সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

কেন এই লুকোচুরি, কালো ঘোড়াটা কার পকেটে?

কেন এই লুকোচুরি, কালো ঘোড়াটা কার পকেটে?


॥ মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক ॥

কলামটি যে মুহূর্তে লিখতে বসি তখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ উত্তপ্ত। বিএনপির জনপ্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুম হওয়াকে কেন্দ্র করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শনিবার পর্যন্ত সরকারকে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, তা পেরিয়ে গেলেও সরকার ইলিয়াসকে এখনো ফেরত দিতে পারেনি। ইলিয়াস আলীকে সরকারি এজেন্সির লোকেরা গুম করেছে, এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরও সরকার তাকে নিয়ে কেন যে এখনো লুকোচুরি করছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। ১৮ দলীয় জোট হরতাল কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না, কারণ সরকারকে তারা যথেষ্ট সময় দিয়েছে এবং নানাভাবে সহায়তা করেছে; কিন্তু সরকার ইলিয়াস আলীকে ফেরত না দিয়ে তাদেরকে হরতাল দিতে আবারো বাধ্য করেছে।
সরকার যদি ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়, তবে দেশের স্বার্থে অবশ্যই এটা ভালো কাজ। কিন্তু তার পরও সরকারকে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আর যদি তাকে ফেরত না দেয়, সে েেত্র তো সরকারকে অবশ্যই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, তাকে ফেরত দিলে সেখানে একটি প্রশ্ন কম থাকবে। যে প্রশ্নগুলোর জবাব সরকারকে দিতে হবে সেগুলো আজ দেশের প্রায় সব মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে সচেতন নাগরিক, যারা পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমের খোঁজখবর রাখেন, তারা অধীর আগ্রহে অপেমাণ যে, ইলিয়াস আলী কবে নাগাদ ফিরবেন। বিবেকের কাঠগড়ায় আজ সবাই অপরাধী। বহুল প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক সংবাদপত্রটিতে ২৬ এপ্রিল ইলিয়াস আলীর গুমের বিষয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম ছিল লাল কালিতে। এতে বিস্তারিত বলা হয়েছে কিভাবে ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন এবং কারা তাকে গুম করেছে; এমনকি গুমের প্রত্যদর্শী হিসেবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি তাৎণিকভাবেই ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। তবে তিনি জানতেন না যে, এই ব্যক্তিটি ছিলেন ইলিয়াস আলী এবং তাকে অপহরণ করা হচ্ছে। এই পুলিশ কর্মকর্তার জবানবন্দী পত্রিকাটিতে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। যদি এই জবানবন্দী সত্য হয় তবে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে ইলিয়াস গুমের সাথে সরকার জড়িত নয় এবং পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা জবানবন্দী দিয়েছেন। আরেকটি জবানবন্দী এসেছে। তা হলো নিকটস্থ পার্কের বেঞ্চে বসা ছিলেন এক ব্যক্তি, যিনি নিকটস্থ একটি বস্তির বাসিন্দা; কিন্তু রাত ১২টার পরে বস্তিতে ঢোকার অনুমতি নেই বিধায় তিনি ওই বেঞ্চের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। সেখান থেকে একটু দূরে বনানী দুই নাম্বার রোডের স্থানটি, যেখান থেকে ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। একপর্যায়ে উভয় পরে ধস্তাধস্তি, আওয়াজ ও হইচইয়ের কারণে ঘুম ভেঙে যায় এবং এ দৃশ্যটি তিনি নিজ চোখে দেখছিলেন। এসব প্রমাণ জনসপক্ষে প্রকাশ হওয়ার পর সবার চোখ-কান খুলে গেছে এবং কেউ কোনো অবস্থাতেই বলতে পারবে না যে, এই গুমের কোনো সাী-প্রমাণ নেই।
ছোটকালে আমরা অনেক ধরনের গল্পের বই পড়তাম। সবচেয়ে বেশি পড়তাম স্বপন কুমার সিরিজ নামে একটি গোয়েন্দা কাহিনীর বই; সেখানে গোয়েন্দার নাম ছিল দীপক চ্যাটার্জী। এটি অন্তত পঞ্চাশ বছর আগের কথা। পাশাপাশি অপর কয়েকটি সিরিজের নাম ছিল দস্যু বাহরাম, দস্যু বনহুর । তারও বেশ কিছু দিন পরে বাজারে আসে মাসুদ রানা সিরিজ। কথাগুলো এখানে এ জন্যই বললাম, সর্বাবস্থায় আমরা দেখেছি, পৃথিবীর যেকোনো চোর-ডাকাত বা হত্যাকারী বা সন্ত্রাসী যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাক না কেন, তার কোনো না কোনো একটি কু, নিশানা তথা প্রমাণ সে রেখে যায়। এর নামই বোধহয় ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। আর এমনিভাবে ইলিয়াস আলীকে যে অপহরণ করা হয়েছে তারও কু, প্রমাণ বা সাী ওই দু’জন ব্যক্তি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, অপরজন বেঞ্চে বসে থাকা ব্যক্তি। আমি বলতে চাই আজ হোক কাল হোক, এক বছর পরে হোক কিংবা পাঁচ বছর পরে হোক ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার মুখোশ উন্মোচিত হবেই এবং যারা এর সাথে জড়িত তাদেরকে এর জবাব দিতেই হবে। পৃথিবীতে এমন কোনো ইতিহাস নেই যে, মিথ্যার মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। এক মাইল মাটির গভীরে মিথ্যার অবস্থান থাকলেও তা খুঁড়লে সত্য ঘটনা বের হয়ে আসবে। এটাই অনস্বীকার্য বাস্তব তা।
হত্যা ও গুমের রাজনীতি প্রসঙ্গে আজ প্রায় সব পত্রিকায়ই লেখা হচ্ছে। এ েেত্র সরকারপন্থী পত্রিকাও পিছিয়ে নেই। সরকারপন্থী পত্রিকা হিসেবে পরিচিত দৈনিক জনকণ্ঠ, সমকাল এবং অনুরূপ অন্যান্য দৈনিকেও হত্যা, গুম বিষয়ে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে সমকাল পত্রিকায় একটি বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সমকালের সম্মানিত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। কি সরকারপন্থী আর কি বিরোধীপন্থী, আজ সবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন দেয়ার মতো লোকের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। দু’চার-পাঁচজন হয়তো আছেন যারা দেশ-বিদেশে এবং বিভিন্ন জেলা শহরে দলের দায়িত্বে থাকায় অন্য পথ না পেয়ে এখনো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জনগণ তাদের পাশে নেই। তবে হ্যাঁ, দলের পোষা ক্যাডার, যারা টাকার বিনিময়ে তাদের পেশিশক্তি ব্যবহার করে, শাসক দলের প হয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঘায়েল করার জন্য হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়Ñ তাদের কথা আলাদা।
গত কয়েক দিন ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশ আন্দোলনমুখর ছিল। এর মধ্যে যে বিষয়টি আমার মনকে ব্যথিত করে এবং দারুণভাবে নাড়া দেয়, তা হলো পুলিশ বাহিনীর নির্মম নির্যাতন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে সরকারি পোষা ক্যাডারদের পাশাপাশি পুলিশবাহিনী আজ অত্যন্ত দাপুটে মারদাঙ্গা ভূমিকায় চূড়ান্তভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গাছের সাথে বেঁধে, ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে কিংবা বুটের তলায় পিষ্ট করে পেটাচ্ছে। আমার মনে হয়, যেই পুলিশ কর্মকর্তারা এই কাজগুলো করেছেন হয় তারা মস্তিষ্কবিকৃত, নয়তো তারা আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের পাকাপোক্ত ক্যাডার ছিলেন; যাদেরকে সরকার পুলিশ বাহিনীতে চাকরি দিয়ে মাঠে পাঠিয়েছে শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনের জন্য। কারণ কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের লোক এ কাজ কখনো করতে পারে না। সরকারি বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণের প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ইতঃপূর্বে তারা প্রমাণসহ দেশ-বিদেশে সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। 
আগামী দিনে সরকার গঠনের বিষয় পর্যালোচনা করলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সরকার গঠন করবে। আর এ েেত্র সর্বপ্রথম তাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তা হচ্ছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এই সরকারের আমলে যত রাজনৈতিক ক্যাডারকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদেরকে বাছাই করে অপসারণ এবং নানা অপরাধের সাথে যেসব পুলিশ জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক দলীয় ক্যাডারেরা কোনো দিনও নিরপে সরকারি কর্মকর্তা হতে পারে না। রাজনৈতিক মত থাকলেই সরকারি চাকরি করতে পারবে না, এমন কথা বলছি না। বলছি, পেশিশক্তির ব্যবহারকারী রাজনৈতিক বা ক্যাডারের কথা দুর্বৃত্ত। 
পাঠক যখন এই কলাম পড়ছেন, তার ৪৮ ঘণ্টা কিংবা তার কিছু সময় আগে চ্যানেল আইয়ের ‘তৃতীয় মাত্রা’র একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমার পাশে অন্যতম আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপরিচিত মহিলা আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। সেখানে অল্প একটু প্রসঙ্গ উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের তথা ১৯৭১ সালের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কথা। আমি শুধু এটুকু বলার সুযোগ পেয়েছিলাম যে, জনাব তাজউদ্দীনের স্মৃতিকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার সুযোগ্য সন্তান তানজিম আহমদ সোহেল তাজ প্রথমে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন, তারপর সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন; এমনকি পত্রিকায় দেখেছি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার জন্য তিনি নাকি স্পিকার বরাবর অনুরোধও করেছেন ‘যেন তার এই পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রধান স্তম্ভ, সরেজমিন যুদ্ধ পরিচালনা করে যিনি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন সেই মহান নেতার যোগ্য সন্তান কেন বর্তমান স্বাধীনতাবান্ধব সরকারের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন? সোহেল তাজের পদত্যাগের চিঠি প্রকাশিত হয়েছে; সেখানে তিনি কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। তবে বলেছেন এমন কিছু কারণ আছে যা মুখে বলা যায় না এবং রাষ্ট্রের খাতিরে বলাও ঠিক নয়। অবাক হতে হয়! কত বড় রাষ্ট্রীয় কারণ লুকিয়ে থাকলে এমন কথা মুখে বলা যায়? আমার মনে হয়, বলতে পারলে হয়তো তিনি খুশি হতেন। দ্বন্দ্বটা কীÑ আমি জানি না, তবে সন্দেহ করছি দ্বন্দ্বটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৃহত্তর পরিবারের সাথে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী বাকি নেতৃত্বের বর্তমান প্রজন্মের। বৃহত্তর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সংসদ সদস্য শেখ সেলিম, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপসসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন। অপর পে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত নয় কিংবা আত্মীয়স্বজনও নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত তথা এই দলটির ক্রান্তিকালীন নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পরিবার, তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার, কামরুজ্জামানের পরিবার। এদের পরিবারের সাথে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাদের দূরত্বটা কোথায় এবং কত দূর? আমরা ল করেছি, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের বর্তমান মতাসীন আওয়ামী লীগ উপযুক্ত মূল্যায়ন করে না। রণাঙ্গনের একজন জীবিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা দুরূহ ছিল; জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা আর মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ময়দানে থেকে নেতৃত্ব দেয়া, দুটো আলাদা জিনিস। কেন আজ আমরা সেই মহান মুক্তিযোদ্ধা বীর নেতাদেরকে অস্বীকার করছি; তাদের প্রজন্মকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি তা সরকারের কাছে আমার প থেকে একটি প্রশ্ন? আজ এই মহান নেতাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে অনেকেই সরকারের কাছ থেকে চরম অবহেলিত; তাদের কোনো খোঁজখবর নেয়া হয় না। সোহেল তাজের মা জোহরা তাজ আজ চরম অবহেলিত। এমন পরিস্থিতিতে তার পদত্যাগকে সরকার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। সোহেল তাজের প্রতি সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। আরেকটি বিষয় আমার মনে হয়, দেশের স্বার্থবিরোধী এমন কোনো কাজ হয়েছে যা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। তিনি তার পিতার অর্জিত গরিব দেশটির জনগণের সাথে বেঈমানি করতে চাননি। পদত্যাগটি যদি দেশের স্বার্থে হয়ে থাকে তবে বলতেই হয়, সাবাশ ব্যাটা! মহান তাজের বিদ্রোহী তাজ।’ আজ হোক কাল হোক সেই লুকিয়ে থাকা কারণ উন্মোচিত হওয়ার অপোয় থাকলাম। 
আমরা একটি গিরিখাদের মধ্যে বন্দী হয়ে ঝুলন্ত ভাঙা সাঁকোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। আর দু-এক পা অসতর্কভাবে এগোলে আমরা গর্তে নিমজ্জিত হব। বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটি গর্তে পড়ে গেলে তাৎণিক উদ্ধার করার জন্য উদ্ধারকারী দল ও সরঞ্জাম আনতে হবে। রূপক অর্থে বলতে চাই, এই উদ্ধারকারী দল বা সরঞ্জামের জোগানদাতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে অকার্যকর করা এবং দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কারো না কারো স্বার্থ নিহিত। বাংলাদেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে দেশটিকে অকার্যকর করে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে একদল দোসর দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কাছে দেশপ্রেম মূল বিষয় নয়, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের স্বার্থরা এবং বিদেশীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহয়তা করা। খাঁটি দেশপ্রেমিক যারা, তারা আজো বড় ধরনের কোনো প্রতিরোধ কিংবা শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারেননি। তবে আগের চেয়ে অনেক মজবুত হয়েছে তাদের খুঁটি। পাশাপাশি, বর্তমান তরুণসমাজ এবং দেশসেবায় উজ্জীবিত সব দেশপ্রেমীকে আহ্বান জানাচ্ছি এ বিষয়ে চিন্তা করার জন্য। আজ বাংলাদেশের অস্তিত্ব গভীর সঙ্কটের মুখে এবং দেশের স্বার্থ বিঘিœত; জনচাহিদা উপেতি। 
সম্মানিত পাঠকের কাছে একটা গল্প বলি, তা হলোÑ প্যারিস নগরীতে বিশ্ববিখ্যাত একটি স্থাপনা আছে যার নাম আইফেল টাওয়ার। এখন থেকে প্রায় দেড়-দুই যুগ আগে বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন রিডার্স ডাইজেস্টে একটি গল্প পড়েছিলাম; তার শিরোনাম ছিলÑ ‘দি ম্যান হু সোল্ড দি আইফেল টাওয়ার টোআইস’। অর্থাৎ ওই ব্যক্তিটি যিনি আইফেল টাওয়ারকে দু’বার বিক্রি করে দিয়েছেন। আইফেল টাওয়ার প্যারিসের জাতীয় সম্পদ, এটা কারো বাবার সম্পদ নয়। কোনো একজন অতি চতুর প্রতারক আইফেল টাওয়ারকে নিজের সম্পদ বানিয়ে বিদেশী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করার বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং দু-দু’বার সাফল্যের সাথে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তিনি তৃতীয়বার বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় পড়েছিÑ ‘একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছে কোম্পানি জমি কিনেছে, তারপর ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দিয়েছে, ব্যাংকের কাছ থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছে, আবার ওই বন্ধকি জমি কিছু লোকের কাছে বিক্রি করে তাদেরকে রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে; এর সাথে প্রতারণার বিরাট একটি চক্র জড়িয়ে আছে।’
দু-তিন সপ্তাহ আগে ডেসটিনি নামে একটি কোম্পানি নিয়ে অনেক শোরগোল হয়ে গেল। একই নামে তাদের নাকি ১৫-২০টি কোম্পানি আছে। সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল হারুনুর রশিদ বীরপ্রতীক ডেসটিনি গ্র“পের সভাপতি। যুগান্তর পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম চার-পাঁচটা কোম্পানিতে কয়েক লাখ শেয়ার তার আছে। অর্থাৎ জেনারেল হারুনুর রশিদ জেনেশুনেই ওই কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। অনেকে সন্দেহ করে বলে, ওই কোম্পানি একই গাছ কত জনের কাছে যে বিক্রি করছে তা এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। সাধারণ লোকে বলাবলি করে, গাছের নামে বাঁশ লাগিয়ে তা বিক্রি হচ্ছে কি না, তাই বা কে জানে? ডেসটিনি কক্সবাজারে টাওয়ার বানিয়ে সে টাওয়ার ঢাকা শহরে বিক্রি করছে। এভাবেই সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা, এক অভিনব ব্যবসায়িক কায়দায় তারা অগ্রসর হচ্ছে। ডেসটিনির মাধ্যমে অনেক তরুণ ব্যতিক্রমী পন্থায় কর্মসংস্থান বা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন সত্য, তেমনি নিবিড় আশঙ্কা অতীতের ‘যুবক’-এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে কি না।
অনুরূপভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে রূপক অর্থেই যে কেউ বিক্রি করে দিচ্ছে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে? যদি বিক্রি হয়, তবে এমন সুচতুরভাবে সূক্ষ্মভাবে বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে যে, আপনি যত দিনে বুঝতে পারবেন, তত দিনে আর কিছু বাকি থাকছে নাÑ সব বিক্রি হয়ে গেছে। পুনরুদ্ধারের কোনো পথ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, একটি দেশ কিভাবে বিক্রি হয়ে যায়? দেশ বিক্রি মানে দেশের নেতাদের দেশপ্রেম, বিবেকবুদ্ধি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা বিলীন বা বিপন্ন, সর্বোপরি দেশের নেতৃত্ব যখন নতজানু হয়ে বিদেশীদের দোসর হয়ে কাজ করে, দেশের মাটির ওপর দিয়ে যখন কোনো বিদেশীর পদচারণা, ট্রানজিট, খনিজসম্পদ, সমুদ্রসীমা, আকাশসীমা, নৌসীমা অন্য দেশকে বিনামাসুলে বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়। এতই হীনম্মন্যতায় সে পতিত হয়েছে যে, সে নিজকে বাংলাদেশের নাগরিকও বলতে লজ্জাবোধ করে। আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশীÑ রাষ্ট্রীয় মতাধর ব্যক্তিটি যদি এ কথাটি বলতে লজ্জাবোধ করেন; রূপকার্থে হলেও মনে করতে হবে বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে গেছে। কাগজপত্র ও দলিল দিয়ে দেশ বিক্রি হয় না, তখন বিক্রি হয় মানুষের বিবেক। রাষ্ট্রের সর্বত্র আজ এমনটিই দেখা যাচ্ছে। ভারত যদি আমাদের অমীমাংসিত নদীগুলোর পানি না দেয় এবং আমাদের বাধ্য করে যে, পানি পেতে হলে ‘এই এই’ শর্ত মানতে হবে; সে েেত্র নিজের অধিকারের কথা না বলে উল্টো তাদের শর্ত মেনে নিলাম এবং তাদের কাছে মাথা নত করলাম; তার মানে তাদের কাছে আমি বিক্রি হলাম। আর এ কথাটি দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছি, বাস্তবিক আমরা আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি।
এই সঙ্কট থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হলে দেশপ্রেমী সব মানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। তবে সচেতন হওয়ার পথে কয়েকটি জায়গা থেকে বাধা আসছে। সেই বাধাগুলো পদতলে মাড়িয়ে ফেলতে হবে। দেখা গেছে, আমরা যেন সচেতন হতে না পারি সে জন্য আমাদের চিন্তাশক্তিকে ডাইভার্ট তথা ভিন্নপথে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরঞ্জিত বাবুর অর্থ কেলেঙ্কারির দোষ ঢাকতে সিলেটের জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে অপহরণ এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা ও গুমসহ নানা নতুন ঘটনার উদ্ভব। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এক পতাকাতলে জমায়েত হতে হবে; সেই আশায় শেষ করছি। 
লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন