ব দ রু দ্দী ন উ ম র
চোর ধরা পড়েছে। আওয়ামী লীগের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মাত্র ৪ মাস গদিতে বসে যে লুটপাট করেছেন এর যিকঞ্চিত্ তার বাসায় বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় তার এপিএস ও রেলের জেনারেল ম্যানেজার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের হাতে ধরা পড়েছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রীসহ কিছু মন্ত্রী ও দলীয় নেতা-নেত্রী সুরঞ্জিতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ এ কারণে নয় যে তিনি চুরি করেছেন, চাকরিপ্রার্থীদের একেক জন থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। চুরি করার জন্য তারা ক্ষুব্ধ নন। চুরি তো তাদের লোকজন, নেতা-নেত্রীরা করেই থাকেন। তারা সুরঞ্জিতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কারণ সুরঞ্জিত কাঁচা কাজ করেছেন। চুরি করে তিনি ধরা পড়েছেন! বাংলায় একটি বচন আছে, ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা’। কাজেই সুরঞ্জিতের প্রধান অপরাধ চুরি নয়, তার অপরাধ ধরা পড়ার মতো কাঁচা কাজ করা! মনে হয়, গত তিন বছর তিনি মন্ত্রী না থাকায় পাঁচ বছরের কর্ম দু’বছরেই সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই এভাবে ধরা পড়েছেন। তাড়াহুড়ো করা রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন, চুরির ক্ষেত্রেও তেমনি অনুমোদনযোগ্য নয়!
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ধরা পড়ার পর রুটিনমাফিক নিজের দোষ অস্বীকার করেছেন। প্রথমে তিনি জানান, তার এপিএসের ড্রাইভার তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। আসল গণ্ডগোল সেটাই! ঠিক কথা, কারণ ড্রাইভার ব্ল্যাকমেইল না করলে তার এপিএস ৭০ লাখ টাকা নিয়ে তার কাছে মধ্যরাতে নিরাপদে পৌঁছে দিত। আপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে এপিএসের ড্রাইভার তাদের গাড়ি কৌশলে বর্ডার গার্ডের পিলখানা হেড কোয়ার্টারে ঢুকে পড়াতেই তাদের সর্বনাশ হয়েছে।
তবে সুরঞ্জিত বলেন, তার এপিএসের গাড়িতে টাকা থাকলেও অত রাতে গাড়ি তার বাড়িতে আসছিল না। অত রাতে মন্ত্রীর বাড়িতে কেউ আসে না। মন্ত্রীর বাড়িতে অত রাতে কেউ আসে না, এটা এক হাস্যকর কথা ছাড়া আর কী? যে কাজে এপিএস তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, সে কাজে শুধু রাতের বেলা নয়, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে কোনো সময়ে যাওয়া যায়! তার বাড়ির দিকে গাড়ি যাওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করলেও ঘটনাটি ঘটেছে তার ঝিগাতলার বাড়ির কাছেই। যার থেকে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, গাড়ি তার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। তাছাড়া গাড়ির আরোহী খোদ রেলের জেনারেল ম্যানেজার (পূর্বাঞ্চল) বলেন, তিনি মন্ত্রীর এপিএসকে সঙ্গে নিয়ে রাতেই যাচ্ছিলেন মন্ত্রীর বাড়িতে। তবে টাকার কথা তিনি কিছু জানেন না!!! হাস্যকর কথা, তাই না?
গাড়ির ড্রাইভার আলী আজম বর্ডার গার্ডের হেড কোয়ার্টারে গাড়ি ঢুকিয়ে বলেন, গাড়ির মধ্যে অবৈধ টাকা আছে। তিনি গাড়ি আরোহীদের আটক করতে বলেন। কী কারণে ড্রাইভার এ কাজ করেছিল বোঝা মুশকিল। তবে প্রথম দিন শোনা গিয়েছিল, সে গাড়িতে রাখা ঘুষের টাকার বখরা হিসেবে ড্রাইভার পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। এপিএস ওই টাকা দিতে না চাওয়ায় তাদের মধ্যে বচসা হয় এবং সেই অবস্থায় ড্রাইভার বিজিবির গেটের ভেতর ঢুকে পড়ে। বিজিবির লোকরা গাড়ির মধ্যে ৭০ লাখ টাকা পায়। এরপর তারা এপিএস, জেনারেল ম্যানেজার, কমান্ড্যান্ট এনামুল ও ড্রাইভার আজমকে সারা রাত আটক রেখে সকালের দিকে টাকাসহ তিনজনকে ছেড়ে দিলেও ড্রাইভারকে আটক রাখে। ওই দিন সকালেই ৭০ লাখ টাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংকে এপিএস ফারুকের নামে জমা হয়! শুধু চুরি নয়, চুরি যে কত ঔদ্ধত্যপূর্ণ হতে পারে, বাংলাদেশের ওই সব কারবার তার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। ধরা পড়ার পর সুরঞ্জিত বলেছিলেন, টাকাটা এপিএসের নিজের! একজন এপিএস ৭০ লাখ টাকা কোথা থেকে হঠাত্ পাবে এবং গাড়িতেই বা সে টাকা বহন করবে কেন? যাই হোক, মনে হয় সুরঞ্জিতের পরামর্শ মতোই তার এপিএস নিজের নামে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিলের মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জমা দেন। আওয়ামী লীগ দলটি যে একটি চুরির আখড়া, এর থেকেও সেটা প্রমাণিত হয়।
রেলে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে তাদের চাকরি দেয়া হয় বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। এই টাকার মোট পরিমাণ কয়েক কোটি। তারই একটা অংশ হিসেবে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মন্ত্রীর এপিএস রেলের জেনারেল ম্যানেজারকে নিয়ে যাচ্ছিলেন মন্ত্রীর কাছে জমা দিতে। সেখানে বসে মধ্যরাতের নিশ্চিন্ত অন্ধকারে নিশ্চয় সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির ব্যবস্থা হতো।
এই ঘটনার অন্যতম তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ধরা পড়ার পরদিন সকালে গাড়ির তিন আরোহীকে ৭০ লাখ টাকাসহ ছেড়ে দিলেও ড্রাইভার আজমকে ছাড়া হয়নি, অথচ তিনজনের মধ্যে তার সঙ্গেই ঘুষের টাকা সংগ্রহের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং তার কারণেই চোররা ধরা পড়েছিল। তাছাড়া তিনজন আরোহীকে ছাড়লেও তাদের সঙ্গে থাকা ৭০ লাখ টাকা কীভাবে বিজিবি ছাড়তে পারে, এটাও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এ বিষয়ে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের লোকের নির্দেশ ছাড়া যে এটা হওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়, এটা যে কোনো সামান্য বুদ্ধির লোকের পক্ষেও বোঝা কঠিন নয়।
ড্রাইভার আজমকে আটক করার ব্যাপারটিও যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে হয়েছে, এ বিষয়েও সন্দেহের কারণ নেই। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, সব ধরনের প্রমাণ বা আলামত গায়েব করে দেয়া যাতে শেষ পর্যন্ত প্রমাণাভাবে মামলা খারিজ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন এটাই চলছে প্রত্যেকটি ক্রাইমের ক্ষেত্রে। টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিক দম্পতি খুনের মামলার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। পুলিশ নিজেই নিহত সাংবাদিকদের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ ঘটনাস্থলে পাওয়া অন্যান্য জিনিস গায়েব করে দিয়ে মামলার এক রকম নিষ্পত্তি করেছে। কাজেই সাংবাদিকরা নিজেদের মতো করে যতই আন্দোলন করুন, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এই মারাত্মক ক্রাইমের জন্য কারও শাস্তি হবে না। কিংবা হয়তো কোনো নিরপরাধী লোককে অপরাধী বানিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা হবে। ড্রাইভারকে গুম করার বিষয়টি নিয়ে চারদিকে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু এই গুমের জন্য প্রাথমিকভাবে এবং সব থেকে বেশি দায়িত্ব যে বিজিবির মহাকর্তার, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তারা সবাই সারারাত তাদের হেফাজতে ছিল। তিনজন ছাড়া পেলেও ড্রাইভার ছাড়া পেল না! ছাড়া না পাওয়ায় সে তো বিজিবির হেফাজতেই থাকল!! কিন্তু এ নিয়ে বিজিবিকে কেউ ধরছে না, তার প্রধানের থেকেও এর কোনো ব্যাখ্যা কেউ চাইছে না!!! এ এক মহা আশ্চর্য ব্যাপার। এক ধরনের প্রশাসনিক ভেল্কিবাজি।
আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক কাজ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে আদালতও নিশ্চুপ!!!
বাংলাদেশে এখন গুম-খুন এক আলোচ্য বিষয়, কারণ সরকারি সংস্থাগুলোর দ্বারাই প্রধানত এসব হচ্ছে। ড্রাইভার আজমকে যদি পাওয়া না যায় তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বিজিবির হেফাজতে রেখেই তাকে গুম-খুন করা হয়েছে। এভাবেই চেষ্টা করা হয়েছে ৭০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে। এই মামলার সব আলামত গায়েব করার উদ্দেশ্যে।
চুরি ধরা পড়ার পর সুরঞ্জিত মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে অস্বীকার করে নিজের নিরীহতার কীর্তন করছিলেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে যে তার দায় নৈতিকভাবে মন্ত্রীকেই নিতে হয় এবং পদত্যাগ করতে হয়, এটা জানা থাকলেও সে পথে না গিয়ে সুরঞ্জিত বললেন, প্রাপ্ত টাকাটা এপিএসের! অর্থাত্ চুরির দায়িত্ব এপিএসের। এজন্য তিনি নিজের অফিসের লোক দিয়ে এক লোক হাসানো তদন্ত কমিটিও গঠন করলেন! এপিএসকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো। কিন্তু মন্ত্রী নিজের পদে বহাল থেকে পদত্যাগ করতে অস্বীকার করতেই থাকলেন। তার এই কাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি এবং কার্টুন পর্যন্ত ছাপা হলো। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলে তাকে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে অথবা পদত্যাগ করতে বললেন!! এ সবই অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ নির্দোষিতা প্রমাণ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কাজেই নির্দোষিতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রী পদেই বহাল থাকবেন। এই হলো প্রধানমন্ত্রীর কথা!! কিন্তু নির্দোষিতা প্রমাণ কীভাবে হবে? কেউ কি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে? তার নির্দোষিতা তিনি তো নিজে থেকেই প্রমাণ করতে পারেন না। সে নির্দোষিতা কোনো কমিশন, কমিটি বা আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হবে। সেরকম কি কিছু হয়েছে? কাজেই প্রধানমন্ত্রীর কথা ফাঁকা বাহাদুরি ও লোক ঠকানো ব্যাপার ছাড়া আর কি?
প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রীকে নির্দোষিতা প্রমাণ করতে বললেও জনগণ, প্রচার মাধ্যম, বিভিন্ন বিরোধী দল এ ধরনের প্রমাণের জন্য অপেক্ষা না করে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করল। চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতেই হলো। এই পদত্যাগের পর আর এক ধরনের ম্যাজিক দেখা গেল। পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগ মহল এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মহলে বলা শুরু হলো, মন্ত্রী পদত্যাগ করে এক নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। প্রধানমন্ত্রীও প্রমাণ করলেন, আওয়ামী লীগে চোর নেই!!! কিসের নৈতিক দৃষ্টান্ত? কঠিন চাপের মুখে পদত্যাগ করলে তার মধ্যে আবার নৈতিকতা কী? তার মধ্যে অনুকরণযোগ্য ও মহত্ দৃষ্টান্ত দেখা কীভাবে সম্ভব? এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মাহাত্ম্যই বা কীভাবে প্রকাশ পায়? কিন্তু নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য এটাই এখন দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের কাজ। রেলমন্ত্রী শিগগিরই নির্দোষ প্রমাণিত হবেন এবং সেই সঙ্গে সমগ্র আওয়ামী লীগ দলও প্রমাণিত হবে নির্দোষ বলে!! এ ব্যাপারে আদালতও সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে সবই সম্ভব।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেদের বিষয়ে কী বলে ও প্রশাসনের সহায়তায় এবং আদালতের মাধ্যমে তারা আইনের আওতার বাইরে থাকলেও জনগণ ও জনমত অন্য জিনিস। এসব করে জনগণকে ফাঁকি দেয়া এবং জনমত নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আওয়ামী লীগের শীর্ষতম নেতৃত্ব থেকে মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের নেতানেত্রীদের মধ্যে চোর নয়, এমন ব্যক্তি দুষ্প্রাপ্য ব্যতিক্রম। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে যদি চুরি, দুর্নীতি, ডাকাতি না থাকত তাহলে দলটির সর্বস্তরে এভাবে এসব ছড়িয়ে পড়ত না। এত নিশ্চিন্তে এসব অপরাধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমি অসংখ্যবার লিখেছি যে, বাংলাদেশে অপরাধ ব্যাপকভাবে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ এদেশে অপরাধীর শাস্তি নেই। উপরন্তু অপরাধীকে আড়াল ও রক্ষা করাই এখানে হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের এক নিত্যকার কাজ। শত শত ব্যাপার এভাবেই কয়েক দিন হৈচৈয়ের পর ধামাচাপা পড়ছে। কোনো সুরাহাই হচ্ছে না। সম্প্রতি নরসিংদীর মেয়র লোকমান তাদের নিজেদের দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার দ্বারা খুন হওয়া এবং সাংবাদিক দম্পতি খুন হওয়া নিয়ে প্রথম দিকে কিছু হৈচৈ হলেও এখন সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা, এর জন্য কারও বিচার ও শাস্তি হবে না।
এখন ঘটনাপ্রবাহ থেকে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জনমতের প্রবল চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেও এর জন্য তার কোনো বিচার ও শাস্তি হবে না। তিনি পদত্যাগের পর নিজেই বলেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে’। তার এ ঘোষণা ভিত্তিহীন নয়। এ ব্যাপারে সরকারি প্রশাসন ও আদালতের সহযোগিতা এবং সর্বোপরি নিজের দলীয় নেতা-নেত্রীদের আশীর্বাদ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা না করলে তার পক্ষে এই নির্লজ্জ ঘোষণা প্রদান সম্ভব হতো না। সর্বশেষ খবর, তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
১৭.৪.২০১২
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ধরা পড়ার পর রুটিনমাফিক নিজের দোষ অস্বীকার করেছেন। প্রথমে তিনি জানান, তার এপিএসের ড্রাইভার তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। আসল গণ্ডগোল সেটাই! ঠিক কথা, কারণ ড্রাইভার ব্ল্যাকমেইল না করলে তার এপিএস ৭০ লাখ টাকা নিয়ে তার কাছে মধ্যরাতে নিরাপদে পৌঁছে দিত। আপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে এপিএসের ড্রাইভার তাদের গাড়ি কৌশলে বর্ডার গার্ডের পিলখানা হেড কোয়ার্টারে ঢুকে পড়াতেই তাদের সর্বনাশ হয়েছে।
তবে সুরঞ্জিত বলেন, তার এপিএসের গাড়িতে টাকা থাকলেও অত রাতে গাড়ি তার বাড়িতে আসছিল না। অত রাতে মন্ত্রীর বাড়িতে কেউ আসে না। মন্ত্রীর বাড়িতে অত রাতে কেউ আসে না, এটা এক হাস্যকর কথা ছাড়া আর কী? যে কাজে এপিএস তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, সে কাজে শুধু রাতের বেলা নয়, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে কোনো সময়ে যাওয়া যায়! তার বাড়ির দিকে গাড়ি যাওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করলেও ঘটনাটি ঘটেছে তার ঝিগাতলার বাড়ির কাছেই। যার থেকে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, গাড়ি তার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। তাছাড়া গাড়ির আরোহী খোদ রেলের জেনারেল ম্যানেজার (পূর্বাঞ্চল) বলেন, তিনি মন্ত্রীর এপিএসকে সঙ্গে নিয়ে রাতেই যাচ্ছিলেন মন্ত্রীর বাড়িতে। তবে টাকার কথা তিনি কিছু জানেন না!!! হাস্যকর কথা, তাই না?
গাড়ির ড্রাইভার আলী আজম বর্ডার গার্ডের হেড কোয়ার্টারে গাড়ি ঢুকিয়ে বলেন, গাড়ির মধ্যে অবৈধ টাকা আছে। তিনি গাড়ি আরোহীদের আটক করতে বলেন। কী কারণে ড্রাইভার এ কাজ করেছিল বোঝা মুশকিল। তবে প্রথম দিন শোনা গিয়েছিল, সে গাড়িতে রাখা ঘুষের টাকার বখরা হিসেবে ড্রাইভার পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। এপিএস ওই টাকা দিতে না চাওয়ায় তাদের মধ্যে বচসা হয় এবং সেই অবস্থায় ড্রাইভার বিজিবির গেটের ভেতর ঢুকে পড়ে। বিজিবির লোকরা গাড়ির মধ্যে ৭০ লাখ টাকা পায়। এরপর তারা এপিএস, জেনারেল ম্যানেজার, কমান্ড্যান্ট এনামুল ও ড্রাইভার আজমকে সারা রাত আটক রেখে সকালের দিকে টাকাসহ তিনজনকে ছেড়ে দিলেও ড্রাইভারকে আটক রাখে। ওই দিন সকালেই ৭০ লাখ টাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংকে এপিএস ফারুকের নামে জমা হয়! শুধু চুরি নয়, চুরি যে কত ঔদ্ধত্যপূর্ণ হতে পারে, বাংলাদেশের ওই সব কারবার তার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। ধরা পড়ার পর সুরঞ্জিত বলেছিলেন, টাকাটা এপিএসের নিজের! একজন এপিএস ৭০ লাখ টাকা কোথা থেকে হঠাত্ পাবে এবং গাড়িতেই বা সে টাকা বহন করবে কেন? যাই হোক, মনে হয় সুরঞ্জিতের পরামর্শ মতোই তার এপিএস নিজের নামে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিলের মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জমা দেন। আওয়ামী লীগ দলটি যে একটি চুরির আখড়া, এর থেকেও সেটা প্রমাণিত হয়।
রেলে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে তাদের চাকরি দেয়া হয় বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। এই টাকার মোট পরিমাণ কয়েক কোটি। তারই একটা অংশ হিসেবে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মন্ত্রীর এপিএস রেলের জেনারেল ম্যানেজারকে নিয়ে যাচ্ছিলেন মন্ত্রীর কাছে জমা দিতে। সেখানে বসে মধ্যরাতের নিশ্চিন্ত অন্ধকারে নিশ্চয় সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির ব্যবস্থা হতো।
এই ঘটনার অন্যতম তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ধরা পড়ার পরদিন সকালে গাড়ির তিন আরোহীকে ৭০ লাখ টাকাসহ ছেড়ে দিলেও ড্রাইভার আজমকে ছাড়া হয়নি, অথচ তিনজনের মধ্যে তার সঙ্গেই ঘুষের টাকা সংগ্রহের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং তার কারণেই চোররা ধরা পড়েছিল। তাছাড়া তিনজন আরোহীকে ছাড়লেও তাদের সঙ্গে থাকা ৭০ লাখ টাকা কীভাবে বিজিবি ছাড়তে পারে, এটাও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এ বিষয়ে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের লোকের নির্দেশ ছাড়া যে এটা হওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়, এটা যে কোনো সামান্য বুদ্ধির লোকের পক্ষেও বোঝা কঠিন নয়।
ড্রাইভার আজমকে আটক করার ব্যাপারটিও যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে হয়েছে, এ বিষয়েও সন্দেহের কারণ নেই। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, সব ধরনের প্রমাণ বা আলামত গায়েব করে দেয়া যাতে শেষ পর্যন্ত প্রমাণাভাবে মামলা খারিজ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন এটাই চলছে প্রত্যেকটি ক্রাইমের ক্ষেত্রে। টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিক দম্পতি খুনের মামলার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। পুলিশ নিজেই নিহত সাংবাদিকদের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ ঘটনাস্থলে পাওয়া অন্যান্য জিনিস গায়েব করে দিয়ে মামলার এক রকম নিষ্পত্তি করেছে। কাজেই সাংবাদিকরা নিজেদের মতো করে যতই আন্দোলন করুন, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এই মারাত্মক ক্রাইমের জন্য কারও শাস্তি হবে না। কিংবা হয়তো কোনো নিরপরাধী লোককে অপরাধী বানিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা হবে। ড্রাইভারকে গুম করার বিষয়টি নিয়ে চারদিকে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু এই গুমের জন্য প্রাথমিকভাবে এবং সব থেকে বেশি দায়িত্ব যে বিজিবির মহাকর্তার, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তারা সবাই সারারাত তাদের হেফাজতে ছিল। তিনজন ছাড়া পেলেও ড্রাইভার ছাড়া পেল না! ছাড়া না পাওয়ায় সে তো বিজিবির হেফাজতেই থাকল!! কিন্তু এ নিয়ে বিজিবিকে কেউ ধরছে না, তার প্রধানের থেকেও এর কোনো ব্যাখ্যা কেউ চাইছে না!!! এ এক মহা আশ্চর্য ব্যাপার। এক ধরনের প্রশাসনিক ভেল্কিবাজি।
আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক কাজ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে আদালতও নিশ্চুপ!!!
বাংলাদেশে এখন গুম-খুন এক আলোচ্য বিষয়, কারণ সরকারি সংস্থাগুলোর দ্বারাই প্রধানত এসব হচ্ছে। ড্রাইভার আজমকে যদি পাওয়া না যায় তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বিজিবির হেফাজতে রেখেই তাকে গুম-খুন করা হয়েছে। এভাবেই চেষ্টা করা হয়েছে ৭০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে। এই মামলার সব আলামত গায়েব করার উদ্দেশ্যে।
চুরি ধরা পড়ার পর সুরঞ্জিত মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে অস্বীকার করে নিজের নিরীহতার কীর্তন করছিলেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে যে তার দায় নৈতিকভাবে মন্ত্রীকেই নিতে হয় এবং পদত্যাগ করতে হয়, এটা জানা থাকলেও সে পথে না গিয়ে সুরঞ্জিত বললেন, প্রাপ্ত টাকাটা এপিএসের! অর্থাত্ চুরির দায়িত্ব এপিএসের। এজন্য তিনি নিজের অফিসের লোক দিয়ে এক লোক হাসানো তদন্ত কমিটিও গঠন করলেন! এপিএসকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো। কিন্তু মন্ত্রী নিজের পদে বহাল থেকে পদত্যাগ করতে অস্বীকার করতেই থাকলেন। তার এই কাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি এবং কার্টুন পর্যন্ত ছাপা হলো। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলে তাকে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে অথবা পদত্যাগ করতে বললেন!! এ সবই অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ নির্দোষিতা প্রমাণ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কাজেই নির্দোষিতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রী পদেই বহাল থাকবেন। এই হলো প্রধানমন্ত্রীর কথা!! কিন্তু নির্দোষিতা প্রমাণ কীভাবে হবে? কেউ কি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে? তার নির্দোষিতা তিনি তো নিজে থেকেই প্রমাণ করতে পারেন না। সে নির্দোষিতা কোনো কমিশন, কমিটি বা আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হবে। সেরকম কি কিছু হয়েছে? কাজেই প্রধানমন্ত্রীর কথা ফাঁকা বাহাদুরি ও লোক ঠকানো ব্যাপার ছাড়া আর কি?
প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রীকে নির্দোষিতা প্রমাণ করতে বললেও জনগণ, প্রচার মাধ্যম, বিভিন্ন বিরোধী দল এ ধরনের প্রমাণের জন্য অপেক্ষা না করে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করল। চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতেই হলো। এই পদত্যাগের পর আর এক ধরনের ম্যাজিক দেখা গেল। পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগ মহল এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মহলে বলা শুরু হলো, মন্ত্রী পদত্যাগ করে এক নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। প্রধানমন্ত্রীও প্রমাণ করলেন, আওয়ামী লীগে চোর নেই!!! কিসের নৈতিক দৃষ্টান্ত? কঠিন চাপের মুখে পদত্যাগ করলে তার মধ্যে আবার নৈতিকতা কী? তার মধ্যে অনুকরণযোগ্য ও মহত্ দৃষ্টান্ত দেখা কীভাবে সম্ভব? এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মাহাত্ম্যই বা কীভাবে প্রকাশ পায়? কিন্তু নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য এটাই এখন দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের কাজ। রেলমন্ত্রী শিগগিরই নির্দোষ প্রমাণিত হবেন এবং সেই সঙ্গে সমগ্র আওয়ামী লীগ দলও প্রমাণিত হবে নির্দোষ বলে!! এ ব্যাপারে আদালতও সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে সবই সম্ভব।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেদের বিষয়ে কী বলে ও প্রশাসনের সহায়তায় এবং আদালতের মাধ্যমে তারা আইনের আওতার বাইরে থাকলেও জনগণ ও জনমত অন্য জিনিস। এসব করে জনগণকে ফাঁকি দেয়া এবং জনমত নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আওয়ামী লীগের শীর্ষতম নেতৃত্ব থেকে মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের নেতানেত্রীদের মধ্যে চোর নয়, এমন ব্যক্তি দুষ্প্রাপ্য ব্যতিক্রম। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে যদি চুরি, দুর্নীতি, ডাকাতি না থাকত তাহলে দলটির সর্বস্তরে এভাবে এসব ছড়িয়ে পড়ত না। এত নিশ্চিন্তে এসব অপরাধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমি অসংখ্যবার লিখেছি যে, বাংলাদেশে অপরাধ ব্যাপকভাবে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ এদেশে অপরাধীর শাস্তি নেই। উপরন্তু অপরাধীকে আড়াল ও রক্ষা করাই এখানে হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের এক নিত্যকার কাজ। শত শত ব্যাপার এভাবেই কয়েক দিন হৈচৈয়ের পর ধামাচাপা পড়ছে। কোনো সুরাহাই হচ্ছে না। সম্প্রতি নরসিংদীর মেয়র লোকমান তাদের নিজেদের দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার দ্বারা খুন হওয়া এবং সাংবাদিক দম্পতি খুন হওয়া নিয়ে প্রথম দিকে কিছু হৈচৈ হলেও এখন সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা, এর জন্য কারও বিচার ও শাস্তি হবে না।
এখন ঘটনাপ্রবাহ থেকে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জনমতের প্রবল চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেও এর জন্য তার কোনো বিচার ও শাস্তি হবে না। তিনি পদত্যাগের পর নিজেই বলেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে’। তার এ ঘোষণা ভিত্তিহীন নয়। এ ব্যাপারে সরকারি প্রশাসন ও আদালতের সহযোগিতা এবং সর্বোপরি নিজের দলীয় নেতা-নেত্রীদের আশীর্বাদ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা না করলে তার পক্ষে এই নির্লজ্জ ঘোষণা প্রদান সম্ভব হতো না। সর্বশেষ খবর, তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
১৭.৪.২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন