মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী | তারিখ: ০৭-০৯-২০০৯
শিরোনামটি প্রথমে ভাসা ভাসা পাঠে মনে হতে পারে, লেখাটি বোধহয় হালকা ধরনের হবে। কিন্তু আসলে এটা আদৌ সে ধরনের নয়; বরং নাগরিক ও সরকারের মধ্যে এমন সম্পর্কবিষয়ক একটি গম্ভীর রচনা, যেটা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাভাবিক ব্যাপার এবং অপরদিকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সেটা নয়। মানবেন্দ্রনাথ তাঁর লেখা দ্য প্রবলেম অব ফ্রিডম বা স্বাধীনতার সংকট বইটিতে লিখেছেন, ফ্যাসিবাদ একটি আগ্রাসী রাষ্ট্রের কার্যক্রমের পদ্ধতি, যার লক্ষ্যই হলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুঁজিবাদকে চিরস্থায়ী করতে সাহায্য করা আর যুক্তিহীনতার দিকে মানুষকে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলা সম্প্রতি যে উত্পাদন-অংশীদারি চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে, তার অনেক ধারা জনস্বার্থবিরোধী—এই দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ২ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলার অফিস ঘেরাও করার কর্মসূচি নেয় এবং সেই মতো ওই তারিখে দুপুরে মুক্তাঙ্গন থেকে একটি মিছিলের যাত্রা শুরু হয়। পথিমধ্যে পুলিশ মিছিলের ওপর লাঠিপেটা করে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে ৭০ জন আহত হন এবং তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ওই জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, যিনি দুই পায়ের গোড়ালি থেকে পাতা পর্যন্ত প্লাস্টার করা অবস্থায় হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়েছেন।
চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাকস্বাধীনতা—এগুলো প্রতিটি গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তর্কিত অংশীদারি চুক্তিটি জনস্বার্থের অনুকূলে না প্রতিকূলে, এখানে সেটা আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি একজন কিংবা একাধিক নাগরিকের বিবেচনায় সেটা প্রতিকূল হয়, সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে মিছিল করা এবং পেট্রোবাংলার অফিস ঘেরাও করা মৌলিক অধিকার প্রয়োগের মধ্যে অবশ্যই পড়ে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা শিক্ষিত সচেতন নাগরিক এবং জনস্বার্থে তাঁরা এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এই মিছিলের আবহাওয়া শান্তিপূর্ণই থাকার কথা এবং তাঁরা দাঙ্গাকারী পর্যায়ের লোকও নন।
১৯৭০ সালে বসন্তকালের একদিনে আমেরিকার সরকারের যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে ওয়াশিংটন শহরে তথাকার বিশিষ্ট নাগরিকেরা আইন অমান্য আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য সমবেত হন। তাঁরা সারিবদ্ধ হয়ে এমনভাবে দাঁড়ালেন, যার ফলে সব কটি রাস্তায়, যেগুলো পোটোম্যাক নদীর ওপর সেতুগুলোর দিকে গেছে, যানজট হয়ে গেল। সারিবদ্ধদের মধ্যে ছিলেন নোয়াম চমস্কি, ইতিহাসবিদ ম্যারিলিন ইয়াং, পেন্টাগনের গোপন নথির পরিবেশক সাংবাদিক ড্যানিয়েল এলবার্গ, জীববিজ্ঞানী মার্ক পিটশোন, লাওসের গ্রামাঞ্চল পরিভ্রমণকারী ফ্রেড ব্রাফম্যান—এমন সব আরও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তেমন আরেকজন হাওয়ার্ড জিন পরবর্তীকালে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘আমরা বিরোচিত কোনো কিছুই করিনি, আমরা অতি সামান্যই সফল হয়েছি, তথাপি এমতো বেখাপ্পা উপায়ে ঘোষণা করতে পেরেছিলাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাদের আবেগানুভূতি।’ উদাহরণ হিসেবে লক্ষ্য করার ও শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টি হচ্ছে, তাদের এই কর্মকাণ্ডটির জন্য পুলিশের লাঠিপেটার বস্তু হতে হয়নি।
পরের দিন খবরের কাগজের ছবিতে দেখা গেল, অধ্যাপক আনু রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন, এক পায়ে স্যান্ডেল নেই—পুলিশের লাঠির ঘায়ে সেটা ছিটকে গেছে। আরেকবার ছবিটির দিকে তাকাতেই মনে হলো, আনু নয়, কী আশ্চর্য মতিয়া চৌধুরী রাস্তায় পড়ে আছেন। তবুও পুলিশের লাঠি তাঁর ওপর উঁচিয়ে আছে। তাহলে পুলিশের আচরণ বদলায়নি। তবে স্বস্তি পাওয়া গেল সরকারের আচরণ পূর্ববত্ নয়। ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আশা করা যায়, ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে পুলিশ সদস্যদের আচরণ বদলাবে।
তবে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশের এই প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডের ভেতর আবদ্ধ থাকা যথেষ্ট বিবেচিত হবে না, যদি না ঘেরাও কিংবা বাদ-প্রতিবাদের সামনে স্থির ও ধৈর্যশীল আচরণ দেখা না যায়। আবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সে সময় আমি আমেরিকায় বেড়াতে গেছি। একদিন টিভি ছেড়ে বসে আছি। দেখলাম, একটি অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচারিত হবে যে (সে দেশের তত্কালীন) প্রতিরক্ষামন্ত্রী র্যামজেফিল্ড নিউইয়র্ক সিটি প্রেসক্লাবে বক্তৃতা দেবেন। র্যামজেফিল্ড বক্তৃতা দিতে দাঁড়াতেই তিন দিক থেকে ১০ কিংবা ১২ জন সম্ভবত সাংবাদিক তাঁকে খুনি ইত্যাদি সম্বোধনে চিত্কার করে গালি দিতে শুরু করলেন। র্যামজেফিল্ড নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকলেন হাসিমুখে। তবে আমার মনে হলো, সেটা বোকার হাসি। মিনিট দশেক পর খালি হাতে কয়েকজন পুলিশ অনুষ্ঠান হলে প্রবেশ করল। তাদের বাচনিক আদেশে ও হাতের চাপে প্রতিবাদকারীরা স্থান ত্যাগ করলেন। বাংলাদেশে যারা রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধিসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি, তাঁরা উক্তরূপে ধৈর্যশীল স্থির আচরণ করবে নাগরিকদের দাবি-দাওয়া প্রতিবাদের বিপরীতে—এটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে, সেটা কি আশা করা যায়? প্রশ্নটির উত্তর একমাত্র ভবিষ্যত্ই দেবে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলা সম্প্রতি যে উত্পাদন-অংশীদারি চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে, তার অনেক ধারা জনস্বার্থবিরোধী—এই দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ২ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলার অফিস ঘেরাও করার কর্মসূচি নেয় এবং সেই মতো ওই তারিখে দুপুরে মুক্তাঙ্গন থেকে একটি মিছিলের যাত্রা শুরু হয়। পথিমধ্যে পুলিশ মিছিলের ওপর লাঠিপেটা করে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে ৭০ জন আহত হন এবং তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ওই জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, যিনি দুই পায়ের গোড়ালি থেকে পাতা পর্যন্ত প্লাস্টার করা অবস্থায় হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়েছেন।
চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাকস্বাধীনতা—এগুলো প্রতিটি গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তর্কিত অংশীদারি চুক্তিটি জনস্বার্থের অনুকূলে না প্রতিকূলে, এখানে সেটা আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি একজন কিংবা একাধিক নাগরিকের বিবেচনায় সেটা প্রতিকূল হয়, সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে মিছিল করা এবং পেট্রোবাংলার অফিস ঘেরাও করা মৌলিক অধিকার প্রয়োগের মধ্যে অবশ্যই পড়ে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা শিক্ষিত সচেতন নাগরিক এবং জনস্বার্থে তাঁরা এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এই মিছিলের আবহাওয়া শান্তিপূর্ণই থাকার কথা এবং তাঁরা দাঙ্গাকারী পর্যায়ের লোকও নন।
১৯৭০ সালে বসন্তকালের একদিনে আমেরিকার সরকারের যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে ওয়াশিংটন শহরে তথাকার বিশিষ্ট নাগরিকেরা আইন অমান্য আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য সমবেত হন। তাঁরা সারিবদ্ধ হয়ে এমনভাবে দাঁড়ালেন, যার ফলে সব কটি রাস্তায়, যেগুলো পোটোম্যাক নদীর ওপর সেতুগুলোর দিকে গেছে, যানজট হয়ে গেল। সারিবদ্ধদের মধ্যে ছিলেন নোয়াম চমস্কি, ইতিহাসবিদ ম্যারিলিন ইয়াং, পেন্টাগনের গোপন নথির পরিবেশক সাংবাদিক ড্যানিয়েল এলবার্গ, জীববিজ্ঞানী মার্ক পিটশোন, লাওসের গ্রামাঞ্চল পরিভ্রমণকারী ফ্রেড ব্রাফম্যান—এমন সব আরও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তেমন আরেকজন হাওয়ার্ড জিন পরবর্তীকালে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘আমরা বিরোচিত কোনো কিছুই করিনি, আমরা অতি সামান্যই সফল হয়েছি, তথাপি এমতো বেখাপ্পা উপায়ে ঘোষণা করতে পেরেছিলাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাদের আবেগানুভূতি।’ উদাহরণ হিসেবে লক্ষ্য করার ও শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টি হচ্ছে, তাদের এই কর্মকাণ্ডটির জন্য পুলিশের লাঠিপেটার বস্তু হতে হয়নি।
পরের দিন খবরের কাগজের ছবিতে দেখা গেল, অধ্যাপক আনু রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন, এক পায়ে স্যান্ডেল নেই—পুলিশের লাঠির ঘায়ে সেটা ছিটকে গেছে। আরেকবার ছবিটির দিকে তাকাতেই মনে হলো, আনু নয়, কী আশ্চর্য মতিয়া চৌধুরী রাস্তায় পড়ে আছেন। তবুও পুলিশের লাঠি তাঁর ওপর উঁচিয়ে আছে। তাহলে পুলিশের আচরণ বদলায়নি। তবে স্বস্তি পাওয়া গেল সরকারের আচরণ পূর্ববত্ নয়। ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আশা করা যায়, ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে পুলিশ সদস্যদের আচরণ বদলাবে।
তবে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশের এই প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডের ভেতর আবদ্ধ থাকা যথেষ্ট বিবেচিত হবে না, যদি না ঘেরাও কিংবা বাদ-প্রতিবাদের সামনে স্থির ও ধৈর্যশীল আচরণ দেখা না যায়। আবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সে সময় আমি আমেরিকায় বেড়াতে গেছি। একদিন টিভি ছেড়ে বসে আছি। দেখলাম, একটি অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচারিত হবে যে (সে দেশের তত্কালীন) প্রতিরক্ষামন্ত্রী র্যামজেফিল্ড নিউইয়র্ক সিটি প্রেসক্লাবে বক্তৃতা দেবেন। র্যামজেফিল্ড বক্তৃতা দিতে দাঁড়াতেই তিন দিক থেকে ১০ কিংবা ১২ জন সম্ভবত সাংবাদিক তাঁকে খুনি ইত্যাদি সম্বোধনে চিত্কার করে গালি দিতে শুরু করলেন। র্যামজেফিল্ড নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকলেন হাসিমুখে। তবে আমার মনে হলো, সেটা বোকার হাসি। মিনিট দশেক পর খালি হাতে কয়েকজন পুলিশ অনুষ্ঠান হলে প্রবেশ করল। তাদের বাচনিক আদেশে ও হাতের চাপে প্রতিবাদকারীরা স্থান ত্যাগ করলেন। বাংলাদেশে যারা রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধিসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি, তাঁরা উক্তরূপে ধৈর্যশীল স্থির আচরণ করবে নাগরিকদের দাবি-দাওয়া প্রতিবাদের বিপরীতে—এটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে, সেটা কি আশা করা যায়? প্রশ্নটির উত্তর একমাত্র ভবিষ্যত্ই দেবে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন