রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

আস্থা-অনাস্থার দোলায় নির্বাচন কমিশন

আস্থা-অনাস্থার দোলায় নির্বাচন কমিশন


॥ ইকতেদার আহমেদ ॥

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। একটি নির্বাচনকে অর্থবহ এবং দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও অবিতর্কিত ব্যক্তি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। আর এ ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হলে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এমন সব দলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হতে পারে বিতর্ক পরিহারে সর্বোত্তম পন্থা। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন-পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এমন সব দলের মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে সে কথা বলার অবকাশ আছে কি?
‘নির্বাচন কমিশন’ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে এর গঠন ও দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন বর্তমানে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে নির্বাচন কমিশনারের সর্বোচ্চসংখ্যা বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা সর্বোচ্চ চারজন নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
সংবিধানে যদিও বলা আছে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলিসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগদান করবেন কিন্তু অদ্যাবধি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগসংক্রান্ত কোনো আইন প্রণীত না হওয়ায় রাষ্ট্রপতির একক এখতিয়ারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় এ ধরনের আইনের অস্তিত্ব রয়েছে সে ক্ষেত্রেও সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের বিধানাবলিকে উপেক্ষা করে নিয়োগ প্রদান সম্ভব কি না তা বিবেচনা ও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা হয়েছে ৫৬ অনুচ্ছেদের তিন দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের এক দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ বছরের ইতিহাসে যে ক’টি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে তার মধ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ব্যতীত সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারক আবদুল আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট ছিল। তা ছাড়া সাবেক সচিব আবু সাঈদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন চার সদস্যবিশিষ্ট ছিল। অপর সব নির্বাচন কমিশনের সদস্যসংখ্যা ছিল দুই থেকে তিনজনের মধ্যে।
সংবিধান ও অন্যান্য আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশনকে যেসব দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী একলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতি পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচন পরিচালনার জন্য রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটানির্ং অফিসার কর্তৃক মনোনয়নপত্র বৈধ বা বাতিল ঘোষিত হলে বিক্ষুব্ধ পক্ষ কর্তৃক দাখিলকৃত আপিলের শুনানি ও নিষ্পত্তিকরণ, নির্বাচন চলাকালীন যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের ওপর কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়ার জন্য বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, অবৈধ প্রভাব প্রভৃতি বিদ্যমান থাকার কারণে তাৎক্ষণিক ভোট গ্রহণ বন্ধের নির্দেশ প্রদান, নির্বাচন-পরবর্তী অনিয়ম পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন এবং কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ প্রদান, পদত্যাগ ইত্যাদি কারণে আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তিকরণ, একটি নির্বাচনী এলাকার সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীর নাম গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের কার্যক্রম গ্রহণ প্রভৃতি।
উপরিউক্ত দায়িত্বগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু নির্বাচন-পূর্ববর্তী বিক্ষুব্ধ প্রার্থী কর্তৃক মনোনয়নপত্র বাতিল বা গ্রহণের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত আপিলের শুনানি এবং পদত্যাগ ইত্যাদি কারণে সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি ব্যতীত অপর সব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধানকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। তত্ত্বাবধানকারী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সদস্যসংখ্যা সীমিত অর্থাৎ অনধিক তিনজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে কমিশনের পক্ষে সার্বিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন সম্ভব মর্মে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অভিমত পোষণ করেন। মনোনয়নপত্র বাতিল বা গ্রহণের বিরুদ্ধে কমিশনে দায়েরকৃত আপিলগুলো তিন দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও আইনের জ্ঞান ও প্রয়োগ বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির কমিশনে প্রবেশ ঘটলে অনধিক তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের এ দায়িত্বটি সফলভাবে পালনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ ব্যর্থ হওয়ার অবকাশ আছে কি? আর যদি ব্যর্থ হওয়ার অবকাশ না-ই থাকে তাহলে কেন রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের মাধ্যমে কমিশনের সদস্যসংখ্যার এ বাহুল্য?
১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি এরশাদ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কমিশনকে পদত্যাগে বাধ্য করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচারক মো: আবদুর রউফ এ কমিশনের প্রধান ও অপর কর্মরত বিচারক নাঈমুদ্দিন আহমেদ সদস্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারককে সংবিধানের ৯৯ নং অনুচ্ছেদের বিধানাবলির আলোকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায় কি না সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ কমিশনের প্রধান ও সদস্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করলে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ কে এম সাদেকের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হয়। এ কমিশনটি ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬-এর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে জনমতের চাপে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। এরপর নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের ব্যত্যয়ে একজন সাবেক সচিবকে প্রধান করে এবং অপর একজন সাবেক সচিব ও একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজকে সদস্য করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এরপর থেকে অদ্যাবধি শুধু একবার নির্বাচন কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারকের এর প্রধান হিসেবে আগমন ঘটেছিল। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলনের মুখে মেয়াদপূর্তির আগেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা পদত্যাগ করলে অপর এক সাবেক সচিব আবু সাঈদের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশনের ব্যাপারে বিএনপির আপত্তি থাকলেও যেকোনো কারণেই হোক এ কমিশনকে মেনে নিয়ে বিএনপি অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারক আবদুল আজিজের নেতৃত্বে অনধিক পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিশন গঠিত হলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন-পরবর্তী এ কমিশনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর সাবেক সচিব শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিশন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পূর্বাপর এ কমিশনের বিরোধিতা করে এলেও এ কমিশন তার নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে সমর্থ হয়। এরপর সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দীনের নেতৃত্বে অনধিক পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিশন গঠন করা হয়েছে এ কমিশনকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আজ্ঞাবহ, অনভিজ্ঞ ও নিম্নমানের আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের আনুগত্য কী হবে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দলীয় সরকারের বিকল্পে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অনুরূপ কোনো অস্থায়ী সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আবু সাঈদ কমিশনের অনুরূপ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগমন-পরবর্তী এ নির্বাচন কমিশন যদি ভিন্ন ধরনের আচরণ করে তখন বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আগের মতো হয়তো বা আবারো হতবাক হতে হবে।
১৯৯০-পরবর্তী নির্বাচন কমিশনগুলোর নিয়োগপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একমাত্র আবু সাঈদ আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ব্যতীত ক্ষমতাসীনদের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত অপর সব কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগমন-পরবর্তী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান বিপরীতমুখী। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না আমাদের দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি এখনো বিতর্কিত এবং অমীমাংসিত। এ বিতর্কের সুরাহা না করে দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন প্রধান বিরোধী দলের আস্থা অর্জনে কতটুকু সক্ষম হবে তা এ মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, সাংবিধানিক পদে আসীন চারজন পদধারী সমন্বয়ে গঠিত একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে সুপারিশকৃত ১০টি নাম থেকে রাষ্ট্রপ্রতি পাঁচটি নাম গ্রহণ করে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চারজনকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ প্রদান করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা অনির্বাচিত ব্যক্তি এবং শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য অনির্বাচিত ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও ধ্যান-ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক ও অবমাননাকর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে এ যুক্তিকে গ্রহণ করে নিলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক অনির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন কতটুকু যৌক্তিক?
রাষ্ট্রপতির কার্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং একজন দলীয় ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও পদে আসীন-পরবর্তী জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তাকে নিরপেক্ষ বিবেচনা করা হয়। রাষ্ট্রপতি তার নিরপেক্ষতা হারালে প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা ক্ষুণœ হয়। অনুরূপভাবে একজন দলীয় ব্যক্তি সংসদের স্পিকার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও নিয়োগের পর সবাই প্রত্যাশা করে তিনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে সংসদের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখবেন। সংসদের কার্যাবলি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্পিকারের নেতৃত্বে সরকার ও বিরোধী দলের প্রধানসহ সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সদস্য সমন্বয়ে সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটি গঠিত। রাজনীতি সচেতন দেশের জনগণের ধারণা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব রাজনৈতিক দলের সদস্য সমন্বয়ে গঠিত স্পিকারের নেতৃত্বাধীন সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগপ্রক্রিয়া সমাধা করা হলে যেকোনো ধরনের অনাহূত বিতর্ক পরিহার সম্ভব।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) মাধ্যমে ভোট গ্রহণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ব্যাপারে আগ্রহী। অপর দিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণপ্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ আছে এ যুক্তিতে ওই পদ্ধতিটির মাধ্যমে ভোট গ্রহণ বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ইভিএম বিষয়ে অবস্থান এখনো সুস্পষ্ট নয়। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, পৃথিবীর শিল্পোন্নত বেশির ভাগ রাষ্ট্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দেয়ায় তা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে প্রচলিত কাগজের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণপদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন ঘটছে। একজন ভোটার কাগজের ব্যালটের মাধ্যমে তার পছন্দের প্রতীকে সিল মেরে ভোট প্রদান করলে যে আত্মিক সন্তুষ্টি লাভ করে সে ধরনের আত্মিক সন্তুষ্টি ইভিএমের মাধ্যমে ভোট কি দিতে পারে? আর যদি দিতে না-ই পারে তবে কেন আমরা একটি মীমাংসিত বিষয়কে নিয়ে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করছি?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা বা না থাকা অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে সৎ, যোগ্য, দক্ষ এবং সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। যেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে। রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি করেন দেশ ও জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। একটি দলীয় সরকারের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী কী ব্যবস্থায় সরকার পরিচালিত হবে এবং কোন ধরনের ব্যক্তি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে সে বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হলে জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণের বিষয়গুলো পর্যুদস্ত হবে। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে অনিবার্য বিপদ ও সঙ্ঘাত এড়িয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্যে নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনকেই প্রমাণ করতে হবে তারা দল-মতের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষম। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য কাজটি দুরূহ হলেও অসাধ্য নয়। বর্তমান সরকারের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আস্থার ওপরই নির্ভর করছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যৎ।
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিম কোর্ট
iktederahmed@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন