রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

কিনার নাইরে'



শাহদীন মালিক
সব মিলিয়ে আমরা অশান্তিতে আছি। এর বেশিরভাগ দায় সরকারি দলের। তবে লাগাতার হরতাল করে বিরোধী দল যথার্থ প্রতিবাদ করছে কিন্তু তা আমাদের অশান্তি কমাচ্ছে না। আমাদের অশান্তি ও দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে বড় দুই দল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবিলম্বে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে এই দুই রাজনৈতিক দল থেকে এই দেশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নতুন দল খুঁজবে


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল সমুদ্রজয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সবাই আনন্দিত ও উৎফুল্ল। এর সঙ্গে আমরা আশা করব, শুধু ভারতের বিরুদ্ধে আরও সমুদ্রজয় হবে না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্রমান্বয়ে ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরও বাংলাদেশের জন্য জয় করবেন। আপাতত যে সমুদ্রজয় হয়েছে সেই সমুদ্র থেকে অবশ্যই সম্পদ আহরণ হবে। গ্যাস, তেল আরও অন্যান্য খনিজসম্পদের জন্য বহু বড় বড় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কোটি কোটি টাকার চুক্তি সম্পাদন হবে। এই বিশাল সমুদ্রজয়ের পর সমুদ্রের সম্পদ আহরণের জন্য বড় বড় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এই চুক্তিগুলো খোলামেলা হওয়া উচিত। দেশের সব খনিজসম্পদের মালিক জনগণ। অর্থাৎ আমি, আপনি, দেশের নাগরিক আমরা সবাই এই সম্পদের মালিক। আমাদের সম্পত্তি নিয়ে, আমাদের পক্ষ হয়ে সরকার কার সঙ্গে কী চুক্তি করছে সেটা জানার অধিকার আমাদের সবার আছে। আমাকে না জানিয়ে আমার সম্পত্তির ব্যাপারে অন্যের সঙ্গে চুক্তি করা যায় না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তেল-গ্যাস সংক্রান্ত চুক্তিতে বহু বছর ধরেই বিশাল বিশাল দুর্নীতি হয়েছে। সেই দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ নতুন কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশে এই চুক্তিগুলো প্রকাশ করা সংক্রান্ত আইনও হয়েছে। আমাদেরও প্রথমত সেই আইন হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, আইন না হলেও কোনো বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে তেল-গ্যাস নিয়ে এখন যে নতুন নতুন চুক্তি হবে তা আমাদের না জানিয়ে করা যাবে না। করলে আমরা ধরে নেব সমুদ্রজয়ের ফল শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার আশপাশের প্রিয়জনেরাই ভোগ করবেন। তখন তা হবে কেবল প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্রজয়, দেশের সমুদ্রজয় নয়। উপরের এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, ইদানীং স্থলভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন অত্যন্ত নড়বড়ে হয়ে গেছে। ক্রমাগত একের পর এক ঘটনা ও দুর্ঘটনায় একদিকে যেমন সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়ছে, অন্যদিকে জনগণেরও অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা বাড়ছে।
আমরা সবাই খুব অশান্তিতে আছি। প্রথমত, কতগুলো লোমহর্ষক অপরাধের কোনো সুরাহা না হওয়া; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদে থাকা বা পদে না থাকার ব্যাপারে খুব সাদামাটা আইনি ব্যাপারগুলোকে সাংঘাতিক ঘোলাটে করে ফেলা; তৃতীয়ত, হাতেনাতে ধরা দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে টালবাহানা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আইনের বাইরে এবং জবাবদিহিতার লেশমাত্র না থাকা। সব মিলিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও অশান্তির প্রেক্ষাপটে সমুদ্র বিজয়ের উৎসব সেটা যত ঘটা করে হোক না কেন তা আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে না। চলমান উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সোহেল তাজের পদে থাকা না থাকা এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে ঘোলা জল সরকারের আইন ও সুশাসন বিষয়ে চরম খামখেয়ালিপনা ও অদক্ষতার পরিচায়ক।
স্পষ্টত সোহেল তাজ তার প্রতিমন্ত্রী পদেও থাকতে চাননি, এখন সংসদ সদস্য পদেও থাকতে চান না। যে পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে চায় তাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত মধ্যযুগীয়, সামন্তবাদী চিন্তার নোংরা বহিঃপ্রকাশ। উনিশ শতকে জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার বহু এলাকা থেকে হাজার হাজার প্রজা ভেগে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল। এই ভেগে যাওয়া প্রজাদের নতুন বসতি স্থাপন প্রক্রিয়াই পদ্মার দক্ষিণে বর্তমানে দক্ষিণ বাংলাদেশে বসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু জমিদাররা প্রজাদের চলে যাওয়ায় সবসময় বাধা দিত। পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা বা গ্রহণ করতে টালবাহানা, এ সংক্রান্ত উদ্ভট আইনি প্রশ্নের অবতারণ ইত্যাদি সবই সহকর্মীদের আজ্ঞাবহ অধীন হিসেবে গণ্য করার চিন্তাচেতনা বলে কেউ যদি মনে করে, তাহলে তার সঙ্গে তর্ক করা কঠিন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের উচিত ছিল আইনি অবস্থান প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরা এবং বলা যে, যেহেতু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল সেহেতু তাকে মন্ত্রীর পদে রাখতে হলে পুনরায় শপথবাক্য পাঠ করানো আইনসিদ্ধ হতো। আর জনগণ তার করের টাকায় কোনো কাজ না করা, দায়দায়িত্ব পালন না করা ব্যক্তিকে মন্ত্রীর সব সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা দেবে কি-না সেটা জনগণের কাছ থেকে জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, দফতরবিহীন মন্ত্রীর সব খরচ জনগণকেই বহন করতে হবে। আমাদের ধারণা, আমরা যেহেতু কোনো কাজ না করে বেতন-ভাতা পাই না সেহেতু আমরাও যিনি কোনো কাজ করবেন না অর্থাৎ দফতরবিহীন মন্ত্রীর বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার খরচ এবং গাড়ির জন্য খরচ দিতে প্রস্তুত নই।
পদত্যাগের এ ব্যাপারগুলো থেকে জনগণের এই ধারণা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে যে, সরকার বা সরকারপ্রধান আইনের কোনো ব্যাপারেই তোয়াক্কা করে না। এখানে তার ইচ্ছা যেটাকে তার কঠিন সমালোচকরা বলেন জেদ ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশই মুখ্য, আইন-সংবিধান এখানে গৌণ।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল সমুদ্র তো জয় করতে পারেইনি, স্থলভাগের ব্যাপারেও তারা জনগণের যে খুব বেশি আস্থা অর্জন করতে পারছেন তা মনে হচ্ছে না। তবে তাদের সাংগঠনিক সম্পাদক গুম হয়ে যাওয়ায় তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা যথার্থ ও যৌক্তিক ইস্যু পেয়েছেন। এই ইস্যুতে হরতাল হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে আরও হরতাল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু আপাতত হরতালের পক্ষে জনসমর্থন থাকলেও এই জনসমর্থন দু'চারদিনের বেশি থাকবে না। আমাদের হরতালে নিরীহ লোক নিহত হয়, ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও সম্পত্তির বিনষ্ট হয়, লাখ লাখ লোকের রুজি-রোজগার ব্যাহত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়, বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমে যায় অর্থাৎ হরতালের বিপক্ষে যুক্তির তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিরোধী দলের হরতাল ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং গত ২০ বছরে বিএনপি থেকে হরতাল আওয়ামী লীগ করেছে অনেক বেশি। তবে এখানে মুখ্য প্রশ্ন হলো, বিএনপির আন্দোলন দেশকে শুধু অস্থিতিশীল করবে, নাকি একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে।
উভয় প্রধান দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনই যদি আলাপ-আলোচনা শুরু না করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এবং সংসদ কার্যকর করার প্রশ্নে বড় দাগে কয়েকটা বিষয়ে সহযোগিতামূলক অবস্থান না আসে, তাহলে জনদুর্ভোগ ও জনঅশান্তি খুব তাড়াতাড়ি এতটাই বেড়ে যাবে যে জনগণই তখন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেবে।
আমাদের ধারণা, এখন একটা জরিপ হলে দেখা যাবে যে, আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা নিকট অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। উভয় রাজনৈতিক দলকে তাদের প্রতি জনগণের এই আস্থাহীনতাকে অবিলম্বেই কমাতে হবে। সেটা না করে তারা যদি একে অপরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করে, অতীত নিয়ে জঘন্য ভাষায় সমালোচনা করা চালিয়ে যান এবং অতীতের মতোই কাজ করতে থাকেন, তাহলে এই দেশে নতুন বড় রাজনৈতিক দলের উত্থান খুব দূরের ব্যাপার থাকবে না।
মোদ্দাকথা, সব মিলিয়ে আমরা অশান্তিতে আছি। এর বেশিরভাগ দায় সরকারি দলের। তবে লাগাতার হরতাল করে বিরোধী দল যথার্থ প্রতিবাদ করছে কিন্তু তা আমাদের অশান্তি কমাচ্ছে না। আমাদের অশান্তি ও দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে বড় দুই দল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবিলম্বে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে এই দুই রাজনৈতিক দল থেকে এই দেশের ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নতুন দল খুঁজবে।


ড. শাহদীন মালিক : পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন