শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা

মাহমুদুর রহমানঃ ১০-০৫-২০১০
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আইনের শাসন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এই রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিন অন্তত একটি করে সেমিনারের আয়োজন করা হতো। তত্কালীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে উদগ্রীব স্বার্থান্বেষী বিদেশি মহলের অর্থায়নে এ দেশের চিহ্নিত পরজীবী শ্রেণী সেসব সেমিনার আয়োজনের দায়িত্বে থাকত। সুশাসন নামটি ফেরি করার সুবিধার্থে নতুন নতুন সংগঠনও গজিয়ে উঠেছিল সুশীল(?) সমাজের চাঁইদের সমন্বয়ে। জেনারেল মইন ও তার শাসন ব্যবস্থার অনুসারী শেখ হাসিনার যৌথ শাসনের সাড়ে ৩ বছরে দেশে প্রকৃতপক্ষে জঙ্গলের আইন চললেও আইনের শাসনের দেশি-বিদেশি ধ্বজাধারীদের টিকিটিরও আর নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত তাদের বিবেচনায় শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে আইনের শাসন ও সুশাসন উভয়ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণ সংবিধানে প্রদত্ত সব অধিকার বিনা বাধায় ভোগ করতে পারছে। সুশীলদের(?) এ জাতীয় পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিবেচনাবোধ আমাদের মতো আমজনতার বুদ্ধির অগম্য হওয়ারই কথা। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমরা বুঝি, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তই হচ্ছে রাজনৈতিক পক্ষপাতশূন্য, বিবেক দ্বারা তাড়িত বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিচার ব্যবস্থা। ২০০৭ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখে জেনারেল মইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ দেশের বিচার বিভাগে যে পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার আমলে তা দ্রুততর হয়ে এখন সেখান থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এই মন্তব্যের মাধ্যমে আমি এ ধরনের কোনো অসার দাবি করতে চাচ্ছি না যে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের আদালতপাড়ায় কোনোই রাজনীতিচর্চা হতো না, কিংবা জায়গাটি একেবারে সুবিচারের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। তবে এটুকু বোধহয় সবাই মানবেন যে, মূল্যবোধের অবক্ষয় চলমান থাকলেও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তখন পর্যন্ত অন্তত খানিকটা চক্ষুলজ্জা অবশিষ্ট ছিল। কিংবা তারও আগে শেখ হাসিনার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় উচ্চ আদালতের মেরুদণ্ড এতটাই শক্ত ছিল যে, তারা তত্কালীন দুর্বিনীত প্রধানমন্ত্রীকে Wrong Headed (বিকৃত বুদ্ধি) অভিহিত করতেও কোনো ধরনের দ্বিধা করেননি। ভাবতে অবাক লাগে, বর্তমানের বিচারপতিরা উচ্চ আদালতের একই আসনে বসলেও পূর্বসূরিদের কাছ থেকে বিচারকের সাহস, নিরপেক্ষতা, সংবিধানের প্রতি আনুগত্যবোধ কিছুই শিখতে পারেননি। সমাজের নানা স্তরের অবক্ষয় মেনে নেয়া গেলেও বিচার বিভাগের অবক্ষয় বিনা প্রতিবাদে মুখ বুঝে সহ্য করা হলে এই রাষ্ট্রের বিনাশ অনিবার্য।
এক-এগারোর পর থেকে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশুমার ঘটনা ঘটে চলেছে। জেনারেল মইন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগের নানা দুর্বলতাসৃষ্ট অসহায় আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়েই এই নিপীড়ন চালাতে পেরেছেন বা পারছেন। জরুরি সরকারের সময় গুটিকয়েক সাহসী ও বিবেকসম্পন্ন বিচারককে ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করলে তত্কালীন বিচার বিভাগ একটি অবৈধ ও জুলুমবাজ সরকারের সহায়তাকারীর ভূমিকায় নিঃসন্দেহে অবতীর্ণ হয়েছিল। নির্বাচিত সরকারের আমলে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫-এ বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে :
‘অনুচ্ছেদ-৩৫ : বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ।—
১) অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবত্ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবত্ সেই আইন বলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।
২) এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাইবে না।
৩) ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।
৪) কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।
৫) কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।
৬) প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোন দণ্ড বা বিচারপদ্ধতি সম্পর্কিত কোন বিধানের প্রয়োগকে এই অনুচ্ছেদের(৩) বা (৫) দফার কোন কিছুই প্রভাবিত করিবে না। ’
বিগত সাড়ে ৩ বছরে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত উপরোক্ত ধারাটির প্রত্যেকটি নির্দেশনা জরুরি ও নির্বাচিত উভয় সরকারই নির্দ্বিধায় অমান্য করেছে। হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি বর্ণিত সোনার শিকলে বাঁধা স্বাধীন বিচার বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ তো দূরের কথা, নিজেরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারকে নির্যাতনের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। বছরের পর বছর কোনো ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কেবল সরকারের বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে দুগ্ধপোষ্য শিশু, বালক, মহিলা নির্বিশেষে অসংখ্য ব্যক্তিকে বিনাবিচারে আটক রাখা হলেও উচ্চ আদালত চোখে কালো পট্টি বেঁধে যার যার আসন রক্ষা করতে ব্যস্ত। অত্যাচারিতদের মধ্যে কেউ কেউ সৌভাগ্যক্রমে হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করলেও চেম্বার নামক ফাটকে আবার বিশাল তালা মেরে দেয়া হচ্ছে। হাইকোর্টের বিচারিক অধিকার কেড়ে নেয়ার যে প্রক্রিয়া মইনের চেম্বার জজরা আরম্ভ করেছিলেন তা শুধু অব্যাহতই নেই, বর্তমানে হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের প্রদত্ত রায় নিয়ে অবমাননাকর ছেলেখেলা করা হচ্ছে। এই সংক্রান্ত একটি সংবাদ ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষের স্টে’ শিরোনামে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আদালত অবমাননার মামলা করা হয়েছে। দেশের উচ্চতম আদালতে বিচারাধীন বিষয় সম্পর্কে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো নাগরিক মন্তব্য করার অধিকার রাখেন না। আমারও সেই সুযোগ নেই। শুধু এটুকু আগাম বলে রাখছি, সত্য কথা প্রকাশের অপরাধে কারাগারে যেতে আমি বরং গৌরবই বোধ করব। কারাগার থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারলে আবার সত্য কথা বলব এবং লিখব, প্রয়োজনে পুনর্বার কারাগারে যাব।
আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদের আইনের নজির দেখানোর ধৃষ্টতা আমি রাখি না। তবে পাঠকের জ্ঞাতার্থে নাসরীন কাদের সিদ্দিকী বনাম রাষ্ট্রের একটি মামলায় আপিল বিভাগ প্রদত্ত রায়ের অংশবিশেষ এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করতে চাচ্ছি,
‘‘A question of fact or mixed question of fact and law ought to be raised in the High Court Division for a proceeding under Article 102 of the Constitution. An appellant should not ordinarily be allowed to convert the Appellate Division into a court of first instance.
[Nasrin Kader Siddiqui vs Bangladesh 44 DLR(AD)16]”
(তথ্যসংক্রান্ত প্রশ্ন অথবা তথ্য ও আইনের বিশ্লেষণ মিশ্রিত প্রশ্ন সংবিধানের ১০২ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট ডিভিশনে উত্থাপিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আপিল বিভাগকে প্রাথমিক বিচারিক আদালতে পরিণত করার সুযোগ গ্রহণ করা থেকে মামলার আপিলকারীকে সাধারণভাবে নিবৃত্ত করতে হবে।)
উপরোক্ত রায়ের আলোকে এক-এগারো পরবর্তী চেম্বার জজদের রায়ের বিশ্লেষণ করা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই অত্যন্ত জরুরি। হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের রুল ও স্থগিতাদেশ জারি হওয়া মাত্র চেম্বারে সেই রায় স্থগিত করার প্রবণতা বিগত সাড়ে ৩ বছরে বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী হাইকোর্ট ডিভিশনে তথ্যের সত্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা এবং আইনি প্রশ্ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ সঙ্কুচিত করে ইনসাফের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো মামলায় হাইকোর্ট ডিভিশন রুল নিষ্পত্তি করে রায় দেয়ার পর আপিলের অবশ্যই যৌক্তিকতা থাকতে পারে। কিন্তু সরকারকে হাইকোর্ট বিভাগের রুলের জবাব দেয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে বাঁচানোর অপচেষ্টাকে আর যাই হোক আইনের শাসন বলা যেতে পারে না। এতে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও বিশ্বস্ততা ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের কাঠামোও দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের যৌথ, সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। সেই স্বাধীনতার খোলসের আড়ালে বিচার বিভাগের এমন বন্দিদশা এদেশে আমরা আগে কখনও দেখিনি। মরহুম শেখ মুজিবের ফ্যাসিবাদী শাসনামলেও রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রমকে বেআইনি ঘোষণা করে রায় দেয়ার মতো বিবেকসম্পন্ন ও সাহসী বিচারকরা উচ্চ আদালতে ছিলেন। এদেশের নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সেই সময় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ পরস্পরকে সহযোগিতা করতেন। এক-এগারো দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার পাশাপাশি উচ্চ আদালতের দুই বিভাগকেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং এর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আদালতপাড়ায় নজিরবিহীন দলীয়করণ। সামগ্রিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকবৃন্দ তাদের নিয়োগপ্রাপ্তির সংবর্ধনার আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় সংবিধান ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পরিবর্তে দলীয় নেতানেত্রীদের বন্দনাতেই অধিকতর সময় ব্যয় করেন।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্য এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ, সর্বত্র অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে অন্যায়-অবিচারের ভয়াবহ বিস্তৃতি এক সময় দোষী নির্দোষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন ক্যালদীয়রা পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছিল, সেই সময়ের নবী যেরেমিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জাতির সঞ্চিত পাপ সমস্ত জাতিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় (অভিশপ্ত নগরী, সত্যেন সেন)।
গত শনিবার সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের এক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বক্তৃতাকালে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, এক-এগারোর ভূত এখনও সুপ্রিমকোর্টে ঘোরাফেরা করছে। ভূত তাড়ানোর জন্য তিনি সেখানে মিলাদ পড়ানোরও প্রস্তাব করেছেন। একই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া অবশ্য সেই এক-এগারোর ভূতকে তাড়ানোর জন্য গণ-আন্দোলনের কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, মাননীয় বিচারপতিরা ভূতের হাত থেকে আদৌ নিষ্কৃতি পেতে চান কিনা। আগেই বলেছি, কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া অন্যদের মধ্যে বিবেকের অস্তিত্ব দুঃখজনকভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রায় প্রদানকালে আইনের ব্যাখ্যার পরিবর্তে বাদীর রাজনৈতিক পরিচয় এখন অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। যে বিচারপতি বিশেষ কোনো দলের দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাকে আইনবহির্ভূতভাবে বিরল ছাড় দিয়ে হাইকোর্ট থেকে সরাসরি জামিন দিচ্ছেন, তিনিই আবার অন্যদের ক্ষেত্রে ন্যায্য জামিন স্থগিত করছেন। এক বিচারপতি তো বিদেশি নাগরিকত্বের তথ্য গোপন করে উচ্চ আদালতে বিচারকের চাকরি নিয়ে দিব্যি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। হারানো বিবেক ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ এদের মধ্যে জনগণ দেখতে পাচ্ছে না। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তারা বরং আদালত অবমাননা নামক এক দেয়াল খাড়া করে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছেন। বিচার বিভাগের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেই সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের বিচার বিভাগকে কাচের ঘরের সঙ্গে তুলনা করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এই ভঙ্গুর ঘরটির যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন। যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এক-এগারো পরবর্তী সময়ে সাহসিকতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনিও নির্বাচিত সরকারের আমলের বিচার বিভাগের ভূমিকায় একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
অত্যাচারী শাসক ও ক্ষমতাবানদের নির্যাতন, নিপীড়ন, জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই একজন মজলুম নাগরিক আদালতের শরণাপন্ন হয়। পৃথিবীতে বিচারকদের ওপরই ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা আল-হাদীদের ২৫নং আয়াতে বলেছেন, ‘আমি আমার রসুলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।’ আজকের বাংলাদেশের আদালতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিচারকদের মধ্যকার একটি বৃহত্ গোষ্ঠী ক্ষমতাসীনদের এসব অপতত্পরতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে বরং ন্যক্কারজনকভাবে তাদের সক্রিয় সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এসব বিচারকের মধ্যে কেউ কেউ আবার বাহ্যিকভাবে নাকি ধর্মপালনও করে থাকেন। ধর্মপালনকারীদের মধ্যকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা শুনেছি নিয়মিত নামাজও আদায় করেন। তাদের উদ্দেশ্যে সুরা আল-বাকারা’র তিনটি আয়াত উদ্ধৃত করে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করব।
সুরা আল-বাকারা
(৮) আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়।
(৯) তারা আল্লাহ্ ও ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না।
(১০) তাদের অন্তকরণ ব্যাধিগ্রস্ত এবং আল্লাহ্ তাদের ব্যাধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুত তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আজাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন।
পুনশ্চ : লেখার শুরুতেই বলেছিলাম আমার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আদালত অবমাননার একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আজই সম্ভবত আপিল বিভাগে সেই মামলার প্রথম শুনানি। পাঠক যখন আমার এই লেখা পড়ছেন তখন হয়তো আপিল বিভাগে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানি চলছে। আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন লেখার অপরাধে আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলা মোকাবিলারও আগাম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। মহান আল্লাহ্ আমাদের সুপথে পরিচালিত করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন