মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

টাকার কথা


সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ১৭-০৪-২০১২

টাকা। দুনিয়ার দুটি সবচেয়ে মধুর শব্দের একটি। বাংলাদেশি মুদ্রার নাম টাকা। আমি যেকোনো দেশের যেকোনো কালের মুদ্রাকেই টাকা বলছি। এই শব্দ কানে গেলে মৃতপ্রায় মানুষও প্রাণশক্তি ফিরে পায়। টাকার আরেক নাম অর্থ। কোনো এক বাঙালি মনীষী বলেছেন, অর্থই অনর্থের মূল।
অর্থ অনর্থের মূল সব ক্ষেত্রে নয়। সবার ক্ষেত্রে তো নয়ই। দৈবাৎ কারও কারও ক্ষেত্রে। অধিকাংশ মানুষের জীবনে টাকা অতি অর্থবহ। হঠাৎ কারও জীবনে অর্থ অনর্থ হয়ে দেখা দিতে পারে দিনের যেকোনো প্রহরে। কখনো অর্থ কারও জীবনে অনর্থ হয়ে দেখা দেয় মধ্যরাতে। লোকনাথ পঞ্জিকামতে, যে রাতগুলোতে যাত্রানাস্তি। মানুষের জীবনে কখনো আসে অমৃতযোগ। কখনো মাহেন্দ্রযোগ। তখন শুধু আসে। জমি আসে, বিল-বাঁওড় আসে, টাকা আসে। 
টাকা দরকার কেনাকাটা করতে। এক দিন কড়ি দিয়ে কেনাকাটা হতো। তারপর মানুষ চালু করল ধাতব মুদ্রা। তামা, রুপা ও সোনার মুদ্রা। এখন কাগজের নোট। কড়ি ও ধাতব মুদ্রা বহন করা হতো থলেতে। বাংলার মাটিতে এখন কাগজের টাকা বহন করতে থলে নয়, ব্যবহূত হচ্ছে বস্তা। পাটের ব্যবহার প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। টাকা বহনের জন্যও এখন পাটের বস্তার প্রয়োজন। এখন থেকে হয়তো পাটচাষিদের উৎপাদন খরচটা উঠবে।
টাকার লোভে জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না মানুষ। টাকার জন্য মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে ছোটে। টাকার জন্য মানুষ জমিজিরেত বেচে শরীরের শ্রম বেচতে যায় প্রিয়জন ফেলে দূর দেশে। টাকার কারণে মানুষ রাজ্যপাট হারিয়ে, স্বজন ছেড়ে নির্বাসিত হয় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে। বস্তা বস্তা টাকা আছে বলেই সেখানে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে আরামে থাকা যায়। কারও কারও টাকার প্রয়োজন হয় পেটের চারটে ভাতের জন্য। তাই পৃথিবীর লাখ লাখ নারীর দেহের মতো পবিত্র জিনিসকে অপবিত্র করতে হয়। কিন্তু জগতের অনেক মানুষের কাছে টাকাটা প্রয়োজনের জিনিস নয়—টাকা তাদের কাছে নেশার দ্রব্য।
পৃথিবীর ৯৯ ভাগ মানুষের জীবনে অর্থের অভাবই বড় সমস্যা। হাজারে একজনের জীবনে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’। জগতে এমন কেউ কেউ আছেন, যিনি নিজে টাকাকে মূল্য না দিলেও তাঁর ছেলেরা বউ-বাচ্চা নিয়ে পরবাসে নির্বাসনে থাকলেও টাকার অভাবে তাঁদের কোনো প্রবলেম হয় না।
বহুকাল আগে মানুষ পকেট ছাড়া আমার মতো থান কাপড় পরত। শুধু টাকা রাখার জন্যই জামায় পকেটের জন্ম। আবার টাকার জন্যই মানুষ পকেট কাটে। টাকা না থাকলে দুনিয়ায় পকেটমার থাকত না। এক দেশ থেকে আরেক দেশে খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল পাচার হয় না—পাচার হয় টাকা।
জনগণের সেবক হিসেবে তাদের প্রতিনিধি হয়ে নির্বাচিত হতে টাকা লাগে। নমিনেশন কিনতে টাকা লাগে বস্তাভর্তি। নির্বাচন করতে টাকা লাগে বস্তা বস্তা। তবে একবার জনপ্রতিনিধি বা জনসেবক হলে টাকা আসে বানের পানির মতো। উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের মতো। এমপি হলে যত টাকা আসে, মন্ত্রী হলে আসে তার ১০ গুণ। এক শ গুণও হতে পারে। টাকার কারণেই বহু গণতান্ত্রিক দেশে অনেকের মন্ত্রিত্ব চলে যায়। কোনো কোনো নির্ভেজাল গণতন্ত্রে টাকা তো তুচ্ছ—খুনের কারণেও মন্ত্রিত্ব যায় না, এমপিত্ব যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
শুধু মন্ত্রী-উপদেষ্টা-এমপি নন, আমলা হলেও টাকা আসে। মন্ত্রীর এপিএস হলে তো কথাই নেই। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউএনও, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার হলেও টাকা আসে। কারও কারও আলমারি ভরে যায় টাকায়। চাকরিতে যত উপরে ওঠা যাবে, তত টাকা। কোথায় টাকা নেই? দারোগা-পুলিশের চাকরিতে টাকা। শিক্ষা কর্মকর্তা হলে টাকা। রেল কর্মকর্তা হলে টাকা। আবগারিতে টাকা। বাংলায় মন্ত্রী হলেও টাকা। মিটার রিডার হলেও টাকা। এ দেশ রত্নপ্রসবিনী। হিসাববিহীন টাকা। বনবাবু হলে টাকা। তার বালিশের খোলে টাকা। বাথরুমে টাকা। টয়লেট পেপার আর টাকা পাশাপাশি। তোষকের তুলার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে টাকা। মাইক্রোবাসের মধ্যে বস্তায় টাকা।
টাকার যেন পাখা আছে। সে উড়ে আসে বড় বড় ব্রিজের টেন্ডারদাতাদের থেকে। টাকা আসে সড়ক ও জনপথ থেকে। টাকা আসে গণপূর্তের ইমারতগুলোর ইটের ভেতর থেকে। টাকা আসে সমুদ্রের উত্তাল বক্ষে ব্লক ইজারা দেওয়া থেকে। কখনো আসে গ্যাসের কূপ থেকে। কখনো আসে এবং অতিদ্রুত আসে রেন্টাল ও কুইক রেন্টার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেকে। যাদের ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন নেই, তাদের টাকা আসে স্কুলের ভর্তি-বাণিজ্য থেকে। যাদের কোনো পদপদবি নেই, তাদের টাকা আসে তদবির-বাণিজ্য বা দালালি থেকে। টাকা আসে পরিবহনশ্রমিক নেতাদের থেকে। টাকা আসে ঘুষ থেকে। বিভিন্ন কেনাকাটার কমিশন থেকে। নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য থেকে যে টাকা আসে, তা রাখার জন্যই প্রয়োজন হয় পাটের অথবা প্লাস্টিকের বস্তার। আর টাকা আসে অবাধ ও নিরপেক্ষ চাঁদাবজি থেকে।
টাকার উৎসের তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। কারও কারও টাকা আসে ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে; দেবোত্তর সম্পত্তি ও শ্মশানের জমি থেকে অথবা অর্পিত সম্পত্তি থেকে। কখনো টাকা আসে মৎস্য ও কৃষি খামার থেকে। কখনো সুপার মার্কেট থেকে।
দেশ স্বাধীন করেছি কি ঘাস খেতে? টাকার টিলা বানাতে চাই। নেমে পড়ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে এমএলএম (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং) ব্যবসায়। বহুমাত্রিক ব্যবসা। এমএলএম-বাণিজ্যে বিল গেটস বা মুকেশ আম্বানি হতে সময় লাগে মাত্র ৩৬ মাস। রাতারাতি না হলেও মাসামাসি হাজার হাজার একর জমির মালিক হওয়া কোনো সমস্যাই নয়। আমাদের এই রাষ্ট্র তো সেই সুযোগ ও অধিকার আমাদের দিয়েছে। আপনার রেলের জমি লিজ চাই? আনুন বস্তায় টাকা। যান, গিয়ে গড়ে তুলুন অবৈধ স্থাপনা। টাকা সব পারে।
টাকা মানেই ‘ব্যক্তিগত’ টাকা। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক তাতে হাত দিতে পারে না। টাকা যার হেফাজতে থাকবে, টাকা তার। ব্যক্তিগত টাকা অথবা লন্ডন থেকে ভাইয়ের পাঠানো টাকাও বস্তায় ভরে দিনদুপুরে মাথায় বা কাঁধে বা পিঠে বহন করা শোভন নয়। গাড়িতে টাকা বহনে কি বা দিন আর কি বা রাত্রি।
যে গাড়ির পেটে টাকা আছে, তার তেজ আলাদা। পেট্রলের চেয়ে টাকার জোর বেশি। যে মাইক্রোবাসের পেটে টাকা আছে, তা সোজা চলে না। তার যদি ডান দিকে মোড় নেওয়ার কথা থাকে তো সে ধা করে মোড় নেয় বাঁয়ে। ঢোকার কথা কোনো এক বাড়ির গেটে, তা গিয়ে সিংহের মতো গর্জন করে ঢুকে পড়ে এক প্রকাণ্ড ফটকে। মুহূর্তে সব ওলটপালট হয়ে যায়।
বাংলার মাটিতে যার বস্তা বস্তা টাকা আছে, তাকে পক্বকেশ নীতিবাগীশও জিজ্ঞেস করেন না: এ টাকা এত তাড়াতাড়ি তুমি কীভাবে কামাই করলে? এ টাকা কি তোমার বাবা বা বাবামহ অথবা শ্বশুর বা শ্বশুরমহ রেখে গেছেন? এত টাকার তোমার প্রয়োজনই বা কী? অবশ্য জিজ্ঞেস করলেও সোজা জবাব আসবে: জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করব চেতনা বাস্তবায়ন করতে। টাকার দরকার। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করব, টাকার দরকার। যে নেতাকে এক দিন গালাগালি করেছি, তারই আদর্শ আজ বাস্তবায়ন করতে ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে যাচ্ছি। টাকা ছাড়া ওসব হবে না।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাঁরা টাকা কামাই করেন, তাঁদের মানুষ শ্রদ্ধা করে। টাটা, বিরলা, আম্বানি, আদমজী, বাওয়ানি, ইস্পাহানি, জহুরুল ইসলাম, রণদা প্রসাদ সাহার টাকার উৎস নিয়ে কেউ কথা বলে না। তাঁদের টাকা বস্তায় থাকে না—ব্যাংকে থাকে। হাতখরচের জন্য অল্প কিছু টাকা থাকে ঘরে।
বিড়াল দুই প্রকার: সাদা ও কালো। টাকাও দুই প্রকার: সাদাটাকা ও কালোটাকা। সরকার যতই সুযোগ দিক, কালো বিড়ালকে সাদা করা যাবে না। কিন্তু বাংলার মাটিতে কালোটাকাকে ধলা করা যায়। বিড়ালের পা চারটি। তাই দিয়ে সে এক জায়গা থকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করে। কালোটাকার পা আটটি। অথবা কালোটাকার আছে পাখির মতো ডানা। তাই দিয়ে সে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে।
গত ১৬৯ সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় টেলিভিশনের পর্দা থেকে উচ্চারিত হচ্ছে অমুকে ‘টাকাচোর’, ‘টাকা মারে’, ‘মানি লন্ডারিং করে’, ‘চোরের মা’ প্রভৃতি শব্দ ও বাক্যাংশ। অবুঝ বালক-বালিকারা বিশ্বাস না করে পারে না যে টাকা মারামারি জিনিসটি ২০০৬ সালেই শেষ হয়ে গেছে। টাকার ইংরেজি নাম মানি। সেই মানি জিনিসটি যে লন্ডারিং করা যায়, তা এখন কেরানির বাড়ির কাজের মেয়েটিও জেনে গেছে।
টাকার কারণে জগতে কত কিছু ঘটে। টাকার কারণে শেয়ারবাজারে আগুন লাগে। লাখ লাখ গরিব মানুষের টাকা গিয়ে জমা হয় ১০ জন স্বাধীনতাপ্রেমীর আলমারিতে। সেখান থেকে বিদেশি ব্যাংকে। রাজনীতির ভেতরে যে মধু আছে, সেই মধুর নামই টাকা। এমপি হিসেবে শপথ নেওয়ার প্রথম ২৫ সপ্তাহে যত টাকা থাকবে ঘরে ও ব্যাংকে, পরবর্তী ২৫ সপ্তাহে তার ২৫ গুণ। তার পরবর্তী প্রতি সপ্তাহে টাকা বাড়তে থাকবে পাঁচ গুণ করে। অর্থাৎ, ২৬০ সপ্তাহে টাকা বাড়বে ২৬০ গুণ বা তারও বেশি। জনসেবার সামান্য উপহার।
ভিড়ের ভেতরে ৪২০ টাকা পকেট মেরে ধরা পড়লে তাকে এই সুন্দর নীতিবান সমাজ পিটিয়ে মেরে ফেলে। হাসতে হাসতে জনগণের ৪২০ কোটি টাকা মারছেন যে লোক, তার সঙ্গে করমর্দনের জন্য হাত নিশপিশ করে সবচেয়ে নীতিবাগীশ সর্বজনশ্রদ্ধেয়ের। এ সমাজে যার বস্তা বস্তা টাকা, তাকে কুর্নিশ করে সমাজপতিরা। টাকা থাকলে বন্ধুর অভাব হয় না।
তবে বুদ্ধিমান বাঙালি বুদ্ধিদীপ্ত প্রবচন বের করে বেশ! চোরের দশ দিন আর গেরস্তের এক দিন। টাকাচোরও ধরা পড়ে। টাকাখোরকেও ধরা খেতে হয়। ধরা পড়া মানে বিপদে পড়া। যার টাকা আছে, সাধারণত বিধাতা তাকে বিপদে ফেলতে ভয় পান। কিন্তু তাকে বিপদে ফেলতে পারে ত্যাঁদড় মানুষ, অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের লোক।
কবি ও কলামলেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া এখন এই বঙ্গের মানুষের জীবন অচল। তিনি জানতেন, যুগে যুগে বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর প্রয়োজন হবে। কোনো মন্ত্রী টাকাসংক্রান্ত ব্যাপারে সাময়িক বিপদে পড়লে তাঁকে তাঁর সান্ত্বনা দিতে হবে। বিশ্ববিধাতার কাছে প্রার্থনার গানটি বিশ্বকবিই লিখে গেছেন: 
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
বিপদ কেটে যাবে। পদ বা মর্যাদা থাকুক বা না থাকুক, টাকা থাকবে। দুঃখকে জয় করতে টাকার চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কিছু নেই। বিশ্ববিধাতা যতই সাময়িক বিরূপ হোন, বিশ্বকবির অনুরোধ তিনি ফেলতে পারবেন না। সাময়িক ব্যথিত চিতের দুঃখ দূর হবেই। দুঃখ থাকবে না, থাকবে শুধু টাকা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন