বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১২

ইভিএম ও আমাদের নির্বাচন কমিশন



॥ এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী ॥

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের গতিময় জীবনে অফুরন- কল্যাণ সাধিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাথে সাথে কিছু অনাকাঙিক্ষত ঘটনাও ঘটছে। পৃথিবীর সভ্য সমাজে নাগরিকেরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তাদের পছন্দের আইনপ্রণেতা নির্বাচন করে থাকে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে, যা বিশ্বের ভৌগোলিক সীমাভেদে শান্তিকামী মানুষের কাছে এক সার্বজনীন স্বীকৃত পদ্ধতি। দেশ পরিচালনায় গোপন ভোটের কোনো বিকল্প ব্যবস'া আজো আবিষ্কৃত হয়নি। 

গোপন ব্যালটের মাধ্যমে মত প্রকাশের এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নানা ধরনের প্রাযুক্তিক কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। উদ্ভাবিত কৌশল যদি জনস্বার্থের পরিপন'ী বলে প্রমাণিত হয় অথবা গোপন মত প্রকাশে কোনো ধরনের অন্তরায় হয়, তবে সে দেশের নীতিনির্ধারকেরা খারাপ দিকগুলো বাদ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে জনস্বার্থের অনুকূলে নতুন পদ্ধতি 
বাস-বায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। 

সনাতনী পদ্ধতিতে প্রার্থীর নাম ও প্রতীকসংবলিত কাগজের ব্যালট ছাপিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে সুনির্দিষ্ট স'ানে উপসি'ত ভোটারকে ওই ব্যালট সরবরাহ করে গোপন কক্ষে পাঠিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে সিল মেরে বা টিক চিহ্ন দিয়ে অথবা ক্রস চিহ্ন দিয়ে মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়। ভোটার কর্তৃক ভাঁজ করা ব্যালট পেপার একটি নির্দিষ্ট বাক্সে জমা দেয়ার মাধ্যমে ভোট নেয়ার সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে ব্যালট বাক্স খুলে প্রার্থী ও তার প্রতিনিধি এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপসি'তিতে প্রত্যেক প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট গণনা শেষে ফলফল প্রকাশ করা হয়। নির্বাচন কমিশন প্রচলিত এ পদ্ধতির সমস্যাগুলো একটু পরেই আলোকপাত করব। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, ইভিএম পদ্ধতির ভালো-মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। গোটা দুনিয়ায় বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্রের যে সুবিধাগুলো আলোচিত হচ্ছে তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরা হলো। ইভিএম অতি সাধারণ বৈদ্যুতিক যন্ত্র। ব্যালট ছাপানোর প্রয়োজন পড়ে না। ব্যালট বাক্সের প্রয়োজন নেই। ইভিএম অবৈধ ও সন্দেহভাজন ভোট বন্ধ করে। অতি দ্রুত ভোট গণনা সম্ভব। দেশব্যাপী ব্যালট পেপার ছাপাতে প্রচুর কাগজের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। গাছ ও পরিবেশ রক্ষা করে। ব্যালট পেপার ছাপানোর খরচ বেঁচে যায়। বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় এ যন্ত্র ব্যাটারি দিয়ে চালানো সম্ভব। প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে একটি আসনের সব প্রার্থীর নাম, প্রতীক সংরক্ষণ করা যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রার্থীদের প্রদেয় ভোট যোগ হয়ে যায়। প্রোগ্রামিং সম্পন্ন হওয়ার পর প্রোগ্রামিং কন্ট্রোল ইউনিট ডিভাইসটি জ্বালিয়ে দেয় বিধায় প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করা যায় না। প্রধান বা সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুই প্রার্থীর ভোট সহজেই পুনর্গণনা করা যায়। কন্ট্রোল ইউনিট ডিভাইসটি জ্বালিয়ে দেয়ার ফলে এটার পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রত্যেক ভোটারের ভোটদানের সময় রেকর্ড হয়ে যায়। ভোট শেষ হওয়ার পরে সমাপ্ত বোতাম টিপে দিলে নতুনভাবে আর ভোট দেয়া যায় না। ভোটার তালিকার সাথে ইভিএম মিলিয়ে কতজন ভোট প্রদান করল তা নিশ্চিত হওয়া যায়। কোনো টেম্পারিং হলে তা-ও জানা যায়। একটি মেশিনে তিন হাজার ৮৪০ জন ভোটার ভোট দিতে পারেন। সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর ভোট একটি মেশিনে নেয়া যায়। ইভিএমের মাধ্যমে নিরক্ষর ভোটারের ভোটও নেয়া যায়। কোনো ভোটকেন্দ্রে ইভিএম খারাপ হলে তা পরিবর্তন করে নতুন ইভিএম বসানো যায়। একটি ইভিএম বিভিন্ন নির্বাচনে বারবার ব্যবহার করা যায়। একটি ইভিএমে মিনিটে পাঁচটি বা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০টি ভোট দেয়া যায়। ইভিএমে একবার ভোট গ্রহণের পর দ্বিতীয়বার এই মেশিনটি ব্যবহারের আগ পর্যন- ভোটের ফলাফল সংরক্ষণ করা যায়। বারবার বাটন টিপে ভোট দেয়া যায়, যদি প্রিজাইডিং অফিসার বারবার কন্ট্রোল ইউনিটে বোতাম টিপে দেন। ওপরে আমরা ইভিএমের সুবিধাগুলো জেনেছি। এবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএম ব্যবহার করে কী কী সমস্যা দেখা দিয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করব।

Facts about Electronic Election, www.votersunite.org -এ যা আছে : বৈদ্যুতিক মেশিনে ভোট গ্রহণে যেসব সমস্যা সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে দেয়া হলো : নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যে ২০০৪ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ৪,৪৩৮টি ভোট চিরতরে হারিয়ে যায়। ১০,৫০০টি ভোট একটি মেশিনের গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকলেও তা গ্রহণ করে মাত্র ৩০০৫টি। তৎপরবর্তী ৪,৪৩৮ জন ভোটারের ভোট মেশিন গ্রহণ করলেও তা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। মেশিন প্রস'তকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলেক্টের স্বত্বাধিকারী জ্যাক জারবেল স্বীকার করেন, মেশিনে হারিয়ে যাওয়া ৪,৪৩৮টি ভোট আর কোনোক্রমেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ফলে ২,২৮৭ ভোটের ব্যবধানে একজন প্রার্থী এগিয়ে থাকার পরেও ফলাফল ঘোষণা সম্ভব না হওয়ায় রাজ্য নতুন নির্বাচন ঘোষণা করে। ২০০৩ সালের নভেম্বরে মিসিসিপি রাজ্যের নির্বাচনে ভোটিং মেশিনগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সিনেট নতুন নির্বাচন ঘোষণা করে। ২০০৪ সালের নভেম্বরে নির্বাচনে নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যের মেশিনে ভোট গ্রহণ করা হয়। তালিকাভুক্ত মোট ভোটারের চেয়ে মেশিনে ৩০০০ ভোট বেশি পড়ে। একই সময়ে নির্বাচনে নিউ মেক্সিকো রাজ্যে ২৭০০টি ভুতুড়ে ভোট শনাক্ত করা হয়।

২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম ৭০ হাজার ভোট হারিয়ে ফেলে। একই নির্বাচনে নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যে মেশিনের দুই বারের গণনায় দুই রকম ফলাফল আসে এবং জন ক্যারির অনুকূলে ২২ হাজার অতিরিক্ত ভোট চলে যায়। ইভিএম প্রস'তকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক স্বীকার করেন, তিনি বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন; কিন' কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি।

একই নির্বাচনে নিউ ম্যাক্সিকো রাজ্যে ভোটারদের মধ্যে যারা ক্যারিকে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন, তাদের ভোট বুশের হিসাবে জমা হচ্ছিল। কোনো কোনো ভোটার বারবার ক্যারিকে ভোট দিচ্ছিলেন এবং প্রতিবারই বুশের হিসাবে ভোট জমা হচ্ছিল। একই নির্বাচনে ম্যারিল্যান্ড রাজ্যে ৫৩১টি ঘটনায় ৩৮৩টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। মার্চ ২০০৪ সাল অরেঞ্জ নির্বাচনে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে ভোটযন্ত্র ভোটারদেরকে ভুল ব্যালট দেখাচ্ছিল। ফলে অনেকের ভোট নষ্ট হয়ে যায়।

২০০৪ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ইভিএমের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভোট গণনায় প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ ‘না’ ভোট পাওয়া যায়, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। একই নির্বাচনে পেনসিলভানিয়া রাজ্যে ইভিএম পদ্ধতি নির্বাচন-পূর্ববর্তী টেস্টিংয়ে পাস করলেও নির্বাচনকালে মেশিনে অনেক যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে এবং অসংখ্য মেশিন কোনো কাজই করেনি। সংশ্লিষ্ট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এসব ত্রুটিবিচ্যুতি সারাতে ব্যর্থ হয়। ইন্ডিয়ানা রাজ্যে ইভিএমের ভুল প্রোগ্রামিংয়ের কারণে ভোট গণনায় মেশিন ভুল ফলাফল দেয়। একই অবস'া ঘটে ক্যারোলিনা নিউ ম্যাক্সিকো কানসাস ও টেক্সাস রাজ্যে। ফলে এসব রাজ্যে ফলাফল বিপর্যয় ঘটে। ২০০৪ সালে টেক্সাস রাজ্যে ইভিএম এর স্ক্রিনে ভুয়া প্রার্থী দেখিয়েছিল। ২০০৪ সালের অক্টোবরে ফ্লোরিডা রাজ্যে ইভিএমের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভোটারদের অনেকেই সারা দিন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভোট দিতে পারেননি। ফলে অনেক ভোটার পরের দিন এসে ভোট দিতে বাধ্য হন এবং ব্যস- ভোটারেরা ব্যস-তার কারণে ভোট দিতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেন। Johns Hopkins University Information Security Institute Technical Report TR- 2003-19 July 23, 2003 এবং Tadayoshi Kahno, Adam Stubblefield AVIEL D. RUBIN, DANS. WALLACH প্রণীত ÔAnalysis of an electronic voting system’ প্রতিবেদনে যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি উল্লেখ করা হয়েছে তার কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো : ব্যালট পেপারে ভোটদানের চেয়ে নিরাপত্তার প্রশ্নে ইভিএম অনেক বেশি নিম্নমানের। মেশিনের ভোটদান পদ্ধতি অবৈধ সুযোগ সৃষ্টি করে। ভোটিং মেশিনকে অবৈধভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ভোটকেন্দ্রের বাইরে অনেক দূর থেকে বিভিন্ন ধরনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভোটিং মেশিনকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়। একই ব্যক্তির পক্ষে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একাধিক ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। উৎস কোড ছাড়াই বাইরে থেকে এ যন্ত্রকে প্রভাবিত করা যায়। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে বৈধভাবে অবস'ানকারী ব্যক্তিরা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে ভোটিং মেশিনকে প্রভাবিত করতে পারে। ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তারা অতি কৌশলে মুহূর্তের মধ্যে রায় পরিবর্তন করে একজনের ভোট অন্যজনের হিসাবে নিয়ে নিতে পারে। ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তারা সহজেই ভোটারের ও ভোটের গোপনীয়তা বিনষ্ট ও পাস করিয়ে দিতে পারে। 

তাদের এ প্রতিবেদনে তারা বিস-ারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে যা যা বলেছেন : ভোটের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার সঠিক প্রতিফলন ঘটতে হবে। জনগণ কার দ্বারা কিভাবে শাসিত হবে, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। কোনো আপত্তি উত্থাপিত হলে নিখুঁত গণনা ও সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত ফলাফলের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ভোট ও ভোটারের গোপনীয়তা শত ভাগ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অবস'াতেই ভোট ও ভোটারের গোপনীয়তা প্রকাশ পায় এমন কোনো চুল পরিমাণ সুযোগ রাখা যাবে না। এক প্রার্থীকে ভোট দিলে তা অন্য প্রার্থীর অনুকূলে চলে যাওয়ার সব ধরনের সম্ভাবনা বিলীন করে দিতে হবে। সঠিকভাবে ভোট সমাপ্তির পর ভোট গণনার ভুল যাতে সহজেই নিরূপণ করা যায় এবং সঠিক ফলাফল প্রকাশ করা যায়, তার ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা থাকতে হবে। ভোটদান পদ্ধতি ভোটারের জন্য অতীব সহজ, নিরাপদ, প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ হতে হবে। এরপরও ভোটার ভুল করে ফেললে তা সংশোধন করে আবার গোপনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোটদানের সুযোগ দিতে হবে। ভোটদান শেষে ভোটার ভোটকেন্দ্র ত্যাগের মূহূর্তে তার ইচ্ছার প্রতিফলনের আত্মতৃপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্র ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে উপরিউক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাল বা ভুয়া স্মার্ট কার্ড দিয়ে ভোট দেয়া যায়। নির্বাচনী কর্মীরা সহজেই সফ্টওয়্যারে প্রবেশ করে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে। নির্বাচনী কর্মী বা ইন্টারনেট সরবরাহকারী ভোটিং নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে।

ভোটিং ডিভাইস ডেভেলপারেরা নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে পারে। জাল স্মার্ট কার্ড দিয়ে চোখের পলকে একাধিক ভোট প্রদান করা যায়। নির্বাচনী কর্মীরা যেকোনো সময়ে বৈদ্যুতিক ভোটিং মেশিনের ভোটগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে, যা ভোটারেরা জানতে পারবে না। নির্বাচনী কর্মীরা যেকোনো সময় ভোটের ফলাফল পদ্ধতি গোপনে পরিবর্তন করে দিতে পারে। ভোটিং যন্ত্র টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ভুল গণনা নিশ্চিত করা যায়। এক প্রার্থীর ভোট অন্য প্রার্থীর নামে গণনা করার সুযোগ তৈরি করা যায়। ভোট সৃষ্টি করা যায়। ভোট মুছে দেয়া যায়। ভোট সংশোধন করা যায়। সুকৌশলে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমকে বিলম্বিত করা যায়। ইন্টারনেট থেকে পাওয়া একদল বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের ইউরোপ ও আমেরিকায় ভোটিং পদ্ধতি গবেষণায় ভোটিং মেশিনের যেসব গুরুতর বিষয়াবলি বেরিয়ে এসেছে এবং ভারতীয় বৈদ্যুতিক ভোটিং মেশিন সম্পর্কে যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়েছে, তা প্রশ্নোত্তর আকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন-১ : আপনারা ভারতীয় ইভিএম নিয়ে কী কারণে গবেষণা করলেন?

উত্তর : পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইভিএমগুলো যেসব গুরুতর সমস্যা মোকাবেলা করছে, সে তুলনায় ভারতীয় ইভিএম অভ্রান্ত ও খাঁটি বলে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন দাবি করছে। যদিও ভারতীয় ইভিএম নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ গবেষণা হয়নি।
প্রশ্ন-২ : আপনাদের গবেষণার জন্য ইভিএম কিভাবে পেলেন?
উত্তর : আমরা এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মাধ্যমে পেয়েছি, যার পরিচয় গোপন রাখার জন্য আমাদের অনুরোধ করা হয়েছে।
প্রশ্ন-৩ : গবেষণায় আপনারা কী কী পেলেন?
উত্তর : কোনো ব্যক্তি চাইলে ইভিএমের সফটওয়্যারে প্রবেশ করতে পারে এবং টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমরা এ ধরনের দু’টি গবেষণালব্ধ উদাহরণ দিতে পারি : ক. নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত অথবা বহিরাগত অসৎ কোনো ব্যক্তি ইভিএমের কোনো যন্ত্রাংশ দেখতে একই ধরনের কোনো যন্ত্রাংশ দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল পরিবর্তন করতে পারে। খ. সহজেই বহনযোগ্য কোনো ডিভাইস দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল পরিবর্তন সম্ভব। এ কাজটি নির্বাচন কমিশন বা ইভিএম প্রস'তকারী প্রতিষ্ঠানের অজ্ঞাতসারে স'ানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তা বা বহিরাগত কোনো ব্যক্তি করে ফেলতে পারে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ ধরনের ঘটনা উদঘাটন করা বড়ই দুরূহ ব্যাপার।
প্রশ্ন-৪ : আপনারা কি কোনো সঠিক ইভিএমের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এমন ফলাফল দেখাতে পেরেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহৃত একটি ইভিএমের ওপরে আমাদের কার্যক্রম ও গবেষণা চালিয়ে উপরিউক্ত ফলাফল পেয়েছি।
প্রশ্ন-৫ : এসব ইভিএম সিল করে দেয়ার পরও এবং মেমোরি ডিভাইস জ্বালিয়ে দেয়ার পরও আপনারা কিভাবে অভ্যন-রীণ মেমোরিকে নিপুণভাবে আপনাদের ইচ্ছামতো কাজ করিয়ে নিয়ে ফলাফল পরিবর্তন করে দিলেন?
উত্তর : এটিতে প্রবেশ করা কোনোই কঠিন কাজ নয়। আমরা এটি কিভাবে করেছি, তার ভিডিও চিত্রটি আপনি অনুগ্রহ করে দেখলে অতি সহজেই বুঝতে পারবেন এবং আপনি চাইলে নিজেই মেমোরিকে আপনার অনুকূলে নিয়ে যা করতে চান তা করতে পারবেন।

প্রশ্ন-৬ : একটি অসৎ ইভিএম বা অসৎ মেমোরি বা অসৎ প্রোগ্রামিং কী করে জানে বা বোঝে কোন প্রার্থীর অনুকূলে কাজ করতে হবে?
উত্তর : আমাদের অসৎ ডিসপ্লে বোর্ড আক্রমণ একটি ব্লু টুথ রেডিও যোগ করে নেয়। সুতরাং দুর্বৃত্তরা বেতারের মাধ্যমে সঙ্কেত পাঠাতে পারে যে, কোন প্রার্থীর অনুকূলে ভোটটি যাবে। তখন ভোটার যে প্রার্থীকে ভোট দেন না কেন, ভোটটি দুর্বৃত্তের পছন্দের প্রার্থীর অনুকূলে জমা হবে। আমরা এ অপকর্মটি করি নির্বাচন ও গণনাকালে, অর্থাৎ ফলাফল প্রকাশের আগে। আমাদের তৈরি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আমরা বিস-ারিত বলেছি। আমরা আরো অনেক জটিল পদ্ধতিতে এ আক্রমণ চালাতে পারি। আমরা সাধারণ নির্বাচনের সমুদয় আসনকে আমাদের আক্রমণের আওতায় নিয়ে আসতে পারি। সুনির্দিষ্ট আসনের সব প্রার্থীকে আমাদের আক্রমণের আওতায় নিয়ে আসতে পারি।

প্রশ্ন-৭ : কিন' আমরা তো নির্বাচন কমিশনের ইভিএমের মাধ্যমে কৃত্রিম ভোট গ্রহণকে চমৎকার দেখতে পাই।
উত্তর : সংক্ষিপ্তাকারে পাতানো নির্বাচনে এবং স্বল্প সময়ের নির্বাচনে আপনি এমন ভালো ফলাফল দেখতে পান। এই পাতানো নির্বাচনে তাৎক্ষণিক প্রার্থী ও ভোটার নির্দিষ্ট করে সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং করে অতি দ্রুত নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়; কিন' জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমাদান থেকে ভোটের ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয়। কাজেই প্রার্থী ও ভোটার সম্পর্কিত তথ্যগুলো আমরা অনেক আগেই জেনে যাই বিধায় কারচুপি করা আমাদের পক্ষে অতীব সহজ।
প্রশ্ন-৮ : আপনাদের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি মোবাইল ফোন থেকে ইভিএমে (EVM) সঙ্কেত পাঠানো হচ্ছে, কিন' ভোট চলাকালে ও গণনায় মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ!
উত্তর : আমরা তো কেবল এটাই প্রমাণ করছি যে, বেতারের সাহায্যে ইভিএমে যেকোনো সঙ্কেত পাঠানো সম্ভব। বেতার সঙ্কেতের মাধ্যমে অসংখ্য ব্যবস'া ও পদ্ধতিতে ইভিএমকে আক্রমণ করা সম্ভব। বেতার ডিভাইসের মাধ্যমে গোপনে সহজে অসংখ্য পদ্ধতিতে ভোটকেন্দ্রে রক্ষিত ইভিএমে অত্যন্ত কার্যকর ও সফলভাবে সঙ্কেত পাঠানো সম্ভব।

প্রশ্ন-৯ : ভারতীয় নির্বাচন কমিশন দাবি করে যে, ইভিএম শত ভাগ নির্ভুল ও খাঁটি। তাহলে কিভাবে এটি সম্ভব?
উত্তর : ভারতীয় ইভিএম নির্ভুল ও খাঁটি- এ দাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন যদি আমাদের দাবিতে দ্বিমত পোষণ করে তাহলে আমরা যথাযথ বৈজ্ঞানিক বিতর্কের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস'াপন করব।
প্রশ্ন-১০ : ভারতীয় নির্বাচন কমিশনও তো অসংখ্য বিজ্ঞানীকে এ কাজে নিয়োগ করেছে। তাহলে আমরা কী করে বুঝব যে আপনারা সঠিক এবং নির্বাচন কমিশন ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত?
উত্তর : ভারতীয় নির্বাচন কমিশন যে দুু’টি বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট মূল্যায়ন করেছে, সে কমিটির দৃশ্যমান কোনো ভোট নিরাপত্তা পরিচিতি নেই। ওই রিপোর্টে গবেষণাগুলো কেবল উৎপাদকদের উপস'াপনা ও বিভিন্ন স'ান পরিদর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওই কমিটি ভোটিং মেশিনের কর্মসূচির গভীরে বা উৎস কোডের ভেতরে প্রবেশ করেছে। পক্ষান্তরে, আমরা প্রকৃত ভোটিং মেশিন নিয়ে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি ও বিভিন্ন উপায়ে ও পদ্ধতিতে ভোটিং মেশিনকে আক্রমণ চালিয়েছি।

প্রশ্ন-১১ : আপনারা এসব তথ্য প্রকাশ করার মাধ্যমে আমাদের নিরাপদ ইভিএমকে অনিরাপদ বানিয়ে দিচ্ছেন না তো?
উত্তর : বাস্তবতা হলো, ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে সর্বসাধারণের যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সুযোগ রাখেনি। এ সুযোগ না রাখায় অনিরাপদ ইভিএম নির্বাচনী কর্তৃপক্ষকে নিরাপদ করতে পারে না। ভারতে প্রায় ১৪ লাখ ইভিএম রয়েছে। অপরাধপ্রবণ আক্রমণকারীরা এই ইভিএমে ঢুকে ফলাফল পাল্টে দেয়ার মাধ্যমে গোটা নির্বাচনকেই ভণ্ডুল করে দিতে পারে। আমরা তো কেবল ইভিএমের নিরাপত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা করে তার ফলাফল জনসাধারণকে অবহিত করছি।
প্রশ্ন-১২ : ইভিএম নিয়ে সমস্যা ও জটিলতা কি নির্দিষ্ট করা সম্ভব?
উত্তর : অতি সহজে নয়। ইভিএম নিয়ে হাজারো সমস্যা তৈরি করা সম্ভব। কারণ এতে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভালো-মন্দ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা না করেই ভোটারদের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করছে। 

প্রশ্ন-১৩ : ইভিএমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কি কিছুই করতে পারি না?
উত্তর : হ্যাঁ। নির্বাচন কমিশন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতিকে কঠিন করে তুলতে পারে। কিন' অপরাধীদের ভোট জালিয়াতি বন্ধ করা অসম্ভব।
প্রশ্ন-১৪ : তাহলে ভারত কেন অত্যধিক প্রযুক্তি নিয়ে সামনে এগোচ্ছে না?
উত্তর : আমরা বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। প্রযুক্তি উন্নয়নে আমাদের রয়েছে গভীর একাগ্রতা। তার সাথে আছে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা। বৈদ্যুতিক ভোটিং মেশিন অনিরাপদ, অখাঁটি ও ভোটের ফলাফল নিরীক্ষাবহির্ভূত। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতে যে ধরনের ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে। একই ধরনের ইভিএম ব্যবহার করেছিল এ দু’টি রাষ্ট্র। যখন দেখা গেল, ইভিএমে রয়েছে গুরুতর নিরাপত্তা সমস্যা ও অস্বচ্ছতা, তখন কাগজের ব্যালট তার পুরনো জায়গা দখল করে নিলো। ইভিএম বাতিল হয়ে গেল।

প্রশ্ন-১৫ : ভারতে ইভিএম বিতর্ক সম্পর্কে আমরা আরো অধিক তথ্য কোথায় পেতে পারি?
উত্তর : Indian EVM.com -এ পেতে পারেন। vita নামে একটি গ্রুপ এ ওয়েবসাইটটি চালু করেছে। আমাদের গবেষণা তাদের চেয়ে আলাদা ও স্বাধীন।
ওপরের তথ্যগুলো পর্যালোচনায় আমরা যা পাই- * ইভিএম মানুষের তৈরি একটি যন্ত্র। * মানুষ এটি ব্যবহার করে, মানুষ এটিতে প্রোগ্রামিং করে রাখে। * যেকোনো যন্ত্রের ভালো বা মন্দ ব্যবহার সম্ভব। * ইভিএম তার ব্যতিক্রম নয়।
একনজরে ইভিএমের সুবিধাগুলো : ১. ইভিএম পরিবেশবান্ধব; ২. ইভিএম সহজেই পরিবহনযোগ্য; ৩. ইভিএমের কারণে কাগজ খরচ কমে যায়; ৫. ইভিএমে ভোটদান সহজ ও ৬. ইভিএমে ভোট গণনা সহজ ও দ্রুত।
ইভিএম ব্যবহারে সমস্যাগুলো : 

ক. সাধারণ সমস্যা : ১. ইভিএম বিদ্যুৎ বা ব্যাটারিতে চলে বলে যেকোনো সময় ভোল্টেজ ওঠানামার কারণে বিকল হয়ে যেতে পারে; ২. এটি একটি যন্ত্র, তাই যেকোনো সময় বিকল হতে পারে; ৩. অধিকসংখ্যক যন্ত্র বিকল হলে এবং প্রতিস'াপন সম্ভব না হলে ভোটগ্রহণ বিলম্বিত ও বন্ধও হয়ে যেতে পারে ও ৪. ভোল্টেজের ওঠানামায় এ যন্ত্র বিকল না হলেও ভুল ফলাফল দিতে পারে।

খ. অসৎ উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা যা যা করতে পারেন : ১. কোনো এক বা একাধিক নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রের ইভিএমে কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীর অনুকূলে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ১০০, ২০০, ৩০০, ৪০০ বা ইচ্ছামতো ভোট জমা করে রাখতে পারেন, যা ভোট শুরুর আগের টেস্টিংয়ে কোনো অবস'াতেই ধরা পড়বে না। কিন' গণনার সময়ে ঠিক ঠিকভাবে ওই প্রার্থীর অনুকূলে ফলাফল এসে যাবে। ধরুন, একটি নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে পাঁচ হাজার ভোটার আছে। সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশলী কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে অগ্রিম ৫০০ ভোট দিয়ে দিলো এবং এমনভাবে প্রোগ্রামিং করল যে, চার হাজার ৫০০ ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপসি'ত হয়ে ভোট দেয়ার পর অবশিষ্ট ৫০০ ভোটার উপসি'ত হয়ে ভোট দিলো এবং পর্দায় দেখল যে, তাদের ভোট দেয়া সঠিক হয়েছে; কিন' প্রোগ্রামটি এমনভাবে করা যে, এই পরের ৫০০ ভোটারের ভোট বাস্তবে যোগ হবে না এবং ভোটার বুঝতেও পারবে না। কারণ প্রোগ্রামিংটা এমনভাবে করা হয়েছে যে, ভোট শুরুর সময় থেকে ফলাফল বের করা পর্যন্ত এই কারচুপিটি কার্যকর থাকবে।

২. তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশলী এমনভাবে প্রোগ্রামিং করল যে, প্রতি তিন, পাঁচ, সাত বা দশ ভোট অন্তর একটি ভোট একজন নির্দিষ্ট প্রার্থীর অনুকূলে চলে যাবে; ভোটার যাকেই ভোট দিক না কেন; অথচ ভোটার গোপন কক্ষে দেখতে পাবে যে তার ভোটটি নির্দিষ্ট জায়গায় গেছে।
৩. প্রোগ্রামিং এমনভাবে করা হলো যে, প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রধান দুই প্রার্থীর যাকে প্রোগ্রামার জেতাতে চায়, তার প্রাপ্ত ভোটের শতকের অঙ্কটি ছোট হয় তাহলে ফলাফলের মুহূর্তে শতকের অঙ্কদ্বয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে অদল-বদল হয়ে যাবে। মনে করুন, আমি প্রোগ্রামার ‘ক’ প্রার্থীকে জেতাতে চাই। একটি নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে ‘খ’ প্রার্থীর এগিয়ে থাকার সমূহ সম্ভাবনা। আমি শতকের অঙ্কটি স্বয়ংক্রিয় পরিবর্তনের প্রোগ্রামিং করে (এক হাজার ৪৩১টি) এবং ‘খ’ প্রার্থীকে ভোট দিলো এক হাজার ৭১২টি। ফলাফল এলো ‘ক’ প্রার্থী এক হাজার ৭৩১ ভোট এবং ‘খ’ প্রার্থী এক হাজার ৪১২টি। একটি নির্বাচনী এলাকার ১০-১৫টি ভোট কেন্দ্রের ইভিএমে এভাবে প্রোগ্রামিং করলে ফলাফল পাল্টে যাবে; ধরা পড়ারও সম্ভাবনা থাকবে না। এ রকম অসংখ্য পথে ভোট ডাকাতির কৌশলী পন'া অবলম্বন করা যায়।

গ. ভোট চলা কালে ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা কর্তৃক কারচুপি :
১. প্রিজাইটিং অফিসার বা সহকারী প্রিজাইটিং অফিসার ভোট চলা কালে তার কাছে রক্ষিত বোতামে একটি ভারী কোনো কিছু পড়ে যায়। কোনো কোনো সময় গোপন কক্ষে পরিদর্শনে যান এভাবে সারা দিনে মিলে ৩০-৪০ ভোট কোনো নিদিষ্ট প্রার্থীর অনুকূলে চলে যেতে পারে।
২. নির্বাচনী কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কোনো কলাকৌশল অবলম্বন করে অথবা ভোটগ্রহণ বন্ধের বোতাম টিপে দিতে পারে অথবা ভোটা গ্রহণ বন্ধ করে দিতে পারে অথবা মাঝে মধ্যে ভোটযন্ত্রের পরীক্ষার নাম করে গোপন কক্ষে গিয়ে নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আসতে পারে।

ঘ. বাইরে অবস'ানরত অপরাধী চক্র, মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো অত্যাধুনিক বেতার যন্ত্র ব্যবহার করে :
ইভিএম ডিজাইনে আক্রমণ চালিয়ে ইচ্ছেমতো নিজের প্রার্থীকে যত ইচ্ছা ভোট দিয়ে দিতে পারে অথবা ইভিএম ডিভাইসে আক্রমণ চালিয়ে ইচ্ছেমতো নিজের প্রার্থীকে যত ইচ্ছা ভোট দিয়ে দিতে পারে অথবা ইভিএম ডিভাইসের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে ইভিএম স্ক্রিনের অনুরূপ স্ক্রিনে দেখতে পারে নতুন ভোটার কখন স্ক্রিন চালু করে পছন্দের প্রার্থীর নাম ও প্রতীক খুঁজছে। এ অবস'ায় অতি দ্রুত এবং ভোটারের আগেই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দিলো; কিন' ভোটারের স্ক্রিনে তা প্রতিফলিত না হয়েও ভোট হয়ে গেল। ভোটার ভোট দিলো, তার ভোট গণনা হলো না অথবা এমনও হতে পারে যে, অপরাধী চক্র এমনভাবে হ্যাকিং করল যে, ভোটার যাকেই ভোট প্রদান করুক না কেন, একজন নির্দিষ্ট প্রার্থীর হিসাবেই ভোটটি পড়ল।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএমের সহায়তায় নির্বাচনে যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে, তার আলোকে ওপরের সম্ভাব্য ঘটনা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করা হলো। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় এ ধরনের হাজার হাজার ঘটনার মাধ্যমে মারাত্মক ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছিল সে দেশের নির্বাচনগুলোতে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এসব ঘটনা জানেন বলেই আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। নির্বাচন কমিশনের কাছে এসব তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনা মজুদ আছে। তার পরও আমাদের বিজ্ঞ নির্বাচন কমিশন ইভিএম পদ্ধতির মতো একটি অসম্ভব, অনিরাপদ ও ফলাফল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যবস'া বলপূর্বক জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। সামনে চোখ থাকাবস'ায় পেছনে হাঁটার এবং অনিশ্চিত ও বিপদসঙ্কুল যাত্রার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আমাদের নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই অবহিত রয়েছে।

আমাদের নির্বাচন কমিশন এ পদ্ধতি পরীক্ষামূলক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন, নারায়ণঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও নরসিংদী পৌরসভা নির্বাচনে চালিয়েছে। নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিক সাফল্যও দাবি করেছে। আমার জানা তথ্য মতে, বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহার পরবর্তী সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণা হয়নি। খোদ নির্বাচন কমিশন নিজস্ব উদ্যোগে সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কোনো গবেষণায় হাত দেয়নি। গবেষণা করে ফলাফল পেয়ে তার পর যদি তারা কোনো দাবি করত, তা হতো যুক্তিনির্ভর, অকাট্য ও প্রামাণ্য দলিল।

উন্নত বিশ্বের দেশে দেশে এ বিষয়ে নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। কোথাও এ পর্যন্ত ইভিএমের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্বিক ফলাফল প্রদানে সক্ষমতা প্রমাণিত হয়নি। এ কথা সত্য যে, স'ান-কাল-পাত্রভেদে কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে শত ভাগ সঠিক ফলাফল এসেছে। কিন' এ নিয়ে আমাদের বা নির্বাচন কমিশনের পুলকিত হওয়ার কোনোই কারণ নেই। কেননা সার্বিকভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলে মাত্র এক ভোটেও ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে। অতএব পরীক্ষামূলক ইভিএম ব্যবহারের তাৎক্ষণিক সাফল্য দাবি একটি হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের নির্বাচন কমিশন বেমালুম ভুলেই গেছেন যে, জাতীয় নির্বাচন ও স'ানীয় সরকার নির্বাচন কোনো অবস'াতেই সমান গুরুত্ব বহন করে না। জাতীয় নির্বাচনে একটি রাষ্ট্রের সরকারের পরিবর্তন ঘটে। কিন' স'ানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের পরিবর্তন ঘটে না। আমরা আরো লক্ষ করেছি যে, আমাদের নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি ছাড়া নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন যেখানে এক ভোটের ব্যবধানেও ফলাফল ভিন্ন হতে পারে, সেখানে ত্রুটিবিচ্যুতির কথা স্বীকার করে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করা জাতির সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর ইভিএম ব্যবহারে তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা ছাড়া ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।

আগেভাগেই নির্বাচন কমিশন ইভিএমের পক্ষে সাফাই গেয়ে জাতিকে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, এটি তারাই ভালো জানেন। তবে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে ইভিএমের কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। উন্নত বিশ্ব ইভিএমের মতো একটি ভোট ডাকাতি, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনবিরোধী, ভোট নিয়ে নয়-ছয় করার অবাধ অন্যায় ও অবৈধ সুযোগ দেয়ার চমৎকার এই যন্ত্রটিকে যে প্রত্যাখ্যান করেছে এটি প্রমাণিত বাস্তব সত্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত বিশ্ব যেখানে ইভিএমে মারাত্মক জনস্বার্থ পরিপন'ী ধৃষ্টতা থেকে বেরিয়ে এসেছে ও আসছে, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ইভিএমের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ও চমৎকার পর্যবেক্ষণ রয়েছে; সেখানে ইভিএমের পক্ষে আমাদের নির্বাচন কমিশনের ওকালতি অবাক করার মতো বিষয়।

ইভিএম সম্পর্কে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো বড় রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে মতামত দিয়েছে বলে জানা নেই। অপর বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি ইভিএম চেয়েছিল, নির্বাচন কমিশন এ অনুরোধ রক্ষা না করে কমিশন কার্যালয়ে গিয়ে স্বল্প পরিসরে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের উপসি'তিতে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রকারান্তরে এটিই প্রমাণ করল যে, সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো নয়-ছয় করার প্রোগ্রামিং করা, ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতির সুযোগগুলো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সেট করা, বাইরে থেকে ইভিএমের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ভোট ডাকাতি করার কৌশল খাটানো এবং পরে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো কমিশনের সামনে তুলে ধরার কোনো সুযোগ যেন বিএনপি না পায়। নির্বাচন কমিশন কি এমন ভাবল যে তারা চোখ বন্ধ করে থাকলে অন্য কেউ তাদের দেখতে পাবে না?

নির্বাচন কমিশনের চোখ সামনে রেখে পেছনের দিকে হাঁটার নানাবিধ কারণ ও ব্যাখ্যা থাকতে পারে। বিশ্বব্যাপী ইভিএম নিয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা হয়েছে, তার ঋণাত্মক ফলাফলকে যৌক্তিক চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে সাফল্যজনকভাবে মোকাবেলা করে ইভিএমের কোনোই কুফল নেই, কেবল সুফল আছে- এমন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং ইভিএমের হাজার হাজার নেতিবাচক ঘটনা যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন' দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের নির্বাচন কমিশন ইভিএমের কুফল জানার পরও তাদের ইভিএমের পক্ষে অবস'ান গ্রহণ সাধারণ মানুষের সন্দেহকে আরো সুদৃঢ় করেছে।
কাগজের ব্যালটে ভোটগ্রহণের সমস্যা অনেক। এসব সমস্যা মোকাবেলার সব কৌশল আয়ত্তের মধ্যে। উন্নত বিশ্বও আবার কাগজের ব্যালটের মাধমে নির্বাচন পদ্ধতিতে ফিরে গেছে ও যাচ্ছে। আমাদের নির্বাচন কমিশনের যত তাড়াতাড়ি এ ব্যাপারে বোধোদয় হবে আমাদের জাতির জন্য ততই মঙ্গল। 
লেখক : সাবেক সচিব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন