॥ বিচারপতি মোসৱফা কামাল ॥
দ্রম্নতযোদ্ধা বিচারপতি এস এম মোরশেদ আদালতের ভেতরে ও বাইরে নিঃসন্দেহে একজন বর্ণাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। মন কেড়ে নেয়ার মতো একটা আকর্ষণীয় শক্তি বিচারপতি মোরশেদের ছিল। অতি সহজেই তার আদালতকৰটি জুনিয়রদের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। অতি অল্প সময়ে তিনি যেকোনো দুরূহ মামলার তথ্যে ও আইনগত প্রশ্নে অবলীলায় ঢুকে যেতে পারতেন। আলঙ্কারিক ইংরেজি ভাষা শোনার আকর্ষণে তার আদালতকৰে ভিড় লেগে থাকত। তার রায়গুলো ছিল এক-একটা বোমা বিস্ফোরণের মতো। আইয়ুবী শাসনামলে জনগণের অধিকার, জনকল্যাণ ও জনস্বার্থের প্রতিষ্ঠায় তিনি তার রায়গুলোকে একরকম জেহাদি মনোভাব নিয়েই প্রয়োগ করেছিলেন। সরকার বা সরকারিপৰের কোনো বাড়াবাড়ি, অন্যায় ও অবৈধ ৰমতাপ্রয়োগ তার রোমদৃষ্টির বাইরে পড়েনি।
স্বাভাবিকভাবে সে সময়কার স্বৈরাচারী পরিবেশে বিচারপতি মোরশেদ আদালতকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন জনগণের আশা-ভরসার শেষ মাধ্যম হিসেবে। তার অনেক রায় সুপ্রিম কোর্টে নাকচ হয়েছে, কিন্তু তাতে তিনি শেষ বিচারে পরাজিত- এ কথা বলা চলে না। অথচ বিচারকার্যে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন কতকগুলো মহৎ দান। কৌঁসুলিদের উপস্থাপনা উন্নত মানের না হলে উন্নত মানের রায় আশা করা যায় না। বিচারপতি মোরশেদের যুগানৱকারী রায়গুলোতে তদানীনৱন পাকিসৱানের প্রখ্যাত কৌঁসুলিদের উলেস্নখযোগ্য অবদানের কথা স্বীকার করলেও নির্দ্বিধায় এ কথা বলা চলে যে, শেষ পর্যনৱ বিচারপতি মোরশেদের রায়ে যেটা স্বচ্ছন্দভাবে ফুটে উঠেছে তা হলো- তার নিজের ব্যক্তিত্ব। বিচারপতি মোরশেদ কৌঁসুলিদের মনৱব্য ধারণ করেছেন, তাদের উপস্থিত নজির ও যুক্তিতর্ক পর্যালোচনা করেছেন, কিন্তু সর্বোপরি তার রায়ে ফুটে উঠেছে তারই নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, তার জীবন-দর্শন, তার নিজস্ব বিশেস্নষণ ও তার সংগৃহীত নজির। গতানুগতিকতার সোজা পথ দিয়ে না হেঁটে তিনি সৃষ্টি করে নিতেন নিজের পথ, নিজের পাথেয়। এ জন্যই তার রায়গুলো স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল, তার নিজস্ব বিদগ্ধতায় সমৃদ্ধ।
বিচারপতি মোরশেদের রায়ের এই স্বকীয়তা একটা আকস্মিকতা নয়, দীর্ঘকালের সযত্নলালিত প্রচুর অধ্যয়ন ও পরিশ্রমের ফলে এই স্বকীয়তা। যেকোনো পেশায় বা বৃত্তিতে শুধু পেশাগত বা বৃক্তিগত দৰতা অর্জন করলে এই স্বকীয়তা আসে না। পেশা-অনৱপ্রাণ শেষ পর্যনৱ পেশার গুণের সাথে কিছু অলঙ্ঘনীয় ত্রম্নটির এক বিচিত্র সমাবেশ। কৌঁসুলিদের যুক্তিতর্ক একেবারেই শুনতেন না তা বলা যায় না, তবে যতটুকু শোনা উচিত তার চেয়ে হয়তো কম শুনতেন। যে পৰের যুক্তিতর্ক তিনি গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না, সে পৰের উদ্দেশ্যে তার শাণিত প্রশ্ন, মনৱব্য ও বাক্যবাণ প্রায়ই ছিল বড় কঠিন। হয়তো আবেগপ্রবণতা, উচ্ছ্বাস ও সহানুভূতি বা তার অভাব তার বিচারবুদ্ধিকে কোনো কোনো সময় আচ্ছন্ন করে ফেলত। আমরা এই দোষ-গুণে মণ্ডিত উদার হৃদয়, মহৎপ্রাণ বিচারপতিকে সবার অলৰে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
একজন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকের মতো বিচারপতি মোরশেদের বিচারপতি অনৱরেও একটি কান্না ছিল, একটি জ্বালা ছিল, একটি অস্থিরতা ছিল। যাদের কান আছে তারা এই কান্না শুনতে পাবেন তার রায়ে, যাদের অনুভূতি আছে তারা এই জ্বালার প্রখরতায় দগ্ধ হবেন। বিচারকের রায় তার বিচারকর্মের চূড়ানৱ প্রকাশ। বিচারপতি মোরশেদের রায়গুলো এই চূড়ানৱ প্রকাশে শিল্পকর্মের মতো। শব্দবিন্যাস, ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিশীলতায়; বিচার-বিশেস্নষণের নিপুণতা, মতপ্রকাশের স্পষ্টতা ও বলিষ্ঠতায় তার বহিরঙ্গ যেমন অনবদ্য ও অসাধারণ; তেমনি জীবনদর্শনের গভীরতা, সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, মানবাধিকারের প্রতি আনুগত্য ও বঞ্চিতের প্রতি সমবেদনায় তার অনৱর তেমনি নিটোল ও ভরপুর।
যেকোনো বিচারকের রায়ে বিবদমান পৰের কৌঁসুলিদের যুক্তিতর্ক একটি গুরম্নত্বপূর্ণ উপধারাই হয়। পেশার বাইরে যার জ্ঞান সীমিত; জীবন, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে প্রায় অনভিজ্ঞ ও অজ্ঞাত, তার জীবনবোধের ভেতর পরিপক্বতা বা ব্যাপ্তি আশা করা চলে না। বিচারপতি মোরশেদ নিছক আইনশাস্ত্র অনুশীলন করে আইনের টেকনোক্র্যাট হননি। তার জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার পরিধি ছিল বহুধাবিস্তৃত। একাধারে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইংরেজি সাহিত্য ইত্যাদি অধ্যয়ন করা ছাড়াও তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। ফারসি, আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষার বিস্তৃত জ্ঞান ও অধ্যয়ন ছিল তার বিশিষ্ট গুণাবলির একটি। তার নিজস্ব গ্রন্থাগারে বহু দুর্লভ গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির সমাহার রয়েছে। এই বিস্তৃত ও ব্যাপক অধ্যয়নের ফলে তার মনোজগৎও সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনি আইনকে ইতিহাসের মাপকাঠিতে, দর্শনের তুলনামূলক বিচারে ওজন করে নিতে পারতেন। আইন তার কাছে নিছক কতকগুলো বিধিব্যবস্থা ছিল না। আইনের পেছনে যে ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, দর্শন ও কার্যকারিতা সক্রিয়, তিনি তার মূলে সহজে ও অবাধে বিচরণ করতে পারতেন। যদিও দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আইনের ৰেত্রে তার একটি সহজাত বিচরণ ছিল, তবু যেন শাসনতান্ত্রিক আইনের ৰেত্রে তার গতায়াত আরো স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল বলে মনে হয়। এই আইনের সুনিপুণ ব্যাখ্যায় ও প্রয়োগে পাকিসৱানে তার জুড়ি কেউ ছিলেন না। সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশে শাসনতান্ত্রিক আইনের এমন নিপুণ কলাকার দুর্লভ।
লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
দ্রম্নতযোদ্ধা বিচারপতি এস এম মোরশেদ আদালতের ভেতরে ও বাইরে নিঃসন্দেহে একজন বর্ণাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। মন কেড়ে নেয়ার মতো একটা আকর্ষণীয় শক্তি বিচারপতি মোরশেদের ছিল। অতি সহজেই তার আদালতকৰটি জুনিয়রদের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। অতি অল্প সময়ে তিনি যেকোনো দুরূহ মামলার তথ্যে ও আইনগত প্রশ্নে অবলীলায় ঢুকে যেতে পারতেন। আলঙ্কারিক ইংরেজি ভাষা শোনার আকর্ষণে তার আদালতকৰে ভিড় লেগে থাকত। তার রায়গুলো ছিল এক-একটা বোমা বিস্ফোরণের মতো। আইয়ুবী শাসনামলে জনগণের অধিকার, জনকল্যাণ ও জনস্বার্থের প্রতিষ্ঠায় তিনি তার রায়গুলোকে একরকম জেহাদি মনোভাব নিয়েই প্রয়োগ করেছিলেন। সরকার বা সরকারিপৰের কোনো বাড়াবাড়ি, অন্যায় ও অবৈধ ৰমতাপ্রয়োগ তার রোমদৃষ্টির বাইরে পড়েনি।
স্বাভাবিকভাবে সে সময়কার স্বৈরাচারী পরিবেশে বিচারপতি মোরশেদ আদালতকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন জনগণের আশা-ভরসার শেষ মাধ্যম হিসেবে। তার অনেক রায় সুপ্রিম কোর্টে নাকচ হয়েছে, কিন্তু তাতে তিনি শেষ বিচারে পরাজিত- এ কথা বলা চলে না। অথচ বিচারকার্যে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন কতকগুলো মহৎ দান। কৌঁসুলিদের উপস্থাপনা উন্নত মানের না হলে উন্নত মানের রায় আশা করা যায় না। বিচারপতি মোরশেদের যুগানৱকারী রায়গুলোতে তদানীনৱন পাকিসৱানের প্রখ্যাত কৌঁসুলিদের উলেস্নখযোগ্য অবদানের কথা স্বীকার করলেও নির্দ্বিধায় এ কথা বলা চলে যে, শেষ পর্যনৱ বিচারপতি মোরশেদের রায়ে যেটা স্বচ্ছন্দভাবে ফুটে উঠেছে তা হলো- তার নিজের ব্যক্তিত্ব। বিচারপতি মোরশেদ কৌঁসুলিদের মনৱব্য ধারণ করেছেন, তাদের উপস্থিত নজির ও যুক্তিতর্ক পর্যালোচনা করেছেন, কিন্তু সর্বোপরি তার রায়ে ফুটে উঠেছে তারই নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, তার জীবন-দর্শন, তার নিজস্ব বিশেস্নষণ ও তার সংগৃহীত নজির। গতানুগতিকতার সোজা পথ দিয়ে না হেঁটে তিনি সৃষ্টি করে নিতেন নিজের পথ, নিজের পাথেয়। এ জন্যই তার রায়গুলো স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল, তার নিজস্ব বিদগ্ধতায় সমৃদ্ধ।
বিচারপতি মোরশেদের রায়ের এই স্বকীয়তা একটা আকস্মিকতা নয়, দীর্ঘকালের সযত্নলালিত প্রচুর অধ্যয়ন ও পরিশ্রমের ফলে এই স্বকীয়তা। যেকোনো পেশায় বা বৃত্তিতে শুধু পেশাগত বা বৃক্তিগত দৰতা অর্জন করলে এই স্বকীয়তা আসে না। পেশা-অনৱপ্রাণ শেষ পর্যনৱ পেশার গুণের সাথে কিছু অলঙ্ঘনীয় ত্রম্নটির এক বিচিত্র সমাবেশ। কৌঁসুলিদের যুক্তিতর্ক একেবারেই শুনতেন না তা বলা যায় না, তবে যতটুকু শোনা উচিত তার চেয়ে হয়তো কম শুনতেন। যে পৰের যুক্তিতর্ক তিনি গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না, সে পৰের উদ্দেশ্যে তার শাণিত প্রশ্ন, মনৱব্য ও বাক্যবাণ প্রায়ই ছিল বড় কঠিন। হয়তো আবেগপ্রবণতা, উচ্ছ্বাস ও সহানুভূতি বা তার অভাব তার বিচারবুদ্ধিকে কোনো কোনো সময় আচ্ছন্ন করে ফেলত। আমরা এই দোষ-গুণে মণ্ডিত উদার হৃদয়, মহৎপ্রাণ বিচারপতিকে সবার অলৰে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
একজন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকের মতো বিচারপতি মোরশেদের বিচারপতি অনৱরেও একটি কান্না ছিল, একটি জ্বালা ছিল, একটি অস্থিরতা ছিল। যাদের কান আছে তারা এই কান্না শুনতে পাবেন তার রায়ে, যাদের অনুভূতি আছে তারা এই জ্বালার প্রখরতায় দগ্ধ হবেন। বিচারকের রায় তার বিচারকর্মের চূড়ানৱ প্রকাশ। বিচারপতি মোরশেদের রায়গুলো এই চূড়ানৱ প্রকাশে শিল্পকর্মের মতো। শব্দবিন্যাস, ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিশীলতায়; বিচার-বিশেস্নষণের নিপুণতা, মতপ্রকাশের স্পষ্টতা ও বলিষ্ঠতায় তার বহিরঙ্গ যেমন অনবদ্য ও অসাধারণ; তেমনি জীবনদর্শনের গভীরতা, সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, মানবাধিকারের প্রতি আনুগত্য ও বঞ্চিতের প্রতি সমবেদনায় তার অনৱর তেমনি নিটোল ও ভরপুর।
যেকোনো বিচারকের রায়ে বিবদমান পৰের কৌঁসুলিদের যুক্তিতর্ক একটি গুরম্নত্বপূর্ণ উপধারাই হয়। পেশার বাইরে যার জ্ঞান সীমিত; জীবন, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে প্রায় অনভিজ্ঞ ও অজ্ঞাত, তার জীবনবোধের ভেতর পরিপক্বতা বা ব্যাপ্তি আশা করা চলে না। বিচারপতি মোরশেদ নিছক আইনশাস্ত্র অনুশীলন করে আইনের টেকনোক্র্যাট হননি। তার জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার পরিধি ছিল বহুধাবিস্তৃত। একাধারে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইংরেজি সাহিত্য ইত্যাদি অধ্যয়ন করা ছাড়াও তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। ফারসি, আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষার বিস্তৃত জ্ঞান ও অধ্যয়ন ছিল তার বিশিষ্ট গুণাবলির একটি। তার নিজস্ব গ্রন্থাগারে বহু দুর্লভ গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির সমাহার রয়েছে। এই বিস্তৃত ও ব্যাপক অধ্যয়নের ফলে তার মনোজগৎও সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনি আইনকে ইতিহাসের মাপকাঠিতে, দর্শনের তুলনামূলক বিচারে ওজন করে নিতে পারতেন। আইন তার কাছে নিছক কতকগুলো বিধিব্যবস্থা ছিল না। আইনের পেছনে যে ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, দর্শন ও কার্যকারিতা সক্রিয়, তিনি তার মূলে সহজে ও অবাধে বিচরণ করতে পারতেন। যদিও দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আইনের ৰেত্রে তার একটি সহজাত বিচরণ ছিল, তবু যেন শাসনতান্ত্রিক আইনের ৰেত্রে তার গতায়াত আরো স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল বলে মনে হয়। এই আইনের সুনিপুণ ব্যাখ্যায় ও প্রয়োগে পাকিসৱানে তার জুড়ি কেউ ছিলেন না। সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশে শাসনতান্ত্রিক আইনের এমন নিপুণ কলাকার দুর্লভ।
লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন