॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥
বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকার যুদ্ধাপরাধের মামলা শুরু করেছিল। কিন্তু সে মামলা এখন খাবি খেতে শুরু করেছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ মতায় এসেছিল, তখন এসেছিল জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই। তার আগে বিএনপি সরকারের আমলে তারা হাতে হাত মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্বার আন্দোলন করেছিল একযোগে। তখন কোনো দিনই আওয়ামী লীগের এ কথা মনে পড়েনি যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সাথে জোট বাঁধা ও সরকার গঠনের পর থেকে তাদের মনোভাব বদলে যেতে শুরু করল। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলো। প্রাথমিকভাবে জামায়াতে ইসলামীও বলল যে, সরকার যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারে, তাহলে তারাও স্বাগত জানাবে। কিন্তু মতলবি আওয়ামী আঙুল উঠে থাকল ওই জামায়াতে ইসলামীর দিকেই। এ যাত্রা তাদের দোষ সম্ভবত দাঁড়িয়েছিল এই যে, তারা কেন বিএনপির সাথে যোগ দিলো। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ২০০১ সালেও যদি জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাতে থাকত, তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াতকে ফাঁসানোর কোনো চেষ্টাই করত না আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল যখন গঠন করা হলো তখন এর নাম দেয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিধিমালা সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে যখন সোচ্চারভাবে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকল তখন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলতে শুরু করলেন, এটি কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয়। এটি অভ্যন্তরীণ (ডোমেস্টিক) ট্রাইব্যুনাল। ভাবখানা এমন যে, বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যেহেতু আন্তর্জাতিক নয়, আন্তর্জাতিক মহলে এই নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকারই নেই। এভাবেই বিষয়টির একটি ইতি টানার চেষ্টা করেছে সরকার। তার পরও আন্তর্জাতিক মহল কখনোই চোখ বন্ধ করে থাকেনি। শুধু যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নয়, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ আছে। সরকার হয়তো মনে করছে যে, এগুলো আমলে না নিয়ে দেশ পরিচালনা সহজ হবে। আর তাই এসব বিষয়ের প্রতি সরকার বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইতোমধ্যেই আমাদের মহামান্য বিচারকদের মন্তব্যাদি নিয়ে কঠোর সমালোচনা ও প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। সেগুলো বিচার বিভাগ সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধার যে আকাঙা, তারই প্রতিফলন মাত্র। আইনের ছাত্র নন এমন সাধারণ মানুষের মনে এখন বিচার বিভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। অর্থাৎ আমার ভাই যদি খুন হয়, তাহলে বিচার বিভাগের কাছে আমার স্বাভাবিক আকাঙা হবে, খুনি গ্রেফতার হবে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন আদালত। কিন্তু যদি কোনো আদালত ওই খুনের মামলা আমলেই নিতে না চান, তাহলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমার অনাস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য। এসব অবস্থা রাষ্ট্রের ভেতরে অরাজকতার জন্ম দিতে পারে।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের েত্ের সমপ্রতি আদালত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, সে সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি দিয়ে যৌক্তিক মনে হয় না। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলছে। এ আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাখেন। যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনে তা থাকার কথা। কিন্তু এ মামলার সাী হিসেবে কিছু দাগি চোর, নারী নির্যাতনকারী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে আদালতে হাজির করতে পেরেছিল প্রসিকিউশন বা সরকার প। তারা সাী দিতে এসে বিবাদী পরে আইনজীবীদের জেরার মুখে এমন সব কথা বলে ফেলেছেন যে, এ মামলা সাজানোর েত্ের সরকারের মতলব অস্পষ্ট থাকেনি। তাদের কাউকে কাউকে আদালতে আনা হয়েছিল, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। কিন্তু দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধা এরা নন। সে কথা আদালতে এরা আসামি পরে আইনজীবীদের জেরার মুখে অকপটে বলেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তাকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সেভাবে তিনি সনদ লাভ করেছেন এবং আওয়ামী লীগ নেতার কল্যাণে তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভাতাদি গ্রহণ করে যাচ্ছেন। এই হলো মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাীর নমুনা।
ফলে সরকার প বিপদে পড়ে গেছে। এখন এরা আর আদালতে সাীদের হাজির করতে নারাজ। সরকার পরে আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বাকি সব সাী অসুস্থ, সমপ্রতি তাদের কারো কারো স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হয়েছে। কেউ কেউ মারা গেছেন। কেউ বা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। ফলে তাদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের সম্পর্কে সরকার প এ রকম বক্তব্য দিয়েছেন, দৈনিক নয়া দিগন্ত তাদের কারো কারো সাথে কথা বলে যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা উদ্বেগজনক। এসব সাীর কেউ কেউ নিজ গৃহেই আছেন। কেউ কেউ জমিজমা চাষ করেন। কেউ কেউ আছেন নিজ বাড়িতেই। কেউ কেউ বলেছেন, আদালতে গিয়ে এরা সরকার পরে শেখানো মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না। একজন পেশায় উকিল, তিনি নিয়মিত তার নিজ এলাকায় বরাবরের মতো ওকালতি করতে প্রতিদিন আদালতে হাজির হচ্ছেন। এ রিপোর্টের কোনো কিছুই সরকার প বা সংশিস্নষ্ট সাীরা অস্বীকার করেননি।
সরকার প দাবি করছিল, এরা পুলিশের কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন বলে যে রেকর্ড রয়েছে সেটাকে তাদের সা্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক। কিন্তু আদালত তো একটা বিচারিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাী হাজির হবেন। তারা পুলিশের কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন আসামিপরে আইনজীবীরা জেরার মাধ্যমে সেটা যাচাই করবেন। তার মধ্য দিয়েই সত্য উদ্ঘাটিত হয়ে আসবে। কিন্তু মহামান্য যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরকার পরে আইনজীবীদের দাবি অনুযায়ী গড়হাজির সাীদের জবানবন্দীকেই সা্য হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আইনি বিবেচনা ভিন্ন। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীকে তো সাীর অনুপস্থিতিতে সা্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। পুলিশ তাদের জোর করে কিছু বলিয়েছে কি না, টাকা-পয়সার সুবিধা দিয়ে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য আদায় করেছে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়। পুলিশের এসব তদন্তের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। সাধারণ মানুষ আদালতের ওপর আস্থা রাখতে চায়। সুতরাং সাী আদালতে আসবেন। তাকে এভাবে জেরা করা হবে। জেরার মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হবে। এটা স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ।
কিন্তু আদালত পুলিশের রিপোর্টকেই সা্য হিসেবে মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশের আইনজীবী মহল এতে ভয়াবহ উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষও, যারা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী নন, তারাও একে ন্যায়বিচারপরিপন্থী বলে মনে করছেন। ধরা যাক, পুলিশ আমাকে ধরল, ধরে এমন নির্যাতন চালাল যে, তোমাকে আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই কথা বলতেই হবে। নির্যাতনের একপর্যায়ে আমি পুলিশের শেখানো কথা বলতে বাধ্য হলাম। কিন্তু আদালত এমন জায়গা, সেখানে আমি স্বাধীন মানুষ। আদালতে দাঁড়িয়ে পুলিশের নির্যাতনের কথা বলব। আমার ওপর জোরজবরদস্তির কথা বলব। পুলিশের কাছে যা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলাম তা অস্বীকার করে আসল সত্য প্রকাশ করব। আদালত সত্য আমলে নেবেন এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমি আইনের ছাত্র নই। কিন্তু সম্ভবত বুদ্ধি-প্রতিবন্ধীও নই। সে কারণে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, অনুপস্থিত সাীর জবানবন্দীকে কিভাবে আদালত প্রকৃত ঘটনা হিসেবে বিবেচনায় নিলেন। কেন অনুপস্থিত সাীর জবানবন্দী বাতিল বলে ঘোষিত হলো না। আইনের অন্ধিসন্ধি তো আমি জানি না। ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার না হলে জরিমানার ব্যবস্থা আছে। প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান করলে জরিমানার ব্যবস্থা আছে। আমি ফার্মগেট এলাকায় এই দুটো কাজই করি। ফার্মগেটের পুলিশবঙের কাছাকাছি বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপো করি। পুলিশ নির্দেশ না দিলে আমরা ডজন ডজন লোক রাসৱা পার হয়ে ওপারে চলে যাই। আমার কর্মস্থল কলোনি বাজারে। সারা দিন যদি সিগারেট নাও খাই কলোনি বাজারে যাওয়ার পথে ফার্মগেটের ওই মোড় থেকেই একটি সিগারেট কিনে ধরাই। কোনো পুলিশ আমার কাছে জরিমানা চায়নি। আমি কোনো চিন্তাও করি না।
কিন্তু এই পুলিশের তথাকথিত জবানবন্দী সা্য হিসেবে আদালতে গ্রহণ করা হবে? হতে পারে পুলিশ কোনো সাীর কাছে যায়ইনি। সরকারের নির্দেশে নিজেরাই মনগড়া রিপোর্ট লিখে দিয়েছে। আর আদালত সেটাকেই সা্য হিসেবে গ্রহণ করবেন। তাহলে ওই আদালত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ধারণা হবে? আইনজীবীরা বলছেন, সাীকে আইন অনুযায়ী আদালতে শপথ নিয়ে সা্য দিতে হয়। কিন্তু শপথ না নিয়ে পুলিশের কাছে কিছু বললে তা সা্য হয় না। এভিডেন্স গ্রহণ করে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়; কিন্তু সা্য হিসেবে তা গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সাীকে আদালত শুনবেন। অভিযুক্ত প তাকে জেরা করবেন। ডিফেন্স লইয়ার ক্রসচেক করবেন। তারপর তা সা্য হতে পারে। কিন্তু পুলিশের দেয়া এভিডেন্সকে সা্য হিসেবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। এটা যদি গ্রহণ করা হয় এবং এর ভিত্তিতে যদি বিচার করা হয়, তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে না। বিচারের সাথে সংশিস্নষ্ট বিচারক-আইনজীবীসহ সবাই সে কথা ভালোভাবেই জানেন।
যুদ্ধাপরাধ প্রহসনে এখন গ্রেফতার আছেন বিএনপির সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি চিরাচরিত রসবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সরকারের এত নির্যাতনের মুখেও হাস্যরস সৃষ্টি করতে পারেন। তার স্ত্রী মহীয়সী ফারহাত কাদের বিচার প্রক্রিয়ায় একেবারেই অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। এসব না করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পল্টন ময়দানে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিলেই হয়। এতে করে দেশে টাকারও অপচয় বন্ধ হবে। সেই সাথে সরকারের সিদ্ধান্ত বাসৱবায়ন হবে, ‘তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দেয়া বিভিন্ন সাীর জবানবন্দীকে সা্য হিসেবে গ্রহণ’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রতিবাদে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গত শুক্রবার তিনি এ কথা বলেন।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত বিচারকের প্রতি আবেদন, এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের খাতায় কী আছে সেটা এ দেশের সাধারণ মানুষ কখনোই বিবেচনায় নেবেন না। তাদের কাছে যা কিছু ন্যায়বিচার মনে হয় সেটাকেই তারা বিবেচনায় নেবেন। ট্রাইব্যুনাল কি জন-আকাঙার ঊর্ধ্বের কিছু হয়ে থাকবেন?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকার যুদ্ধাপরাধের মামলা শুরু করেছিল। কিন্তু সে মামলা এখন খাবি খেতে শুরু করেছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ মতায় এসেছিল, তখন এসেছিল জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই। তার আগে বিএনপি সরকারের আমলে তারা হাতে হাত মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্বার আন্দোলন করেছিল একযোগে। তখন কোনো দিনই আওয়ামী লীগের এ কথা মনে পড়েনি যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সাথে জোট বাঁধা ও সরকার গঠনের পর থেকে তাদের মনোভাব বদলে যেতে শুরু করল। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলো। প্রাথমিকভাবে জামায়াতে ইসলামীও বলল যে, সরকার যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারে, তাহলে তারাও স্বাগত জানাবে। কিন্তু মতলবি আওয়ামী আঙুল উঠে থাকল ওই জামায়াতে ইসলামীর দিকেই। এ যাত্রা তাদের দোষ সম্ভবত দাঁড়িয়েছিল এই যে, তারা কেন বিএনপির সাথে যোগ দিলো। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ২০০১ সালেও যদি জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাতে থাকত, তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াতকে ফাঁসানোর কোনো চেষ্টাই করত না আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল যখন গঠন করা হলো তখন এর নাম দেয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিধিমালা সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে যখন সোচ্চারভাবে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকল তখন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলতে শুরু করলেন, এটি কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয়। এটি অভ্যন্তরীণ (ডোমেস্টিক) ট্রাইব্যুনাল। ভাবখানা এমন যে, বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যেহেতু আন্তর্জাতিক নয়, আন্তর্জাতিক মহলে এই নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকারই নেই। এভাবেই বিষয়টির একটি ইতি টানার চেষ্টা করেছে সরকার। তার পরও আন্তর্জাতিক মহল কখনোই চোখ বন্ধ করে থাকেনি। শুধু যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নয়, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ আছে। সরকার হয়তো মনে করছে যে, এগুলো আমলে না নিয়ে দেশ পরিচালনা সহজ হবে। আর তাই এসব বিষয়ের প্রতি সরকার বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইতোমধ্যেই আমাদের মহামান্য বিচারকদের মন্তব্যাদি নিয়ে কঠোর সমালোচনা ও প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। সেগুলো বিচার বিভাগ সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধার যে আকাঙা, তারই প্রতিফলন মাত্র। আইনের ছাত্র নন এমন সাধারণ মানুষের মনে এখন বিচার বিভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। অর্থাৎ আমার ভাই যদি খুন হয়, তাহলে বিচার বিভাগের কাছে আমার স্বাভাবিক আকাঙা হবে, খুনি গ্রেফতার হবে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন আদালত। কিন্তু যদি কোনো আদালত ওই খুনের মামলা আমলেই নিতে না চান, তাহলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমার অনাস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য। এসব অবস্থা রাষ্ট্রের ভেতরে অরাজকতার জন্ম দিতে পারে।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের েত্ের সমপ্রতি আদালত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, সে সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি দিয়ে যৌক্তিক মনে হয় না। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলছে। এ আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাখেন। যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনে তা থাকার কথা। কিন্তু এ মামলার সাী হিসেবে কিছু দাগি চোর, নারী নির্যাতনকারী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে আদালতে হাজির করতে পেরেছিল প্রসিকিউশন বা সরকার প। তারা সাী দিতে এসে বিবাদী পরে আইনজীবীদের জেরার মুখে এমন সব কথা বলে ফেলেছেন যে, এ মামলা সাজানোর েত্ের সরকারের মতলব অস্পষ্ট থাকেনি। তাদের কাউকে কাউকে আদালতে আনা হয়েছিল, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। কিন্তু দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধা এরা নন। সে কথা আদালতে এরা আসামি পরে আইনজীবীদের জেরার মুখে অকপটে বলেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তাকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সেভাবে তিনি সনদ লাভ করেছেন এবং আওয়ামী লীগ নেতার কল্যাণে তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভাতাদি গ্রহণ করে যাচ্ছেন। এই হলো মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাীর নমুনা।
ফলে সরকার প বিপদে পড়ে গেছে। এখন এরা আর আদালতে সাীদের হাজির করতে নারাজ। সরকার পরে আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বাকি সব সাী অসুস্থ, সমপ্রতি তাদের কারো কারো স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হয়েছে। কেউ কেউ মারা গেছেন। কেউ বা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। ফলে তাদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের সম্পর্কে সরকার প এ রকম বক্তব্য দিয়েছেন, দৈনিক নয়া দিগন্ত তাদের কারো কারো সাথে কথা বলে যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা উদ্বেগজনক। এসব সাীর কেউ কেউ নিজ গৃহেই আছেন। কেউ কেউ জমিজমা চাষ করেন। কেউ কেউ আছেন নিজ বাড়িতেই। কেউ কেউ বলেছেন, আদালতে গিয়ে এরা সরকার পরে শেখানো মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না। একজন পেশায় উকিল, তিনি নিয়মিত তার নিজ এলাকায় বরাবরের মতো ওকালতি করতে প্রতিদিন আদালতে হাজির হচ্ছেন। এ রিপোর্টের কোনো কিছুই সরকার প বা সংশিস্নষ্ট সাীরা অস্বীকার করেননি।
সরকার প দাবি করছিল, এরা পুলিশের কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন বলে যে রেকর্ড রয়েছে সেটাকে তাদের সা্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক। কিন্তু আদালত তো একটা বিচারিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাী হাজির হবেন। তারা পুলিশের কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন আসামিপরে আইনজীবীরা জেরার মাধ্যমে সেটা যাচাই করবেন। তার মধ্য দিয়েই সত্য উদ্ঘাটিত হয়ে আসবে। কিন্তু মহামান্য যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরকার পরে আইনজীবীদের দাবি অনুযায়ী গড়হাজির সাীদের জবানবন্দীকেই সা্য হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আইনি বিবেচনা ভিন্ন। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীকে তো সাীর অনুপস্থিতিতে সা্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। পুলিশ তাদের জোর করে কিছু বলিয়েছে কি না, টাকা-পয়সার সুবিধা দিয়ে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য আদায় করেছে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়। পুলিশের এসব তদন্তের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। সাধারণ মানুষ আদালতের ওপর আস্থা রাখতে চায়। সুতরাং সাী আদালতে আসবেন। তাকে এভাবে জেরা করা হবে। জেরার মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হবে। এটা স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ।
কিন্তু আদালত পুলিশের রিপোর্টকেই সা্য হিসেবে মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশের আইনজীবী মহল এতে ভয়াবহ উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষও, যারা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী নন, তারাও একে ন্যায়বিচারপরিপন্থী বলে মনে করছেন। ধরা যাক, পুলিশ আমাকে ধরল, ধরে এমন নির্যাতন চালাল যে, তোমাকে আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই কথা বলতেই হবে। নির্যাতনের একপর্যায়ে আমি পুলিশের শেখানো কথা বলতে বাধ্য হলাম। কিন্তু আদালত এমন জায়গা, সেখানে আমি স্বাধীন মানুষ। আদালতে দাঁড়িয়ে পুলিশের নির্যাতনের কথা বলব। আমার ওপর জোরজবরদস্তির কথা বলব। পুলিশের কাছে যা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলাম তা অস্বীকার করে আসল সত্য প্রকাশ করব। আদালত সত্য আমলে নেবেন এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমি আইনের ছাত্র নই। কিন্তু সম্ভবত বুদ্ধি-প্রতিবন্ধীও নই। সে কারণে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, অনুপস্থিত সাীর জবানবন্দীকে কিভাবে আদালত প্রকৃত ঘটনা হিসেবে বিবেচনায় নিলেন। কেন অনুপস্থিত সাীর জবানবন্দী বাতিল বলে ঘোষিত হলো না। আইনের অন্ধিসন্ধি তো আমি জানি না। ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার না হলে জরিমানার ব্যবস্থা আছে। প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান করলে জরিমানার ব্যবস্থা আছে। আমি ফার্মগেট এলাকায় এই দুটো কাজই করি। ফার্মগেটের পুলিশবঙের কাছাকাছি বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপো করি। পুলিশ নির্দেশ না দিলে আমরা ডজন ডজন লোক রাসৱা পার হয়ে ওপারে চলে যাই। আমার কর্মস্থল কলোনি বাজারে। সারা দিন যদি সিগারেট নাও খাই কলোনি বাজারে যাওয়ার পথে ফার্মগেটের ওই মোড় থেকেই একটি সিগারেট কিনে ধরাই। কোনো পুলিশ আমার কাছে জরিমানা চায়নি। আমি কোনো চিন্তাও করি না।
কিন্তু এই পুলিশের তথাকথিত জবানবন্দী সা্য হিসেবে আদালতে গ্রহণ করা হবে? হতে পারে পুলিশ কোনো সাীর কাছে যায়ইনি। সরকারের নির্দেশে নিজেরাই মনগড়া রিপোর্ট লিখে দিয়েছে। আর আদালত সেটাকেই সা্য হিসেবে গ্রহণ করবেন। তাহলে ওই আদালত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ধারণা হবে? আইনজীবীরা বলছেন, সাীকে আইন অনুযায়ী আদালতে শপথ নিয়ে সা্য দিতে হয়। কিন্তু শপথ না নিয়ে পুলিশের কাছে কিছু বললে তা সা্য হয় না। এভিডেন্স গ্রহণ করে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়; কিন্তু সা্য হিসেবে তা গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সাীকে আদালত শুনবেন। অভিযুক্ত প তাকে জেরা করবেন। ডিফেন্স লইয়ার ক্রসচেক করবেন। তারপর তা সা্য হতে পারে। কিন্তু পুলিশের দেয়া এভিডেন্সকে সা্য হিসেবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। এটা যদি গ্রহণ করা হয় এবং এর ভিত্তিতে যদি বিচার করা হয়, তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে না। বিচারের সাথে সংশিস্নষ্ট বিচারক-আইনজীবীসহ সবাই সে কথা ভালোভাবেই জানেন।
যুদ্ধাপরাধ প্রহসনে এখন গ্রেফতার আছেন বিএনপির সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি চিরাচরিত রসবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সরকারের এত নির্যাতনের মুখেও হাস্যরস সৃষ্টি করতে পারেন। তার স্ত্রী মহীয়সী ফারহাত কাদের বিচার প্রক্রিয়ায় একেবারেই অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। এসব না করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পল্টন ময়দানে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিলেই হয়। এতে করে দেশে টাকারও অপচয় বন্ধ হবে। সেই সাথে সরকারের সিদ্ধান্ত বাসৱবায়ন হবে, ‘তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দেয়া বিভিন্ন সাীর জবানবন্দীকে সা্য হিসেবে গ্রহণ’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রতিবাদে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গত শুক্রবার তিনি এ কথা বলেন।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত বিচারকের প্রতি আবেদন, এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের খাতায় কী আছে সেটা এ দেশের সাধারণ মানুষ কখনোই বিবেচনায় নেবেন না। তাদের কাছে যা কিছু ন্যায়বিচার মনে হয় সেটাকেই তারা বিবেচনায় নেবেন। ট্রাইব্যুনাল কি জন-আকাঙার ঊর্ধ্বের কিছু হয়ে থাকবেন?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন