা দেখে আমরা বেদনাহত হয়েছিলাম, কিন্তু বিস্মিত ছিলাম না।’
তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৮২ সালের আইনে ন্যায়পরায়ণতার বিধান টিকে যায় এবং আজ আমরা তার ফল পাই। স্পেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমদূরত্ব নীতির বিরোধিতা করেছিল। মোস্তাফা কামাল লিখেছেন, ‘আমরা ব্যাপক অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলাম, যাতে সমদূরত্ব নীতি সমালোচিত হয়েছিল এবং কেবল ন্যায়পরায়ণতার নীতি সবচেয়ে নিরাপদ বিবেচিত হয়েছিল।’ তাই ২০১২ সালে বড় জয়টা হলো ’৭৭ সালের আমাদের উল্লিখিত নীতিগত অবস্থান নাকচ করা হয়নি, সমর্থিত হয়েছে। রায়ের ৩২৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘ট্রাইব্যুনাল তাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা যেখানে তার অবতলতার জন্য কাটা পড়ছে (আগে উল্লিখিত ‘তালাবদ্ধ’ অবস্থা) তা এড়াতে সমদূরত্ব নীতি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিল। আদালত স্থির করলেন, একটি ন্যায়সংগত সমাধান দরকার।’
ইটলস রায় ও মিয়ানমারের সংসদে দেওয়া বিবৃতিতেও আমরা তার স্বীকৃতি পাই। ইটলসে মিয়ানমারের এজেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ড. তুন শিন গত ২২ মার্চ মিয়ানমারের সংসদে একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘আদালত বাংলাদেশের উপকূলের ভৌগোলিক অবতলতা বিবেচনায় নিয়েছেন। তাঁরা মিয়ানমার বা বাংলাদেশের দাবি করা সমুদ্রসীমারেখার কোনোটিই গ্রহণ করেননি।’
তবে লক্ষণীয়, দুই দেশের উপকূলের আয়তনের অনুপাতে জলসীমার বণ্টন সমন্বয়কে উভয়ের জন্য ‘ন্যায্য ও সুবিচারপূর্ণ’ উল্লেখ করেও ড. শিন তথ্য দেন যে বাংলাদেশ বেশি সমুদ্র এলাকা পেয়েছে। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ ৬৯ হাজার ৭১৭ বর্গ কিলোমিটার দাবি করেছিল। ইটলসের সিদ্ধান্তের সীমারেখা অনুযায়ী তারা পেয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কিলোমিটার, যা ৪১ হাজার ৯১৪ বর্গ কিলোমিটার বেশি।’ (সূত্র: নিউ লাইট অব মিয়ানমার, ২৩ মার্চ, ২০১২)। আমাদের উক্ত দাবি ছিল মূলত পদ্ধতিগত কারণে। বর্মী ভাষায় প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক সাময়িকী ১৬ মার্চ সংখ্যায় আমাদের লাভবান হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। উল্লেখ্য, সমদূরত্বের নীতি টিকে গেলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটারও ছাড়াত না।
ম. ইনামুল হকের ওই নিবন্ধ বেশ জীবাণু ছড়িয়েছে। তিনি রায়ের ৪৭১ অনুচ্ছেদের ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন। ট্রাইব্যুনাল বলেননি যে ‘বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানের (সিএস) যে দাবি করেছে, তা মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইল ইইজেড।’ সেন্ট মার্টিনে ১২ নটিক্যাল মাইল পাওয়ার পরও তাকে পরাজয় বলা তাঁর ধারণাগত ভুল।
আসলে আমরা আদালতের বদান্যতা কিংবা প্রজ্ঞায় সাগরে ‘তিনবিঘা করিডর’-এর কবলে পড়া থেকে বেঁচে গেছি। বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল মানে যেখানে শেষ, সেখান থেকে আমাদের আউটার মহীসোপান অর্থাৎ গভীর সমুদ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইলের সমুদ্রসীমা পথ আগলায়। এতে দ্বৈত অবতলগত সংকট সৃষ্টি হয়। সে কারণে গভীর সমুদ্রেও আমরা দ্বিতীয়বার ‘তালাবদ্ধ’ অবস্থায় পড়ি। আদালত তাই একধরনের করিডর সৃষ্টি করেন, নামকরণ করেন ‘ধূসর এলাকা’। এর মাছ খাবে মিয়ানমার, তলদেশের খনিজ তুলবে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের আপত্তি সত্ত্বেও ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরে বাংলাদেশের আউটার মহীসোপানের সূচনা তিরচিহ্ন দিয়ে ইটলস নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। জগৎশীর্ষ সমুদ্র আইনবিশারদ কেমব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ক্রফর্ড (এ মুহূর্তে হেগের আদালতে কাশ্মীরের কিষাণগঙ্গা নদী মামলায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মুখ্য কৌঁসুলি) আমাকে নিশ্চিত করেন যে বাংলাদেশের অনুকূলে আদালতের এ সিদ্ধান্তের কোনো তুলনা নেই। ওই ‘ধূসর এলাকা’ পেরিয়ে আমরা অবাধে আউটার মহীসোপানে যাতায়াত করতে পারব। উল্লেখ্য, চূড়ান্ত আউটার মহীসোপান-সীমা ঠিক করবে জাতিসংঘের কমিশন। মিয়ানমারের অ্যাটর্নি জেনারেল এর সুরাহা ২০৩৬ সালের আগে মিলবে না বলে সংসদকে জানান। তাই মহীসোপানের বিশাল এলাকা বিসর্জনের দাবি উদ্ভট।
আর কাল্পনিক ও আইনত এখতিয়ারবহির্ভূত ‘ব্লক হারানোর’ ঘটনায় পরাজয়ের প্রশ্ন বালখিল্যতা। বিএনপি ভাগ্যিস অ্যান্টার্কটিকায় ব্লক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাহলে অবশ্য আজ তারা বলতে পারত, আওয়ামী লীগ অ্যান্টার্কটিকা বিসর্জন দিয়েছে!
বড় কথা হলো, ইটলস আমাদের সেই রায় দিয়েছে, যাতে উল্লিখিত আগিয়্যার কুলের ন্যায়বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পরাস্ত হয়েছে।
ভুলত্রুটির সমালোচনা কাম্য, কিন্তু তা যেন আদালত অবমাননার শামিল না হয়। সুপ্রতিষ্ঠিত সমদূরত্ব নীতির বিচ্যুতি বিরল। বিচারক নেলসন, চন্দ্রশেখর ও কট ন্যায়পরায়ণতার নীতি মেনেও তাঁদের খুঁতখুঁতানি চাপা রাখেননি। এক যৌথ ঘোষণায় তাঁরা বলেন, ‘এটা একটা বিষয়কেন্দ্রিক রায় হলো। উপকূলীয় বৈশিষ্ট্য যতই অনন্য হোক, তা বিবেচনায় এক দেশের জন্য ভিন্ন রকম রায় প্রদানের বিপদ কম নয়।’ তাই জয়-পরাজয় মাপতে পানিতে নামার আগে সমুদ্র আইন এবং তার বিচার-আচারের ভেতরকার এসব সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ড. মোশাররফ হোসেন প্রেসক্লাবে মিয়ানমারের কাছে ‘ঠকে আসার’ অভিনব তত্ত্ব হাজির করেন। এর পরই মির্জা ফখরুল ইসলাম, যিনি এর আগে ‘সরকারকে বাদ দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে’ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি এখন ‘শুভংকরের ফাঁকি’ আবিষ্কার ও ‘বিসর্জনের’ তালিকা প্রকাশের দাবি করেছেন। রায় প্রকাশের মতো হাস্যকর দাবিও তুলছেন। কারণ, ইটলস ওয়েবসাইটে মূল রায়, এমনকি উভয় পক্ষের শুনানি, কে কী দাবি করেছে, তার সবকিছু দেওয়া আছে।
তবে বিশেষজ্ঞ মহলের অযাচিত আক্রমণ দুঃখজনক। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা রায় না পড়ার কথা স্বীকার করেও ‘মিথ্যাচার’ ও ‘জাতিকে লজ্জা’ দেওয়ার কথা বলতে দ্বিধাহীন। প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক জয়-পরাজয় নিয়ে প্রথম আলোয় গত ৩০ মার্চ যা লিখেছেন, তা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর, অসত্য এবং উদ্ভট বটে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. শাহ আলম তাঁর রচনার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দিগ্ধ। এই লেখকের সঙ্গে আলোচনায় লেখাটি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম। তাঁর মন্তব্য, ‘ইনামুল সাহেব নদী নিয়ে কাজ করেন। লেখা পড়ে মনে হয়, সাগরের অথৈ জলে পড়ে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছেন।’
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ড. মোশাররফ ২০০১ সালে জাতিসংঘে কী দাখিল করেছেন, সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অজানা। তিনি ইয়াঙ্গুনে বিজয়োল্লাসের তথ্য দেন। কিন্তু সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
খালেদা জিয়ার উচিত তাঁর কাছে একটি কৈফিয়ত চাওয়া। বিএনপির নেত্রীর সভাপতিত্বে ৯ ডিসেম্বর ২০০২ অনুষ্ঠিত বৈঠকে মহীসোপানের দাবি ২০০৪ সালের মধ্যে জাতিসংঘে পেশ করার (যা ২০১১ সালে আওয়ামী লীগকে করতে হয়েছে) সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নইলে স্থলভাগের দুই-তৃতীয়াংশের সমান সমুদ্রসীমা ‘হাতছাড়া’ হতে পারে—এ কথা সাফ বলে দিয়ে ড. মোশাররফকে আহ্বায়ক করে তিনি ১৫ সদস্যের কমিটি করে দিয়েছিলেন। আজ যদি মির্জা ফখরুলের দাবি অনুযায়ী ‘শুভংকরের ফাঁকি’ ঘটে, তাহলে তার দায় কে নেবে? সাগরে ‘দুই-তৃতীয়াংশ’ জলভাগ হাতছাড়া হওয়ার জন্য তো খালেদা জিয়ার শর্তেই ড. মোশাররফকেই আগে কাঠগড়ায় তুলতে হবে। বিএনপিকে মায়াকান্না করতে হলে মরিচের গুঁড়া সরবরাহের খরচটা তাঁর কাছ থেকেই উসুল করতে হবে।
নৌবাহিনী ও সরকারের অন্য সংস্থা যে দুটি জরিপ ২০১০ সালে ঝঞ্ঝার বেগে করল, সেই জরিপ ২০০৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার দায়িত্বও ওই কমিটির কার্যপরিধিতে ছিল। কিন্তু ব্যর্থ ড. মোশাররফ ও তাঁর কমিটি সম্ভবত এরপর কোনো বৈঠকেই বসেনি।
আজকের লেখায় আমি অবশ্য সেই সব বন্ধুদেশকে ধন্যবাদ জানাব, যাঁরা ৩৫ বছর আগে বাংলাদেশের সমুদ্রনীতির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিল।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল জিয়া-জমানায় অ্যাডভোকেট (অ্যাটর্নি) জেনারেল ছিলেন। ১৯৮২ সালের যে আইনটির অধীনে আমরা রায় পেলাম, সেটি তৈরির পর্বে বাংলাদেশ তাতে ন্যায়পরায়ণতা নীতি সংযোজনে ব্রতী হয়। কারণ, সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ সাগরে ‘তালাবদ্ধ’ হয়ে পড়ে। তাই জিয়াউর রহমান সরকার সমুদ্রে তালা খোলার কূটনীতিতে যথার্থই মনোনিবেশ করেছিল।
১৯৭৭ সালের ২৩ মে থেকে ১৫ জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সমুদ্র আইনবিষয়ক একটি সম্মেলন শেষ হয়েছিল। ব্যারিস্টার মোস্তাফা কামাল এর সঙ্গে গোড়া থেকেই যুক্ত হন। এ বিষয়ে তাঁর একটি রিপোর্ট অন্তত ১২ বছর আগে তাঁর কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশ তখনই ন্যায়পরায়ণতার সংশোধনী আনে এবং এর সপক্ষে লবি শুরু করে। ওই সম্মেলনে ২৩ জুন ১৯৭৭ আমাদের প্রস্তাবের ওপর ২৮টি দেশ আলোচনায় অংশ নেয়। প্রথম বক্তা সৌদি আরব বলেছিল, বাংলাদেশের উপকূলের যে অনন্য বৈশিষ্ট্য, সেটা বিশ্বের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তার প্রস্তাব ন্যায্য ও যুক্তিসংগত। ইরান, বাহরাইন, তুরস্ক, সিরিয়া, বেলজিয়াম, রোমানিয়া, সোমালিয়া, মরক্কো, কাতার, সেনেগাল, আলজেরিয়া, ইয়েমেন, যুগোস্লাভিয়া ও ফিলিপাইন সমর্থন দেয়।
পাকিস্তান বলেছিল, বাংলাদেশের প্রস্তাব সুষ্ঠু ও ন্যায্য। ৫০টি দেশ তা সমর্থন করেছে, তাই সমুদ্র আইনে এর ঠাঁই পাওয়া উচিত। মিসর বলেছিল, এটা আইনানুগ ও ন্যায্য। গাদ্দাফির লিবিয়া ‘উষ্ণ সমর্থন’ দেয়। আফগানিস্তান বলেছিল, বাংলাদেশের সমস্যা ব্যতিক্রমী। তাদের সংশোধনী প্রস্তাব আইনে অন্তর্ভুক্ত হোক।
১৪তম বক্তা ছিল ভারত। ভারতীয় প্রতিনিধি বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সামুদ্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাদের প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখব। তবে ভারতের এ মুহূর্তে দুটি আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের শর্তে বেজলাইন স্থির করা হলে তা সমুদ্রসীমা ও ইইজেড নির্ধারণে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু মিয়ানমার নীরব থাকে।
এই সম্মেলনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো বেশি সরব ছিল। বার্বাডোজ বলেছিল, বাংলাদেশ অবিরাম পাললিক ক্ষয়সাধন সমস্যায় ভুগছে। তাদের প্রস্তাব আইনকে আরও উন্নত করবে। মালটা, বাহামা ও সেনেগাল শুধু সমর্থনই নয়, তারা আমাদের পক্ষে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও তুলে ধরেছিল। ইন্দোনেশীয় প্রতিনিধি হাস্যরস সঞ্চার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় চেয়ারম্যান, বাংলাদেশের সংশোধনী বিশাল সমর্থন লাভ করেছে। আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন। তাদের প্রস্তাব ইতিমধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি করেছে।’ এর পরই হাসির রোল। আমাদের রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সার সম্মেলনে বলেছিলেন, অন্যের স্বার্থ ক্ষতি করে নয়, বাংলাদেশের চাওয়া হলো, তাকে যেন প্রকৃতির কারণে খেসারত দিতে না হয়। ‘তালাবদ্ধ’ হতে না হয়।
সেদিন সম্মেলনকক্ষে কেউ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, জাতিসংঘের দ্বিতীয় কমিটির ওই অধিবেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ভেনেজুয়েলীয় আইনবিদ ও কূটনীতিক আন্দ্রেজ আগিয়্যার। পরে তিনি আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস আইসিজের বিচারক হন। তিনি যেন আমাদের প্রতি নারাজ ছিলেন। রাষ্ট্রদূত কায়সারকে পরে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য সমুদ্ররাষ্ট্রও বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি।’ তখন তাঁকে বলা হয়, কেউ কিন্তু বিরোধিতাও করেনি। এ সময় আগিয়্যার বলেন, বৈঠক শেষে ফ্রান্সের প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং একান্তভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি, ফরাসি প্রতিনিধি তাঁকে বলেছেন, প্রকাশ্যে তাঁরা আপত্তি তোলেননি। কারণ, বাংলাদেশকে তাঁরা বিব্রত করতে চান না। বাংলাদেশ এমন দাবি করেছে, যা মেনে নেওয়া হলে বহু দেশ তাদের অনন্য উপকূলীয় বৈশিষ্ট্যের কথা বলে সমুদ্র গলাধঃকরণের মওকা পাবে।
আগিয়্যার আরও বলেছিলেন, সমর্থক দেশগুলোর ১৬টিই ইসলামি। আর তাদের সমর্থন অনেকটা রাজনৈতিক ধাঁচের। তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূতকে এমনও বলেছিলেন, স্পেন যখন প্রস্তাব নিয়ে এল, তখন লাতিন আমেরিকান দেশগুলো সমর্থন দিতে দ্বিধা করল না।
আগিয়্যার বলেছিলেন, ‘ভারতীয় আপত্তি অগ্রাহ্য করা যায় না। সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রিয়া যদিও বলেছে তারা প্রস্তাব সমর্থন করবে, কিন্তু একই সঙ্গে তারা বলেছে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থ সুরক্ষা বিবেচনায় নিতে হবে। সুতরাং, তারা শর্তযুক্ত সমর্থন দিয়েছে। উপরন্তু চীন তার “নীতিগত সমর্থন” বলতে কী বুঝিয়েছে, তা তারা ব্যাখ্যা করেনি। একইভাবে বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো তাদের সমর্থনের পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ দেখায়নি।’
মোস্তাফা কামাল লিখেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আগিয়্যার বাংলাদেশের জন্য ঝামেলা পাকাতে পণ করেছেন।’ আগিয়্যার অবশ্য দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর একটি হচ্ছে, শীর্ষ সমুদ্ররাষ্ট্র ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশকে বৈঠকে বসা। দ্বিতীয়ত, খসড়া আইনে ভারতীয় আপত্তিসহ বাংলাদেশের সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করা। এর একটিতেও বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এরপর যখন খসড়া প্রকাশ পেল, তখন দেখা গেল, সেখানে বাংলাদেশের সংশোধনী অনুপস্থিত। মোস্তাফা কামাল লিখেছিলেন, ‘এটা দেখে আমরা বেদনাহত হয়েছিলাম, কিন্তু বিস্মিত ছিলাম না।’
তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৮২ সালের আইনে ন্যায়পরায়ণতার বিধান টিকে যায় এবং আজ আমরা তার ফল পাই। স্পেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমদূরত্ব নীতির বিরোধিতা করেছিল। মোস্তাফা কামাল লিখেছেন, ‘আমরা ব্যাপক অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলাম, যাতে সমদূরত্ব নীতি সমালোচিত হয়েছিল এবং কেবল ন্যায়পরায়ণতার নীতি সবচেয়ে নিরাপদ বিবেচিত হয়েছিল।’ তাই ২০১২ সালে বড় জয়টা হলো ’৭৭ সালের আমাদের উল্লিখিত নীতিগত অবস্থান নাকচ করা হয়নি, সমর্থিত হয়েছে। রায়ের ৩২৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘ট্রাইব্যুনাল তাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা যেখানে তার অবতলতার জন্য কাটা পড়ছে (আগে উল্লিখিত ‘তালাবদ্ধ’ অবস্থা) তা এড়াতে সমদূরত্ব নীতি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিল। আদালত স্থির করলেন, একটি ন্যায়সংগত সমাধান দরকার।’
ইটলস রায় ও মিয়ানমারের সংসদে দেওয়া বিবৃতিতেও আমরা তার স্বীকৃতি পাই। ইটলসে মিয়ানমারের এজেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ড. তুন শিন গত ২২ মার্চ মিয়ানমারের সংসদে একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘আদালত বাংলাদেশের উপকূলের ভৌগোলিক অবতলতা বিবেচনায় নিয়েছেন। তাঁরা মিয়ানমার বা বাংলাদেশের দাবি করা সমুদ্রসীমারেখার কোনোটিই গ্রহণ করেননি।’
তবে লক্ষণীয়, দুই দেশের উপকূলের আয়তনের অনুপাতে জলসীমার বণ্টন সমন্বয়কে উভয়ের জন্য ‘ন্যায্য ও সুবিচারপূর্ণ’ উল্লেখ করেও ড. শিন তথ্য দেন যে বাংলাদেশ বেশি সমুদ্র এলাকা পেয়েছে। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ ৬৯ হাজার ৭১৭ বর্গ কিলোমিটার দাবি করেছিল। ইটলসের সিদ্ধান্তের সীমারেখা অনুযায়ী তারা পেয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কিলোমিটার, যা ৪১ হাজার ৯১৪ বর্গ কিলোমিটার বেশি।’ (সূত্র: নিউ লাইট অব মিয়ানমার, ২৩ মার্চ, ২০১২)। আমাদের উক্ত দাবি ছিল মূলত পদ্ধতিগত কারণে। বর্মী ভাষায় প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক সাময়িকী ১৬ মার্চ সংখ্যায় আমাদের লাভবান হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। উল্লেখ্য, সমদূরত্বের নীতি টিকে গেলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটারও ছাড়াত না।
ম. ইনামুল হকের ওই নিবন্ধ বেশ জীবাণু ছড়িয়েছে। তিনি রায়ের ৪৭১ অনুচ্ছেদের ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন। ট্রাইব্যুনাল বলেননি যে ‘বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানের (সিএস) যে দাবি করেছে, তা মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইল ইইজেড।’ সেন্ট মার্টিনে ১২ নটিক্যাল মাইল পাওয়ার পরও তাকে পরাজয় বলা তাঁর ধারণাগত ভুল।
আসলে আমরা আদালতের বদান্যতা কিংবা প্রজ্ঞায় সাগরে ‘তিনবিঘা করিডর’-এর কবলে পড়া থেকে বেঁচে গেছি। বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল মানে যেখানে শেষ, সেখান থেকে আমাদের আউটার মহীসোপান অর্থাৎ গভীর সমুদ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইলের সমুদ্রসীমা পথ আগলায়। এতে দ্বৈত অবতলগত সংকট সৃষ্টি হয়। সে কারণে গভীর সমুদ্রেও আমরা দ্বিতীয়বার ‘তালাবদ্ধ’ অবস্থায় পড়ি। আদালত তাই একধরনের করিডর সৃষ্টি করেন, নামকরণ করেন ‘ধূসর এলাকা’। এর মাছ খাবে মিয়ানমার, তলদেশের খনিজ তুলবে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের আপত্তি সত্ত্বেও ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরে বাংলাদেশের আউটার মহীসোপানের সূচনা তিরচিহ্ন দিয়ে ইটলস নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। জগৎশীর্ষ সমুদ্র আইনবিশারদ কেমব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ক্রফর্ড (এ মুহূর্তে হেগের আদালতে কাশ্মীরের কিষাণগঙ্গা নদী মামলায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মুখ্য কৌঁসুলি) আমাকে নিশ্চিত করেন যে বাংলাদেশের অনুকূলে আদালতের এ সিদ্ধান্তের কোনো তুলনা নেই। ওই ‘ধূসর এলাকা’ পেরিয়ে আমরা অবাধে আউটার মহীসোপানে যাতায়াত করতে পারব। উল্লেখ্য, চূড়ান্ত আউটার মহীসোপান-সীমা ঠিক করবে জাতিসংঘের কমিশন। মিয়ানমারের অ্যাটর্নি জেনারেল এর সুরাহা ২০৩৬ সালের আগে মিলবে না বলে সংসদকে জানান। তাই মহীসোপানের বিশাল এলাকা বিসর্জনের দাবি উদ্ভট।
আর কাল্পনিক ও আইনত এখতিয়ারবহির্ভূত ‘ব্লক হারানোর’ ঘটনায় পরাজয়ের প্রশ্ন বালখিল্যতা। বিএনপি ভাগ্যিস অ্যান্টার্কটিকায় ব্লক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাহলে অবশ্য আজ তারা বলতে পারত, আওয়ামী লীগ অ্যান্টার্কটিকা বিসর্জন দিয়েছে!
বড় কথা হলো, ইটলস আমাদের সেই রায় দিয়েছে, যাতে উল্লিখিত আগিয়্যার কুলের ন্যায়বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পরাস্ত হয়েছে।
ভুলত্রুটির সমালোচনা কাম্য, কিন্তু তা যেন আদালত অবমাননার শামিল না হয়। সুপ্রতিষ্ঠিত সমদূরত্ব নীতির বিচ্যুতি বিরল। বিচারক নেলসন, চন্দ্রশেখর ও কট ন্যায়পরায়ণতার নীতি মেনেও তাঁদের খুঁতখুঁতানি চাপা রাখেননি। এক যৌথ ঘোষণায় তাঁরা বলেন, ‘এটা একটা বিষয়কেন্দ্রিক রায় হলো। উপকূলীয় বৈশিষ্ট্য যতই অনন্য হোক, তা বিবেচনায় এক দেশের জন্য ভিন্ন রকম রায় প্রদানের বিপদ কম নয়।’ তাই জয়-পরাজয় মাপতে পানিতে নামার আগে সমুদ্র আইন এবং তার বিচার-আচারের ভেতরকার এসব সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন