বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১২

স্বাধীনতার শত্রু কারা?




॥ এরশাদ মজুমদার ॥

ক’দিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, একুশের চেতনাবিরোধীরা স্বাধীনতার শত্রু। একই দিন তিনি আবার বলেছেন, চার নীতি বিরোধীরা স্বাধীনতার শত্রু। আবার কেউ কেউ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা স্বাধীনতার শত্রু। সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য সন-ান সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘রাজনীতিকদের সব কথা সিরিয়াসলি নেবেন না। রাজনীতিকেরা নানা কারণে নানা কথা বলেন।’ ওসব নাকি কথা নয়, কথার কথা। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলে থাকেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি নাকি পাকিস-ানিদের গোয়েন্দা ছিলেন। আরেক আওয়ামী নেতা বলেছেন, কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। বুঝতে পারছি না, কার কথা বিশ্বাস করব আর কার কথা বিশ্বাস করব না। এমনিতেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে নানা কথা চলছে। আমরা জানি , ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে। শামসুল হক ছিলেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও খোন্দকার মোশতাক ছিলেন নতুন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। কিন' ইদানীং এমন লোকের দেখাও পাই যিনি বা যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু কখনো মুসলিম লীগ করেননি। তিনি পাকিস-ান আন্দোলন করেননি। বলা হয়, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। এই শ্রেণীর লোকেরা বলেন, ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করতে হবে। এঁদের ভাবটা যেন এমন বঙ্গবন্ধু কোনো দিনও মুসলিম লীগার বা পাকিস-ানি ছিলেন না। তিনি জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগার এবং বাংলাদেশী। তিনি যে একদিন জিন্নাহ টুপি পরেছেন এবং পাকিস-ান জিন্দাবাদ বলেছেন, এ তথ্য মানতে রাজি নন তারা। তার অতি উৎসাহী ভক্তরা। এসব কারণেই জাতির জীবনে নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। পৃথিবীতে বহু জাতি আছে যাদের ভাষা একই। কিন' তারা এক জাতি নন। আরব বিশ্বে বহু জাতি আছে যাদের ভাষা আরবি। তবুও তারা এক জাতি নন। পৃথিবীর বহু জাতি ইংরেজিতে কথা বলে, কিন' তারা সবাই ইংরেজ নন এবং এক জাতিও নন। যেমন বাংলাদেশের মানুষ আর পশ্চিম বাংলার মানুষ এক জাতি নন। অথচ এই দুই দেশের মানুষের ভাষা একই। শুধু ভাষার কারণে আমরা একটা জাতিতে পরিণত হইনি। যদি তাই হতো তাহলে বঙ্গদেশ একটি দেশ থাকত বা ভারতের সাথেই থাকত; ’৪৭ সালে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস-ানের সাথে যোগ দিত না। এ কথা আজ মহাসত্য যে, আমরা বাঙালি মুসলমান বলেই একটি আলাদা স্বাধীন দেশ গঠন করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের কাছে বাঙালিত্ব আর মুসলমানিত্ব কোনোভাবেই আলাদা নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উপাদান শুধু বাঙালিত্ব নয়। শুধু ভাষাও নয়। এক হাজার বছরেরও বেশি আগে থেকে এই ভৌগোলিক এলাকায় মুসলমানদের বসতি। শত শত পীর-ফকির ও ধর্মগুরু এ দেশে ইসলাম প্রচার করেছেন এবং নির্যাতিত, লাঞ্ছিত অধিবাসীদের মুক্তির পথ দেখিয়ে মুসলমান করেছেন। হয়তো মুসলমান হওয়ার আগে তারা নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিলেন। সমাজে তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না। আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক কারণে তাদের ভাষা বাংলা। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সাথে সাথে সমাজে তাদের নতুন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী বর্ণ প্রথা থেকে তারা মুক্তি লাভ করেছেন। তাই আমাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, তিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের নেতা। বিষয়টা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়তো বিস-ারিত ভাবেননি, নতুবা তাকে কেউ এ বিষয়ে ভুল বুঝিয়েছেন। অথবা কেউ প্রধানমন্ত্রীর সারল্যের সুযোগ নিয়েছে। যারা মনে করেন, আমরা একটি ভাষাভিত্তিক জাতি তারা হয়তো বিভ্রানি-তে আছেন, নয়তো কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ভারতীয় বাঙালিদের রাষ্ট্রভাষা এখন হিন্দি। তাদের জাতীয়তা বাঙালি নয়, ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান। ভাষার ব্যাপারে বাংলাদেশ কখনোই ভারতীয় বাঙালিদের মুখাপেক্ষী নয়।
সম্প্রতি ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার, শুদ্ধ বানান নিয়ে আদালতের নির্দেশে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার প্রতি দেশের মানুষের কোনো সমর্থন নেই। এই কমিটির সদস্যরা একটি রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। এই কমিটির ধ্যানধারণার সাথে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের চিন-াচেতনার কোনো মিল নেই। তারা মনে করেন বাংলা ভাষার রাজধানী এখনো কলকাতা এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য কলকাতা যেতে হবে। ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র নামে তারা এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের চিন-াচেতনার বিরুদ্ধে অবস'ান নিয়ে থাকেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী হয়তো মনে করেন, ৯০ ভাগ মানুষের চিন-াচেতনার বিরুদ্ধে অবস'ান করাটাই হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সেটাই একুশের চেতনা। তাহলে বলতে হয়, তিনি সঠিক পথে চলছেন না। আমাদের কাছে একুশের চেতনা মানে বাংলাদেশের মানুষের চেতনা; যে চেতনায় তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন; যে চেতনায় তারা লালিত ও বিকশিত হয়েছেন; যে চেতনার কারণে মুসলমান হয়েও এ দেশের মানুষ পাকিস-ানের সাথে থাকেনি। বরং নিজের জাতিসত্তাকে রক্ষা করার জন্য পাকিস-ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে বেদ, উপনিষদ ও গীতার উপাদান নিয়ে। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাধনার মূল উপাদান ছিল বেদ, উপনিষদ ও গীতা। আর আমাদের বাংলা ওই সব উপাদান থেকে মুক্ত। আমরা তো বলেই থাকি, একুশ মানে মাথা না নোয়ানো। একুশ মানে ভাষার মর্যাদার জন্য লড়াই করা। যদি এসব কথা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কেমন করে পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষার কাছে মাথা নোয়াতে পারি? না, পারি না। আমরা আমাদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। আমরা বাঙালি মুসলমান হিসেবে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, যা পশ্চিম বাংলার মানুষ করতে সাহস করেনি। তাই তারা দিল্লির অধীনেই রয়ে গেছে।

সংবিধানের চার মূলনীতি, যা বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই নির্ধারিত হয়েছিল, তা এখন কাগজে-কলমে আছে। আমাদের জীবনচর্চায় নেই। সমাজতন্ত্র একটি অর্থনৈতিক চিন-াধারা, যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি নিয়ে এসেছিল। তা এখন কাগজে এবং বইতে স'ান নিয়েছে। খোদ রাশিয়া বা চীন এই অর্থনৈতিক ব্যবস'াকে আর অনুসরণ করছে না। সমাজতন্ত্র এখন বহু দেশ থেকেই বিদায় নিয়েছে। এর পরিবর্তে এখন উদার অর্থনীতি, মিশ্র অর্থনীতি বা কল্যাণধর্মী ধনতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস'ার কথা বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিজেও তার রাজনৈতিক চিন-াধারার পরিবর্তন করেছে। মিশ্র অর্থনীতির ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর আমলেই শুরু হয়েছিল। পরে বিশ্ব-অর্থনীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশও তার পথ পরিবর্তন করে কল্যাণমুখী অর্থনীতির দিকে পা বাড়িয়েছে। কিন' কোনো সরকারই বাংলাদেশে কল্যাণমুখী অর্থনীতি চালু করতে পারেনি। বরং সব সরকারই শোষণমুখী, গণবিরোধী অর্থনীতি চালু করেছে। ফলে খুবই উলঙ্গভাবে এখানে ধনের বিকাশ ঘটেছে। একশ্রেণীর ধনী এখন সমাজ ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। রাজনৈতিক দলগুলো ধনীদের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশে এখন যে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা খুবই বুড়িয়ে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে, চোখে দেখে না। এক সময় সমাজপতিরা এই গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। এক নাগাড়ে কয়েক শ’ বছর ব্যবহারের ফলে এই গণতন্ত্র এখন মানুষের কল্যাণে কিছুই করতে পারছে না। ২০০৮ সালের নির্বাচন এর ন্যক্কারজনক নমুনা। ‘১/১১’-এর সরকার জাতিকে দেখিয়ে গেছে, নিরপেক্ষ নির্বাচন কাকে বলে। বুড়ো গণতন্ত্র নিয়ে এখন ব্রিটেন-আমেরিকাতেও নানা কথা। সত্যিকারের গণতন্ত্র এখন জগতের কোথাও নেই। থাকলে মানুষের এত কষ্ট হতো না। তথাকথিত এই গণতন্ত্রের সাথে শোষণের একটা বিরাট সম্পর্ক রয়েছে। তাই বিশ্বব্যাপী ‘অকুপাই’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। গণতন্ত্রের নেতারা জনগণকে লাঠিপেটা করে গণতন্ত্র আর ধনবাদকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড আন্দোলন জেনারেল মইনকে দেশের ক্ষমতা দখল করে নিতে সহযোগিতা করেছে। এই জেনারেল সাবেক আমলা ফখরুদ্দীন আহমদকে তথাকথিত কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হিসেবে চাকরি দিয়েছিল। নির্বাচনের আগে জেনারেল মইনের সরকার নানা ধরনের মাদারীর খেল দেখিয়েছে। কিন' নির্বাচনের পর বোঝা গেল- কেন তারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তথাকথিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করেছে। বিএনপির ১১ বছরের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে দিয়ে নতুন বিএনপি গঠনের চেষ্টা করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ১/১১-এর সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। ক্ষমতায় গেলে তারা ওই (বেআইনি) সরকারের সব কার্যকলাপকে বৈধতা দেবেন। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার মর্মানি-ক ঘটনার বিচার না হওয়ায় দেশবাসী তখনি বুঝতে পেরেছে জেনারেল মইন কেন ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখলের ফলে ২৮ অক্টোবরের সেই মর্মানি-ক ঘটনার বিচার হয়নি। ওই ঘটনার ছবি যখন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখেছে তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ধিক্কার দিয়েছে। ওই ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে ইনু মিনুরা এখনো নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করেন।

ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম আরেকটি চিন্তাধারা, যা এসেছে পশ্চিমের অবক্ষয়ী সমাজব্যবস'া থেকে। আমি এর আগেও বারবার বলেছি ধর্মনিরপেক্ষতা একটি স্লোগান যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান- করে। বহু দেশে এখনো এই স্লোগানটি জারি আছে। সত্যি কথা বলতে কি, চলমান বিশ্বে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে কিছু নেই। আছে শুধু একটি স্লোগান, যা আমাদের দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, কলামিস্টদের বিভ্রান- করেছে। সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন, ব্রিটেন একটি খ্রিষ্টান দেশ। এ দেশের অধিবাসীরা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাস করে। ব্রিটেনের রাজপরিবার প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রচারক। এ দেশে প্রধানমন্ত্রীকেও রাজধর্মে বিশ্বাস করতে হয়। ব্লেয়ার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ক্যাথলিক বিশ্বাস ত্যাগ করে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এখন তিনি আবার ক্যাথলিক ধর্মে ফিরে গেছেন। আমেরিকার ওবামা এক সময় মুসলমান ছিলেন। মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। নামের সাথে হুসেন রেখেছিলেন। তার আত্মীয়স্বজন অনেকেই এখনো মুসলমান। তিনি শুধু রাজনীতির স্বার্থে মুসলমানিত্ব ত্যাগ করেছেন। তাতেও রেহাই পাচ্ছেন না। তাকে বারবার জবাবদিহি করতে হচ্ছে তার ধর্ম নিয়ে। তাকে ঘোষণা দিতে হচ্ছে। তিনি আর মুসলমান নেই। কারণ আমেরিকা একটি খ্রিষ্ট দেশ। সে দেশে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হতে হলে অবশ্যই খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলাদেশও একটি মুসলিম দেশ। এখানকার ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। ইসলাম এখানে রাষ্ট্রধর্ম। এ দেশে অন্য ধর্মের মানুষও শানি-তে বাস করে শত শত বছর ধরে। ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার ভারতে বছরে শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। ভারতে মোদির মতো মনুষ্যত্বহীন মানুষ রাজনীতি করে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এমন ভারতের আদর্শ নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশেও একশ্রেণীর রাজনীতিক ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পরে রাজনীতি করে থাকেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ান করলেও নিয়মিত নামাজ-রোজা ও ধর্মকর্ম করেন। সত্যি কথা হলো, সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা জগতের একটা ভণ্ডামি। সেই ভণ্ডামি আমাদের দেশে এসে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তিনটি নববর্ষ পালন করে। প্রথমটি পয়লা বৈশাখ, দ্বিতীয়টি ইংরেজী নববর্ষ এবং তৃতীয়টি পয়লা মহররম। মুসলমান হওয়ার কারণে আমরা পয়লা মহররম পালন করি। ইংরেজদের অধীনে থাকার কারণে পয়লা জানুয়ারি এবং বাংলার নিজস্ব পঞ্জি অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ পালন করি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। আল-কুরআন পড়ার জন্য আমাদের আরবি জানতে হয়, একইভাবে হিন্দুদের সংস্কৃত জানতে হয় গীতা পাঠ করার জন্য। আমরা একসাথে পয়লা বৈশাখ পালন করি, পূজা ও ঈদ পালন করি আলাদাভাবে। এটাই আমাদের সংস্কৃতি ও সহাবস'ানের নীতি। তবে এ কথা কখনোই ভুললে চলবে না, আমরা মুসলমান বলেই আজ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমরা প্রথমে পাকিস-ানের সাথে থাকলেও শেষ পর্যন- একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। মুসলমান না হলে আমাদের আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান।

আমাদের নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স'পতি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলতে চাই ‘আমি একজন বাঙালি মুসলমান’। এ ছাড়া আমার আর কোনো পরিচয় নেই, কোনো অসি-ত্ব নেই। মুসলমানিত্ব বাদ দিলে আমার অসি-ত্ব ও স্বাধীনতা আর থাকে না। বাংলাদেশের হিন্দুদের আলাদা স্বাধীন কোনো দেশের প্রয়োজন ছিল না। যেমন পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা ভারতের অধীনে সুখে শানি-তে আছেন। এ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য স্বাধীনতা বা আলাদা সত্তা অপরিহার্য ছিল। তাই তারা মুসলমান হয়েও পাকিস-ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। ’৪৭ সালেই নিখিল বঙ্গদেশ স্বাধীন হওয়া উচিত ছিল। কিন' হয়নি কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার কারণে। তখন বাঙালিয়ানা বা বাঙালিত্ব কাজ করেনি। কাজ করেছে হিন্দুত্ব। নেহরুজী ও গান্ধীজী বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা যদি অখণ্ড ও স্বাধীন থাকে তাহলে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও জাতিতে পরিণত হবে। নেহরুজী তা কখনোই চাননি। একইভাবে তিনি পাঞ্জাবকে বিভক্ত করেছেন। এক সময় বলা হতো, হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, রেস্ট অব ইন্ডিয়া থিংক টুমরো। বিদ্যা-বুদ্ধিতে বাংলা ছিল সবার আগে। কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রে সেই বাংলাকে ভাগ হতে হলো। এক সময় পাঞ্জাব ছিল ভারতের শস্যভাণ্ডার। আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। পাঞ্জাব এক থাকলে হয়তো দিল্লি তার সাথে পেরে উঠত না। তাই ভারত এখন নানা দিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশকে নিজের প্রভাবের বলয়ে রাখার জন্য দিনরাত নানা ধরনের খেলা খেলে যাচ্ছে। বুঝে হোক না বুঝে হোক দিল্লির সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন বাংলাদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী। 
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে ভারতের নানামুখী আগ্রাসন। অর্থনৈতিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সীমান- আগ্রাসন, পানি আগ্রাসনের মুখে পড়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। স্বাধীনতার চেতনা, একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই সব ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের মানুষকে এসব চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি এগিয়ে যান তাহলে আমরা সবাই তার সাথে আছি। আজ আমাদের প্রধানতম চেতনা হচ্ছে, প্রিয় বাংলাদেশকে ভারতের সব ধরনের শোষণ থেকে রক্ষা করা। এই শোষণবিরোধী লড়াই বা যুদ্ধই হচ্ছে নয়া মুক্তিযুদ্ধের অভিযান। এই অভিযানের বিরুদ্ধে যারা অবস'ান নেবেন, তারা হবেন স্বাধীনতাবিরোধী, একুশের চেতনাবিরোধী ও দেশের উন্নয়নবিরোধী শক্তি। 
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন