মাহমুদুর রহমান মান্না
দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। কিছুদিন ধরেই_ আমি নিকট অতীতের কথা বলছি, রাজনীতি সংঘাতের মুখোমুখি। চ্যালেঞ্জ-পাল্টা চ্যালেঞ্জ ধ্বনিত হচ্ছিল সভা-সমাবেশের ভাষণে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সংবাদের সূত্রে দেশবাসী সব খবরই জানতে পারছে এবং এ উদ্বেগ তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের চরম প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না।
বিএনপি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আন্দোলনের চাপে তারা এটা মেনে নেয়। বর্তমান মহাজোট সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সূত্র ধরে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে এ পদ্ধতি বাতিল করে দিলে বিএনপি বিষয়টিকে মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে তারা জনসমাবেশ ও রোডমার্চের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঢাকা থেকে তারা কয়েকটি এলাকায় গিয়ে সমাবেশ করে এবং এতে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়। জানুয়ারির প্রথম দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। আমাদের জানা আছে, এ সমাবেশ আয়োজনের পথে নানা ধরনের বিঘ্ন ঘটে এবং এ জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকেই পুরোপুরি দায়ী করা হতে থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকাজুড়ে একটি বড় ধরনের সমাবেশ অনুষ্ঠানে তারা সফল হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালের জন্য সরকারকে তিন মাসের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। অন্যথায় ১২ জুন ঢাকায় আরেকটি বড় ধরনের সমাবেশের মাধ্যমে নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল নয়, বরং মহাজোট সরকারের পতন ঘটানো_ এ ধারণাও বিএনপির নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রকাশ পেতে থাকে। খালেদা জিয়া সরকারকে 'ল্যাংড়া-নুলা' করে ঘরে পাঠিয়ে দেবেন, জনসমাবেশে এমন মন্তব্যও করেছেন। কর্মী-সমর্থকদের কাছে এ ধরনের কথা বিপুল আনন্দ-উল্লাসের কারণ হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বুঝতে পর্যবেক্ষকদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এসব ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমশ উত্তাপ বৃদ্ধির ব্যারোমিটার।
বিএনপির দিক থেকে এ ধরনের উত্তাপ ছড়ানো বক্তব্য আসতে থাকলেও দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কিন্তু তার রাজনৈতিক জবাব প্রদানের চেষ্টা করেননি। বরং তাদের কোনো কোনো নেতা একইভাবে দম্ভ প্রকাশ করতে থাকেন বিভিন্ন সমাবেশে। তারা চিরাচরিত মেজাজে বলেন, আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বিএনপি এবং তার মিত্ররা রাজপথে নামলে তারাও সেখানেই পাল্টা শক্তির প্রকাশ ঘটাবেন। ১২ মার্চের সমাবেশের পাল্টা হিসেবে ১৪ মার্চের সমাবেশকে অনেকে এ ধরনের কর্মসূচি হিসেবেই দেখে থাকেন। তবে অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেও অনেকের আশা ছিল, 'তিন মাসের আলটিমেটামের মধ্যে' সংলাপ বা এ জাতীয় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। পরিস্থিতির যদি প্রকৃতই বড় ধরনের অবনতি ঘটে, সেটা প্রকাশ পাবে ১১ জুনের পরে।
কিন্তু ইতিমধ্যেই সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঘটে গেল সাবেক সংসদ সদস্য এবং সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' রহস্য, যা রাজনীতির জন্য সবচেয়ে উদ্বেগ ও অস্বস্তির ঘটনা। ইংরেজিতে বলতে পারি ডিস্টার্বিং। এ ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ঘটনা কে বা কারা ঘটিয়েছে সেটার তদন্ত তো দূরের কথা, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখেছে বলেও প্রতীয়মান হয় না। জনগণের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের আচরণ এবং ঘটনা পরম্পরায় তাদের দিকে সন্দেহের আঙুল উঁচু করেছে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠন জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে অন্তত ১০০ লোক গুম হয়েছে। এর মধ্যে রাজনীতির লোক আছে, বাইরের লোক আছে। সন্ত্রাসীও আছে। এসব ঘটনা কারা ঘটিয়েছে এবং কেন ঘটিয়েছে সে বিষয়ে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সরকার প্রস্তুত করেছে এবং প্রতিকারের কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে_ সে বিষয়ে সরকার কিছুই জানায়নি। আমাদের এটাও জানা আছে যে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির করুণ ও নিষ্ঠুর মৃত্যুর আড়াই মাস পরও এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে একজনকেও চিহ্নিত করা হয়নি, আটক তো দূরের কথা। ভাবতে অবাক লাগে, যে ঘটনা সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে সেই ঘটনার শিকার দু'জন সুপরিচিত সাংবাদিকের ভিসেরা টেস্ট করা হয়নি! এটা কীভাবে সম্ভব?
একইভাবে বিস্মিত হতে হয় ইলিয়াস আলীর 'নিখোঁজ' হওয়ার পরের রাতে তার নিজের এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় তার বিরুদ্ধে ১১ বছরের একটি পুরনো মামলা নতুন করে গ্রহণ করার ঘটনায়। কেন দেশে এমন সব ঘটনা ঘটছে এবং কারা ঘটাচ্ছে তার প্রমাণ থাকুক বা না থাকুক, জনগণ এ জন্য সরকারের প্রতিই কিন্তু আঙুল তুলবে। ইলিয়াস আলীকে ফিরে পেতে বিএনপি ইতিমধ্যে টানা তিনদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে। কোথাও কোথাও হরতালের সহিংসতা ঘটেছে। প্রথমদিকে বিএনপি কর্মীরা মিছিল-সমাবেশ-পিকেটিং করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা পথে নামতেও ভয় পেয়েছে। কিন্তু এ হরতালের এক পর্যায়ে দেখা গেছে রাজপথে তাদের উপস্থিতি বেড়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'সাহসী হয়ে' ভাংচুর-অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ পিকেটার ও মিছিলকারীদের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। আবার তাদের নিশ্চুপ থাকা বা ভাংচুরকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার কথাও শোনা গেছে। ক্ষমতাসীন কর্মীদের বাড়াবাড়ির ঘটনাও সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এসেছে। তারা রাখঢাক না করেই প্রতিপক্ষের প্রতি মারমুখী আচরণ করছে।
এ প্রেক্ষাপটেই এসেছে চারদিনের আলটিমেটাম, যা শেষ হবে শনিবার। এ সময়ের মধ্যে অবশ্যই সরকারকে ইলিয়াস আলীকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় সরকার পতনের জন্য আরও কঠোর কর্মসূচি প্রদান করা হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ইলিয়াস আলীকে ফিরে না পেলে কাল রোববার থেকে গ্রামবাংলার সবুজ প্রান্তরে যে আন্দোলনের আগুন জ্বলবে তা নেভানোর ক্ষমতা বর্তমান মহাজোট সরকারের নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন নবগঠিত ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো বুধবার এক সভায় মিলিত হয়ে লাগাতার হরতাল প্রদানের কর্মসূচি দিতে খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রচার হয়ে গেছে, রোববার ও সোমবার টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতাল দেওয়া হবে। মনে রাখা চাই, এর আগের দু'দিন সরকারি ছুটি এবং মঙ্গলবার মে দিবসের ছুটি।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সংকট যে ঘনীভূত হয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও সর্বত্র। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত করা এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। বিএনপির তরফে আন্দোলন সর্বাত্মক করার হুমকি রয়েছে। আওয়ামী লীগও আন্দোলনের ভয়ে ভীত নয় বলে হুমকি দিয়ে চলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আরও কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, বিরোধীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে। আওয়ামী লীগ কর্মীরাও যে রাজপথে মোকাবেলায় নেমে পড়বে, এমন হুশিয়ারিও শোনা যাচ্ছে।
এসব কথা লিখছি ২৬ এপ্রিল দুপুরে। ২৯ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত দেশে ইতিবাচক কিছু ঘটবে, এমন সম্ভাবনা দেখছি না। এটাও লক্ষণীয়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গিয়েছিল মহাজোটের ব্যানারে। সরকার গঠনেও শরিক দলগুলোর কেউ কেউ ঠাঁই পায়। কিন্তু এখন রাজনৈতিক মোকাবেলার সময়ে শরিকরা কেউ সঙ্গে নেই। তাদের কেউ কেউ পরিস্থিতির অবনতির জন্য সরকারকে দায়ী করছে। এইচএম এরশাদ অনেক আগেই অন্য পথ ধরেছেন। মাঠে আওয়ামী লীগ একা এবং প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি তাদের জোট বড় করেছে। কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হচ্ছে সেটাও দল কিংবা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়।
রাজনীতি যে একটি সংঘর্ষের সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিণতি কী হবে সেটাও দৃশ্যমান নয়। ধরেই নেওয়া যেতে পারে যে আমরা যা চাই না, ভাবি না, পছন্দ করি না_ সে রকম একটা কিছু ঘটে যাবে। এসব নিয়ে উদ্বেগ যথেষ্ট এবং তা সর্বমহলে। আরও উদ্বেগের বিষয় যে, এ সুড়ঙ্গ থেকে আলোর পথে উত্তরণের কোনো আন্তরিক চেষ্টা লক্ষণীয় নয়। পর্দার অন্তরালে অনেক কিছু ঘটে। সেটা ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে সবাইকে চমকে দিয়ে ভালো কিছু ঘটবে, এমন ভরসা কে দেবে? বিএনপির স্পষ্ট ঘোষণা, ইলিয়াস আলীকে না পেলে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। তারা বলবে, এমন অবকাশও নেই। এরপরে তো রয়েছে মূল ইস্যু_ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের তিন মাসের আলটিমেটাম, যার অর্ধেক সময় ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। সংঘাত ছেড়ে সংলাপের পথে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে নিয়ে আসার কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসবে কি? কেউ কি বরফ গলাতে সক্রিয় হবে?
মাহমুদুর রহমান মান্না :রাজনীতিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন