বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

পয়লা বৈশাখ রাজনীতি না সংস্কৃতি?



রাস্তা থেকে বলছি

॥ এরশাদ মজুমদার ॥

বাংলাদেশের মানুষ তিনটি নববর্ষ পালন করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ পালনের জন্য নানা ধরনের মিছিল বের করে। অন্যান্য নববর্ষের তুলনায় বাংলা নববর্ষ অনেক বেশি জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। বলা হয়ে থাকে, পয়লা বৈশাখ ও একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে দু’টি প্রধানতম সার্বজনীন উৎসব। পয়লা মহররমও পালিত হয় হিজরি ক্যালেন্ডার হিসেবে। দেশের শিয়া সম্প্রদায় কারবালার বেদনাময় ঘটনার কথা স্মরণ করে মিছিল বের করেন। সুন্নি মুসলমানেরা ঘরে ঘরে ফিরনি ও রুটি বিতরণ করেন। অনেকেই মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করেন। হিজরি সন চালু হয়েছে রাসূলে পাক সা:-এর হিজরতের বছরকে স্মরণ করে। পয়লা মহররম ও ১০ মহররমকে স্মরণ করে সারা দেশেই মসজিদে বিশেষ মাহফিল ও মুনাজাতের ব্যবস্থা করা হয়। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা পয়লা মহররম পালন করে। বাংলাদেশেও সরকারি ছুটি থাকে। কিন্তু সবার ওপরে গুরুত্ব লাভ করেছে ইংরেজি সন। ইংরেজরা এ দেশটি শাসন করেছে মাত্র ১৯০ বছর। কিন্তু এর প্রভাব সর্বগ্রাসী। আমাদের জীবনে এবং সরকারি অফিস-আদালতে এখনো ইংরেজির অবস্থান শক্তিশালী ও সবচেয়ে বেশি। এর মানে হচ্ছে কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব এখনো খুব শক্তিশালীভাবে বলবৎ আছে। শত চেষ্টা করেও বাংলা তার স্থান করে নিতে পারছে না। এর কারণ আমাদের সরকার, রাজনীতিক, আমলা ও বুদ্ধিজীবীরা ভালোই জানেন। বরং ইংরেজির প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই খবরের কাগজ ও টিভিগুলো এ নিয়ে হইচই ও মাতম শুরু করে দেয়। এতে তাদের ব্যবসায়ও ভালো হয়। অর্থনীতির বিষয়টাকে আমি সব সময় সমর্থন করি। যেকোনো জাতি বা দেশের শক্তিশালী অবস্থানের জন্য শক্তিশালী অর্থনীতির প্রয়োজন। আমাদের সরকারি হিসাব-নিকাশ এখনো ইংরেজি সন মোতাবেকই হয়ে থাকে। বাজেটও তৈরি হয় ইংরেজি সনকে অনুসরণ করে। সরকারি ক্যালেন্ডার ডায়েরি ছাপা হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। দেশী-বিদেশী বড় বড় কোম্পানি, বিদেশী দূতাবাসগুলোও ইংরেজি সন মোতাবেকই তাদের কার্যাবলি পরিচালনা করে। বড় বড় হোটেল ইংরেজি সনের হিসেবেই অনুষ্ঠান কর্মসূচি তৈরি করে। এমনকি তারা খ্রিষ্টমাস পালন করে। ওই সময়ে সব হোটেলে সান্তাকজের ছবি দেখা যায়। সমাজের একশ্রেণীর তরুণ যুবক ও বৃদ্ধরা থার্টিফার্স্ট নাইট ও নিউ ইয়ার পালন করে নাচ-গান, হইচই ও মাতলামি করে। নামজাদা হোটেল ও কাবগুলোতে মদের ঢল নামে। রাতগুলোকে সামাল দেয়ার জন্য পুলিশ বিভাগ বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করেও কিছু তরুণ-তরুণী কাব বা নিজেদের আড্ডা ছেড়ে রাস্তায় নামে এবং অশ্লীলতার প্রকাশ ঘটায়। পুলিশ এদের গ্রেফতার করলেও ছেড়ে দেয় প্রভাবশালীদের কারণে। পয়লা বৈশাখে এরা খাঁটি বাঙালি সাজে আবার থার্টিফার্স্ট নাইটে পশ্চিমাদের অনুসরণ করে। এমন ধারার কিছু শিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক আছেন যারা গভীরভাবে পয়লা বৈশাখ ও থার্টিফার্স্ট নাইট পালন করেন। তাহলে আপনারা বুঝতে পারছেন, আমরা কোন পথে এগিয়ে চলেছি। আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি কোন পথে ধাবিত হচ্ছে।

এর আগেও আমি আপনাদের বলেছি, মনোজগতে আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করিনি। ফলে বিদেশী সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। তাতে জড়িত হয়েছে আমাদের দেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও এনজিও নেতা। আমাদের দেশের পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মালিকদের মৌলিক কোনো আদর্শ নেই। এই মিডিয়া মালিকদের সাথে হাত মিলিয়েছে একশ্রেণীর সাংবাদিক। ওই সাংবাদিকেরা নিজেরাই বলেন, আমরা শ্রমজীবী মানুষ। যিনি বা যারা বেশি বেতন বা মজুরি দেবেন তার জন্য কাজ করব। দিনমজুরের আদর্শের কোনো প্রশ্ন ওঠে না। পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের মালিক চোর-ডাকাত বা হার্মাদ হলেও কোনো আপত্তি নেই। আমাদের দেশে বেশ কিছু পত্রিকা বা চ্যানেল আছে যাদের আদর্শ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এদের বেশির ভাগই দিল্লি বা পশ্চিমাদের তাঁবেদারি করেন। ওদেরই হালুয়া-রুটি খেয়ে নিজের বিরুদ্ধে কলম ধরে ও সেমিনারে বক্তৃতা করে। শুনেছি, সত্য নাও হতে পারে, দিল্লি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। যে জাতির সাংস্কৃতিক পরাজয় ঘটে তার স্বাধীনতা আর বেশি দিন টেকে না। যেমনÑ সিকিম সংসদে আইন পাস করেই ভারতের সাথে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশে নামে মুসলমান, কর্মে মোনাফেক এমন বুদ্ধিজীবী রয়েছে কয়েক হাজার। এদের গলা বড়। নিয়মিত খবরের কাগজে কলাম লেখে। এরা বই রচনা করে প্রভুদের নির্দেশে। এর আগে আমি বহুবার বলেছি আমরা ভাষাগত জাতি নই। আমরা শুধু বাঙালি নই। আর তা নই বলেই আজ আমরা স্বাধীন। শুধু বাঙালি যারা তারা দিল্লির অধীনতা মেনেই সুখেশান্তিতে আছে।

বর্তমান বাংলা সন চালু করেছেন বাদশাহ আকবর। তিনি কাজটি করেছেন বাংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। প্রখ্যাত জ্যোতিষবিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ শিরাজী বাদশাহর নির্দেশে হিজরি সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সন। তখন দিল্লি সরকারের সরকারি ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা ছিল হিজরি সন। আর বাংলায় চালু ছিল বঙ্গাব্দ, যা চালু করেছিলেন রাজা শশাংক। রাজা শশাংকের বঙ্গাব্দ আর চলমান বাংলা সন এক নয়। যদিও আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী চলমান সনকে বঙ্গাব্দ বলে চালাতে চান। যখন ফসলি সন চালু হয় তখনো মাসের নাম বর্তমানের মতোই বৈশাখই ছিল। যদিও বৈশাখ হিন্দু দেবীর নাম। জনসাধারণ বা কৃষকসমাজের সুবিধার্থেই ফতেউল্লাহ্ শিরাজী মাসের নাম আগের মতোই রেখে দিয়েছেন। এটা ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি দিল্লির সম্মান প্রদর্শন। সেই থেকেই বৈশাখ মাসে জমিদার, নবাব ও তালুকদারেরা খাজনা বা রাজস্ব আদায় করতেন। এখনো তহশিল অফিসগুলো বৈশাখ-চৈত্র হিসাবে খাজনা আদায় করে। এই সময়ে এখনো গ্রামবাংলায় ব্যবসায়ীরা হালখাতা পালন করেন। হাল শব্দটি ফারসি, খাতা শব্দটি আরবি ও ফারসি। দুটো শব্দ মিলিয়ে হালখাতা হয়েছে। হাল মানে বর্তমান বা কারেন্ট। নাগাদ শব্দটিও ফারসি। দুটো শব্দ মিলিয়ে হয়েছে হালনাগাদ। পয়লা বৈশাখে জমিদার বাড়িতে পুণ্যা বা রাজস্ব আদায়ের উৎসব পালিত হতো। সে দিন প্রজারা দলে দলে এসে তাদের পুণ্যা খাজনা পরিশোধ করত। পুণ্যা শব্দটি এসেছে পুণ্য শব্দ থেকে। এর মানে হলো ওই দিন খাজনা পরিশোধ করলে পুণ্য লাভ হবে। এই শব্দ চালু হওয়ার কারণ ইংরেজ আমলে বেশির ভাগ জমিদার ছিলেন হিন্দু। তারাই এই শব্দটি চালু করেছেন। তা হলে আমরা বুঝতে পারছি যে, পয়লা বৈশাখ রাজস্বসংক্রান্ত একটি দিন। চৈত্র মাসের শেষ অথবা পয়লা বৈশাখে গ্রামবাংলার সর্বত্র মেলা হয় বহুকাল থেকে। শহর বা নগরবাসী এ মেলাকে তেমন গুরুত্ব দিত না। এ মেলাব্যবস্থা ও গ্রামের সংস্কৃতিকে শহুরেরা তেমন মর্যাদাও দিতেন না। এখন তারা পয়লা বৈশাখকে মহা গুরুত্ব দেন তাদের প্রভুদের নির্দেশে। শহুরেদের কাছে পয়লা বৈশাখের মানে আলাদা ও ভিন্ন । রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে পয়লা বৈশাখ একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র ও কিছু শিক। এরা পয়লা বৈশাখের উৎসবে মঙ্গলপ্রদীপ যাত্রা চালু করেছেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা পশুপাখির মুখোশ পরে মিছিল করে। মুখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে উল্কি আঁকে। এই আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য রাজধানীতে মানুষের ঢল নামে। সাধারণ মানুষের সাথে মঙ্গলপ্রদীপ মিছিলের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা জানেনও না কেন এই পশুপাখির মিছিল। কী উদ্দেশ্য এই মিছিলের। এটা নাকি সার্বজনীন উৎসব। রাস্তায় যে বিশাল আলপনা আঁকা হয়েছে তার সম্পর্কে প্রখ্যাত শিল্পী কাইউম চৌধুরী ও রফিকুন্নবী বলেছে, এটা বাঙালিদের উৎসব। আমরাও এই দেশে বাস করি, যেমন বাস করেন শ্রদ্ধেয় কাইউম চৌধুরী ও রফিকুন্নবী। দশ-পনেরো বছর ধরে হঠাৎ করে ঢাকায় এ উৎসব চালু হয়েছে। কিন্তু এই মিছিলের পেছনে কোন অদৃশ্য শক্তি আছে, তা আজো স্পষ্ট হয়নি। কারা এই মিছিলের জন্য অর্থ জোগান দেন তা-ও স্পষ্ট নয়। আমাদের বাপ-দাদারা কখনো পয়লা বৈশাখ এমন করে পালন করেননি। কাইউম চৌধুরী ও রফিকুন্নবীর বাপ-দাদারাও এমন ধারার পয়লা বৈশাখ পালন করেননি। এমনকি পশ্চিম বাংলার দাদারাও পয়লা বৈশাখ নিয়ে এমন মাতামাতি করেন না। পশুপাখির মিছিল বের করেন না। তাহলে বাংলাদেশে এসব হচ্ছে কেন? কারা এসব করাচ্ছে। কী-ই বা তাদের উদ্দেশ্য? পশ্চিম বাংলার জ্ঞানীজন তো পয়লা বৈশাখ নিয়ে এমন মাতামাতি করছেন না। সত্যি কথা বলতে, কলকাতা এখন আর বাঙালি দাদাদের দখলে নেই। ব্রিটিশ সাহেবদের রাজধানী কলকাতা এখন ভিন্নভাষীদের দখলে। পশ্চিম বাংলার রাষ্ট্র ও সরকারি ভাষা এখন হিন্দি। স্কুল-কলেজে হিন্দি পড়া এখন বাধ্যতামূলক।

একটা কথা খুব বেশি করে স্পষ্ট হওয়া দরকার। তা হলো এ জগতে শুধু বাঙালি বলে কোনো কথা বা শব্দ নেই। যখন সুবাহ বাংলা ছিল তখনো ছিল বাঙালি, বিহারি ও উড়িয়া। শুধু বঙ্গদেশ (অখণ্ড) বললেও শুধু বাঙালি নেই। অখণ্ড বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমান ও ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন। এ কারণেই ১৯০৫ সালে বাংলা মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়েছেন তারা ’৪৭ সালে এসে বাংলা মাকে দ্বিখণ্ডিত করলেন। ’৪৭ সালে তারা হাসতে হাসতেই বাংলাকে দুই ভাগ করেছেন। মুসলমানেরা চেয়েছিলেন অখণ্ড বঙ্গদেশ। কিন্তু হিন্দু দাদারা ও কংগ্রেস নেতারা তা চাননি। এসব হলো ইতিহাসে বিষয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এ ইতিহাস জানতে চায় না। তারা নাকি এসব নিয়ে ভাবে না। এর মানে তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে তারা ভাবে না। কেউ কেউ এটাই চান। কারণ যে জাতি নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ভাবে না বা সজাগ নয় তাদের স্বাধীনতা থাকে না। বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ কবিগুরু হয়েও শুধু হিন্দু ছিলেন। তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শনে তিনি কখনো ধর্মচিন্তা ত্যাগ করেননি। আমি মনে করি তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন। নিজ ধর্ম ত্যাগ করা কোনো গৌরবের কাজ নয়। বরং তিনি এবং তার পরিবার হিন্দু ধর্মসংস্কারের চেষ্টা করেছেন। আমাদের এই বাংলাদেশে তাকে অনেকেই দেবতার আসনে বসানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এসব লোক প্রকাশ্যে নিজেদের দেবতা বা ধর্মহীন বলে দাবি করেন। কবিগুরু নিজেকে কখনোই দেবতা মনে করেননি এবং দেবতুল্য মর্যাদাও দাবি করেননি। কবিগুরু একজন মানুষ, তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। মনুষ্য সীমাবদ্ধতার ওপর তিনি কখনোই ছিলেন না। আজকের এই নিবন্ধে কবিগুরু জমিদারি ও সওদাগরি জীবন নিয়ে কোনো আলোচনা করতে চাই না। কবি হিসেবেও তিনি কখনো মহাগুরু, কখনো বিশ্বমানবতার প্রাণ ও মান। আমি নিজেও তার সঙ্গীতের একজন পরম ভক্ত। তবুও মাঝে মধ্যে মনে হয়, তিনি কখনোই বেদ উপনিষদ ও গীতার বাইরে আসতে পারেননি। ঘুরেফিরেই তিনি হিন্দুত্বের কাছে ফিরে গেছেন। আমাদের কিছু মানুষ কবিগুরুকে ধর্মহীন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগে গেছেন।

নাগরিক জীবনের পয়লা বৈশাখ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলেছি। বাংলাদেশের জনজীবন বা গণজীবনে এর কোনো প্রভাব নেই। গ্রামবাংলায় এটি শুধুই একটি আর্থসামাজিক দিন। এ দিন বকেয়া খাজনা বা বকেয়া সওদাগরি পাওনা আদায় হবে। এ ছাড়া মেলা বসে গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সব পণ্য বেচাকেনা করার জন্য। সময়টা কৃষকের জন্য ভালো। ফসল তোলার পর কৃষকের হাতে বেশ কিছু পয়সা আসে। আসল কথা হলো পয়লা বৈশাখের জন্মই হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। মোগলরা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার অর্থনীতির জন্য বৈশাখ দিয়ে বছরের যাত্রা কল্যাণকর, যা আজো আমাদের নেতারা বুঝতে পারেননি। ফসল ও গ্রামীণ অর্থনীতির কথা চিন্তা করে আমাদের বাজেট শুরু হওয়া দরকার পয়লা বৈশাখ বা পয়লা এপ্রিল থেকে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও কোনো সরকার এ উদ্যোগ নিতে পারেনি। কারণ আমাদের নেতারা মনোজগতে এখনো স্বাধীন নন।

পয়লা বৈশাখ নিয়ে রাজনীতি ও মাতামাতি করা এখন একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। পয়লা বৈশাখ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আমি সমর্থন করি। পশুপাখির মুখোশ লাগিয়ে বা গাঁজা-ভাং খেয়ে অশ্লীল নৃত্য দেশের কোনো মানুষই সমর্থন করে না। এসব অশ্লীল বেলেল্লাপনা শুরু হয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। হঠাৎ করে কে বা কারা তরুণদের উসকে এসব করাচ্ছে তার মূলে যাওয়া দরকার। কেনই বা অদৃশ্য শক্তি আমাদের তরুণদের দিয়ে এসব করাচ্ছে, তাদের ল্য কী সেটা আজ খুবই জরুরি। ভারতীয়দের ধর্মে নানা ধরনের পশুপাখির প্রভাব রয়েছে। তাদের দেবতারা ওই সব পশুপাখি ভর করে ভ্রমণ করেন। এমনকি ইঁদুরও তাদের দেবতার সম্মান পায়। গ্রামীণ মেলায় মুখোশ বেচাকেনা হয়। তা ব্যবহার করে শিশুরা ণিকের আনন্দ লাভের জন্য। কিন্তু রাজধানীতে রাষ্ট্রীয় সম্মতি নিয়ে পশুপাখির মিছিল আমাদের সাধারণ মানুষ কখনোই সমর্থন করে না। রাজধানীর পয়লা বৈশাখের বর্তমান রূপ এ দেশের এর আগে কখনোই দেখেনি।পয়লা বৈশাখ উপলে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো নানা রকমের পোশাক তৈরি করে। যাতে অনেক সময় পশুপাখির ছাপ থাকে, যা আমাদের তরুণ-তরুণীরা খেয়াল করে না। আমি আগেই বলেছি পয়লা বৈশাখের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু শাড়ি, কামিজ, জামায় যা ছাপা হচ্ছে তার সাথে আবহমান বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোনো মিল নেই। পশ্চিম বাংলার ঐতিহ্যের সাথেও এর কোনো মিল বা সাযুজ্য নেই। পয়লা বৈশাখের বিজ্ঞাপনের দিকে একটু নজর দিন, দেখতে পাবেন পশুপাখির ছবি দিয়ে বহু ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রখ্যাত শিল্পী রফিকুন্নবী বলেছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৮৫ সালে যশোর থেকে। আপনাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যশোর জেলার আশপাশের জেলা নিয়ে একটি স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখান থেকেই ওই মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু হয়েছে রাজধানীতে এবং এখনো চলছে। এর পেছনে রয়েছে কোনো এক অদৃশ্য মহলের রাজনৈতিক অভিলাষ, যা খোলা চোখে আমাদের তরুণ-তরুণীরা দেখতে পায় না। তারা ভাবছে এটা বাঙালিপনা বা বাঙালিয়ানা। তারা মনে করছে বা তাদের বলে দেয়া হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। তারা ভুলে যায়, ভাষা এক হলেও দুই বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এক নয়। বাংলাদেশীরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আলাদা ঐতিহ্যের কারণেই বাংলাদেশ নামের ভৌগোলিক এলাকাটা আজ স্বাধীন। ভৌগোলিক লোকজ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য এক হয়েই আমরা একটি আলাদা জাতিতে পরিণত হয়েছি। আর ওই একই কারণেই পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা দিল্লির অধীনে থেকেই নিজেদের স্বাধীন মনে করছে। তারা চান বাংলাদেশের মানুষ তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যাক। সোজা কথায় বলা যেতে পারে এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের সাংস্কৃতিকভাবে পদানত ও পরাজিত করতে চায়। আমরা যারা বাংলাদেশের আলাদা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা বলি আমাদের সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন বলে গালিগালাজ দেয়া হয়। বাংলাদেশী শব্দটা নাকি পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী চালু করেছে। আপনি যখনই ইসলাম বা মুসলমানের কথা বলবেন তখনি আপনাকে গালমন্দ করা হবে। এই গোষ্ঠী নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মনে করে। কিন্তু এদের চিন্তাধারায় বিকাশ ঘটেছে বেদ উপনিষদ থেকে। এরা মনে করে সনাতনী হিন্দু ঐতিহ্যই বাংলাদেশীদের সংস্কৃতি। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু একই সময়ে ভারতে কয়েক হাজার দাঙ্গা হয়েছে। এই তো ক’দিন আগে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত নিজেকে সেকুলার অসাম্প্রদায়িক দেশ বলে বড় গলায় জাহির করে, বাস্তবে ভারত কখনোই অসাম্প্রদায়িক ছিল না। অসাম্প্রদায়িকতা ভারতের এক খোলস ও চাণক্য নীতি। 

তবে এ কথা সত্যি যে, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ কিছু লোকজ সনাতনী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে লালন করে। যার সাথে হিন্দু সমাজের মিল রয়েছে। যেমন রয়েছে হিন্দুদের ভেতর বহু মুসলমানি ভাবধারা। এ সবই সাংস্কৃতিক মেল বন্ধনের ফলাফল। বাঙালি হয়েও বাংলাদেশের মুসলমানেরা হাজার বছর ধরে নিজেদের আলাদা ঐতিহ্য রা করে আসছে। যা আর কোনো দিনও বাঙালি হিন্দুর মতো হওয়ার নয়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন