সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

দেশে গুম খুন জেল-জুলুম বিশ্ব দরবারে কী করবেন



আ তা উ স সা মা দ
‘যখন রাষ্ট্র অথবা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের অনুমোদনক্রমে, তাদের সমর্থন নিয়ে অথবা সম্মতিতে কোনো ব্যক্তিকে গোপনে অপহরণ করা হয় অথবা বন্দি রাখা হয় এবং ঐ ব্যক্তি যাতে আইনের আশ্রয় না নিতে পারেন, সে উদ্দেশে তার ভাগ্যে কী ঘটেছে বা তিনি কোথায় আছেন, তা জানতে দেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে (International Human Rights Law) তখন ঘটনাটিকে বলপূর্বক গায়েব করে দেয়া (Forced disappearance or enforced disappearance) বলা হয়।’ অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে ‘ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ শিরোনামের নিবন্ধের শুরুতেই এই কথাগুলো বলা আছে।
নিবন্ধটিতে এর পরেই আছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম আইন (Rome statute of the International Criminal court) অনুসারে যখন কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বলপূর্বক নিখোঁজ বা অদৃশ্য করে দেয়ার অস্ত্রটি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তখন এরকম গুম করাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে এবং এটি অন্য কোনো সীমিতকরণ আইন দ্বারা এই অপরাধীর বিচার বন্ধ করা যাবে না। ২০০২ সালের ১ জুলাই এই আন্তর্জাতিক আইনটি পাস হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও ‘গুম হয়ে যাওয়ার হাত থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য কনভেনশন’ নামক একটি আন্তর্জাতিক আইন ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গৃহীত হয়।’
উইকিপিডিয়ায় প্রচারিত নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘গুম হওয়ার অর্থই প্রায়ই হলো খুন হওয়া। প্রথমে একজনকে অপহরণ করা হয়, তারপর তার ওপর চলে অত্যাচার, অতঃপর তাকে খুন করে তার লাশটি লুকিয়ে রাখা হয়। প্রায়ই গুপ্তহত্যার পর লাশ এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যাতে তা কোনো দিনই খুঁজে না পাওয়া যায়।’
বাংলাদেশে যে গুম-খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে ও ঘটছে সেগুলো উপরিউক্ত অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। তাই গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের দাবি অবশ্যই তুলতে পারেন। আর যারা এই অপরাধগুলো ঘটাচ্ছে ও করছে তাদেরও জেনে রাখা ভালো যে, তারা একদিন না একদিন বিশ্বের কোথাও না কোথাও, বিচারের সম্মুখীন হবে, অপরাধ ঘটানোর সময় তারা যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন। বর্তমান বিশ্বে এক দেশের পলাতক যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধীর আন্তর্জাতিক আদালতে অথবা আশ্রয়গ্রহণকারী দেশের আদালতে বিচার করার প্রথা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আর দেশের ভেতরেই ক্ষমতার মসনদের অধিকারী পাল্টে গেলে এ রকম মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গোপন কুকর্মের তথ্যপ্রমাণ ফাঁস হবেই। বাংলাদেশের এরকম অপরাধ ঘটনাবলী নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এরই মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে এই ধরনের ‘গুম’ করার অপরাধ ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। একটি মানবাধিকার সংস্থা বলেছে যে, চলতি ২০১২ সালেই অন্তত ২২টি গুম করার ঘটনা ঘটেছে। সংস্থাটি বলেছে, এই গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দাবি করেছে, গত ৩ বছরে তাদেরই কমপক্ষে ১০০ জন নেতাকর্মী গুপ্তহত্যা ও গুমের শিকার হয়েছে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ১৩ দিন আগে ঢাকার বনানীতে তার ঘরে ফেরার সময় মাঝ রাতে বাড়ির কাছাকাছি অপহৃত হন। সরকারি দায়িত্বরত, অর্থাত্ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এই পরিচয় দিয়ে ওই সশস্ত্র ব্যক্তিরা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে উধাও হয়। তারপর থেকে তারা দু’জনই নিখোঁজ রয়েছেন।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তাকে যে তারিখে আদালতে হাজির করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা পার হয়ে গেছে কিন্তু ইলিয়াস আলীকে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন সংস্থা তাকে খুঁজছে কিন্তু এখনও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ইলিয়াস আলী অপহৃত হওয়ার পর দিনই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলেন, সরকারি বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গেছে, অতএব সরকারকেই তাকে জীবিত ফিরিয়ে দিতে হবে। ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাতে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল তাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু ইলিয়াস আলী ফিরে না আসায় বিএনপি পরপর তিন দিন দেশজুড়ে হরতাল করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন নতুন মোর্চা ১৮দলীয় জোট গত পরশু ও গতকাল একই দাবিতে হরতাল করেছে।
গত পরশু হরতালের সময় সচিবালয়ে দুটি এবং ঢাকা শহরের অন্যত্র ছয়-সাতটি ছোট বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। বেশ কিছু গাড়িও ভাংচুর হয়। কেউ বলেন, হরতাল-সমর্থক পিকেটাররাই সবক’টি সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী আর অন্য কেউ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্টরাই বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। গতকাল জানা গেল, এসব ঘটনার জন্য দায়ী করে সরকার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমানউল্লাহ আমান, এলডিপি নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিএনপির দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী এবং আরও তিরিশ-চল্লিশ জনের নামে থানায় মামলা করেছে। পুলিশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছে। এর আগে তারা বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ-এর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। সহজ ভাষায়, বিএনপি ও তার সঙ্গী দলগুলো ইলিয়াস আলীর সন্ধান লাভ করার জন্য তথা গুম ও গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চালিয়ে যাবার হুশিয়ারি দিয়েছিল তা নস্যাত্ করার জন্য সরকার এখন হামলা ও মামলা এই দুই পথেই বিরোধীদের ওপর জুলুমের স্টিমরোলার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান সরকারের এই নীতি ১৯৬৬ সালে তত্কালীন সেনাশাসক আইয়ুব খান ও তার দোসর মোনায়েম খান শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে যে মামলা ও গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছিল, তার কথা কিছুটা হলেও মনে করিয়ে দেয়। আশা করি সে সময়ের অনেক তরুণ নেতা যারা এখন সরকারের সঙ্গে আছেন, তারাও সে সময়ের কথা একেবারে ভুলে যাননি। এখন এ পথ ধরে চলার সময় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ‘অনুমোদন, সমর্থন ও সম্মতিক্রমে’ আরও কত লোক নিখোঁজ হয় কে জানে? এই শঙ্কা প্রকাশ করছি এ জন্য যে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে মতপার্থক্য ছিল তা দিন দিন বড় হচ্ছে। কারণ, এতে নতুন ও উত্কট সব সমস্যা যোগ হচ্ছে।
ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী অপহৃত হওয়ার পর পর সরকারের দু’চারজন নেতার গলায় যে একটু নরম সুরের ছোঁয়া লেগেছিল তা বেশ ক’দিন হলো একেবারেই উবে গেছে। এখন তারা ইলিয়াস আলীর পরিবার, বিএনপি এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন যে, তাকে খুঁজে বের করতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করছেন না। আমরা যতদূর জানি, অভিযোগগুলো ধোপে টেকে না। বরং এর উল্টোটাই সত্যি বলে মনে হয়। অন্তত এটুকু তো দেখা যাচ্ছে যে, সাংবাদিকরা ওই অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করেন এবং তাদের ভাষ্য প্রকাশ করেন আর তার পরপরই দেখা গেল, ওই প্রত্যক্ষদর্শীরা একে একে চোখের আড়াল হয়ে গেছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা প্রথম দিকে পুলিশ ও র্যাবকে খুবই সহযোগিতা করেছিলেন, পরে সম্ভবত তদন্তকারীদের উল্টাপাল্টা প্রশ্ন ও নিষম্ফল জিজ্ঞাসাবাদ এবং অভিযান দেখে তারা হতাশ হয়ে নিজেদের অনেকখানিই গুটিয়ে নিয়েছেন। আর বিএনপির বেশ ক’জনকে এরই মধ্যে পুলিশ ও র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা গেছে। তারা তো এ জন্য নিজেদের উপস্থিত রেখেছেনই। এদিকে কল্যাণ পার্টির প্রধান মেজর জেনারেল ইব্রাহীম সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনারা আগে বলুন যে কী সহযোগিতা চান, তারপর দেখুন আমরা তা দিই কী না দিই। আগেই অভিযোগ কেন?’ এদিকে ইলিয়াস আলীর দেশের বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে ইলিয়াস আলীর তিন বিক্ষোভরত সমর্থক নিহত হয়েছেন। পরে লক্ষ্মীপুরেও বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে দলের একজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথম বার হরতালের আগের দিন ও হরতালের সময়ে দুঃখজনকভাবে দুইজন গাড়িচালক নিহত হয়েছেন।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় বিএনপি ও তাদের সঙ্গী দলগুলোকে এখন হামলা-মামলা, জেল-জুলুম প্রতিরোধ করতে জোরদার বা দুর্বল যেমনই হোক ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরাও সন্দেহ করছেন যে, বিরোধীরা আসলে সরকার পতনের আন্দোলন করছে এবং সেটা তারা যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করবেন। আর আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্বত-প্রমাণ ব্যর্থতা, অপরাধ ও দুর্নীতি এতই স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা খুবই ভয়ে আছেন যে, এই সরকার গদিচ্যুত হলেই তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, তাই তারা মরণ কামড় দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। আমাদের জন্য খুবই ভীতিকর হলো যে, এরকম অসময়ে গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা কায়মনোবাক্যে সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন বাংলাদেশকে ও এ দেশের মানুষকে এই বিপদ থেকে বের করে আনেন।
আজ ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। আজ এদেশের শ্রমিক-জনতা ভারাক্রান্ত চিত্তে স্মরণ করবে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে। তাকে গত ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে অপহরণ করে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা। তার পর দিন টাঙ্গাইলে তার লাশ পাওয়া যায়। এই শ্রমিক নেতার হত্যাকারীরা এখনও ধরা পড়েনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন