রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

পিতাকে পুত্র





পিতাকে পুত্র

পিতাকে পুত্র

॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥

(দুই)
কী বলি তোমাকে, তুমি একজন পোড় খাওয়া মানুষ। লোভী, দুর্বল চিত্তের মানুষ সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় সকাল-বিকাল কেমন রঙ বদলায় তা তো তোমার জানা। আমরাও তোমার ছায়ায়, মায়ায় থেকে ছিটেফোঁটা জেনেছি। কী বলব! মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কত দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা আছে। আমার আপন চাচা আমার মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে দিতে ভরসা পায়নি। অজানা-অচেনা দূরের মানুষ ধানগড়ার নাজির, সিরাজ, হামিদ, নাজিরের ছেলে শাহজাহান তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। বাবার আপন মামা তার দিঘলকান্দির বাড়িতে ছোটবোন রহিমা-শুশুমাকে আশ্রয় দেয়নি। অথচ পাশের গ্রাম উপলদিয়ায় ফজলুল হকের বাবা টিও আব্দুল গনির বাড়িতে আমার আশ্রয় জুটেছিল। রহিমা-শুশুমা ছিল ছোট্ট মেয়ে। ওদের তেমন কেউ চিনতও না। কিন' তখন আমার পরিচিতি টাঙ্গাইলের পথেপ্রান-রে, গ্রামেগঞ্জে। পাকিস-ানি হানাদারেরা নিরন-র ঘোষণা করছিল কাদের সিদ্দিকীকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে লাখ টাকা পুরস্কার। তা-ও অনাত্মীয়রা আশ্রয় দিয়েছে, কোনো অসুবিধা হয়নি। তখন আমি শক্তিশালী ছিলাম না, ছিলাম খুবই অসহায়, দুর্বল। হ্যাঁ, এটা সত্য সংগঠিত হওয়ার পর লাখ টাকা কেন, হাজার কোটি পুরস্কার দিলেও আল্লাহর রহমতে বাংলার মাটিতে আমাকে ধরা বা ধরিয়ে দেয়ার কারো শক্তি ছিল না। কিন' যখন লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল তখন ধরিয়ে দেয়ার সুযোগ অনেকেরই ছিল। এখন কতজন আমায় কত গালাগাল করে, বিরোধিতা করে। কিন' মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা যে কী অপরিসীম সাহায্য করেছে তা এখনো ভাবলে চোখে পানি আসে। তুমি যখন বেঁচে ছিলে স্বাধীনতার পর কত কথা হয়েছে আমাদের দু’জনের মাঝে। হানাদারদের লাখ টাকা পুরস্কারের কথাও হয়েছে। মনে হয়, এপ্রিলের ২১ তারিখ সকালে আমি ফজলুদের উপলদিয়ার বাড়িতে বসেছিলাম। তখন টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের কদমতলী, মোগলপাড়া, ব্রাহ্মণশাসনের পাকা রাস-া দিয়ে ওই ঘোষণা প্রচার করছিল। তখন তেমন বাড়িঘর ছিল না। শুধু ধানক্ষেত বা মাঠ আর মাঠ। মাইকের আওয়াজ অনেক দূর যেত। তাই পুবাল হাওয়ায় অনেক পশ্চিমে বসে নিজ কানে শুনেছিলাম। আমার কাছে তখন অস্ত্র ছিল বটে। কিন' কোনো গুলি ছিল না। অন্যেরা না জানলেও আমি তো জানতাম, আমার কাছে কোনো গুলি নেই। সে সময় আমরা ছিলাম মাত্র দু’জন। আমি আর সিলেটের উদ্বাস' ফারুক আহমেদ। গ্রামের মানুষ আগে বড় আন-রিক ছিল। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, মোবাইল ছিল না। কেরোসিনের কুপি জ্বালাত। কিন' মানুষের অন-র ছিল বিদ্যুতের আলোর চেয়ে ঝলমলে, পরিষ্কার। বিশেষ করে মেয়েরা ছিল মায়ার আধার। পাকিস-ানিদের আমাকে ধরিয়ে দেয়ার ঘোষণা হয়তো ফজলুর মায়ের কানেও গিয়েছিল। তাই আমি যখন চিনি-ত ও বিমর্ষ, তখন হঠাৎই নরম হাতের স্পর্শ পাই। চমকে তাকিয়ে দেখি, ফজলুর মা দাঁড়িয়ে। আমি তার দিকে মুখ ফেরাতেই বলেছিলেন, ‘বাবা, চিন-া কোরো না। আমার কাছে ফজলুও যা, তুমিও তা।’ ওই বাড়ির আরেক শরিক নুরু মিয়া জামালপুর মহকুমা কো-অপারেটিভে চাকরি করত। একটু পরে সে এসে বলেছিল, ‘কাদের ভাই, আমাদের কাছে আপনার দাম লাখ কোটি টাকার বেশি। চিন-া করবেন না। আপনার ক্ষতি কেউ করবে না। করতেও পারবে না।’ তাদের আশ্বাসবাণী শুনে বুকটা জুড়িয়ে গিয়েছিল। অমনি আশ্বস- হয়েছিলাম আরেকবার। প্রতিরোধ যুদ্ধের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। কালিহাতী থানার মরিচায় একটা বটগাছে ঠেস দিয়ে বসেছিলাম। একেবারে দিশেহারা বিমর্ষ হৃদয় ভারাক্রান-। তখনো সাথী মাত্র একজন। সেই সিলেটের ফারুক আহমেদ। হঠাৎ পিঠে হাত রেখে বলেছিল, ‘বজ্র ভাই, চিন-া করবেন না। আমি আছি আপনার সাথে।’ কেন যেন তার সে হাত সেদিন তার একার মনে হয়নি। মনে হয়েছিল জননী জন্মভূমি। মনে হয়েছিল সারা দেশ আমার সাথে। সারা মুক্তিযুদ্ধে আর খুব একটা পিছু ফিরে তাকাইনি। কিন' আজ কে বলবে ‘আমি আছি তোমার সাথে?’ কার স্পর্শ জননী জন্মভূমির মতো মনে হবে? মা নেই, বাবা নেই। তুমি তো আগেই এতিম করে রেখে গেছো। পদে পদে অপমান-অপদস' হয়ে মাঝে মাঝে তোমার ওপরও যে রাগ বা দুঃখ হয় না তা নয়। বড় খারাপ লাগে। প্রশ্ন করতে তো ইচ্ছে জাগেই- আমাদের অস্ত্রগুলো নিয়ে আমাকে আতুর না করলে কি চলত না? তুমি পাকিস-ানি পুলিশ বাহিনী রাখলে, ইস্ট পাকিস-ান রাইফেলসকে বিডিআর নামে রাখলে, পাকিস-ানের সেনাবাহিনীকে শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নাম দিয়ে রেখে দিলে, যারা মুক্তিবাহিনী গঠন করে দেশকে স্বাধীন করল, তোমাকে কারাগার ভেঙে ফিরিয়ে আনল, শুধু তাদের সব অস্ত্র নিয়ে নিলে? একবারো কি ভেবে দেখলে না, কোনো বিপদ হলে কিভাবে তা মোকাবেলা করবে? তখন সত্যিই ছোট ছিলাম। আর তোমার ভালোবাসায় ছিলাম বিভোর। বয়সটা ছিল শাশ্বত প্রেমের। কোনো নারীর প্রেম আমাকে স্পর্শ করেনি। তাই তোমাতেই প্রেমের আবেশ খুঁজেছি। এ তো ধ্রুবতারার মতো সত্য, তোমার প্রতি ভালোবাসা আমাকে দেশপ্রেমী করেছে। তা না হলে দেশ কী, দেশের মানুষ কী, ’৬০-৬৫ সালের আগে ওসবে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। তোমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলাম মনে নেই। তবে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের কথা মনে আছে। না বুঝেই সেখানে গিয়েছিলাম। মোচটোচ থাকা এবং লম্বাচওড়া হওয়ায় তুমি সহজেই চোখে পড়েছিলে। আর ’৬২-তে বাসাইলে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নির্বাচনে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে। তোমাকে পানি পান করাতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছিলাম। সেই স্মৃতি প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পেতে পেতে অন্ধ ভালোবাসার আবেশের সৃষ্টি করেছিল, যা থেকে আজো মুক্তি পেলাম না। চেয়েছিলাম গোছিয়ে বলব। মনই যেখানে অগোছালো সেখানে গুছাই কী করে? গোছানো হোক আর না হোক সব কিছু তো জানাতেই হবে। সেখানে কোনো ঘাটতি রাখা চলবে না। সেখানে নিখাদ প্রেম থাকতে হবে, যাতে কোনো কিছু বাদ না পড়ে, কোনো কিছু বাড়িয়ে-কমিয়ে যাতে বলা না হয়। কারণ যেখানে আছো, সেখানে দেশের খবর, আমাদের খবর পাবে কী করে? তোমাকে যখন খুনিরা হত্যা করে তখন আমায় টাঙ্গাইলের জেলা গভর্নর করেছিলে। আজ তোমার সেই যুগান-কারী দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে কত ঠাট্টা-মশকারা, কত তাচ্ছিল্য! এখন গাড়িতে গাড়িতে, বাড়িতে বাড়িতে দেশ ছেয়ে গেছে। উঁচু উঁচু ইমারতের জ্বালায় বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায় না। তোমার সেই অজপাড়াগাঁ গোপালগঞ্জেও বড় বড় ইমারত উঠেছে। সিলেটে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রবাসীরা অকামে বাড়ি বানিয়ে ফেলে রেখেছে। কিন' ’৭৫-এ তুমি যখন মারা যাও, তখন এমন ছিল না। দু-তিন তলার ওপর ঢাকা শহরেই তেমন কোনো বাড়িঘর ছিল না। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়া ছিল একেবারেই কম। কিন' গভর্নর হওয়ার কারণে তখনো বাবর রোডের বাড়ির সামনে সব সময় ৪০-৫০টি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। এখন তোমার কন্যার মন্ত্রীদের বাড়ির সামনেও অত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে না। কারণ এখন কারো কোনো মর্যাদা নেই। মুখে গণতন্ত্র থাকলেও ক্ষমতার সব এক দিকে তোমার কন্যার, অন্য দিকে বীরোত্তম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার হাতে। আর মাঝে যা কিছু আছে, সব কর্মচারীদের। অন্যভাবে বলা চলে সব ক্ষমতাই সরকারি কর্মচারীদের। যখন যাকে দিয়ে সুবিধা তাকে শিখণ্ডী করে আমলারা ব্যবহার করে মাত্র। তাই কখনো আওয়ামী লীগ বা মহাজোট আবার কখনো বিএনপি বা চারদলীয় জোট। এ সবই নিমিত্ত মাত্র। আসল সেই আমলারাই। যে জন্য এত কথা বললাম তা হলো, তোমার প্রিয় লতিফ সিদ্দিকী তিনি ’৭৩ সালে চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিয়ে করেছিলেন। তার আত্মীয়স্বজন আমাদের সাথে লতায়-পাতায় মিশে গিয়েছিল। ভাবীর বড় ভাই নুরুল ইসলাম বাবর রোডের বাসায়ই থাকতেন বেশি। বাবর রোডের পশ্চিমে তার এক বন্ধু ছিল। ১৪ আগস্ট আমাদের বাড়ি থেকে বন্ধুটি নুরুল ইসলামকে জোর করে নিয়ে গিয়ে কত যত্ন করে সিনেমা দেখিয়েছে! কিন' যেই তোমার মৃত্যুসংবাদ এলো, ঘুম থেকে তুলে তাকে তাড়িয়ে দিলো। এখন দেখো তোমার মাহাত্ম্য কত! তুমি থাকলে মাথায় তোলে, না থাকলে পায়ে দলে। এসব তোমায় যখন জানাচ্ছি, তখন পরিবেশ একটু ভিন্ন। চাটুকারেরা চাটু মেরে মেরে তোমার কন্যাকে জেরবার করে ফেলেছে। বলতে চেয়েছিলাম ১৫ আগস্টের পরের কথা। আগেই বলেছি সেদিন আমার খাওয়া হয়নি। মাংস চিবুতে গিয়ে তোমার মাংস মনে হয়েছে। কিন' ওইটুকু তো শেষ নয়, আরো আছে। তুমি তো জানো না, তোমার মৃত্যুর পর আবার অস্ত্রহাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। তাতে প্রায় ৬০০ আহত ও ৭২ জন নিহত হয়। শহীদ বললাম না এই জন্য যে, এ দেশের শক্তিমানদের সাথে অমত হলে সত্যকে মিথ্যায় পর্যবসিত করতে সময় লাগে না। একেবারে অল্প সময়ে ডাহা মিথ্যাকেও সত্য বানানোর বহু কারখানা এখন তোমার সত্যের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কারখানা বসাতে এখন কোনো জামানত লাগে না। এমনিতেই বিপুল পুঁজি পাওয়া যায়। তবুও এক-এক করে বলি, তুমি তোমার সুবিধামতো দেখে নিয়ো। হাতের কাছে থাকলে যখন তখন ওটা দেখতে পাবে।

১৫ আগস্ট ’৭৫ সকালের দিকটা খুব দিশেহারা ছিলাম। লতিফ ভাই তখন কালিহাতী থানার তোমার এমপি। এখনো কালিহাতী থানার এমপি এবং তোমার কন্যার মন্ত্রী। মাঝখানে অনেকটা দিন অবহেলা-অনাদরে কেটেছে। এখনো যে মন্ত্রী হয়ে খুব দর বেড়েছে তা নয়। এখন কারো কাছে কারো দর নেই। মন্ত্রীদেরও নেই। তোমার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। যেহেতু ক্ষমতা তার হাত দিয়ে পরিচালিত হয় সেহেতু আমলা-ফাইলারা, ক্ষমতার তামিশগিররা তাকে চার দিক থেকে ঘিরে আছে। অন্য দিকে তোমার জিয়াউর রহমান বীরোত্তম যাকে তুমি মাঝে মাঝেই গণভবনে দুপুরে খাওয়াতে, তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন একজন বিরাট নেতা। তাকে অবলম্বন করে ক্ষমতার বাইরের বলয় সৃষ্টি হয়েছে। কিন' কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা নেই। এ দিক থেকে ক্ষমতাহীন, পিতা-মাতাহীন এতিম হিসেবে ভালোই আছি।

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় প্রথমে কথা হয়েছিল স্বাস'্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নানের সাথে। তার কণ্ঠ বড় করুণ, অসহায় মনে হয়েছিল। তাকে বলেছিলাম, কিছু করতে বাসা থেকে বের হোন। বাইরে বেরুবেন কী করে, গাড়িঘোড়া নেই। অন্যের গাড়ি দিয়ে আমার ড্রাইভার ইউসুফকে পাঠিয়েছিলাম। ইউসুফ বড় ভালো ছেলে। সে হেয়ার রোডে গিয়ে তাকে পায়নি। তার আগেই খালেদা হাবিব গাড়ি পাঠিয়ে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে নিরাপদেই ছিলেন। তার খবর বলে দিয়েছিল তার প্রাইভেট সেক্রেটারি। সে-ও তো ছিল পাকিস-ানি ক্যাডারের। তাই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় থাকলেও পাকিস-ানি অফিসারেরা যে কী চিজ, তা আমাদের মন্ত্রীরা বুঝতে পারেননি। কথা হয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে। তিনি আমার রক্তের কেউ না হলেও ঘনিষ্ঠতায় আমরা আত্মীয়ের বেশি ছিলাম। দাদুর কাছ থেকে তেমন দৃঢ়তা পাইনি। যতটা অসহায়ত্ব, ওরকম পরিসি'তিতে স্বাভাবিক কারণেই ক্ষোভ পেয়েছিলাম। তবে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী একমাত্র নেতা যিনি বড় দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘কাদের, তুমি বা তোমরা এই হত্যার প্রতিকারে যা করবা তাতে আমাকে পাবা।’ কিন' তাদের পেলাম কোথায়? এক-দু’দিন পরই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো বঙ্গভবনে। মোশতাক তাদের সমর্থন চাইলেন। তারা বলেছিলেন, ‘যা হবার হয়ে গেছে। আমরা তো আর কিছু করছি না। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া আমাদের কী-ই বা করার আছে? তাই তার খুনে আমাদের অংশীদার না বানিয়ে এমনি থাকতে দিলেই আমরা খুশি হবো।’ খোন্দকার মোশতাক নেতৃবৃন্দের কথায় বিপদের সঙ্কেত পেয়েছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এইচ এম কামারুজ্জামানকে তখনই গ্রেফতার করা হয়েছিল। তোমার পরিবারের সব সদস্যকে কবর দেয়া হয়েছিল বনানীতে। আর তোমাকে এক ভাঙা হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তোমার আবাল্যের লীলাভূমি টুঙ্গিপাড়ায়। থানা স্বাস'্য কমপ্লেক্সের পাশে কফিন নামানো হয়েছিল। সারা জীবন তুমি যাদের মানুষ ছিলে, তাদেরই মতো একেবারে অনাদরে ৫৭০ সাবান দিয়ে তোমাকে ইহজগতের শেষ গোসল করানো হয়েছিল। তোমার শেষ কাপড় জুটেছে তোমারই সরকারের রিলিফে দেয়া মার্কিন কাপড়ের কাফনে। (চলবে)



॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
এখন আর কোনো কিছুই সহজভাবে বলা যায় না, করা যায় না, পদে পদে বাধা। ’৭২ সালে যখন মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলে যেতাম ১০-১২ মিনিট লাগত। এখন সেখানে হরহামেশাই এক-দেড় ঘণ্টা লাগে। কখনো তো দুই-আড়াই-তিন ঘণ্টার প্রয়োজন হয়। ভাবলাম, ৩৭-৩৮ বছরের জমা কথা সব হরহর করে বলে ফেলব। কিন্তু পদে পদে এটা-ওটা সামনে এসে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। তাই জমানো কথাগুলো বলার পথে ভীষণ ভীষণ সমসাময়িক কিছু ঘটনাও তোমাকে বলব। তাই প্রতি পর্বেই প্রথম দিকটায় বর্তমান ঘটমান দু-একটি ঘটনা অবশ্যই তোমাকে জানাব।
এবার ১৪১৯ বাংলা বর্ষে আশা করেছিলাম কালিমামুক্ত অমলিন হবে। কিন্তু শুরুর দিকেই যা দেখছি মনে হয় বছরটা ভালো যাবে না। ২ বৈশাখ, ১৫ এপ্রিল সোমবার রেলমন্ত্রীর এপিএস ফারুকের অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ মাথায় নিয়ে বর্ষীয়ান জননেতা শ্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন। ষাটের দশকে আরেকজন মহান নেতা রেল দুর্ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ভারতের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগ করে কিছুটা নিম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই পদত্যাগটা কেলেঙ্কারির পর মুহূর্তে হলে যতটা ভালো হতো, দেরি করায় ততটা হয়নি। কোনো নারীর সামাজিকভাবে স্বীকৃতি ছাড়া সন্তান হলে যেমন হয়, প্রায় তার কাছাকাছি হয়েছে। আর প্রথমে হলে নরনারীর সামাজিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সন্তান হলে যে আনন্দ ও গর্বের হয়, অনেকটাই তেমন হতো। তুমি তো বাবা, আমিও বাবা হয়েছি, তবুও অনেক কিছু বলতে পারি না। এরপর দেখোÑ যার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ, ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার সেই মুজিবনগর দিবস গেল তার খবরাখবর কোনো পত্রপত্রিকায় স্থান তেমন পেল না। শ্রী সুরঞ্জিৎ সেনের পদত্যাগের খবর অনেক পত্রিকায় আট কলামেও এসেছে। কিন্তু মুজিবনগর দিবসের খবর কোনো পত্রপত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় এক কলামেও চোখে পড়েনি। গতবার তোমার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং গিয়েছিলেন মুজিবনগরে। সে কী আড়ম্বর!
এবার মাননীয় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়েছিলেন। লতিফ সিদ্দিকীকে দিয়েও মুজিবনগর দিবস মানাত। তিনি যথার্থই মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন নেতা ছিলেন। কিন্তু এখন তার তো কোনো নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নেই। তার সাথে গিয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। এখন তিনি তোমার কবর দেয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী। তোমার চিনতে অসুবিধা হতে পারে। ময়মনসিংহের ছাত্রনেতা ছিলেন। খুবই চিকন-চাকন ও হালকা-পাতলা। তখনকার দিনে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে তোÑ তাতেই নেতা। এখন তেমন কাজটাজ করে না, বেশ জনবিচ্ছিন্ন। তবু তোমার মৃত দলের সাধারণ সম্পাদক। মানে মুজিবনগর সরকার, মুজিবনগর দিবস অস্বীকার করা, এরপর তোমাকে অস্বীকার করা, তারপর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। এরপর অতিরিক্ত শখ হলে অন্যের অঙ্গীভূত হওয়ার যে সম্ভাবনা নেই তা-ও বলা যায় না। বড় কষ্ট ও অস্বস্তিতে আছি। আবার দেখো স্বাধীনতার মূল কথাই হলো রাষ্ট্র কর্তৃক জীবন ও সম্পদ সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান। বর্তমানে মানুষের মানসম্মান ও জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। নিরাপদ মৃত্যুরও কোনো গ্যারান্টি নেই। এই তো সে দিন গভীর রাত থেকে ইলিয়াস আলীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে যে কত মানুষ গুম হয়েছে তা লেখাজোখা নেই। দোষে-গুণে মানুষ। ইলিয়াস আলী তাদের একজন। ছাত্রনেতা হিসেবে তাদের সংগঠনে সে খুবই সফল। এমপিও হয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক মানুষ। ১৭ তারিখ মঙ্গলবার রাতে গুম হওয়ার পর থেকে আমার এই লেখা পর্যন্ত তার কোনো খবর নেই। এ রকম একজন রাজনৈতিক মানুষের যদি চরম কিছু ঘটে, তাহলে সেটা হবে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। আমরা পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগের জন্মদাতা সাধারণ সম্পাদক জননেতা শামসুল হককে পাকিস্তানি কুচক্রী মহলের গুম করার ষড়যন্ত্রের কথা জানি। এখন তো আমরা কারো কলোনি নই, কারো দাস বা গোলাম নই। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাহলে আমাদের নাগরিকজীবন নিরাপদ হবে না কেন? আমি পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর কাছে ইলিয়াস আলীর সন্তানসন্ততির কাছে তার নিরাপদ প্রত্যাবর্তন কামনা করি এবং সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব হারানোর কলিজাছেঁড়া কষ্ট আপনার চেয়ে বেশি অন্য কারো জানার কথা নয়। তাই আপনার নেতৃত্বে সরকারের সময় কোনো স্ত্রী তার স্বামী, কোনো সন্তান তার বাবা হারালে তার চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে!
সেনাবাহিনীর এক মেজর ও আরো ১০-১২ ঘাতক তোমার লাশের সাথে ছিল। তারা তড়িঘড়ি জানাজা ছাড়াই তোমাকে মাটিচাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পরও দু-একজন বাঙালি ছিল, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সাহসের পরিচয় দিয়েছে। তেমনি কয়েকজন জানাজা ছাড়া তোমার লাশ কবরে নামাতে ওই কঠিন সময়েও রাজি হয়নি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তোমাকে ধোয়ানো হয়। তোমার সারা গায়ে আঠারোটি গুলি ছিল। যে আঙুল উঁচিয়ে পাকিস্তানিদের তুমি শাসাতে, ’৭১ সালে পরাজিত হয়ে যারা তোমার কাছে প্রাণভিা পেয়েছিল, তাদের দালালেরা তোমার সেই আঙুল থেঁতলে দিয়েছিল। কাছে থেকে গুলি করে আঙুলের ডগা ছিন্ন করেছিল। একটি সাধারণ মিসকিন নিহত হলেও ময়নাতদন্ত হয়। এটা রাষ্ট্রের বিধিবিধান। কিন্তু তোমার ময়নাতদন্ত হয়নি। ঘাতকেরা ময়নাতদন্ত করার প্রয়োজনবোধ করেনি। আদৌ কোনো ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করেছিল কি না জানার চেষ্টা করিনি। জানই তো বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত হয়। মিলিটারিদের পা-চাটা পুলিশ কর্মকর্তারা একজনকেও জানাজায় শরিক হতে দিতে চায়নি। তোমাকে খুন করে যারা মতায় বসেছিল, তাদের সময় গোপালগঞ্জের সেই সব পুলিশ কর্মকর্তার পদোন্নতি তো হয়েছেই, ২১ বছর পর তোমার মেয়ে মতায় এলেও তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এখনো হয় না, যত অসুবিধা আমাদের। শুনলে খারাপ লাগবে কি না জানি না, তোমার জীবদ্দশায় তোমাকে যারা সব সময় জ্বালিয়েছে, ভদ্রতা-শালীনতার বালাই না রেখে গালাগাল করেছে, চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছে, তারা বড়ই আরামে আছে। কষ্টে পড়েছি আমরা, যারা তোমাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখি। তা না হলে সেই বিপ্লবী কন্যা, যে পল্টন কাঁপাত, সে আজ তোমার কন্যার সব থেকে প্রিয় মন্ত্রী। তোমাকে খুন করে যারা মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, সেই মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাকারী এইচ টি ইমাম এখন সব চেয়ে মতাবান। রাজাকারদের কথা ছেড়েই দিলাম। তোমার মৃত্যুর পর জিয়া ও এরশাদের মন্ত্রিসভায় যারা দুর্দান্ত প্রতাপে ছিল, তারা আজ সবচেয়ে ভালো অবস্থায়। শুধু নামে যারা তোমাকে খুন করেছে তারা বাদে আর সবার অবস্থা ভালো। টুঙ্গিপাড়ায় জানাজা ছাড়া যারা তোমার কবর দিতে আপত্তি করেছিল, ’৯০ সালে দেশে ফিরে আমরা তাদের সাধ্যমতো সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছি। নাম বললে সবাইকে চিনবে। তারা হলোÑ শেখ আবদুল হাই, আলহাজ আবুল কাশেম, আ: মুকিত ফকির, গাজী ইমাম উদ্দিন, হাজী কেরামত আলী, শেখ মো: ইদ্রিস, নাজির মোল্লা, সোহরাব মাস্টার, আ: হালিম শেখ, শেখ নুরুল হক, গোলাম আলী মোল্লা, ইলিয়াস হোসেন সরদার, কাজী ইদ্রিস, কাজী আকবর, মুন্সী জর্জিস শেখ, তোতা মিয়া মুন্সী, শেখ আ: মান্না ও শেখ আয়ুব আলী। এরাও অনেকে পরপারে চলে গেছে। তুমি এদের জন্য দোয়া করো। বাংলার মানুষের জন্য তোমার দোয়া আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন কখনো ফেলবেন না। তুমি তো জানই, যত গাউস, কুতুব, ওলি আবদেল আছেন বা ছিলেন, তারা কারো জন্য দোয়া করলে সে দোয়া প্রথম রাসূল সা:-এর দরবারে যাবে। রাসূলে করিম সা: রাজি-খুশি হয়ে যদি দোয়া করেন, তবেই সে দোয়া দয়ালু আল্লাহর আরশে পৌঁছবে, তার আগে নয়। কিন্তু মহান স্রষ্টা তার সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের এত উচ্চাসন দিয়েছেন, যা চিন্তারও বাইরে। বাবা-মা যদি খুশি হয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করে তাহলে তা সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছে এবং সন্তানের জন্য কোনো বাবা-মায়ের দোয়া তিনি ফিরিয়ে দেবেন না, মঞ্জুর করবেন। তাই বাঙালি সন্তানদের জন্য তোমার দোয়া কি আল্লাহ কবুল না করে পারেন? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই পরম দয়ালু রাব্বুল আলামিন কবুলে মঞ্জুর করবেন।
’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। দিনে দিনে দিন তো আর কম হলো না। দেখতে দেখতে চলে গেছে তিন যুগ। সে দিনের সেই ভয়াবহ অবস্থার কথা অনেকে ভুলেই গেছে। তুমি তো জানইÑ কখনো কখনো কারো পৌষ মাস কারো আবার সর্বনাশ। তোমার অবর্তমানে আমরা কেউ কেউ সর্বহারা, দিশেহারা। আবার কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ। ছিল রাস্তায়, উঠেছে প্রাসাদে। মাঝে মধ্যে বড় বিব্রত হই। কোনো কোনো সময় কিছুই ভালো লাগে না। আবার তোমার কথা চিন্তা করে শান্ত হই। তুমি কতবার কতভাবে বলেছ, ত্যাগীরা ত্যাগ করবে, ভোগীরা ভোগ করবেÑ এ নিয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। তাই মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে পড়লে তোমার ওই সব কথা মনে করে বুকে বেশ জোর পাই, হালকা লাগে। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, তাই এত দিনে কথারও অনেক ডালপালা গজিয়েছে। কত কিছু ঘটে গেছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি। সারা দেশে ব্যাপক যানজটের মতো তোমাকে বলতে যাওয়া কথা একের আগে আরেক এসে গোলমেলে করে ফেলছে। তবু চেষ্টা করছি সব কিছু ঠেলেঠুলে সোজা রাস্তায় যেতে। তুমি তো জানই, হাতে চাবুক থাকলে আমি সব পারি। তুমি নেই তাই দুর্বল বোধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি আমাদের যোগাযোগ ছিল না। তোমার আদেশ-নির্দেশ-চেতনাই ছিল মূলধন। তার ওপর ভরসা করেই আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। তোমাকে হত্যা করে ঘাতকেরা সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের বড় বেশি তি করেছে। সে তুলনায় আমার তি তো খুবই সামান্য। কিন্তু তবু যখন একা থাকি, নীরবে থাকি বুকের ওপর কেমন যেন পাথরচাপার মতো বোঝা অনুভব করি।
তোমার মৃত্যুর দিন ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার। যদি দিন-রাতের হিসাব ধরা হয়, তাহলে সেদিনও গভীর রাতে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমার মা লতিফা সিদ্দিকী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে ছিল। জেলা গভর্নরদের ট্রেনিং নিতে বঙ্গভবনে যাওয়ার পথে প্রত্যেক দিন সকাল-বিকেল মাকে দেখতে যেতাম। দশ ছেলে-মেয়ের আমার বাবা-মা ছিলেন খুবই ভাগ্যবান। মুরগির বাচ্চার মতো আমরা তাদের ঘিরে থাকতাম। সে রাতেও মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। টাঙ্গাইল থেকে বাবর রোডের বাসায় বহু লোক আসায় হাসপাতালে যেতে দেরি হয়েছিল। মায়ের সাথে বি-ব্লকের কেবিনে তখন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের খালা-ফুফু কেউ একজন ছিলেন। মুখে কিছু না বললেও আমাদের জন্য তাদের ডিস্টার্ব হতো। বুঝতাম তবুও মাকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। মাও তার সন্তানদের ছেড়ে থাকতে পারত না। তাই ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় পিজিতে গিয়ে রাত সাড়ে ১২টা বা পৌনে ১টায় সেখান থেকে বেরিয়েছিলাম। রাত ১২টায়ই ১৫ আগস্ট পড়ে গিয়েছিল। তাহলে সেটা ১৫ আগস্ট সকাল হবে, নাকি রাত? নাকি আমরা যেভাবে সূর্য ওঠার পর সকাল ধরি, সেইভাবে ধরলে ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টা বা পৌনে ১টা হবে। তা যেভাবেই হোক, রাতে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। পিজি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েকটা ট্যাঙ্ক দেখি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোল রুম, কাকরাইল মসজিদÑ এসব জায়গায় ট্যাঙ্ক দেখতে দেখতে বাসায় ফেরার পথে মনে হচ্ছিলÑ শেরেবাংলানগর রীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার দেখে যাই। বহু দিন পর তোমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তারই প্রস্তুতি চলছিল সব দিকে। উত্তেজনার কারণ হয়েছিল আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পুরান ঢাকায় বোমা ফাটায়। সে জন্য তুমি নাকি তিনটি ট্যাঙ্ক নামার অনুমতি দিয়েছিলে। রাস্তায় ট্যাঙ্ক ঘোরাফেরা করতে দেখে রীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে গিয়ে পরিচালক আনোয়ারুল আলম শহীদকে পেয়েছিলাম। ট্যাঙ্ক ঘুরছে কেন বলতেই সে বলছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরান ঢাকায় গ্রেনেড পড়েছে। তাই মহড়া দিতে রাস্তায় তিনটা ট্যাঙ্ক নামাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনুমতি দিয়েছেন।’ ‘কী বলো? আমি তো চারটার বেশি দেখলাম।’ সে বলল, ‘হতেও পারে। আপনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলে দেখুন। মনে হয় তিনি এখনো ঘুমাননি। এইমাত্র আমি তার সাথে কথা বলেছি।’ কত হবে তখন, রাত ১টা ৬-৭ মিনিট। এখনকার মতো তখন কোনো যানজট ছিল না। ক্রিসেন্ট রোড থেকে ডানে মোড় নিয়ে বামে ফিরলেই আমার বাড়ি আর বামে মোড় নিয়ে ডানে ফিরলে তোমার বাড়ি। সে রাতে তাই করেছিলাম। মনে হয় রাত ১টা ১০-১২ মিনিটে তোমার গেটে গিয়েছিলাম। মিনিটখানেক লেগেছিল গেট থেকে রিসিপশন রুমে যেতে। এক ডিএসপি টেলিফোনের কাছে ছিল। আমাকে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে বলেছিল, ‘স্যার, স্যারকে রিং আমি দেবো, না আপনি দেবেন?’
Ñ না, আপনিই দিন। এক রিংয়েই তুমি ফোন ধরেছিলে। কাদের সিদ্দিকী এসেছে বলতেই বলেছিলে ওকে নিয়ে এসো। গিয়ে দেখি লুঙ্গি পরা গেঞ্জি গায়ে দাঁড়িয়ে আছো। পিতার ব্যাকুলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে, ‘কী হয়েছে, এত রাতে?’ বলেছিলাম, ‘তুমি তো জানো, মা হাসপাতালে।’
Ñ হ্যাঁ, তা তো জানিই। সেদিনই তো তাকে দেখে এলাম। কেন, কী হলো?
Ñ না, মায়ের কিছু হয়নি। মা ভালোই আছেন। কিন্তু মাকে দেখে ফেরার পথে রাস্তায় চার-পাঁচটা ট্যাঙ্ক দেখলাম। আমার ভালো লাগেনি। তাই এসেছি।
Ñ কেন, তুই জানিস না, সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফেটেছে? পুরান ঢাকায় বোমা ফেটেছে? বোমাবাজদের বুঝাবার জন্য মহড়া দিতে তিনটা ট্যাঙ্ক বেরোতে পারমিশন দিয়েছি।
Ñ তিনটা কেন, আমি তো বেশি দেখেছি।
Ñ আরে না রে, সবটাতেই তোর সন্দেহ, বাড়াবাড়ি। একটাই হয়তো দু’বার দেখে গোলমাল করছিস।
- না, না, তা হতেই পারে না। চালাকিতে পাকা না হলেও অঙ্কে কখনো অত কাঁচা ছিলাম না। তিনটাকে চার-পাঁচটা গোনার মতো বেকুব আমি না।’ আমার কথা শুনে তুমি পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলে, ‘যা, ঘুমা গিয়ে। যদি পারিস সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিস।’ মনে হয় তোমার সে দিনের স্পর্শ আজো আমার গায়ে লেগে আছে। আমি কিন্তু তোমার কথাতেও সে দিন দমিনি। আবদার করেছিলাম আমার সাথে ঢাকা শহরে বেরিয়ে পড়তে। তুমি আশ্চার্য হয়ে বলেছিলে, ‘আরে পাগল, আমি দেশের প্রেসিডেন্ট না? একটা রাষ্ট্রীয় প্রটোকল আছে না? আমি একা তোর সাথে বেরোবো কী করে?’ তুমি তো জানই, আমি তোমার কাছেও কিছু চাইতাম না। তাই কথা বলতে দ্বিধা হতো না। কোনো কিছু বলতে ভয় করত না। সাথে সাথে চোখে-মুখে বলেছিলাম, ‘কেন, মাত্র ক’মাস আগে শুধু ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে তুমি যে সন্তোষে হুজুর মওলানা ভাসানীকে দেখতে গিয়েছিলে, তখন তোমার প্রটোকল ছিল কোথায়?’ তুমি অবাক হয়ে বলেছিলে, ‘কী বলিস? ওসব তুই জানলি কী করে?’ ‘কেন, আমি তো তোমাদের পিছেই ছিলাম। তোমাকে রেখে মনসুর ভাই যখন বাড়ি ফেরেন তখন তার সাথে কথা হয়েছিল।’ তুমি খুবই অবাক হয়ে বলেছিলে, ‘তাই তো কোনো গাড়ি ফলো করছে বলে ড্রাইভার বলেছিল।’
Ñ হ্যাঁ, ওটাতেই আমি ছিলাম। তাহলে আজ বাইরে যেতে আপত্তি কোথায়? কত রাজা বাদশাহ তো তার নাগরিকদের সুখ-সুবিধা দেখতে রাতে শহর ঘুরেছে। চলো না যাই। শহর দেখে বঙ্গভবনে রাত কাটিয়ে সকালে ওখান থেকেই না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে।’ আমাকে প্রবল জোরে বুকে চেপে ধরে বলেছিলে, ‘শেষ পর্যন্ত আমাকে তুই বাদশাহ হারুনুর রশীদ বানাতে চাস নাকি? পাগলামি করিস না। অনেক রাত হয়েছে, বাড়ি যা।’ নিচে নেমে ঘড়িতে দেখি রাত ১টা ৪০ মিনিট। সারা জীবন খুব বেশি ঘুমের ওষুধ খেতে হয়নি। আর তোমার সান্নিধ্যই ছিল আমার কাছে ঘুমের দাওয়াইয়ের মতো। শুয়ে পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন