সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

ইলিয়াস আলীর গুম, বিরোধী দল নির্মূল ও একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা


মো. নূরুল আমিন

গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার দাবিতে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন আঠারদলীয় জোট আহূত দ্বিতীয় দফা হরতালের দ্বিতীয় দিনে আমি যখন এই কলামটি লিখতে বসেছি তখনও পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোন সন্ধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা তার অধীনস্থ কোন সংস্থা দিতে পারেনি। তবে আজ (সোমবার) সকালে টেলিভিশন চ্যানেলসমূহে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে যে খবরটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে সেটি হচ্ছে- বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, অব: ব্রিগে: জেনারেল হান্নান শাহ, রুহুল কবীর রিজভী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর দু'টি থানায় ককটেল বিস্ফোরণ, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার আসামীদের মধ্যে এলডিপি প্রধান ড. কর্নেল অলি আহমদও আছেন। কর্নেল অলি আহমদ একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর প্রতীক খেতাবধারীও। বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে এই মামলাগুলো দেয়ার পর অনেকেই এখন নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, ইলিয়াস আলীর সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো এখন তিরোহিত হয়েই যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দেশব্যাপী এখন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের চিরুনি অভিযান শুরু হবে।
ভারতবর্ষসহ আমাদের এই অঞ্চলে একসময় নরবলি প্রথা চালু ছিল। বিভিন্ন কাজ ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে নরবলি দেয়া হতো। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনও কিছু লোকের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, বড় বড় পুল ও বৃহৎ নির্মাণ কাজকে টেকসই করার জন্য নরবলি দেয়া অপরিহার্য। ঐ সময়ে ছেলেধরাদের উৎপাত ছিল লক্ষণীয়। পল্লী এলাকায় ছেলেধরারা ছোট ছোট ছেলেদের ফুসলিয়ে কিংবা জবরদস্তি অপহরণ করে ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতো। ঠিকাদাররা নির্মাণ স্থাপনা বা ব্রিজের ফাউন্ডেশনের তলায় তাদের বলি দিতো। এতে নাকি দেবতারা তুষ্ট হতেন এবং এর ফলে ঐ স্থাপনা টেকসই ও মজবুত হতো। এই নির্মম কাজে গ্রাম এলাকার বহু শিশু ঠিকাদারদের বলির শিকার হয়েছিল এবং অনেকের পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজন পাগলও হয়ে গিয়েছিলেন। কালপরিক্রমায় এই কুসংস্কারটি বাংলাদেশ থেকে দূরীভূত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন ছেলেধরা ও অপহরণকারীদের একটি অংশ বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে ছেলেমেয়েদের অপহরণ করে এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই অপহরণকারীদের খপ্পর থেকে আমাদের সরকার প্রধানের বাবুর্চীর মেয়েও রক্ষা পায়নি। কিছুদিন আগে তাকে মুম্বাইয়ের নিষিদ্ধ পল্লীতে পাওয়া গিয়েছে। তবে ছেলে ও মেয়ে শিশু অপহরণ ছাড়াও এখন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর নাম ও পদ ব্যবহার করে একশ্রেণীর অপহরণকারীর দৌরাত্ম্য বেড়েছে বলে মনে হয়। এরা রাজনীতিবিদদের অপহরণ করে গুম করে দিচ্ছে। অপহৃত এসব ব্যক্তিকে এখন ব্রিজ বা বড় ধরনের স্থাপনা নির্মাণের বেদীতে বলি দেয়া হচ্ছে না। তাদের বলি দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক দলসমূহের ক্ষমতায় টিকে থাকার দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের বেদীমূলে। ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার, সিলেটের ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন  শিবির নেতাসহ গত এক বছরে অপহৃত শতাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মী এই ক্ষমতা প্রকল্পের বলি হয়েছেন কিনা আমি জানি না। তবে ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে যে, তাদের বলি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আরেকটি কথা। বিএনপি ও আঠারদলীয় জোট ইলিয়াস আলীর গুমকে ইস্যু করে তার মুক্তির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন শুরু করেছে তাকে ভন্ডুল করার জন্যে সরকার বিএনপি'র সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে যে মামলা দিয়েছে তা তাৎপর্যপূর্ণ। গতবছর একই ধরনের ঘটনায় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং দলটির কেন্দ্রীয় ও মহানগরী দফতর পুলিশ কর্তৃক অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয়া এবং অন্য নেতা-কর্মীদের পাইকারীভাবে গ্রেফতার করায় যারা উল্লসিত হয়েছিলেন কিংবা চুপ ছিলেন তাদের অনেকেই এখন সরকারের আসল উদ্দেশ্য উপলব্ধির চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী অপহরণ ও গুম রহস্যের উন্মোচন এবং তাকে ফেরত দেয়ার জন্য প্রদত্ত আলটিমেটামের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় দফা হরতালের কথা বলছিলাম। হরতালের আগের দিন অর্থাৎ গত শনিবার দেশের বিভিন্নস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাহিনী হরতাল সমর্থকদের উপর একাধিক হামলার খবরও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ উপলক্ষে আঠারো দলীয় জোটের অসংখ্য নেতাকর্মী যেমন হতাহত হয়েছেন, তেমনি তাদের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতারেরও শিকার হয়েছেন। সারাদেশ এখন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। সরকারের দুঃশাসন, সরকারি দল ও আইন-শৃক্মখলা রক্ষাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে হত্যা-গুম, অপহরণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারাদেশ যেমনি প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং মন্ত্রীদের রাজপথে লাঠি নিয়ে বিরোধীদলের আন্দোলন প্রতিহত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেশকে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ, এমনকি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হয়। দেশের মানুষ এখন চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। খুন, ডাকাতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এবং নারী নির্যাতনসহ সবক্ষেত্রেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার্বিক আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়েছে। সহযোগী দৈনিক যুগান্তরের এক সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর আতঙ্কগ্রস্ত রাজনীতিবিদরা অনেকেই রাতের বেলা বাসা থেকে বের হতে ভরসা পাচ্ছেন না। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) শুক্রবার ২৭ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেছে, এম ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সরকারকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭০৩২ জন আসামীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় যাদের নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই হত্যাকান্ডসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চাঞ্চল্যকর দুটি হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ২২ আসামীকে দন্ডাদেশ মওকুফ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতাসহ ১১৮ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সূত্র জানিয়েছে। তাছাড়া ৩ হাজার ৪১২ জন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে। কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ইশারায় তদন্ত করতে হয় পুলিশ ও র‌্যাবকে। ফলে ঘটনাগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস মনে করেন যে, বাংলাদেশে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা-গুমের নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। গত ১৭ এপ্রিল গাড়ি চালকসহ জনাব ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ সরকার দিতে পারেননি। বলাবাহুল্য, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই মানবাধিকার সংস্থাটির রিপোর্টে বিস্ময়ের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে বলেছেন সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং আন্দোলনের ইস্যু তৈরির জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সনের নির্দেশে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক লুকিয়ে রয়েছেন। সংস্থাটির মতে এই বিষয়টি আশ্চর্যজনক।
আশ্চর্যজনক শুধু প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যই নয়, পুরো ঘটনাটি প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ইলিয়াস আলী যখন অপহৃত হন তখন অকুস্থলের নিকটেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা ডিউটিরত ছিলেন। তিনি হৈ চৈ শুনে অতিদ্রুত সেখানে যান এবং ইলিয়াস আলীকে জোরপূর্বক গাড়িতে তোলার প্রাক্কালে এক ব্যক্তিকে ধরে ফেলেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যায়েই অপহরণকারীরা তাদের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা বলে দাবি করে এবং পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে তাকে সরে যেতে বলে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা অপহরণের কাজে ব্যবহৃত গাড়ির মধ্যেও একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় সংক্রান্ত কিছু সামগ্রী দেখতে পান এবং পিছু হটে আসেন। পুরো বিষয়টি পার্শ্ববর্তী এলাকার একজন ডাব বিক্রয়কারী প্রত্যক্ষ করেছেন এবং পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ির এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তা ধারণও করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, এদের সবাই এখন নিখোঁজ। প্রত্যক্ষদর্শী নিখোঁজ ডাব বিক্রেতা সোহেল রানার পিতা রহমত আলীর অভিযোগ অনুযায়ী পুলিশ সনি ক্লাব থেকে তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। সোহেল ২৫ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ। বনানী থানার অফিসার ইনচার্জের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তারা তাকে ছেড়ে দিয়েছে, হয়ত অন্য কোনো এজেন্সি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সোহেলের পিতা বলেছেন যে, পুলিশ তার ছেলেকে ছাড়েনি। গত শুক্রবার রাতে ছেলেকে দেখতে গেলে তাকে শনিবার ১২টায় যেতে বলা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলা হয়েছে যে আগামী ১০ দিনের মধ্যেও পুলিশ সোহেলকে ছাড়বে না। এই এক অদ্ভুত কান্ড। পুলিশ ইচ্ছামত লোকজনকে গ্রেফতার করে লুকিয়ে রাখছে। দেশের আইন-কানুন সংবিধানের কোনও তোয়াক্কা করছে না। তাদের আত্মীয়-স্বজন আহাজারী করছেন। আমাদের সংবিধানের ৩৩নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে গ্রেফতারকৃত কোনও ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের এবং তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এতে আরো বলা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাবে না। আমাদের সরকার তার পুলিশ ও আইন-শৃক্মখলা বাহিনী সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি মানছেন না। একইভাবে তারা মানছেন না এ ব্যাপারে প্রদত্ত দেশের উচ্চ আদালতের দিক-নির্দেশনাও।
ইলিয়াস আলীর গুমের রহস্যটি উদঘাটিত হবার সম্ভাবনা খুবই কম বলে আমার ধারণা। এর কারণ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে কিছুটা উল্লেখ করা হয়েছে। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্যটি করেছেন সেটি ছিলো এই যে, আন্দোলনের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রেখে তাকে অপহরণ ও গুম করা হয়েছে বলছেন বলছেন। পাশাপাশি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তিনি তার সন্ধান করার জন্য আইন-শৃক্মখলা বাহিনীকেও নির্দেশ দিয়েছেন। তার এই নির্দেশের যৌক্তিক যে তাৎপর্য তা হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেত্রী যেসব স্থানে তাকে লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনা আছে প্রাথমিকভাবে সেসব স্থান থেকে তাকে খুঁজে বের করা। কিন্তু ইলিয়াস আলীর গুমের দু'সপ্তাহ পরও তাকে বের করা যায়নি অথবা তাকে বের করা হয়নি। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় সরকারি নেতারা বলছেন যে, ইলিয়াস আলীর অপহরণ বা গুমের সাথে বিএনপি জড়িত রয়েছে। যদিও তাদের কেউই এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোন প্রমাণ জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেননি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আইন-শৃক্মখলা রক্ষাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মতামতের বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে বা বলতে পারেন কিনা। এর একমাত্র উত্তর না। কেননা, তাদের ঘাড়ে একটি মাত্রই মাথা রয়েছে, দু'টি নয়। দেশের গণমাধ্যমসমূহ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আইনজীবী এবং সুশীল সমাজের বৃহত্তর অংশ মনে করেন যে, ইলিয়াস আলীকে সরকারি বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে এবং কয়েকটি পত্রিকায় তাদের দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী এবং বেশকিছু আলামতেরও উল্লেখ করেছে। আইন-শৃক্মখলা রক্ষাবাহিনী বা পুলিশ তাদের তদন্ত বা অনুসন্ধানে যেহেতু নিরপেক্ষ হতে পারছে না সেহেতু ইলিয়াস আলীকে জনসম্মুখে আনা কিংবা তার অপহরণের ব্যাপারে তদন্তে প্রাপ্ত প্রকৃত তথ্যও তুলে ধরতে পারছে না। কেননা এ তথ্য হয়ত প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের মন্তব্য ও বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। এ অবস্থায় ইলিয়াস আলী সমস্যার আশু কোন সমাধান হবে বলে মনে হয় না। উপরের অনুমান আরও দৃঢ় হয় যখন দেখা যায় সরকার এই নির্মম ঘটনাটির সুরাহার পথে না গিয়ে ব্যাপক হামলা-মামলার পথ অনুসরণ করছেন। এই পথ শান্তির পথ নয়। সংঘাত ও হানাহানির পথ এবং সংঘাত ও হানাহানি শুরু হলে তা থেকে ফিরে আসা অত্যন্ত কষ্টকর। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অশনি সংকেত হয়ে থাকবে। বিরোধী রাজনীতিকরা এর শিকার হচ্ছেন। তারা নিরাপত্তা বঞ্চিত। কিন্তু এর ঢেউ যে সরকারি দলের ওপর পড়বে না তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক প্রবণতা নয়। সরকারি দল মনে করছেন বিরোধী দলকে নির্মূল করে অনন্তকাল তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দিকেই তারা এগুচ্ছেন বলে মনে হয়। ৩০ এপ্রিল সোমবারের দৈনিক যুগান্তরের ৮ম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সিঙ্গেল কলামের একটি খবরের প্রতি আমি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ‘‘চৌদ্দগ্রামের বিএনপি নেতাকে জুতারমালা পরিয়ে দল না করার হুঁশিয়ারি’’ শিরোনামে প্রকাশিত এই রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারকে সরকার দলীয় ছাত্রলীগ নামধারী নেতাকর্মীরা বেধড়ক মারধর করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে রোববার হাসান শাহরিয়ার একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংবাদ সম্মেলনে হাসান শাহরিয়ার অভিযোগ করে বলেছেন, বুধবার ছাত্রলীগ নামধারী কাজী রিয়াদ, ইসমাইল, সায়মনসহ ১৫/২০ জন নেতাকর্মী তাকে জোরপূর্বক অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে এবং বেদম মারধর করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হুমকি দিয়ে বলে, ভবিষ্যতে যেন বিএনপির রাজনীতি না করি। যদি এ কথার পরও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকি তাহলে তাকে ইলিয়াস আলীর মত গুম করা হবে। এ ঘটনার পরে হাসান শাহরিয়ার জীবনের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবিতে শনিবার চৌদ্দগ্রাম থানায় অভিযোগপত্র দায়ের করেছেন। খবরটির শিরোনামের উপরেই গলায় জুতার মালা পরা অবস্থায় বিএনপি নেতা হাসান শাহরিয়ারের একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। এই খবরটি থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ইলিয়াস আলী গুমের ম্যাসেজটি তার তাৎপর্যসহ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং ঐ পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী নেতাকর্মীরা বিশ্বাস করে যে, ইলিয়াসকে তারা অর্থাৎ তাদের দলীয় সরকারই গুম করেছে। এর পর আর মন্তব্য করা নি্রয়োজন।
শেষ করার আগে শেখ সাদীর একটি গল্প বলি। একবার একটি বণিক দল বাণিজ্য সফরে বেরিয়েছিলেন। কয়েক ক্রোশ যাবার পর একদল ডাকাত প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের পথ আগলে ধরে এবং সর্বস্ব কেড়ে নিতে উদ্যত হয়। এই অবস্থায় বণিক দলের একজন প্রবীণ সদস্য আক্ষেপ করে বলে উঠেন যে, সারাজীবন শুনে এসেছি চোর-ডাকাতরা গৃহস্থ ও ভালো মানুষদের ভয় করে এবং তাদের দেখলে পালায়। এখন দেখছি জামানা পাল্টে গেছে। তারাই এখন আমাদের তাড়াচ্ছে। আমাদের সমাজের অবস্থাও এখন অনেকটা এরকমের হয়ে পড়েছে। দাগী অপরাধী ও চোর-ডাকাতরা সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে সজ্জনদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে এবং তাদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং গুমের শিকার বানাচ্ছে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করাই হচ্ছে পুলিশের কাজ। পুলিশের লোকেরা এখন শিষ্টদের দমন করছে দুষ্টকে করছে লালন-পালন। একজন মন্ত্রী ঘুষ কেলেংকারির ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য একজন রাজনীতিককে গুম করা তারই প্রমাণ। এই অবস্থার অবসান ঘটানোর দায়িত্ব শুধু ১৮ দলীয় রাজনৈতিক জোট বা নেতাদের নয়, ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যেকের। তারা কি তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন না।

বাংলাদেশে পহেলা মে



বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশে পহেলা মে যেভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে, লাল টুপি পরে বড় বড় মিছিল ও সভা করে পালিত হয় তা থেকে বোঝা মুশকিল শ্রমিকরা এখানে কতখানি শোষিত ও নির্যাতিত। বোঝা মুশকিল এখানে প্রকৃত শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন বলে কিছু নেই। কাজেই যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চান তাদের কর্তব্য হলো, শুধু কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে খোদ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা। যত দ্রুত সম্ভব শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, নিজেদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি, সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালীভাবে সংগঠিত করা


বাংলাদেশে পহেলা মে দিবসে নানা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায়। কট্টর শ্রমিকবিরোধীদের শাসন বলবৎ থাকলেও এ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর থেকেই এখানে পহেলা মে সরকারি ছুটি। পহেলা মে উপলক্ষে এখানে যে সভা-সমিতি-অনুষ্ঠান ইত্যাদি হয় সেগুলোর মধ্যে জৌলুসপূর্ণ অধিকাংশই হয় শিল্প-বাণিজ্যের মালিকশ্রেণী ও সরকারি লোকদের উদ্যোগে! এসব সভা-সমিতি অনুষ্ঠানে ধুয়োর মতো করে শ্রমিকদের বলা হয় উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে, কলকারখানায় ও সব ধরনের শ্রমিক অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে! কোনো কোনো অতি উৎসাহী এই দিবসে শ্রমিকদের ধর্মঘট না করার উপদেশও দিয়ে থাকেন! এসব দেখে মনে হয় বাংলাদেশে মে দিবস মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূল স্তম্ভের মধ্যে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করে একটি 'সমাজতান্ত্রিক' রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে পহেলা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। এই কাজ করার অল্পদিন পরই ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে টঙ্গী শ্রমিক এলাকায় জিন্নাত টেক্সটাইল মিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি আলী আজমসহ কয়েকজন শ্রমিক নিখোঁজ হন। পরে আলী আজমের মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। অন্য কারও কোনো খবর আর না পাওয়ায় ধরে নেওয়া হয় যে, তাদের গুম-খুন করা হয়েছে। সে সময় ১ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে আমি ইংরেজি দৈনিক হলিডে পত্রিকায় গঁৎফবৎ রহ ঞড়হমর নামে একটি প্রবন্ধ লিখি।
এরপর ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডুতে আরআর জুট ও টেক্সটাইল মিলে শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বিরোধীদলীয় শ্রমিক সংগঠন একেবারে ভেঙে দিয়ে সরকারি শ্রমিক সংগঠনের আধিপত্য ওই শ্রমিক অঞ্চলে স্থাপন করা। এর কয়েক মাস আগে খুলনার শ্রমিক অঞ্চলে একই রকম ঘটনা ঘটে। সেখানে শ্রমিকদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়। তাদের লাশ নদীতে ফেলা হয়। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের কালুরঘাট শ্রমিক অঞ্চলে শ্রমিকদের ওপর একই ধরনের সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়। বাড়বকুণ্ডুতে শ্রমিকদের ওপর যে সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়েছিল তা অন্য জায়গায় এই ধরনের আক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক ব্যাপক ছিল। বহু শ্রমিক এই ঘটনায় হতাহত হয়েছিলেন। সে সময় ঞযব ইধৎধনশঁহফধ ওহপরফবহঃ নামে এর ওপর আমার একটি প্রবন্ধ হলিডেতে প্রকাশিত হয়েছিল ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ তারিখে।
১৯৭৩ সালের ৫ এপ্রিল টঙ্গীতে 'বাংলা শ্রমিক ইউনিয়ন'-এর সদস্যদের ওপর সরকারি শ্রমিক ইউনিয়ন ও পুলিশ এক সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে বিরোধী শ্রমিক সংগঠনটিকে টঙ্গী থেকে কার্যত উৎখাত করে। সেদিন দুপুরে টঙ্গীর শিল্প কারখানা অঞ্চলে বিরোধী শ্রমিকদের নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়। তাদের বাড়িতে বাড়িতে পর্যন্ত ধাওয়া করে সমগ্র এলাকা ছাড়তে এমনভাবে বাধ্য করা হয় যাতে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের পরিবারসহ হেঁটে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা উপস্থিত হন। প্রথমে শ্রমিক ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে। তিনি তাদের সুবিচারের আশ্বাস দেন। পরে এই হাজার হাজার শ্রমিক নিজেদের পরিবারসহ ঢাকা স্টেডিয়ামে আশ্রয় নেন এবং সেখানে তারা দু'দিন তিন রাত অবস্থান করেন। এ সময় ঝঃড়ৎস ঃৎড়ড়ঢ়বৎ ড়ঢ়বৎধঃরড়হ রহ ঞড়হমর নামে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি ৮ এপ্রিল হলিডে পত্রিকায়। এখানে উলি্লখিত এই তিনটি প্রবন্ধই আমার চড়ষরঃরপং ধহফ ঝড়পরবঃু রহ ইধহমষধফবংয নামক বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে ('ঝঁনধৎহধ', উযধশধ)।
মে দিবস উপলক্ষে অন্য আলোচনার আগে ১৯৭২-৭৩ সালের এসব শ্রমিকবিরোধী তৎপরতা এবং সশস্ত্র আক্রমণের বিষয় উল্লেখ করার কারণ, বাংলাদেশে মে দিবস উপলক্ষে শাসকশ্রেণী ও সরকারের বিভিন্ন মঞ্চ থেকে যাই বলা হোক, শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ ও শ্রমিক শোষণ এমন পুরোদস্তুর চললেও এটা নতুন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময় থেকেই শাসকশ্রেণী ও সরকার কর্তৃক শ্রমিকদের ওপর এই আচরণ নিষ্ঠুরভাবে শুরু হয় এবং তার ধারাবাহিকতাই এখনও পর্যন্ত চলে আসছে।
যারা প্রগতিশীল তাদের মে দিবস পালনের উদ্দেশ্য ২০১২ সালে এসে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এর জন্য আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশকে বর্তমানে শ্রমিকদের অবস্থার দিকে তাকাতে হবে। তাদের আন্দোলন ও সংগঠনের অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে। শ্রমিকদের ওপর মালিকশ্রেণী ও সরকারের আক্রমণের বিষয়টি উপস্থিত করতে হবে।
বাংলাদেশে শিল্প শ্রমিকদের অবস্থা এখন প্রকৃতপক্ষে খুব খারাপ। তাদের প্রকৃত মজুরি এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা ১৯৬৯-৭০ সালে পাকিস্তান আমলে শ্রমিকদের মজুরির থেকে অনেক কম। সে সময় নূর খান কমিশন শিল্প শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ধার্য করেছিল মাসিক ১৫৫ টাকা। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যে হারে হয়েছে তাতে এখনকার শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি তখনকার ১৫৫ টাকার থেকে অনেক কম। অথচ তখনকার অবস্থা পরিবর্তনের জন্যই ১৯৭১ সালে শ্রমিকরা অন্য সকলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের উন্নতির অনেক স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন। সে স্বপ্ন তাদের অনেক আগেই ভঙ্গ হয়েছে।
মালিকরা ও তাদের সরকার তো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে থাকবেই। কাজেই তাদের বর্তমান দুরবস্থা শুধু সরকার ও মালিকশ্রেণীর নীতি ও কার্যকলাপের দ্বারাই ব্যাখ্যা করতে যাওয়া ঠিক নয়। এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বর্তমান বাংলাদেশে কোনো প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন না থাকা। এই অনুপস্থিতিই শ্রমিক পরিস্থিতিকে সংকটজনক করেছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রার শুরুতেই তৎকালীন সরকার শ্রমিকদের ওপর নিষ্ঠুর ও সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে বিদ্যমান শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ভেঙে দিয়ে নিজেদের সংগঠন শ্রমিক লীগকে সব অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সরকারি শ্রমিক সংগঠন যে শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করবে না এবং দালালদের দ্বারাই পরিচালিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই অবস্থা পরিবর্তিত হতে পারত যদি তার বিকল্প কোনো প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য দাঁড়াত। কিন্তু বাংলাদেশে সে রকম কিছু হয়নি। নানা কারণে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠন দুর্বল ও প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়াই ছিল প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলনের কার্যকর উপস্থিতি না থাকার কারণ। কমিউনিস্ট আন্দোলন এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুনভাবে গঠিত হয়ে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে না পারাই কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক আন্দোলনের অনুপস্থিতির মূল কারণ। এর জন্য শুধু মালিকশ্রেণী ও তাদের সরকারকে দোষারোপ করলে এ ক্ষেত্রে সংগঠনের প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে না।
যে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী নয় সে দেশে শ্রমিক আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারে না, শ্রমিকরা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারেন না। এটা এক বাস্তব ব্যাপার এবং ঐতিহাসিক সত্য। বিশেষ করে বর্তমান দুনিয়া যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে বিশুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না। শ্রমিক আন্দোলনের রাজনীতিকরণ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কোনো কর্মসূচিই শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে না, শ্রমিক শোষণ ও শ্রমিক নির্যাতনকে সহ্যসীমার মধ্যে রাখতে পারে না। বাংলাদেশেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এর মূল কারণ বাংলাদেশে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দুরবস্থা। দালাল শুধু সরকারি ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যেই নেই, তথাকথিত সরকারবিরোধী ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নেতৃত্বও এখন দালালদের হাতে। এই দালালরা এমনভাবে সরকার ও মালিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে যাতে শ্রমিক আন্দোলন স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। শুধু তাই নয়, প্রকৃত প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে এবং অনেক শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না থাকার কারণে বাংলাদেশে এখন শ্রমিক আন্দোলনের শায়িত অবস্থা। গার্মেন্টসহ অন্য কোনো কোনো শিল্পক্ষেত্রে এ কারণেই শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমমূল্য শোষণ এখন নির্মমভাবে হচ্ছে। এই নিম্নমজুরিই এখানকার গার্মেন্ট শিল্পের রমরমা অবস্থার মূল কারণ। এখানে শ্রমিকদের মজুরির এই অবস্থা অর্থাৎ শ্রমিক শোষণের এই সুবর্ণ সুযোগই বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহের মূল কারণ। এ কারণেই গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ এখানে এত দ্রুত।
বাংলাদেশে পহেলা মে যেভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে, লাল টুপি পরে বড় বড় মিছিল ও সভা করে পালিত হয় তা থেকে বোঝা মুশকিল শ্রমিকরা এখানে কতখানি শোষিত ও নির্যাতিত। বোঝা মুশকিল এখানে প্রকৃত শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন বলে কিছু নেই। কাজেই যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চান তাদের কর্তব্য হলো, শুধু কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে খোদ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা। যত দ্রুত সম্ভব শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, নিজেদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি, সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালীভাবে সংগঠিত করা।
৩০.৪.২০১২

ইলিয়াস আলী এবং আমাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতা





W. †d i ‡`Š m Av n g ` †Kv ‡i kx



fvi‡Zi mv‡eK ¯^ivóª mwPe wR‡K wcj­vB eQi `yB Av‡M Zvi †Mv‡q›`v Kg©KZ©v‡`i GK m‡¤§j‡b e‡jwQ‡jb, ÔIf intelligence fails, war is lostÕÑ †Mv‡q›`viv e¨_© n‡j hy‡× civRq AeavwiZ| weGbwci Zi“Y †bZv Bwjqvm Avjx GLbI wb‡LuvR| 17 GwcÖj iv‡Z ebvbx‡Z wbR evwoi Kv‡QB AÁvZ e¨w³iv Zvi Mvwo _vwg‡q Zv‡K †Rvi K‡i GKwU gvB‡µvev‡m Zz‡j wb‡q hvq| Zvici †_‡K Zv‡K Avi cvIqv hv‡”Q bv| wZwb RxweZ Av‡Qb wKbvÑ †m cÖkœ GLb mevi g‡b|
Bwjqvm Avjx RvZxqZvev`x QvÎ`‡ji mvaviY m¤úv`K wQ‡jb| Ggwc n‡q‡Qb| RvZxqZvev`x `‡ji Ab¨Zg mvsMVwbK m¤úv`K| mv¤úÖwZKKv‡j RvZxq ch©v‡q we‡kl K‡i wm‡jU wefv‡M me‡P‡q mwµq I Av‡jvwPZ ivRbxwZK‡`i Ab¨Zg| Ggb GKRb e¨w³‡K †K ev Kviv Gfv‡e Zz‡j wb‡q †Mj, Zz‡j wb‡q hvIqvi GZw`b ciI Zvi †Kvb †LuvRLei Kiv †Mj bv, GUv †`‡k-we‡`‡k D‡ØM I DrKÉv m„wó K‡i‡Q|
Bwjqvm Avjxi ¯^Rb‡`i Rb¨ welqwU KZUv wech©qKi Zv ejvi A‡c¶v iv‡L bv| Zv‡`i mvš—¡bv †`qvi †Kvb fvlv †bB| wKš‘ †`‡ki me©¯—‡ii gvbyl we‡kl K‡i ivR‰bwZK A½b G NUbvq nZwenŸj| AvZsK I AmnvqZ¡ dz‡U DV‡Q mevi g‡b| Zvn‡j †Zv †KDB wbivc` bq! G AmnvqZ¡ AviI Zxeª n‡”Q GRb¨ †h, Avgv‡`i AvBb-k„sLjvi `vwq‡Z¡ wb‡qvwRZ wewfbœ evwnbx I †Mv‡q›`v ms¯’v mv¤úÖwZKKv‡ji A‡bK PvÂj¨Ki AcniY I Ly‡bi NUbvi g‡Zv G NUbviI †Kvb K‚jwKbviv Ki‡Z cvi‡Q bv|
miKv‡ii Zid †_‡K ejv n‡”Q, Bwjqvm‡K D×v‡ii Rb¨ me©vÍK cÖqvm Pj‡Q| me KÕwU †Mv‡q›`v ms¯’v, i¨ve Ges cywjk me©kw³ wb‡q Kv‡R †b‡g‡Q| wKš‘ Bwjqvm‡K Kviv Zz‡j wb‡q‡Q, †Kb wb‡q‡Q, Zv‡K Av‡`Š †diZ cvIqv hv‡e wKbv, Gme cÖ‡kœi †Kvb DËi wgj‡Q bv|
c‡b‡iv †KvwU gvby‡li GKwU mgm¨vmsKzj †`‡ki Aw¯’i mvgvwRK-ivR‰bwZK cwiw¯’wZ‡Z bvbv Kvi‡Y bvbv ai‡bi msNv‡Zi D™¢e NU‡Z cv‡i| msNv‡Zi †Ri a‡i wKQy Abvm„wó NUv wewPÎ wKQy bq| Z‡e †m †¶‡Î iv‡óªi mswk­ó ms¯’vmg~n cwiw¯’wZ †gvKv‡ejvq me©kw³‡Z Suvwc‡q co‡e, Acivax kbv³ n‡e Ges NUbvi myôz Z`‡š—i gva¨‡g cÖK…Z Acivaxiv kvw¯— cv‡e, GUvB cÖZ¨vwkZ| GUvB iv‡óªi m‡½ bvMwi‡Ki ÔmvgvwRK Pzw³Õ ev Social contract; hv AvaywbK RvwZ-iv‡óªi cÖavb wfwË|
`yf©vM¨ekZ mv¤úÖwZKKv‡j Avgv‡`i iv‡óªi kxl© ch©vq †_‡K Ggb me e³e¨ Avm‡Q, hv G ÔmvgvwRK Pzw³Õ A¯^xKvi Kivi kvwgj| mvsevw`K `¤úwZi nZ¨vi ci Avgv‡`i cÖavbgš¿x e‡j em‡jb, ÔKviI †eWi“g cvnviv †`qvi `vwqZ¡ miKv‡ii bq|Õ fv‡jv K_v| Bwjqvm Avjx‡K †Zv †eWi“g †_‡K Zz‡j †bqv nqwb| bMixi †K›`Ö¯’‡ji ivRc_ †_‡KB Zz‡j †bqv n‡q‡Q| Gevi cÖavbgš¿x Kx ej‡eb? wZwb ej‡jb, ÔweGbwc wb‡RivB Bwjqvm‡K jywK‡q †i‡L‡Q!Õ
a‡i †bqv hvK, e¨vcviUv †m iKgB| cÖavbgš¿xi Kv‡Q Lei _vK‡Z cv‡i, weGbwc wKQy GKUv Pµvš—g~jK KvR K‡i †Nvjv cvwb‡Z gvQ wkKvi Ki‡Z PvB‡Q| †m iKg m¤¢vebv G‡Kev‡i Dwo‡qI †`qv hvq bv| ivRbxwZ‡Z Zv wewPÎ wKQy bq| wKš‘ Zvn‡j †Zv DwPZ n‡e Bwjqvm‡K PURjw` Rbmg‡¶ nvwRi Kiv| †m‡¶‡Î weGbwci gy‡L Ggb PzbKvwj jvM‡e †h, AvMvgx wbe©vP‡bi Rb¨ cÖavbgš¿x‡K Avi †Kvb `ywðš—vq _vK‡Z n‡e bv| Ggb †jvfbxq my‡hvM wZwb wb‡”Qb bv †Kb?
Gw`‡K AvIqvgx jx‡Mi mvaviY m¤úv`K ˆmq` Avkivdzj BmjvgI e‡j‡Qb, ÔwkMwMiB Bwjqvm‡K RxweZ D×vi K‡i Rbmg‡¶ nvwRi Kiv n‡e|Õ Zvi G K_v †_‡K A‡b‡K g‡b Ki‡Qb Bwjqvm‡K Kviv Zz‡j wb‡q‡Q Ges wZwb †Kv_vq Av‡Qb KZ…©c¶ Zv Rv‡b Ges Zv‡K D×v‡ii cÖwµqv Pj‡Q| G †jLvwU KvM‡R †ei nIqvi Av‡MB Bwjqvm wd‡i AvmyK| cÖavbgš¿x Ges ˆmq` Avkiv‡di e³e¨ mwVK cÖgvwYZ †nvK| Bwjqvm Avjxi cwiev‡ii wbN©yg w`b-ivwÎi Aemvb †nvK| `jgZ wbwe©‡k‡l †`‡ki me©¯—‡ii gvby‡li †mUvB cÖZ¨vkv|
`yB
Z‡e Bwjqvm Avjx wd‡i G‡jI mviv †`‡ki gvby‡li g‡b mv¤úÖwZKKv‡j †h fq-wenŸjZv `vbv †eu‡a‡Q Zv `~i n‡e bv| MZ GK eQ‡i G ivRavbx‡Z Ges mviv‡`‡k AviI A‡bK ÔLybÕ I Ô¸gÕ-Gi NUbv N‡U‡Q, hvi K‚jwKbviv nqwb| GUv †hb wbqwgZ e¨vcvi n‡q `uvwo‡q‡Q|
wgwWqvi mvg‡b miKvi Ges AvBb-k„sLjv i¶vi `vwq‡Z¡ wb‡qvwRZ evwnbx¸‡jvi AwZ-Drmvnx Dcw¯’wZ _vK‡jI G ai‡bi NUbvejxi inm¨ D˜NvwUZ n‡”Q bv| †m Rb¨ we‡ivax c¶ miKvi, cywjk I †Mv‡q›`v ms¯’v¸‡jvi mgv‡jvPbvq gyLi| we‡¶vf-mgv‡ek, niZvj, fvsPzi Pj‡Q †`kRy‡o|
miKv‡ii 5 eQ‡ii †gqv` c~wZ©i Avi †ewk †`wi †bB| Zviv Avevi ¶gZvq Avm‡Z Pvb| wKš‘ Rbg‡Zi evZvm AbyK‚‡j bq| †mRb¨ Zv‡`i Aw¯’iZv µ‡gB evo‡Q| ¶gZvq wU‡K _vKvi Rb¨ AvcÖvY cÖ‡PóvI †mB m‡½ evo‡Q| Avi Zv Ki‡Z wM‡q bvbvwea evovevwo cwiw¯’wZ AviI †kvPbxq K‡i Zzj‡Q| hZB w`b hv‡”Q, miKvi c¶ †hb gwiqv n‡q DV‡Q|
Afv‡ei msmv‡i cwiev‡ii KZ©v nIqvi weo¤^bv fqsKi| †Zgwb mxwgZ m¤ú‡` mgm¨vi cvnvo Dc‡o †djvi cÖwZkÖ“wZ w`‡q ¶gZvq emvUv ev‡Ni wc‡V Povi g‡Zv SzuwKc~Y©| hZ¶Y m¤¢e wc‡Vi Dc‡iB _vK‡Z n‡e| bvg‡jB wec`| ev‡Ni †c‡U hvIqvi ksKv| Avgv‡`i RvZxq ivRbxwZ‡Z G ch©š— GKeviI †Kvb `j wØZxq †gqv‡` ¶gZvmxb nqwb| wbe©vP‡b Rqx nIqvi Rb¨ nvRviI iK‡gi Awbqg K‡iI †Kvb jvf nqwb| ch©‡e¶Kiv g‡b Ki‡Qb, GeviI Zvi e¨wZµg nIqvi m¤¢vebv Lye GKUv †bB| (PÆMÖvg, bvivqYMÄ I Kzwgj­v †cŠi-K‡c©v‡ikb wbe©vP‡b ¶gZvmxb `‡ji cÖv_©xi †kvPbxq civRq‡K A‡b‡K ZviB AvjvgZ g‡b Ki‡Qb| XvKv wmwU K‡c©v‡ikb wbe©vPb ¯’wMZ nIqvi ga¨ w`‡q †mB ev¯—eZv AviI cÖKU n‡q‡Q|)
G cUf‚wg‡Z Ab¨ A‡bK NUbvi g‡Zv Bwjqv‡mi ¸g nIqv, mvMi-i“bxi nZ¨vKvÊ Ges †ij gš¿Yvj‡qi Nyl †K‡jsKvwii g‡Zv NUbvi inm¨ D˜NvU‡b Avgv‡`i AvBb-k„sLjv evwnbx we‡kl K‡i †Mv‡q›`v ms¯’v¸‡jvi e¨_©Zv ixwZg‡Zv nZvkve¨ÄK|
GLv‡bB Avevi wcj­vB‡qi Kv‡Q wd‡i †h‡Z n‡e| fvi‡Zi GhverKv‡ji ¯^ivóª mwPe‡`i g‡a¨ Zv‡K me‡P‡q Ruv`‡ij I my`¶ g‡b Kiv nq| ¯^ivóª mwPe _vKvKv‡j Zv‡K fvi‡Zi ÔZ…Zxq ¶gZvaiÕ e¨w³ AvL¨v †`qv n‡qwQj| Ic‡i D×…Z Zvi e³e¨wU Aek¨ G‡Kev‡i bZzb wKQy bq| G‡K AvßevK¨I ejv †h‡Z cv‡i| hyׇ¶‡Î kΓi Ae¯’vb Ges cvwicvwk¦©KZv wel‡q †Mv‡q›`v Z_¨ mwVK bv n‡j wech©q †Zv Awbevh© n‡eB| ivóª cwiPvjbv Ges hy× cwiPvjbv cÖvq mgv_©K| Avi †mRb¨B iv‡óªi †Mv‡q›`v ms¯’v¸‡jv mwVKfv‡e KvR bv Ki‡j wKsev Ki‡Z bv cvi‡j ivóª cwiPvjbvi hy‡× civRq Gov‡bv Am¤¢e|
evsjv‡`‡k mv¤úÖwZKKv‡j †hme †jvgnl©K I Awfbe nZ¨v-¸g, Lyb-WvKvwZ-al©Y, Nyl-`ybx©wZi NUbv NU‡Q Zvi AwaKvsk †¶‡ÎB Acivaxiv aiv‡Quvqvi evB‡i †_‡K †M‡Q| we‡kl K‡i MZ GK eQ‡i kZvwaK e¨w³i Ô¸gÕ nIqvi inm¨ D˜NvwUZ nqwb| cÖwZwU NUbv wb‡qB †`kRy‡o ˆn‰P n‡q‡Q, wgwWqvq w`‡bi ci w`b bvbvwea cÖwZ‡e`b cÖKvwkZ n‡q‡Q| _vbv-cywjk †_‡K Z`š—fvi Awc©Z n‡q‡Q †Mv‡q›`v ms¯’vi Ici| GKvwaK †Mv‡q›`v ms¯’vi †Rvi ZrciZvi K_v †kvbv †M‡Q| wKš‘ †kl ch©š— †h wZwg‡i †mB wZwg‡iB| A_©vr Avgv‡`i †Mv‡q›`viv Acivax kbv³ Ki‡Z cvi‡Qb bv, AwaKvsk †¶‡Î Aciv‡ai Ô†gvwUfÕ ev KviY D˜NvU‡bI Zviv m¶g n‡”Qb bv|
†Kb Ggb n‡”Q? GUv wK Avgv‡`i B‡›Uwj‡R‡Ýi B”QvK…Z MvwdjwZ? bvwK Avgv‡`i ÔBb‡Uwj‡RÝÕ Zvi m¶gZv nvwi‡q †d‡j‡Q? Avgv‡`i †Mv‡q›`v ms¯’v¸‡jv wK ¯^vaxbfv‡e KvR Ki‡Z cvi‡Q? bvwK Zviv KvR Kivi Drmvn-DÏxcbv nvwi‡q †d‡j‡Qb? hw` ZvB n‡q _v‡K Zv †h Kvi‡YB n‡q _vKzK bv †Kb, Zvn‡j †Zv AveviI wcj­vB‡qi K_viB cÖwZaŸwb Ki‡Z n‡e : ÔOur intellegence is failed, we must lose the war!Õ
ywZb
ivRbxwZK Bwjqvm Avjxi Ô¸gÕ I mvsevw`K mvMi-i“bxi nZ¨vKv‡Êi NUbv mv¤úÖwZKKv‡ji `ywU AwZ PvÂj¨Ki NUbv| `ywU NUbvB N‡U‡Q ivRavbxi †K›`Öxq GjvKvq| Dfq †¶‡ÎB miKv‡ii D”Pch©vq †_‡K ïi“ K‡i RvZxq Rxe‡bi me©¯—‡i Zxeª Av‡jvPbv-mgv‡jvPbv, ev`-cÖwZev` Pj‡Q| wgwWqvq bvbv msev`, msev` we‡k­lY I gš—e¨ cÖPvwiZ n‡”Q w`‡bi ci w`b| cÖwZev` mfv, gvbeeÜb, Abkb n‡”Q| jvMvZvi niZv‡j RbRxeb wech©¯—| wKš‘ †Kvb ÔK¬zÕ †ei n‡q Avm‡Q bv|
Bwjqvm Avjxi ¸g nIqvi †cQ‡b wgwWqvq bvbv ai‡bi K_vevZ©v n‡”Q| †jvKgy‡L bvbv ¸ReI Wvjcvjv we¯—vi Ki‡Q| Zš§‡a¨ D‡j­L‡hvM¨ K‡qKwU n‡”Q :
0 Bwjqvm wUcvBgyL euva Bmy¨‡Z jsgvP© Av‡qvR‡b Ges Av‡›`vj‡b †Rviv‡jv f‚wgKv cvjb K‡i gnjwe‡k‡li †ivlvb‡j c‡o‡Qb, †mRb¨B Zv‡K G cwiYwZ eiY Ki‡Z n‡q‡Q;
0 weGbwci Af¨š—ixY †Kv›`‡ji wkKvi n‡q‡Qb wZwb;
0 GKwU we‡`kx †Mv‡q›`v ms¯’v evsjv‡`‡ki ivRbxwZ Zv‡`i AbyK‚‡j ivLvi Rb¨ †`‡ki 100 ivRbxwZK, mvsevw`K I wewkó e¨w³‡K mwi‡q †`qvi Rb¨ KvR Ki‡Q, GUv ZviB Ask;
0 weGbwc ev miKviwe‡ivax †Kvb MÖ“c Av‡›`vjb Pv½v Kivi Rb¨ GKUv Bmy¨ ˆZwi K‡i‡Q;
0 †ijI‡q gš¿Yvj‡qi Nyl †K‡jsKvwi duvm nIqvi †cQ‡b Bwjqv‡mi WªvBfv‡ii GKUv c‡iv¶ f‚wgKv wQj, †mB WªvBfvi‡K †K›`Ö K‡iB G NUbvi m~ÎcvZ;
0 e¨w³MZ †Kvb kΓZvi †Ri a‡iB G NUbv BZ¨vw`|
cÖK…Z inm¨ D˜NvwUZ bv nIqv ch©š— G ai‡bi Nywo Iov‡bv Pj‡ZB _vK‡e| miKv‡ii cÖZ¨¶ Bw½‡Z Bwjqvm‡K ¸g Kiv n‡q‡Q, †hgbwU weGbwci c¶ †_‡K ejv n‡”Q, Zv Avgiv wek¦vm Ki‡Z PvB bv| GKwU MYZvwš¿K †`‡k †Kvb wbe©vwPZ miKvi, †h miKvi Avevi wbe©vwPZ n‡Z Pvq, Ggb KvR Ki‡Z cv‡i, Zv wPš—vi AZxZ| †Kvb we‡`kx ms¯’v evsjv‡`‡ki ivRbxwZi wbqš¿Yfvi nv‡Z †bqvi Rb¨ †`‡ki ivRbxwZi gvV †_‡K Zv‡`i AcQ‡›`i ivRbxwZK‡`i mwi‡q †`qv ïi“ K‡i‡Q, †Zgb wPš—vI Avgiv Ki‡Z PvB bv|
G‡¶‡Î fvebvi welq n‡”Q GB, Avgv‡`i †Mv‡q›`v ms¯’v¸‡jv wVKfv‡e KvR Ki‡Q bv| GUv †MvUv RvwZ I ivóªh‡š¿i Rb¨ Pig `ywðš—vi welq| ¶gZvmxb miKv‡ii Rb¨I| KviY ivóªxq †Mv‡q›`v Kvh©µg mwVKfv‡e cwiPvwjZ bv n‡j Zviv c‡` c‡` Revew`wnZv I mgv‡jvPbvi m¤§yLxb n‡eb| Zv‡`i ivR‰bwZK fveg~wZ© µgvMZ AviI cÖkœwe× n‡Z _vK‡e|
A‡b‡K g‡b Ki‡Qb miKv‡ii wewfbœ AvBb-k„sLjv i¶vKvix evwnbx Ges †Mv‡q›`v ms¯’v¸‡jvi †fZi GLb GK ai‡bi nZvkv I j¶¨nxbZv weivR Ki‡Q| gvÎvwZwi³ ivR‰bwZK Pvc, D”Pch©vq †_‡K ˆ`bw›`b n¯—‡¶c, GgbwK we‡`kx civg‡k©i evovevwo Gme ms¯’vi m`m¨‡`i ˆbwZK g‡bvej †f‡O w`‡”Q|
mv¤úÖwZKKv‡j Ggb wKQy NUbvI N‡U‡Q hvi weiƒc I my`~icÖmvix cÖwZwµqvq GLb Gme ms¯’vi A‡b‡K Avi SuzwK wb‡q †Kvb KvR Ki‡Z PvB‡Qb bv| ivR‰bwZK miKv‡ii wb‡`©k Av¶wiKfv‡e cvjb Kiv Zv‡`i KZ©e¨, wKš‘ †Zgb wb‡`©k cvjb Ki‡Z wM‡q mv¤úÖwZKKv‡j A‡bK D”Pc`¯’ cywjk I †Mv‡q›`v Kg©KZ©v wec‡`i m¤§yLxb n‡q‡Qb| GK miKv‡ii Avg‡j Ic‡ii wb‡`©‡k KvR Ki‡Z wM‡q cieZ©x miKv‡ii Avg‡j A‡bK‡K Pig nqivwbi m¤§yLxb n‡Z n‡”Q| G‡¶‡Î Kw_Z Ô`k UªvK A¯¿ gvgjvÕi welqwU we‡ePbvq Avbv †h‡Z cv‡i| KvRwU fv‡jv Kx g›`, DwPZ Kx AbywPZ, †m weZK© _vK| wKš‘ g›`KvR n‡j Zvi P‚ovš— `vq-`vwqZ¡ Kvi †m welqwU ¯úó bv K‡i ZLbKvi mg‡qi †Mv‡q›`v I cywjk Kg©KZ©v‡`i †hfv‡e nvZKov cwi‡q †Kvg‡i `wo w`‡q †nb¯’v Kiv n‡q‡Q, Zv‡Z IB e¨w³‡`i hZUv Acgvb Kiv n‡q‡Q, Zvi †P‡q †ewk mgMÖ cywjk I †Mv‡q›`v wefv‡Mi Aegvbbv Kiv n‡q‡Q, hv mvgwMÖKfv‡e Avgv‡`i cywjk, †mbvevwnbx I †Mv‡q›`v evwnbxi wbqgvbyewZ©Zv I ivR‰bwZK miKv‡ii cÖwZ AvbyM‡Z¨ wPo awi‡q w`‡q‡Q|
Avgv‡`i †Mv‡q›`v e¨_©Zv †m iKg GKUv cwiw¯’wZi cwiYwZ wKbv, Zv eZ©gv‡bi kvmK‡kÖYx I fwel¨‡Zi ¶gZv-cÖZ¨vkx Dfq gnj‡K Mfxifv‡e fve‡Z n‡e|
W. †di‡`Šm Avng` †Kv‡ikx : ivRbxwZK, f‚-ivRbxwZ M‡elK
shapshin@gtlbd.com 

সে আওয়াজ কি শুনতে পাচ্ছেন?


gynv¤§` BmgvBj †nv‡mb



Gevi Avgvi wbR †Rjv cvebv wM‡q A‡bK w`b KvwU‡q Gjvg| MZ `k eQ‡i cvebv wM‡q GKbvMv‡o GZw`b _vwKwb| †mLv‡b A‡bK †jv‡Ki m‡½ IVvemv, K_vevZ©v nj| GK ch©v‡q `vcywbqv evRv‡i wM‡q AvjvcPvwiZvq Rvbv †Mj, †m GjvKvi GKRb e¨emvqx XvKvq G‡m ¸g n‡q‡Qb| Avevi wKQyw`b Av‡M IB e¨emvqxi g¨v‡bRviI PzqvWv½vq wM‡q ¸g n‡q‡Qb Ges IB `yÕR‡bi KviI jvkB cvIqv hvqwb| Gme ¸g ev nZ¨vi †cQ‡bi KvwnbxI Avevi nZ¨v ev Ly‡bi m‡½ mswk­ó| e¨emvqx f`ª‡jvK bvwK n‡R †jvK cvVv‡bvi Rb¨ nvRx †mwjg bv‡g GK †gvqv‡j­‡gi cvU©bvi wQ‡jb| AZtci A_©msµvš— wel‡q nvRx †mwjg Lyb n‡j cici Dc‡iv³ `yB e¨w³ wb‡LuvR ev ¸g nb| `xN©w`b Zv‡`i †Kvb mÜvb ev jvk bv †c‡q Df‡qi cwieviB bvwK g„Zz¨cieZx© agx©q AbyôvbI m¤úbœ K‡i‡Qb| cvebvq e‡m G NUbv ïb‡Z ïb‡ZB XvKvq Bwjqvm Avjx Acni‡Yi NUbv ïbjvg| †ek wKQyw`b AwZevwnZ n‡jI AvR ch©š— Zvi †Kvb †LuvR cvIqv hv‡”Q bv| Zv‡K my¯’fv‡e †diZ cvIqvi Rb¨ †Uwjwfk‡bi c`©vq Zvi cwievi‡K cÖv_©bv Ki‡Z †`Lv hv‡”Q| Gme †`‡L-ï‡b wKQy K‚jwKbviv Ki‡Z cvijvg bv| cvebvi nvRx cvVv‡bv †gvqv‡j­g nvRx †mwjg Lyb nIqvi ci Zvi cvU©bv‡ii g¨v‡bRvi PzqvWv½vq ¸g n‡j e¨emvqx iv‡RgI XvKvq G‡m ¸g n‡q †M‡jb| welqwU ch©v‡jvPbv Ki‡j nq‡Zv GB `uvovq, †gvqv‡j­g nvRx †mwjg Lyb nIqvq g¨v‡bRvi‡K ¸g Kiv KviI Rb¨ Acwinvh© n‡q c‡owQj| Avevi g¨v‡bRvi ¸g nIqvi ci e¨emvqxi XvKvq G‡m ¸g nIqvi NUbvwU KviI cÖwZ‡kva MÖn‡Yi NUbvI n‡Z cv‡i| wKš‘ cÖkœ nj, GB `ywU ¸‡gi NUbv mwµqfv‡e NUvj Kviv? e¨emvqx iv‡Rg Ges Zvi g¨v‡bRvi ¸g nIqvq aviYv Kiv hvq, nq‡Zv †Kvb wKjvi MÖ“c‡K w`‡q †KD Gme Kwi‡q‡Q! hw` ZvB nq, Zvn‡j Gme wKjvi MÖ“c †h mviv‡`‡kB mwµq Zv ejvB evûj¨| KviY PzqvWv½v, XvKv †KvbUvB Zv‡`i Avq‡Ëi evB‡i bq| Zvn‡j †Zv GK_v GLb wbtm‡›`‡nB ejv hvq, †`‡k AvBb-k„sLjvi Pig AebwZ n‡q‡Q| †Kbbv nR e¨emvqx †gvqv‡j­g nvRx †mwjg Ly‡bi NUbvq cÖwZc‡¶i `yÕRb †hfv‡e ¸g n‡jb, Zv‡Z Avi hvB †nvK AvBb-k„sLjvi welqwU †h Lye Lvivc GK_v †Rvi w`‡qB ejv hvq| †mB m‡½ weGbwci cÖfvekvjx †bZv Bwjqvm Avjxi wb‡LuvR nIqvi NUbvI `„pZvi m‡½B D‡j­L K‡i ej‡Z nq, G‡¶‡ÎI AvBb-k„sLjv i¶vKvix evwnbx e¨_©Zvi cwiPq w`‡”Qb| G wb‡q wb‡LuvR Bwjqvm Avjxi `j Ges cwievi †_‡K evievi ejv n‡”Q, miKvwi †Kvb evwnbxi m`m¨ivB Bwjqvm Avjx‡K DwV‡q wb‡q‡Q Ges Zviv miKv‡ii Kv‡QB Bwjqvm Avjx‡K †diZ Pv‡”Qb| miKviI Bwjqvm Avjx‡K D×v‡ii Rb¨ Avš—wiK e‡j Rvbv‡”Q| wKš‘ Kvh©Ki †Kvb dj †`Lv‡Z cvi‡Q bv| Zvn‡j cvebvi †h `yB e¨w³i ¸‡gi K_v ejv nj Ges Bwjqvm Avjxi g‡Zv ¸i“Z¡c~Y© e¨w³i Acni‡Yi Kvi‡Y †`‡k †h ZvÊejxjv Pj‡Q, Gm‡ei Rb¨ `vqx †K? †`ke¨vcx †h nZ¨v, ¸‡gi Rb¨ GKUv AwZ kw³kvjx Pµ we`¨gvb, Ab¨ A‡bK NUbvi g‡a¨ Dc‡ii `ywU NUbvI †Zv Zvi RvR¡j¨gvb cÖgvY| hw` †emiKvwi †Kvb †ckv`vi LywbPµ ev MÖ“c Gme Pvjv‡Z _v‡K, Zvn‡jI †Zv AvBb-k„sLjv i¶vKvix evwnbxi DwPZ Zv‡`i wPwýZ K‡i †`kevmxi mvg‡b Dc¯’vcb Kiv| Ab¨_vq Bwjqvm Avjxi `‡ji †jvKRb w`b-ivZ Mjv dvwU‡q miKvwi evwnbxi Ici †hfv‡e †`vl Pvcv‡”Qb, Zvi Rev‡e miKviB ev wK ej‡e? GLb †h Gme nZ¨v-¸‡gi NUbv Avš—R©vwZKZv jvf Kij, Zvi `vqfviB ev †K enb Ki‡e? †MvUv RvwZ †Zv G `vqfvi MÖnY Ki‡Z cv‡i bv| RvwZ †h GKUz kvwš—‡Z _vK‡Z Pvq, †m kvwš—UzKzB ev †K †`‡e? miKvi †h Zvi AvBb-k„sLjv i¶vKvix evnbx‡K `¶Zvi m‡½ cwiPvjbv Ki‡Q, Zvi cÖgvYB ev †Kv_vq? cvebvi `ywU ¸‡gi NUbvB ewj Avi Bwjqvm Avjxi Acni‡Yi K_vB ewj, Gme D`NvU‡bi `vwqZ¡ †h AvBb-k„sLjv i¶vKvix evwnbxi Ges Zv‡`i hviv cwiPvjbv K‡ib Zv‡`i Ici eZ©vq, †m K_v wK eywS‡q ejvi `iKvi Av‡Q? Gme nZ¨v-¸‡gi wfKwUg cwievi¸‡jv w`‡bi ci w`b AvnvRvwi Ki‡e Ges †mB my‡hv‡M †`‡ki ivR‰bwZK gq`v‡b Av¸b R¡j‡e, Avi †m Av¸‡b †`‡ki wbixn gvbyl cy‡o gi‡e, G †Kgb K_v? †`‡ki gvbyl Avi KZw`b ivR‰bwZK †ilv‡iwli ewji cuvVv n‡eb? D™¢‚Z cwiw¯’wZ‡Z †`‡ki mvaviY gvbylI †h Mjv dvwU‡qB ej‡Z ïi“ K‡i‡Qb, Ô†Kv_vI wK †KD Av‡Qb, Avgv‡`i euvPvbÕ †m AvIqvR wK Avcbviv miKvwi `j ev we‡ivax `j ïb‡Z cv‡”Qb!!! n¨v‡jv, Avcbv‡`i ejwQ!

gynv¤§` BmgvBj †nv‡mb : gyw³‡hv×v, Kjvwg÷

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব




সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ০১-০৫-২০১২

রাজনীতি একটি পেশা। তবে রাজনীতিকের পেশাটি একজন তাঁতির পেশার মতো নয়, কর্মকারের পেশার মতো নয়, সুতার-মিস্ত্রি বা ডাক্তার-কবিরাজের পেশার মতো নয়। শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পেশার মতোও নয় রাজনীতি। একজন তাঁতিকে উপার্জনের জন্য বসে বসে কাপড় বুনতে হয়। কর্মকারকে হাপরে লোহা গলিয়ে দা-বঁটি-খোন্তা-কুড়াল তৈরি করতে হয়। মিস্ত্রি দরজা-জানালা-আসবাবপত্র বানান। ডাক্তার-কবিরাজ রোগীর রোগ নির্ণয় করে ওষুধ দিয়ে তাকে আরোগ্য করেন। এসব কাজের জন্য তাঁরা মজুরি বা ফি পান। 
রাজনীতি একটি অন্য রকম পেশা। পেশা বটে, কিন্তু জীবিকা নয়। রাজনীতি সেবামূলক পেশা। কামার-কুমার-জেলে-তাঁতি যেমন প্রতিদিন জীবিকার জন্য কামাই করেন, রাজনীতির সঙ্গে জীবিকা অর্জনের সম্পর্ক নেই। একসময় তাই ছিল। এখন অবশ্য রাজনীতি শুধু জীবিকা নয়, জীবিকার বাবা। উপার্জনের দিক থেকে আজ একজন মধ্যমশ্রেণীর রাজনীতিকের কাছে একজন মাঝারি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী কিছুই না। শিল্পপতির লোকসানের ভয় আছে, রাজনীতিকের সে শঙ্কা লেশমাত্র নেই। 
প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক যুগের নেতৃত্ব থেকে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতারা বিদেশি শাসকদের কাছে চাইতেন কিছুটা ক্ষমতার ভাগ; আর জনগণের কাছে চাইতেন আনুগত্য। ওই ব্যবস্থায় জনগণ নেতাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদের ধন্য মনে করত, অন্যদিকে আনুগত্য প্রদর্শন না করেও উপায় ছিল না। নেতাদের অনেকের লক্ষ্য ছিল বড় লাটের কাউন্সিলে মেম্বার বা মন্ত্রিত্ব-জাতীয় কিছু পাওয়া—অর্থ উপার্জন নয়। বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্মান-মর্যাদা অর্জন করতে ‘তাঁরা’ অকাতরে নিজের অর্থ ব্যয় করতেন। 
কংগ্রেসের প্রথম দিকের নেতারা সামন্ততান্ত্রিক নেতা ছিলেন। দাদাভাই নওরোজি, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, বদরুদ্দিন তাইয়েবজি, ফিরোজশাহ্ মেহ্তা, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রহিমতুল্লাহ সয়ানি, আনন্দমোহন বসু, মদনমোহন মালব্য, নবাব বাহাদুর সৈয়দ মোহাম্মদ, হাসান ইমাম, মতিলাল নেহরু প্রমুখ ছিলেন সামন্ত-পরিবারের মানুষ। কেউ বিরাট ধনী, কেউ বিখ্যাত ব্যারিস্টার, কেউ জমিদার-জায়গিরদার, কেউ পত্রিকার মালিক, বড় ব্যবসায়ী অথবা অভিজাত পরিবারের মানুষ। তাঁদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সামান্য, শাসকদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠতর। মহাত্মা হওয়ার আগে গান্ধীজির মতো মানবাধিকার আইনজীবীকে ফিরোজশাহ মেহ্তার সঙ্গেও দেখা করতে বেগ পেতে হয়েছে। তারপরও কংগ্রেসের ভেতরে ভিন্নমত প্রকাশের একটা পরিবেশ ছিল।
মুসলিম লিগের নেতৃত্বও ছিল একই রকম সামন্ততান্ত্রিক। কেউ নবাব বাহাদুর, কেউ সামন্তভূস্বামী, কেউ বা বড় আইনজীবী-শিল্পপতি। তবে লিগে ভিন্নমত নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলোচনার সুযোগ ছিল না। নেতার মতই শিরোধার্য।
সেকালের রাজনৈতিক নেতারা জেলা বোর্ড বা মিউনিসিপ্যালিটিতে নির্বাচন করা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করতেন। তারপর কেউ যেতেন কাউন্সিলে, কেউ হতেন মন্ত্রী।
পরাধীন দেশের নেতাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশকে ধীরে ধীরে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বড় জোর মন্ত্রী পর্যন্ত হওয়া যাবে, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। সেকালে মন্ত্রিত্ব ছিল জনসেবামূলক চাকরির মতো। তবে নেতারা জনগণের কিছু দাবিদাওয়া সরকারকে দিয়ে পূরণ করাতে চেষ্টা করতেন।
সব রাজনৈতিক নেতা জননেতা নন, কিন্তু সব জননেতাই রাজনৈতিক নেতাও। জননেতারা মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী ভারতীয়দের অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস সত্যাগ্রহ বা সংগ্রাম করেছেন। মওলানা ভাসানী আসামে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে এবং বাঙাল-খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জননেতায় পরিণত হন। বিদেশি শাসকদের বিতাড়িত করার আন্দোলন করে সুভাষচন্দ্র বসু নেতাজি হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ক্ষমতায় বসা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। মার্টিন লুথার কিং কালোদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জননায়কে পরিণত হন এবং জীবন উৎসর্গ করেন। নিজে ক্ষমতায় যেতে চাননি, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় বারাক হোসেইন ওবামার মাধ্যমে। মিয়ানমারে সু চি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সে কারণে তিনি জননেতা। আপস করলে অনেক আগে মন্ত্রী হতেন। 
সামরিক শাসন সাংবিধানিক শাসন নয়—কয়েকজন সেনাপতির খেয়ালখুশির শাসন। কিন্তু রাষ্ট্রে যদি গণতন্ত্র থাকে, তা হলে যেকোনো পেশার মানুষ জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে। অবসর নিয়ে কোনো সেনাকর্মকর্তাও নির্বাচিত হতে পারেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সে দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার ছিলেন জনপ্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের একজন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল ছিলেন অতি জনপ্রিয় ও সম্মানিত। আইয়ুব খানসহ কোনো সামরিক একনায়কই যত দক্ষ শাসনকর্তাই হোন, জননেতা হতে পারেননি।
গণতন্ত্রের সুবিধা ব্যবহার করে লিগ নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সামন্ত নেতৃত্ব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেন। অ-সামন্তবাদী গণতন্ত্রপন্থী নেতারা লিগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে ১৯৫০-এ জমিদারি প্রথাও বাতিল হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটলেও, কৃষক জমির মালিকানা পেলেও, তাঁর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও, সমাজব্যবস্থা থেকে যায় আধা সামন্ততান্ত্রিক। যাঁর ক্ষমতা বেশি ও যাঁর বিত্ত বেশি, তাঁর কাছে নতজানু হওয়া সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
জনগণের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো। জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু সম্ভাবনাটি ফলপ্রসূ হলো না। গণতন্ত্রের বিরতিহীন চর্চা ছাড়া, নানা মতাদর্শের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান ছাড়া জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু উগ্র পন্থা গ্রহণ করায় তাঁরা সে সুযোগ নস্যাৎ করে দেন। বেসামরিক সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব থেকে দেশ সামরিক একনায়কী নেতৃত্বে চলে যায়।
চতুর্থ সংশোধনীর পর গণতন্ত্র চর্চার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারও আগে ১৯৭৩- দেশের ছোট-মাঝারি দলের নেতারা উপলব্ধি করেন, নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দন তাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। তখন তাঁদের সামনে খোলা ছিল তিনটি পথের যেকোনো একটি: বাকশালে যোগ দেওয়া, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া এবং কোনো অনাগত অসাংবিধানিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া। সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে তাঁরা শেষটি বেছে নেন।
তাঁরা মোশতাক-জিয়া সরকারকে সঙ্গে সঙ্গেই সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭৯-তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল তাঁদের গণতান্ত্রিক উপায়ে আকাঙ্ক্ষা পূরণের শেষ ধাপ। ওই নির্বাচনে সদ্যজাত বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ পায় ৩৯, মুসলিম লীগ—যা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল—পায় ১২টি, জাসদ আটটি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (যা ছদ্মবেশী জামায়াত) পায় আটটি, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), একতা পার্টি প্রভৃতি দলের নেতারাও নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক জিয়া তাঁদের এই সুযোগটা দেন, আওয়ামী লীগ থেকে তাঁরা যা কোনো দিন পেতেন না। জিয়ার কাছ থেকে ওই করুণাটুকু পাওয়ার ফলে অনেকেই সরকারে গেলেন কিন্তু জনগণের নেতা হওয়ার সুযোগটা হারালেন।
শুধু ছোট দলের নেতাদের দোষ দেওয়া যাবে না। বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী প্রথিতযশারা সামরিক একনায়ককে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এক লেখায় ঠিকই বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সামরিক পরিচয় ঘুচে গিয়েছিল, জনগণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলছিল এবং সে কারণে তিনি তাঁকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। সেখানে তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে খাল খনন করেন বা মাটি-টাটি কাটেন।
সামরিক একনায়কেরা নানাভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আইয়ুবের মতো জিয়াও শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কোরিয়ায় পাঠাতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু অর্থ অনুদান নয়, শিল্পী ও কলাকুশলীদের বিমানে ফ্রি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকটি তিনি নিজে বেইলি রোডে গিয়ে উপভোগ করেন। তাতে তিনি সংস্কৃতিসেবীদের কৃতজ্ঞতাভাজন হন। প্রেসিডেন্ট এরশাদও শিল্পী-সাহিত্যিকদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
এসবের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়। সামন্ততান্ত্রিক ধরনের নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্যতা পায়। ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ভার এখন দুই পরিবারের হাতে চলে গেছে। গত ১৬-১৭ মার্চ দিল্লিতে ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত একান্ত বৈঠকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় যথার্থই বলেছেন: ‘উই হ্যাভ টু পলিটিক্যাল ডায়নেস্টিজ ইন আওয়ার কান্ট্রি। ওয়ান ইজ মাই ফ্যামিলি। দ্য আদার ওয়াজ ফাউন্ডেড বাই আওয়ার ফার্স্ট মিলিটারি ডিকটেটর।’ জনাব তারেকও সম্ভবত একই কথা বলবেন।
পারিবারিক বংশপরম্পরার শাসন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। পারিবারিক সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব যত যোগ্যই হোক, মানবকল্যাণে মাদার তেরেসার মতো ব্রতী হোক, তাঁকে জনগণের নেতা বলা যাবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলের নেতারা শীর্ষনেতার সহকর্মী। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বে তাঁরা সহকর্মী নন, অধীনস্ত কর্মচারী বা হুকুমবর্দার।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় দল নয়, ডায়নেস্টি প্রধান। প্রবীণ নেতা আবদুল জলিলসহ অনেকেই এখন প্রকাশ্যে বলছেন, দলের ভেতরে কথা বললে বিপদ। তবে অসাবধানতাবশত একটি কথা তিনি স্বীকার করেছেন, একক সর্বময় নেতৃত্ব সৃষ্টিতে তাঁরা কয়েকজন সংস্কারপন্থীই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাঁরা নন, কিছু প্রথিতযশা বিভিন্নজীবী ও নীতিবিদদের ভূমিকা আরও বেশি। 
গণতন্ত্র একটি ডিসকোর্স বা বিতর্ক ও চিন্তাশীল বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়—ওপর থেকে কারও চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়। কোনো প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করে বিরোধিতা করা আর শ্রদ্ধাহীনতা এক কথা নয়। নেতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য রেখেও ভিন্নমত দেওয়া যায়। 
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবে জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা-ই বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন জননেতারা—প্রচলিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়। 
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভার শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়। তার কাজ এক দিনেই শেষ। গণতন্ত্র শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন নয়, শুধু নেতার শাসন নয়, সবার শাসন। ছোট-বড় সব দলের অনির্বাচিত নেতাদের মতামতের মূল্য দিতে হয়। দক্ষ ও মেধাবী আমলা ও কূটনীতিকদের ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুযোগ্য ও সৎ সামরিক কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে হয়। সব পেশাজীবী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির পরামর্শ ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অতি অল্পসংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতার দাবিও গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়। সেসব সমন্বয় করতে পারেন শুধু একজন জননেতা—সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বের পক্ষে তা সম্ভব নয়। 
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

দেশে গুম খুন জেল-জুলুম বিশ্ব দরবারে কী করবেন



আ তা উ স সা মা দ
‘যখন রাষ্ট্র অথবা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের অনুমোদনক্রমে, তাদের সমর্থন নিয়ে অথবা সম্মতিতে কোনো ব্যক্তিকে গোপনে অপহরণ করা হয় অথবা বন্দি রাখা হয় এবং ঐ ব্যক্তি যাতে আইনের আশ্রয় না নিতে পারেন, সে উদ্দেশে তার ভাগ্যে কী ঘটেছে বা তিনি কোথায় আছেন, তা জানতে দেয়া হয় না, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে (International Human Rights Law) তখন ঘটনাটিকে বলপূর্বক গায়েব করে দেয়া (Forced disappearance or enforced disappearance) বলা হয়।’ অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে ‘ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ শিরোনামের নিবন্ধের শুরুতেই এই কথাগুলো বলা আছে।
নিবন্ধটিতে এর পরেই আছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম আইন (Rome statute of the International Criminal court) অনুসারে যখন কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বলপূর্বক নিখোঁজ বা অদৃশ্য করে দেয়ার অস্ত্রটি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তখন এরকম গুম করাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে এবং এটি অন্য কোনো সীমিতকরণ আইন দ্বারা এই অপরাধীর বিচার বন্ধ করা যাবে না। ২০০২ সালের ১ জুলাই এই আন্তর্জাতিক আইনটি পাস হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও ‘গুম হয়ে যাওয়ার হাত থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য কনভেনশন’ নামক একটি আন্তর্জাতিক আইন ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গৃহীত হয়।’
উইকিপিডিয়ায় প্রচারিত নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘গুম হওয়ার অর্থই প্রায়ই হলো খুন হওয়া। প্রথমে একজনকে অপহরণ করা হয়, তারপর তার ওপর চলে অত্যাচার, অতঃপর তাকে খুন করে তার লাশটি লুকিয়ে রাখা হয়। প্রায়ই গুপ্তহত্যার পর লাশ এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যাতে তা কোনো দিনই খুঁজে না পাওয়া যায়।’
বাংলাদেশে যে গুম-খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে ও ঘটছে সেগুলো উপরিউক্ত অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। তাই গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের দাবি অবশ্যই তুলতে পারেন। আর যারা এই অপরাধগুলো ঘটাচ্ছে ও করছে তাদেরও জেনে রাখা ভালো যে, তারা একদিন না একদিন বিশ্বের কোথাও না কোথাও, বিচারের সম্মুখীন হবে, অপরাধ ঘটানোর সময় তারা যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন। বর্তমান বিশ্বে এক দেশের পলাতক যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধীর আন্তর্জাতিক আদালতে অথবা আশ্রয়গ্রহণকারী দেশের আদালতে বিচার করার প্রথা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আর দেশের ভেতরেই ক্ষমতার মসনদের অধিকারী পাল্টে গেলে এ রকম মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গোপন কুকর্মের তথ্যপ্রমাণ ফাঁস হবেই। বাংলাদেশের এরকম অপরাধ ঘটনাবলী নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এরই মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে এই ধরনের ‘গুম’ করার অপরাধ ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। একটি মানবাধিকার সংস্থা বলেছে যে, চলতি ২০১২ সালেই অন্তত ২২টি গুম করার ঘটনা ঘটেছে। সংস্থাটি বলেছে, এই গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দাবি করেছে, গত ৩ বছরে তাদেরই কমপক্ষে ১০০ জন নেতাকর্মী গুপ্তহত্যা ও গুমের শিকার হয়েছে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ১৩ দিন আগে ঢাকার বনানীতে তার ঘরে ফেরার সময় মাঝ রাতে বাড়ির কাছাকাছি অপহৃত হন। সরকারি দায়িত্বরত, অর্থাত্ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এই পরিচয় দিয়ে ওই সশস্ত্র ব্যক্তিরা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে উধাও হয়। তারপর থেকে তারা দু’জনই নিখোঁজ রয়েছেন।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তাকে যে তারিখে আদালতে হাজির করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা পার হয়ে গেছে কিন্তু ইলিয়াস আলীকে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন সংস্থা তাকে খুঁজছে কিন্তু এখনও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ইলিয়াস আলী অপহৃত হওয়ার পর দিনই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলেন, সরকারি বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গেছে, অতএব সরকারকেই তাকে জীবিত ফিরিয়ে দিতে হবে। ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাতে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল তাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু ইলিয়াস আলী ফিরে না আসায় বিএনপি পরপর তিন দিন দেশজুড়ে হরতাল করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন নতুন মোর্চা ১৮দলীয় জোট গত পরশু ও গতকাল একই দাবিতে হরতাল করেছে।
গত পরশু হরতালের সময় সচিবালয়ে দুটি এবং ঢাকা শহরের অন্যত্র ছয়-সাতটি ছোট বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। বেশ কিছু গাড়িও ভাংচুর হয়। কেউ বলেন, হরতাল-সমর্থক পিকেটাররাই সবক’টি সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী আর অন্য কেউ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্টরাই বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। গতকাল জানা গেল, এসব ঘটনার জন্য দায়ী করে সরকার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমানউল্লাহ আমান, এলডিপি নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিএনপির দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী এবং আরও তিরিশ-চল্লিশ জনের নামে থানায় মামলা করেছে। পুলিশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছে। এর আগে তারা বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ-এর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। সহজ ভাষায়, বিএনপি ও তার সঙ্গী দলগুলো ইলিয়াস আলীর সন্ধান লাভ করার জন্য তথা গুম ও গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চালিয়ে যাবার হুশিয়ারি দিয়েছিল তা নস্যাত্ করার জন্য সরকার এখন হামলা ও মামলা এই দুই পথেই বিরোধীদের ওপর জুলুমের স্টিমরোলার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান সরকারের এই নীতি ১৯৬৬ সালে তত্কালীন সেনাশাসক আইয়ুব খান ও তার দোসর মোনায়েম খান শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে যে মামলা ও গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছিল, তার কথা কিছুটা হলেও মনে করিয়ে দেয়। আশা করি সে সময়ের অনেক তরুণ নেতা যারা এখন সরকারের সঙ্গে আছেন, তারাও সে সময়ের কথা একেবারে ভুলে যাননি। এখন এ পথ ধরে চলার সময় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ‘অনুমোদন, সমর্থন ও সম্মতিক্রমে’ আরও কত লোক নিখোঁজ হয় কে জানে? এই শঙ্কা প্রকাশ করছি এ জন্য যে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে মতপার্থক্য ছিল তা দিন দিন বড় হচ্ছে। কারণ, এতে নতুন ও উত্কট সব সমস্যা যোগ হচ্ছে।
ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী অপহৃত হওয়ার পর পর সরকারের দু’চারজন নেতার গলায় যে একটু নরম সুরের ছোঁয়া লেগেছিল তা বেশ ক’দিন হলো একেবারেই উবে গেছে। এখন তারা ইলিয়াস আলীর পরিবার, বিএনপি এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন যে, তাকে খুঁজে বের করতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করছেন না। আমরা যতদূর জানি, অভিযোগগুলো ধোপে টেকে না। বরং এর উল্টোটাই সত্যি বলে মনে হয়। অন্তত এটুকু তো দেখা যাচ্ছে যে, সাংবাদিকরা ওই অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করেন এবং তাদের ভাষ্য প্রকাশ করেন আর তার পরপরই দেখা গেল, ওই প্রত্যক্ষদর্শীরা একে একে চোখের আড়াল হয়ে গেছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা প্রথম দিকে পুলিশ ও র্যাবকে খুবই সহযোগিতা করেছিলেন, পরে সম্ভবত তদন্তকারীদের উল্টাপাল্টা প্রশ্ন ও নিষম্ফল জিজ্ঞাসাবাদ এবং অভিযান দেখে তারা হতাশ হয়ে নিজেদের অনেকখানিই গুটিয়ে নিয়েছেন। আর বিএনপির বেশ ক’জনকে এরই মধ্যে পুলিশ ও র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা গেছে। তারা তো এ জন্য নিজেদের উপস্থিত রেখেছেনই। এদিকে কল্যাণ পার্টির প্রধান মেজর জেনারেল ইব্রাহীম সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনারা আগে বলুন যে কী সহযোগিতা চান, তারপর দেখুন আমরা তা দিই কী না দিই। আগেই অভিযোগ কেন?’ এদিকে ইলিয়াস আলীর দেশের বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে ইলিয়াস আলীর তিন বিক্ষোভরত সমর্থক নিহত হয়েছেন। পরে লক্ষ্মীপুরেও বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে দলের একজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথম বার হরতালের আগের দিন ও হরতালের সময়ে দুঃখজনকভাবে দুইজন গাড়িচালক নিহত হয়েছেন।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় বিএনপি ও তাদের সঙ্গী দলগুলোকে এখন হামলা-মামলা, জেল-জুলুম প্রতিরোধ করতে জোরদার বা দুর্বল যেমনই হোক ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরাও সন্দেহ করছেন যে, বিরোধীরা আসলে সরকার পতনের আন্দোলন করছে এবং সেটা তারা যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করবেন। আর আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্বত-প্রমাণ ব্যর্থতা, অপরাধ ও দুর্নীতি এতই স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা খুবই ভয়ে আছেন যে, এই সরকার গদিচ্যুত হলেই তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, তাই তারা মরণ কামড় দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। আমাদের জন্য খুবই ভীতিকর হলো যে, এরকম অসময়ে গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা কায়মনোবাক্যে সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন বাংলাদেশকে ও এ দেশের মানুষকে এই বিপদ থেকে বের করে আনেন।
আজ ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। আজ এদেশের শ্রমিক-জনতা ভারাক্রান্ত চিত্তে স্মরণ করবে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে। তাকে গত ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে অপহরণ করে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা। তার পর দিন টাঙ্গাইলে তার লাশ পাওয়া যায়। এই শ্রমিক নেতার হত্যাকারীরা এখনও ধরা পড়েনি।

কেন এই লুকোচুরি, কালো ঘোড়াটা কার পকেটে?

কেন এই লুকোচুরি, কালো ঘোড়াটা কার পকেটে?


॥ মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক ॥

কলামটি যে মুহূর্তে লিখতে বসি তখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ উত্তপ্ত। বিএনপির জনপ্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুম হওয়াকে কেন্দ্র করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শনিবার পর্যন্ত সরকারকে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, তা পেরিয়ে গেলেও সরকার ইলিয়াসকে এখনো ফেরত দিতে পারেনি। ইলিয়াস আলীকে সরকারি এজেন্সির লোকেরা গুম করেছে, এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরও সরকার তাকে নিয়ে কেন যে এখনো লুকোচুরি করছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। ১৮ দলীয় জোট হরতাল কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না, কারণ সরকারকে তারা যথেষ্ট সময় দিয়েছে এবং নানাভাবে সহায়তা করেছে; কিন্তু সরকার ইলিয়াস আলীকে ফেরত না দিয়ে তাদেরকে হরতাল দিতে আবারো বাধ্য করেছে।
সরকার যদি ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়, তবে দেশের স্বার্থে অবশ্যই এটা ভালো কাজ। কিন্তু তার পরও সরকারকে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আর যদি তাকে ফেরত না দেয়, সে েেত্র তো সরকারকে অবশ্যই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, তাকে ফেরত দিলে সেখানে একটি প্রশ্ন কম থাকবে। যে প্রশ্নগুলোর জবাব সরকারকে দিতে হবে সেগুলো আজ দেশের প্রায় সব মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে সচেতন নাগরিক, যারা পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমের খোঁজখবর রাখেন, তারা অধীর আগ্রহে অপেমাণ যে, ইলিয়াস আলী কবে নাগাদ ফিরবেন। বিবেকের কাঠগড়ায় আজ সবাই অপরাধী। বহুল প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক সংবাদপত্রটিতে ২৬ এপ্রিল ইলিয়াস আলীর গুমের বিষয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম ছিল লাল কালিতে। এতে বিস্তারিত বলা হয়েছে কিভাবে ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন এবং কারা তাকে গুম করেছে; এমনকি গুমের প্রত্যদর্শী হিসেবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি তাৎণিকভাবেই ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। তবে তিনি জানতেন না যে, এই ব্যক্তিটি ছিলেন ইলিয়াস আলী এবং তাকে অপহরণ করা হচ্ছে। এই পুলিশ কর্মকর্তার জবানবন্দী পত্রিকাটিতে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। যদি এই জবানবন্দী সত্য হয় তবে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে ইলিয়াস গুমের সাথে সরকার জড়িত নয় এবং পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা জবানবন্দী দিয়েছেন। আরেকটি জবানবন্দী এসেছে। তা হলো নিকটস্থ পার্কের বেঞ্চে বসা ছিলেন এক ব্যক্তি, যিনি নিকটস্থ একটি বস্তির বাসিন্দা; কিন্তু রাত ১২টার পরে বস্তিতে ঢোকার অনুমতি নেই বিধায় তিনি ওই বেঞ্চের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। সেখান থেকে একটু দূরে বনানী দুই নাম্বার রোডের স্থানটি, যেখান থেকে ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। একপর্যায়ে উভয় পরে ধস্তাধস্তি, আওয়াজ ও হইচইয়ের কারণে ঘুম ভেঙে যায় এবং এ দৃশ্যটি তিনি নিজ চোখে দেখছিলেন। এসব প্রমাণ জনসপক্ষে প্রকাশ হওয়ার পর সবার চোখ-কান খুলে গেছে এবং কেউ কোনো অবস্থাতেই বলতে পারবে না যে, এই গুমের কোনো সাী-প্রমাণ নেই।
ছোটকালে আমরা অনেক ধরনের গল্পের বই পড়তাম। সবচেয়ে বেশি পড়তাম স্বপন কুমার সিরিজ নামে একটি গোয়েন্দা কাহিনীর বই; সেখানে গোয়েন্দার নাম ছিল দীপক চ্যাটার্জী। এটি অন্তত পঞ্চাশ বছর আগের কথা। পাশাপাশি অপর কয়েকটি সিরিজের নাম ছিল দস্যু বাহরাম, দস্যু বনহুর । তারও বেশ কিছু দিন পরে বাজারে আসে মাসুদ রানা সিরিজ। কথাগুলো এখানে এ জন্যই বললাম, সর্বাবস্থায় আমরা দেখেছি, পৃথিবীর যেকোনো চোর-ডাকাত বা হত্যাকারী বা সন্ত্রাসী যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাক না কেন, তার কোনো না কোনো একটি কু, নিশানা তথা প্রমাণ সে রেখে যায়। এর নামই বোধহয় ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। আর এমনিভাবে ইলিয়াস আলীকে যে অপহরণ করা হয়েছে তারও কু, প্রমাণ বা সাী ওই দু’জন ব্যক্তি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, অপরজন বেঞ্চে বসে থাকা ব্যক্তি। আমি বলতে চাই আজ হোক কাল হোক, এক বছর পরে হোক কিংবা পাঁচ বছর পরে হোক ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার মুখোশ উন্মোচিত হবেই এবং যারা এর সাথে জড়িত তাদেরকে এর জবাব দিতেই হবে। পৃথিবীতে এমন কোনো ইতিহাস নেই যে, মিথ্যার মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। এক মাইল মাটির গভীরে মিথ্যার অবস্থান থাকলেও তা খুঁড়লে সত্য ঘটনা বের হয়ে আসবে। এটাই অনস্বীকার্য বাস্তব তা।
হত্যা ও গুমের রাজনীতি প্রসঙ্গে আজ প্রায় সব পত্রিকায়ই লেখা হচ্ছে। এ েেত্র সরকারপন্থী পত্রিকাও পিছিয়ে নেই। সরকারপন্থী পত্রিকা হিসেবে পরিচিত দৈনিক জনকণ্ঠ, সমকাল এবং অনুরূপ অন্যান্য দৈনিকেও হত্যা, গুম বিষয়ে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে সমকাল পত্রিকায় একটি বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সমকালের সম্মানিত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। কি সরকারপন্থী আর কি বিরোধীপন্থী, আজ সবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন দেয়ার মতো লোকের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। দু’চার-পাঁচজন হয়তো আছেন যারা দেশ-বিদেশে এবং বিভিন্ন জেলা শহরে দলের দায়িত্বে থাকায় অন্য পথ না পেয়ে এখনো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জনগণ তাদের পাশে নেই। তবে হ্যাঁ, দলের পোষা ক্যাডার, যারা টাকার বিনিময়ে তাদের পেশিশক্তি ব্যবহার করে, শাসক দলের প হয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঘায়েল করার জন্য হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়Ñ তাদের কথা আলাদা।
গত কয়েক দিন ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশ আন্দোলনমুখর ছিল। এর মধ্যে যে বিষয়টি আমার মনকে ব্যথিত করে এবং দারুণভাবে নাড়া দেয়, তা হলো পুলিশ বাহিনীর নির্মম নির্যাতন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে সরকারি পোষা ক্যাডারদের পাশাপাশি পুলিশবাহিনী আজ অত্যন্ত দাপুটে মারদাঙ্গা ভূমিকায় চূড়ান্তভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গাছের সাথে বেঁধে, ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে কিংবা বুটের তলায় পিষ্ট করে পেটাচ্ছে। আমার মনে হয়, যেই পুলিশ কর্মকর্তারা এই কাজগুলো করেছেন হয় তারা মস্তিষ্কবিকৃত, নয়তো তারা আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের পাকাপোক্ত ক্যাডার ছিলেন; যাদেরকে সরকার পুলিশ বাহিনীতে চাকরি দিয়ে মাঠে পাঠিয়েছে শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনের জন্য। কারণ কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের লোক এ কাজ কখনো করতে পারে না। সরকারি বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণের প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ইতঃপূর্বে তারা প্রমাণসহ দেশ-বিদেশে সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। 
আগামী দিনে সরকার গঠনের বিষয় পর্যালোচনা করলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সরকার গঠন করবে। আর এ েেত্র সর্বপ্রথম তাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তা হচ্ছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এই সরকারের আমলে যত রাজনৈতিক ক্যাডারকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদেরকে বাছাই করে অপসারণ এবং নানা অপরাধের সাথে যেসব পুলিশ জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক দলীয় ক্যাডারেরা কোনো দিনও নিরপে সরকারি কর্মকর্তা হতে পারে না। রাজনৈতিক মত থাকলেই সরকারি চাকরি করতে পারবে না, এমন কথা বলছি না। বলছি, পেশিশক্তির ব্যবহারকারী রাজনৈতিক বা ক্যাডারের কথা দুর্বৃত্ত। 
পাঠক যখন এই কলাম পড়ছেন, তার ৪৮ ঘণ্টা কিংবা তার কিছু সময় আগে চ্যানেল আইয়ের ‘তৃতীয় মাত্রা’র একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমার পাশে অন্যতম আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপরিচিত মহিলা আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। সেখানে অল্প একটু প্রসঙ্গ উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের তথা ১৯৭১ সালের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কথা। আমি শুধু এটুকু বলার সুযোগ পেয়েছিলাম যে, জনাব তাজউদ্দীনের স্মৃতিকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার সুযোগ্য সন্তান তানজিম আহমদ সোহেল তাজ প্রথমে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন, তারপর সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন; এমনকি পত্রিকায় দেখেছি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার জন্য তিনি নাকি স্পিকার বরাবর অনুরোধও করেছেন ‘যেন তার এই পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রধান স্তম্ভ, সরেজমিন যুদ্ধ পরিচালনা করে যিনি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন সেই মহান নেতার যোগ্য সন্তান কেন বর্তমান স্বাধীনতাবান্ধব সরকারের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন? সোহেল তাজের পদত্যাগের চিঠি প্রকাশিত হয়েছে; সেখানে তিনি কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। তবে বলেছেন এমন কিছু কারণ আছে যা মুখে বলা যায় না এবং রাষ্ট্রের খাতিরে বলাও ঠিক নয়। অবাক হতে হয়! কত বড় রাষ্ট্রীয় কারণ লুকিয়ে থাকলে এমন কথা মুখে বলা যায়? আমার মনে হয়, বলতে পারলে হয়তো তিনি খুশি হতেন। দ্বন্দ্বটা কীÑ আমি জানি না, তবে সন্দেহ করছি দ্বন্দ্বটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৃহত্তর পরিবারের সাথে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী বাকি নেতৃত্বের বর্তমান প্রজন্মের। বৃহত্তর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সংসদ সদস্য শেখ সেলিম, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপসসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন। অপর পে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত নয় কিংবা আত্মীয়স্বজনও নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত তথা এই দলটির ক্রান্তিকালীন নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পরিবার, তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার, কামরুজ্জামানের পরিবার। এদের পরিবারের সাথে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাদের দূরত্বটা কোথায় এবং কত দূর? আমরা ল করেছি, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের বর্তমান মতাসীন আওয়ামী লীগ উপযুক্ত মূল্যায়ন করে না। রণাঙ্গনের একজন জীবিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা দুরূহ ছিল; জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা আর মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ময়দানে থেকে নেতৃত্ব দেয়া, দুটো আলাদা জিনিস। কেন আজ আমরা সেই মহান মুক্তিযোদ্ধা বীর নেতাদেরকে অস্বীকার করছি; তাদের প্রজন্মকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি তা সরকারের কাছে আমার প থেকে একটি প্রশ্ন? আজ এই মহান নেতাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে অনেকেই সরকারের কাছ থেকে চরম অবহেলিত; তাদের কোনো খোঁজখবর নেয়া হয় না। সোহেল তাজের মা জোহরা তাজ আজ চরম অবহেলিত। এমন পরিস্থিতিতে তার পদত্যাগকে সরকার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। সোহেল তাজের প্রতি সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। আরেকটি বিষয় আমার মনে হয়, দেশের স্বার্থবিরোধী এমন কোনো কাজ হয়েছে যা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। তিনি তার পিতার অর্জিত গরিব দেশটির জনগণের সাথে বেঈমানি করতে চাননি। পদত্যাগটি যদি দেশের স্বার্থে হয়ে থাকে তবে বলতেই হয়, সাবাশ ব্যাটা! মহান তাজের বিদ্রোহী তাজ।’ আজ হোক কাল হোক সেই লুকিয়ে থাকা কারণ উন্মোচিত হওয়ার অপোয় থাকলাম। 
আমরা একটি গিরিখাদের মধ্যে বন্দী হয়ে ঝুলন্ত ভাঙা সাঁকোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। আর দু-এক পা অসতর্কভাবে এগোলে আমরা গর্তে নিমজ্জিত হব। বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটি গর্তে পড়ে গেলে তাৎণিক উদ্ধার করার জন্য উদ্ধারকারী দল ও সরঞ্জাম আনতে হবে। রূপক অর্থে বলতে চাই, এই উদ্ধারকারী দল বা সরঞ্জামের জোগানদাতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে অকার্যকর করা এবং দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কারো না কারো স্বার্থ নিহিত। বাংলাদেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে দেশটিকে অকার্যকর করে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে একদল দোসর দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কাছে দেশপ্রেম মূল বিষয় নয়, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের স্বার্থরা এবং বিদেশীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহয়তা করা। খাঁটি দেশপ্রেমিক যারা, তারা আজো বড় ধরনের কোনো প্রতিরোধ কিংবা শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারেননি। তবে আগের চেয়ে অনেক মজবুত হয়েছে তাদের খুঁটি। পাশাপাশি, বর্তমান তরুণসমাজ এবং দেশসেবায় উজ্জীবিত সব দেশপ্রেমীকে আহ্বান জানাচ্ছি এ বিষয়ে চিন্তা করার জন্য। আজ বাংলাদেশের অস্তিত্ব গভীর সঙ্কটের মুখে এবং দেশের স্বার্থ বিঘিœত; জনচাহিদা উপেতি। 
সম্মানিত পাঠকের কাছে একটা গল্প বলি, তা হলোÑ প্যারিস নগরীতে বিশ্ববিখ্যাত একটি স্থাপনা আছে যার নাম আইফেল টাওয়ার। এখন থেকে প্রায় দেড়-দুই যুগ আগে বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন রিডার্স ডাইজেস্টে একটি গল্প পড়েছিলাম; তার শিরোনাম ছিলÑ ‘দি ম্যান হু সোল্ড দি আইফেল টাওয়ার টোআইস’। অর্থাৎ ওই ব্যক্তিটি যিনি আইফেল টাওয়ারকে দু’বার বিক্রি করে দিয়েছেন। আইফেল টাওয়ার প্যারিসের জাতীয় সম্পদ, এটা কারো বাবার সম্পদ নয়। কোনো একজন অতি চতুর প্রতারক আইফেল টাওয়ারকে নিজের সম্পদ বানিয়ে বিদেশী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করার বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং দু-দু’বার সাফল্যের সাথে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তিনি তৃতীয়বার বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় পড়েছিÑ ‘একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছে কোম্পানি জমি কিনেছে, তারপর ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দিয়েছে, ব্যাংকের কাছ থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছে, আবার ওই বন্ধকি জমি কিছু লোকের কাছে বিক্রি করে তাদেরকে রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে; এর সাথে প্রতারণার বিরাট একটি চক্র জড়িয়ে আছে।’
দু-তিন সপ্তাহ আগে ডেসটিনি নামে একটি কোম্পানি নিয়ে অনেক শোরগোল হয়ে গেল। একই নামে তাদের নাকি ১৫-২০টি কোম্পানি আছে। সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল হারুনুর রশিদ বীরপ্রতীক ডেসটিনি গ্র“পের সভাপতি। যুগান্তর পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম চার-পাঁচটা কোম্পানিতে কয়েক লাখ শেয়ার তার আছে। অর্থাৎ জেনারেল হারুনুর রশিদ জেনেশুনেই ওই কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। অনেকে সন্দেহ করে বলে, ওই কোম্পানি একই গাছ কত জনের কাছে যে বিক্রি করছে তা এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। সাধারণ লোকে বলাবলি করে, গাছের নামে বাঁশ লাগিয়ে তা বিক্রি হচ্ছে কি না, তাই বা কে জানে? ডেসটিনি কক্সবাজারে টাওয়ার বানিয়ে সে টাওয়ার ঢাকা শহরে বিক্রি করছে। এভাবেই সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা, এক অভিনব ব্যবসায়িক কায়দায় তারা অগ্রসর হচ্ছে। ডেসটিনির মাধ্যমে অনেক তরুণ ব্যতিক্রমী পন্থায় কর্মসংস্থান বা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন সত্য, তেমনি নিবিড় আশঙ্কা অতীতের ‘যুবক’-এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে কি না।
অনুরূপভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে রূপক অর্থেই যে কেউ বিক্রি করে দিচ্ছে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে? যদি বিক্রি হয়, তবে এমন সুচতুরভাবে সূক্ষ্মভাবে বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে যে, আপনি যত দিনে বুঝতে পারবেন, তত দিনে আর কিছু বাকি থাকছে নাÑ সব বিক্রি হয়ে গেছে। পুনরুদ্ধারের কোনো পথ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, একটি দেশ কিভাবে বিক্রি হয়ে যায়? দেশ বিক্রি মানে দেশের নেতাদের দেশপ্রেম, বিবেকবুদ্ধি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা বিলীন বা বিপন্ন, সর্বোপরি দেশের নেতৃত্ব যখন নতজানু হয়ে বিদেশীদের দোসর হয়ে কাজ করে, দেশের মাটির ওপর দিয়ে যখন কোনো বিদেশীর পদচারণা, ট্রানজিট, খনিজসম্পদ, সমুদ্রসীমা, আকাশসীমা, নৌসীমা অন্য দেশকে বিনামাসুলে বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়। এতই হীনম্মন্যতায় সে পতিত হয়েছে যে, সে নিজকে বাংলাদেশের নাগরিকও বলতে লজ্জাবোধ করে। আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশীÑ রাষ্ট্রীয় মতাধর ব্যক্তিটি যদি এ কথাটি বলতে লজ্জাবোধ করেন; রূপকার্থে হলেও মনে করতে হবে বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে গেছে। কাগজপত্র ও দলিল দিয়ে দেশ বিক্রি হয় না, তখন বিক্রি হয় মানুষের বিবেক। রাষ্ট্রের সর্বত্র আজ এমনটিই দেখা যাচ্ছে। ভারত যদি আমাদের অমীমাংসিত নদীগুলোর পানি না দেয় এবং আমাদের বাধ্য করে যে, পানি পেতে হলে ‘এই এই’ শর্ত মানতে হবে; সে েেত্র নিজের অধিকারের কথা না বলে উল্টো তাদের শর্ত মেনে নিলাম এবং তাদের কাছে মাথা নত করলাম; তার মানে তাদের কাছে আমি বিক্রি হলাম। আর এ কথাটি দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছি, বাস্তবিক আমরা আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি।
এই সঙ্কট থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হলে দেশপ্রেমী সব মানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। তবে সচেতন হওয়ার পথে কয়েকটি জায়গা থেকে বাধা আসছে। সেই বাধাগুলো পদতলে মাড়িয়ে ফেলতে হবে। দেখা গেছে, আমরা যেন সচেতন হতে না পারি সে জন্য আমাদের চিন্তাশক্তিকে ডাইভার্ট তথা ভিন্নপথে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরঞ্জিত বাবুর অর্থ কেলেঙ্কারির দোষ ঢাকতে সিলেটের জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে অপহরণ এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা ও গুমসহ নানা নতুন ঘটনার উদ্ভব। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এক পতাকাতলে জমায়েত হতে হবে; সেই আশায় শেষ করছি। 
লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্ট ও ক্যান্টনমেন্ট সমানে সমান!


মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ৩০-০৪-২০১২



পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট ২৬ এপ্রিল ৩০ সেকেন্ডের যে প্রতীকী দণ্ড দিয়েছেন, তা পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম। বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশ পায়নি। তবে সংক্ষিপ্ত আদেশ পড়ে প্রতীয়মান হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের এ বেঞ্চ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে গিলানির প্রস্থান চাইছেন। কিন্তু এই আদেশ ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নসাপেক্ষ। 
আমার প্রাথমিক মন্তব্য হচ্ছে, নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ামাত্রই গিলানি প্রধানমন্ত্রীর পদে অযোগ্য হয়ে পড়েছেন বলে যে মন্তব্য করছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এর নৈতিক ভিত্তি যদিও বা আছে, সাংবিধানিক কোনো ভিত্তি নেই। তাঁকে অবৈধ বলা একটা বাগাড়ম্বর।
সুপ্রিম কোর্টে দণ্ডিত হওয়ার পর গিলানি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেন, তাহলে তিনি নৈতিকতার দিক থেকে একটি অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। সেই সুযোগ তাঁর ও পিপিপির সামনে খোলা থাকছে। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনেও আপিলকালে তার রায়ের ত্রুটি শোধরানোর পথ খোলা।
‘ডার্টি মানি’র স্বর্গরাজ্য সুইসব্যাংক। আমাদের দেশি ভ্রাতঃগণও হয়তো পিছিয়ে নেই। ১/১১তে ক্লেম্যান আয়ল্যান্ডে মিলিয়ন ডলার লুকানোর গল্প শুনেছিলাম। সুইস তদন্তকারীরা বেনজির ভুট্টোর এক লাখ ১৭ হাজার পাউন্ডের হীরার অলংকারসহ ভার্জিন আয়ল্যান্ডে পাওয়া জারদারি দম্পতির ১২ মিলিয়ন ডলার জব্দ করেছিলেন। ২০০৩ সালে সুইসকোর্টে ৫০ হাজার ডলার জরিমানাসহ তাঁরা দণ্ডিত হয়েছিলেন। দণ্ডিত রাষ্ট্রপতির পর পাকিস্তান পেল দণ্ডিত প্রধানমন্ত্রী। জারদারি আপিল করেছিলেন। সেই মামলাই বিচারাধীন ছিল, সুপ্রিম কোর্ট যা পুনরুজ্জীবিত করতে সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিতে গিলানিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। 
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ প্রধান বিচারপতি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীকে নজিরবিহীন উপায়ে বরখাস্ত করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ আইনজীবী সমাজকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে এক অসাধারণ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এর ফলে অপসারিত প্রধান বিচারপতি আবার স্বপদে ফেরেন। কিন্তু পিপিপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের সংবিধানে লেখা থাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তাঁর বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের ফৌজদারি কার্যধারা অচল। পাকিস্তানের সংবিধানের ২৪৮ অনুচ্ছেদেও তাই বলা। আমাদের সুপ্রিম কোর্টও এরশাদের একটি মামলায় তেমনই রায় দেন।
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে ওই যে আদেশটি দিলেন, সেটি কী করে ২৪৮ অনুচ্ছেদের ওই বাধানিষেধ পেরিয়ে যৌক্তিক হতে পারল তার ব্যাখ্যা আমরা পাই না। এটাই আদালতের বিরোধপূর্ণ আদেশটির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। 
বিচারপতি নাসির উল মুলকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চের সংক্ষিপ্ত আদেশটি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আক্রমণাত্মক বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। আদালত অবমাননার এই সুয়োমোটো মামলাটি ১৯ জানুয়ারি থেকে ২১ দিন ধরে শুনানি চলেছে। একজন কর্মরত প্রধানমন্ত্রীকে দণ্ডাদেশ দেওয়ার সংক্ষিপ্ত আদেশে অবাক হয়ে দেখি, নির্বাহী বিভাগের পক্ষ থেকে যেসব জ্বলন্ত সাংবিধান প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সে বিষয়ে আদালত একেবারেই নীরব। বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেওয়া হলো। এর কারণসমূহ পরে লিপিবদ্ধ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা, অমান্য ও অবাধ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি যে তিনি যেভাবে আদালত অবমাননা করেছেন, তাতে বিচার প্রশাসনে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতি বয়ে এনেছে এবং দেশের বিচার বিভাগ উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে।’ উপহাস বা রিডুক্যুল শব্দটি সুচিন্তিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে সংবিধানের একটি অভিনব বিধানের ফাঁদে ফেলে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সরানোর রাস্তা খুলে যায়। আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ তাই যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের উপায় নির্দেশ করেছে তাতে তাদের প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন না তুলে উপায় থাকে না। 
সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘ওপরে উল্লিখিত “ফাইন্ডিংস” ও দণ্ডাদেশের ফলে সংবিধানের ৬৩(১)(ছ) অনুচ্ছেদের শর্তাবলিতে কতিপয় গুরুতর ফলাফল আনতে পারে, যা কি না তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ প্রদানের উপশমক ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য হতে পারে। এমতাবস্থায় তাঁকে আজ আদালতের কার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত আদালত কক্ষে অন্তরীণ থাকার শাস্তি দেওয়া হলো।’
পাকিস্তানের সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদটিতে সাংসদেরা কী কী কারণে অযোগ্য হতে পারেন তার ফিরিস্তি রয়েছে, যেমন আছে আমাদের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে, যার আওতায় সম্প্রতি সোহেল তাজ ইস্তফা দিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের ওই অনুচ্ছেদটি একটি অনাসৃষ্টি। ১৯৫৬ সালের ৪৫ অনুচ্ছেদ ও ১৯৬৮ সালের ১০৪ অনুচ্ছেদ আজকের পাকিস্তানের ৬৩ অনুচ্ছেদের পূর্বসূরি। এমপি পদ খাওয়ার এমন আজগুবি শর্তাবলি সেখানে দেখি না। এটা প্রথম দেখি বাংলাদেশকে হারানোর পর ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর তৈরি করা নতুন সংবিধানে। সেই সংবিধানে ভুট্টো চালাকি করে পাকিস্তানের ক্ষমতার শাশ্বত সূতিকাগার সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। জ্যেষ্ঠদের ডিঙিয়ে জিয়াউল হককে তিনি সেনাপ্রধান করেন। জিয়াই তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলান। এই গল্পটা যতটা প্রচার পেয়েছে পিপিপির এই সাংবিধানিক দুষ্কর্ম, যার বিবরণ এখন আমি আপনাদের দেব, সেটা আজও ততটা প্রচার পায়নি। এমনকি আমি হতাশ হচ্ছি, এখনকার পাকিস্তানি নাগরিক সমাজও এ বিষয়ে নীরব। 
আর কী নির্মম পরিহাস, সেই পিপিপি এখন এত বছর পর সেই ৬৩ অনুচ্ছেদের ছ বিধানের ফান্দে পড়েছে। ‘আমি সাধু এবং সম্মানিত’, এ কথা বুকে-পিঠে লিখে যদি কেউ ঘুরে বেড়ান, তাহলে লোকে তাঁকে হয় পাগল, না হয় মতলববাজ হিসেবে সন্দেহ করবেই। ঠিক তেমন করে পিপিপি সম্ভবত ১৯৭৩ সালের সংবিধানেই প্রথম লিখল, ‘যদি কোনো সাংসদ পাকিস্তানের আদর্শের জন্য ক্ষতিকর কোনো মতামত প্রচার কিংবা কোনোভাবে তৎপরতা চালান কিংবা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা বা নৈতিকতা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষা কিংবা পাকিস্তানের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা তার সাধুতা বা বিচার বিভাগ ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মানহানি বা তাকে ঠাট্টা করেন এবং সে জন্য কোনো উপযুক্ত এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে দণ্ডিত হন এবং ছাড়া পাওয়ার পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয় তাহলে তিনি সাংসদ থাকবেন না।’ 
আমরা পাকিস্তানিদের মতো এবার সামরিক শাসন ঠেকাতে ৭ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করেছি। ভুট্টো সামরিক শাসন জারিকে হাইট্রিজন এবং সে জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছিলেন ওই ’৭৩ সালেই। জলপাই রঙের লোকেরা যাতে খেপে না যায় সে জন্য তিনি ওই নতুন বিধানটি যুক্ত করেন। সুপ্রিম কোর্ট ও ক্যান্টনমেন্টের মর্যাদা সমান করেন। এখন পাকিস্তানের বিরোধী দল লম্ফঝম্ফ দিচ্ছে এই বলে যে গিলানি ক্যান্টনমেন্টকে না হলেও সুপ্রিম কোর্টকে ‘উপহাস’ করেছেন। তাই আদালত থেকে বেরোনোর পর থেকেই তিনি আর পাকিস্তানের বৈধ প্রধানমন্ত্রী নন। 
পিপিপির বর্তমান সরকার বিরোধী দলকে আস্থায় রেখে এক ঐতিহাসিক সাংবিধানিক উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। এ থেকে শিক্ষা নিতে একটু বিশদভাবে বলি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা হয়েছে। ৯০ অনুচ্ছেদ বলেছে, নির্বাহী কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির নামে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা প্রয়োগ হবে। আর কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত হবে। আর সেই কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ৯১ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে আর সেটি রাষ্ট্রপতিকে তাঁর দায়িত্ব পালনে পরামর্শ দেবে। ৪৮ অনুচ্ছেদ বলেছে, রাষ্ট্রপতি তাঁর সব কার্য পালনে মন্ত্রিসভা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলবেন। আসিফ আলী জারদারি আর বাংলাদেশের ‘কবরস্থানের ফাতেহা পাঠের’ নন। সংবিধান স্পষ্ট বলেছে, যেসব স্থানে নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিয়েছে সেসব ক্ষেত্রে তিনি ডিসক্রিশন বা একক কর্তৃত্বে চলবেন, সে ক্ষেত্রে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার পরামর্শ নেবেন না। আর সেই দায়িত্ব পালনসংক্রান্ত কোনো ধরনের বৈধতার প্রশ্ন কোনো কারণেই তোলা যাবে না। কোনো আদালতই প্রশ্ন করতে পারবেন না মন্ত্রিসভা বা প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দিয়েছেন। 
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকব, তাঁরা কীভাবে এসব অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে গিলানিকে দণ্ড দিয়েছেন। শুধু নাম সুপ্রিম কোর্ট বলেই তাঁরা যা খুশি তা-ই করতে পারেন না। ব্যক্তির অজ্ঞতা, হঠকারিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার যোগফল ‘আদালত অবমাননা’ বলে গণ্য হতে পারে না। বিশ্বের সব সমাজে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ‘আদালত অবমাননা’ সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। 
সুইস আদালতে একজন কর্মরত রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মামলা পুনরায় চালু করতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শুধু রাষ্ট্রপতির দায়মুক্তিসংক্রান্ত ২৪৮ অনুচ্ছেদ কেন, উক্ত ৪৮ অনুচ্ছেদও মানবেন। সুতরাং প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্ট ২৪৮ ও ৪৮ অনুচ্ছেদের কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আপাতদৃষ্টিতে সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটে এমন আদেশ আদৌ দিতে পারেন কি না। এবং তা দিলেও প্রধানমন্ত্রী তা মানতে বাধ্য কি না। 
আমি মনে করি না যে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আপনাআপনি বৈধতা হারিয়েছেন। স্পিকারও প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের উদ্যোগ নিতে পারবেন না পূর্ণাঙ্গ রায় ও আপিলে সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত। আদালত নয়, গিলানির অপসারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মজলিস ই শুরা (সংসদ)।
স্যার আইভর জেনিংসের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান তৈরির জন্য গঠিত কমিশনের উপদেষ্টা ছিলেন। ‘কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তাহলে তাঁর ক্ষমতা এতটাই অপ্রতিরোধ্য যে রোম সম্রাটও তাঁকে ঈর্ষা করবেন।’ 
পাকিস্তানের বিচার বিভাগের কাছ থেকে এমন সক্রিয়তা চাই না যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে দেয়। বন্দুকের নলের পরিবর্তে আদালতের কলমের খোঁচায় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ বেশি মহীয়ান কিনা, সেই কূটতর্ক বৃথা। পাকিস্তানের জনগণ বন্দুকের দুঃস্বপ্ন ভুলে একজন গিলানিকে ইতিহাসের দীর্ঘকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে। 
ওই বেঞ্চটি ভাগ্যিস গিলানিকে তিন মাস বা ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় অবতীর্ণ হয়নি। অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আদালত সর্বতোভাবে একটি এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয় অনুশীলন করেছেন কিনা, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরে বলার সুযোগ পাব। তবে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন সত্যি হলে আদালত নিশ্চিতই অপ্রয়োজনীয় বিষয় চর্চা করেছেন। কারণ, সুইস প্রসিকিউটররা সাফ বলেছেন, গিলানি যদি চিঠি লিখতেনও, তাহলেও তাঁরা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত চালাতে অক্ষম থাকতেন। 
ধরা যাক গিলানি চলে গেলেন। পিপিপি নতুন প্রধানমন্ত্রী আনল। তাহলে তো তখনো আদালত অবমাননা ঘটতে পারে। তখন সুপ্রিম কোর্ট কী করবেন? গিলানি আপিল করলে সুপ্রিম কোর্ট এ ক্ষেত্রে ‘ডক্টরিন অব প্রসপেক্টিভ ওভাররুলিং’ (আদালতের আদেশ ভবিষ্যতে কার্যকর হবে) প্রয়োগ করতে পারেন। আসিফ জারদারির ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ামাত্রই সুইসদের কাছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার চিঠি পাঠাবে। এটা বাধ্যতামূলক করে রায় লেখা সম্ভব। পাকিস্তানের জনগণের মতো আমরাও আমজনতার প্রাণের টুকরা ‘গণতন্ত্রের প্রাচ্যকন্যাদের’ (বেনজিরের বইয়ের নাম ডটার অব দি ইস্ট) গোপন রত্নভান্ডার সম্পর্কে তথ্য জানতে এবং তার দায়ে দোষীদের দণ্ড চাই। 
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

সখিপুরে মহাপ্রলয় ও কঠিন রাজনৈতিক দুর্যোগ



বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
আমি নুহ নবীর (আ.) প্রলয় দেখিনি। কিন্তু বহু ঘূর্ণি দুর্বিপাক দেখেছি। স্বাধীনতার পর সিলেট, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুরের ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় অনেকদিন ত্রাণ পরিচালনা করেছি। এই তো কিছুদিন আগে ’৯৬ সালে মিরিকপুরের ঘূর্ণিঝড়ে বাসাইল-সখিপুরে মাসব্যাপী দুর্গত এলাকায় রাতদিন দুস্থদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। গত ২১ এপ্রিল শনিবার রাতে সখিপুরের গজারিয়া, কালিয়া, কালমেঘা ও কাকড়াজান ইউনিয়নের ওপর দিয়ে আচমকা বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক ধ্বংসলীলা এর আগে দেখিনি। গজারিয়া ইউনিয়নের বাঘবেড়, পাথারে হাজার হাজার গাছপালা ভেঙে গেছে। লাখো কলাগাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে মাঠে হাজার মণ ধান ফলত, সেখানে এক কেজি ধানও কেউ পাবে না। খুবই আশ্চর্য হয়েছি গজারিয়া মুচারিয়া পাথারের সড়কঘাটা দরগারপাড় শাহ সুফি বদর উদ্দিন শাহ’র মাজার দেখে। যেখানে শীল পড়ে শত শত বাড়িঘরের টিনের চাল ঝাঁঝরা হয়ে ভেঙে খান খান হয়ে গেছে; সেখানে মাজারপাড়ে ঘরের আশপাশে প্রায় দশ-বিশ টন বরফ পড়েছে। অথচ মাজার ঘরের টিনের চালে একটা টোকাও লাগেনি। স্রষ্টার এ কী অলৌকিক কারবার! কাকড়াজানের ঢনঢনিয়া মুচারিয়া চালার একটি ঘরও অক্ষত নেই। ঘরের ঢেউটিন সব সমান হয়ে গেছে। কোনো গাছে ডালপালা নেই, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তৈলধরার শত শত বাড়ির টিন চালুনছিদ্র হয়ে গেছে। আমি প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা পর দুর্গত এলাকায় গিয়েছিলাম। সে সময়ও বরফ গলা শেষ হয়নি। অনেকে বলেছে, ঝড়ের ত্রিশ ঘণ্টা পরও ছয়-সাত কেজি ওজনের বরফ খণ্ড পাওয়া গেছে। ত্রিশ ঘণ্টা পর যদি ছয়-সাত কেজি ওজনের বরফ খণ্ড পাওয়া যায়, তাহলে যখন সেটা পড়েছিল তখন তার ওজন কতটা ছিল, কোনোমতেই ১৫-২০ কেজির কম হবে না। এত ভারী বস্তু আকাশ থেকে পড়লে ঘরের যা অবস্থা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনো গাছের ডালপালা নেই, ক্ষেতের ধান নেই। ওই এলাকায় কোনো মানুষের এক ছটাক ধান পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকার এত বড় বড় কথা বলে, কিন্তু কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। কোনো মন্ত্রী-এমপি বা কোনো বড়সড় নেতা দুর্গত এলাকায় যায়নি। বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। বিজয়ের পর এই সাড়ে তিন বছর শুধু নাচানাচি, কনসার্টে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মানুষজন বলছে, আল্লাহর নাম নেই শুধু সার্কাস, জুয়া, হাউজি, উলঙ্গ নাচ। এত বড় বিপর্যয় ও দুর্যোগ হলো, কিন্তু ত্রাণমন্ত্রী আমার এলাকার মানুষ। এক মুহূর্তের জন্যও দুর্গত এলাকায় যাননি। এক ভয়াবহ দুর্বিষহ অবস্থা সেখানে। এখন কী যে হবে দুর্গত এলাকার মানুষের, আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনই জানেন। আমি যখন করটিয়া কলেজে পড়তাম তখন জমিদার পন্নীদের বলতে শুনেছি, ৬০-৭০ বছর আগে তাদের বাপ-চাচারা যখন হাতি চড়ে পাহাড় এলাকায় যেতেন, সখিপুরের পশ্চিমে মাজারপার হজরত শাহ কামালের মাজারের কাছে গেলে হাতি বসে পড়ত। কোনো সওয়ারী নিয়ে ওই এলাকা পার হতে চাইত না। পাশেই ওলিয়ে কামেল হজরত শাহ কামালের মাজার। হাতি সওয়ারী নিয়ে যেতে চায় না—এটা জানাজানি হওয়ার পর আর কখনও করটিয়ার জমিদাররা হাতিতে বসে ওই এলাকা পার হতেন না। নেমে পায়ে হেঁটে পার হতেন। সেই মাজারের পাশে গত তিন মাস সার্কাস হয়েছে, জুয়া হয়েছে, হাউজি হয়েছে, মেয়েদের অশ্লীল নৃত্য হয়েছে। আমি স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ওসব না করতে কয়েকবার বলেছি। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে আমার সহকর্মী ছিল। কিন্তু এখন যারা আওয়ামী লীগ করে, তারা কেউ কারও কথা শোনে না। সখিপুরের দাড়িয়াপুর ফালুচান্দের এক জাগ্রত মাজার। সেখানে নানাভাবে পাগলদের হয়রানি করা হয়েছে। বাসাইলের বার্থার নব্বেছ চান্দের মাজারে লাখো মানুষের সমাগম হয়। সেখানে কত কী যে করা হয়েছে। বেয়াদবির সীমা-পরিসীমা নেই। মহানন্দপুর হিন্দু পল্লীতে যেখানে কয়েক হাজার গাছের এক আম বাগানে একটি গাছও অক্ষত নেই, দেখে মর্মাহত হয়েছিলাম। সেখানে বয়সী মুরব্বিরা বড় তীর্যকভাবে বলছিলেন—‘এত জুয়া, হাউজি, সার্কাস আর গান-বাজনা করলে আল্লাহ সেখানে গজব না ফেলে কি রহমত দিতে পারেন?’ মুরব্বিদের কথা শুনে বড় বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে কি ক্ষমতাসীনদের পাপের শাস্তি আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন দরিদ্র গরিব জনসাধারণকে দেবেন? লাল বানু নামে ১২০-১২৫ বছরের এক বৃদ্ধা আমায় তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার আমায় খাইয়েছিলেন। তার ঘরের একটি টিনও অক্ষত নেই। বড় বড় শিল পড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তিনি তার ভাঙা চৌকিতে বসিয়ে একটি জাজিম দেখিয়ে বললেন, ‘বাবা, ঘরে ওই জাজিমটা ছিল বলে ওর নিচে গিয়ে শিলের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।’ দুর্গত এলাকার মানুষদের দয়া করে আল্লাহ তো জীবন বাঁচিয়েছেন, কিন্তু দয়াময় আল্লাহর দয়া না হলে বর্তমান উদাসীন সরকারের জমানায় তাদের জীবন বাঁচবে কি করে? দয়াময় তুমি আমার মানুষদের বাঁচাও।
যে উত্সাহ নিয়ে শান্তিময় বাংলা বছরের আশা করেছিলাম তা শুরুতেই কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। একেবারে হতাশ না হলেও কিছুটা শঙ্কাবোধ তো করছিই। একবুক জ্বালা নিয়ে ২৪ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরিক জাতীয়তাবাদী দলের পল্টনের কার্যালয় গিয়েছিলাম। তাদের কাছে যা প্রত্যাশা করেছি, তার চেয়ে কম সৌজন্য পাইনি। চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। তারা ছিল খুবই উদ্বিগ্ন। বাড়ির মালিক ভালো না হলে তার কর্মকর্তা-কর্মচারী ভালো হবে কী করে? সরকারের সৌজন্য নেই, সহনশীলতা নেই, কাউকে ন্যূনতম সম্মান দেখানোর কোনো তাগিদ নেই। সেখানে পুলিশরা তো একটা লাঠিয়াল বাহিনী। তারা কিইবা করতে পারে। চারদিক থেকে তাদের ওপর যে পরিমাণ চাপ, অথচ মানবিক গুণাবলীর কিছুই শিক্ষা দেয়া হয়নি। তার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের যে আচরণ দেখি, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। সেদিনও যে তেমনটি দেখিনি তা নয়। গামছা বিছিয়ে তপ্ত রোদে পল্টনের রাজপথে পড়ে ছিলাম। পল্টন থানার ওসি ও উপ-কমিশনার যথার্থই উপযুক্ত কর্মকর্তার মতন পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। আইনানুগ যতটুকু করা দরকার তা তারা করেছেন। সারাদিন তপ্ত রোদে পুড়ে নিম্নস্থ পুলিশ কর্মচারীরা কীভাবে ধৈর্য রাখে, সেটাই তো প্রায় ৫০-৫৫ মিনিট নিচে-উপরে আগুন নিয়ে পিচঢালা রাজপথে শুয়ে থেকে পিঠে ১০-১৫টি ফোসকা ফেলে নিজেই দেখেছি। তাই সবকিছু একতরফাভাবে বলে কোনো লাভ নেই। আমাদের কর্মচারীদের চাইতে কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বেশি। নেতারা ভালো হলে, সরকার ভালো হলে কর্মকর্তারা অবশ্যই ভালো হতো। ভালো কর্মকর্তা থাকলে দেশের জন্য আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কর্মচারী পেতাম। দুর্ভাগ্য, আমরা তেমন পাইনি। বিএনপি অফিসে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে আমরা যথাযথ রাজনৈতিক আচরণই পেয়েছি। জনাব রুহুল কবীর রিজভীর আচরণও ছিল যথার্থ। আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দলের অফিসে গিয়ে সরকার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি। কাঠফাটা রোদে পল্টনের রাজপথে নেতাকর্মীসহ সস্ত্রীক পড়ে থেকে কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করে বাড়ি ফিরেছি। ওইদিনই প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন ছিল। সৌজন্যের খাতিরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং তার প্রতি সরকারি জুলুম সম্পর্কে কেন যেন একটি কথাও বলেননি। এই একবারও কিছু না বলায় সাধারণ মানুষ যেমন, আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরাও কমবেশি আহত হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক দল থাকে অনেক। সংগ্রামের ধারা সব সময় দুটি। একটি সরকারি, আরেকটি বিরোধী। সরকার সরকারের মতো না চললে সরকারের কানে পানি দেয়ার জন্য বিরোধী দলের ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও মূল লক্ষ্য এক। তা হলো সরকারকে সরকারের মতো চালানো, সেক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল এবং দলনেতার সার্বিক নেতৃত্বই দেশবাসী আশা করে।
২৪ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী দলের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাকর্মীদের ওভাবে গ্রেফতার করা সভ্য সমাজের বিচারে জঘন্য নিন্দনীয় কাজ। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা ফরিদ আহমেদ, আলমগীর হোসেন, রিপন, আতাউল গনি ওসমানী, আরিফ, কাইয়ুমসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করে পল্টন থানার কয়েদখানায় নিয়ে রাখা মোটেই ভালো হয়নি। বিষয়টা সবাইকে খুবই হতাশ এবং মর্মাহত করেছে। দলীয়ভাবে আলোচনা করে একটা বৈঠকে যাওয়ার পর কিছু নেতাকর্মীকে পুলিশের কয়েদখানায় রেখে বাড়ি ফিরতে মন খুব একটা সায় দেয়নি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম করতে চেয়েছি। তাই রাস্তায় শুয়েছিলাম। জনাব গোলাম আজমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তাই অত কাঠফাটা রোদে প্রকাশ্য দিবালোকে সহধর্মিণী নাসরীন সিদ্দিকীকে পাশে রেখে শুয়ে ছিলাম। সেদিন নতুন করে উপলব্ধি করেছি বিপ্লবী কবি কাজী নজরুলের কথা, ‘কোনদিন একা হয়নি তো জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।’ সত্যি পুরুষের পাশে আন্তরিকভাবে কোনো নারী দাঁড়ালে তাকে রোধ করার কোনো শক্তি কারও থাকে না। অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না। সেজন্য নাসরীন সিদ্দিকীকে ধন্যবাদ, গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। আমরা মারামারি, কাটাকাটি করতে যাইনি, গাড়িতে আগুন দিয়ে নিরীহ চালককে পুড়িয়ে মারতে যাইনি। সে সময়ের জন্য আমাদের বিচার-বিবেচনায় যা সবচাইতে বেশি কার্যকরী ও উপযুক্ত মনে হয়েছে, তা-ই করেছি। আমার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক রাজধানীর রাজপথে পড়ে থাকলে যদি দেশ ও জাতির সম্মান বৃদ্ধি হয় তাহলে তা হয়েছে। আর যদি ওইভাবে রাস্তায় পড়ে থাকার কারণ ঘটানোর কাজ করে অন্যায় করে থাকে সরকার ও প্রশাসন এ থেকে সাবধান থাকবে, সেটাই বিবেকবান মানুষ মনে করে। দেশ ও দেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ও সাধারণ মানুষের জন্য শঙ্কাময় হোক, এটা আমরা চাই না। এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বা স্বাভাবিক করা সরকারের দায়িত্ব। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ঘটনা কোনোমতেই কারও জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। গুম কে করেছে—সরকার না বিরোধী দল, এটা আমাদের কোনো বিবেচ্য নয়। ইলিয়াস আলী গুম হয়েছে, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না জনসমক্ষে তাকে হাজির করা সরকারের দায়িত্ব, সেটা করতে হবে। যত মোচড়ামুচড়ি করা হোক, এখান থেকে পরিত্রাণের সরকারের কোনো উপায় নেই। ইলিয়াস আলী কী ধরনের লোক ছিল, এগুলো কোনো কৈফিয়তের মধ্যে পড়ে না। সে এদেশের নাগরিক, মানুষ তার খবর চায়। তার পরিবার-পরিজন শঙ্কিত ও ব্যথিত। আমরাও সমভাবে ব্যথিত। তাই আমরাও তাকে চাই। ইদানীং সরকারি দলের যেসব নেতা কথায় কথায় যুদ্ধ করতে চান, যুদ্ধের সময় তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে না—এটা ষোল আনা নিশ্চিত। এরা সবাই ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া খেলোয়াড়। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে বাগাড়ম্বর করার কোনো মানেই হয় না। তাই ইলিয়াস আলীর ঘটনা সমাধান করতে হবে। প্রধান বিরোধী দলকেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। জনগণকে দুঃখ-দুর্দশায় ফেলে শুধু শুধু হরতাল দিয়ে কেউ কোনো আন্দোলন সফল করতে পারেনি। তেমন আন্দোলনের চেষ্টা করলে সেটা ফলপ্রসূ, সফল হবে না। সেজন্য বিরোধী দলের নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ জানাব, জনগণের সুবিধা-অসুবিধা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অবমূল্যায়ন করবেন না। উত্তপ্ত অবস্থায় আপনাদের কার্যালয়ে গিয়ে সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি। তারপরও দেশের স্বার্থে আন্দোলনের ভবিষ্যত্ নিয়ে আপনাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। উদ্ভূত পরিস্থিতির অবসানে সরকার, মহাজোট ও তার প্রধান নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলতে আমরা উত্সাহ প্রকাশ করছি। ২৫ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে চিঠি দিয়েছি, টেলিফোনে আলাপ করেছি। আশা করি নিশ্চয়ই সরকার এবং সরকারি দলের দেশের এই নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলার সময় সুযোগ হবে। বিরোধী দলের আবার হরতাল আহ্বানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনি এটা কী বলেছেন? আপনি তো পুলিশের মন্ত্রী। আপনি তো পুলিশকে যা বলার বলবেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আপনি বলার কে? আপনি কি আওয়ামী লীগ সভাপতি? নাকি সাধারণ সম্পাদক? নাকি অন্য কিছু? যার যে কাজ, সে কাজ করুন। অন্যের সীমানায় পা দেয়া ভালো নয়। আপনাকে পুলিশের মন্ত্রী বানিয়েছে, পুলিশ নিয়ে থাকুন। আওয়ামী লীগ কর্মী নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? আর সবাই না জানলেও আমরা তো জানি, যারা সভানেত্রীর কথা ভালোভাবে মানে না-শোনে না তারা আপনার কতটা কী শুনবে? তাই ওসব না বলে দেশকে বাঁচান। বাতাসের কান্না কান পেতে শুনুন। রেল মন্ত্রণালয়ের ঘুষ-দুর্নীতি আড়াল করতে ইলিয়াস আলীকে গুম, ইলিয়াস আলীর ঘটনার উত্তাপ প্রশমন করতে আবার অন্য কোনো ঘটনা—এসব জাতির কাম্য নয়। মানুষ শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে চায়। তেত্রিশ মাসেও সোহেল তাজের পদত্যাগ গ্রহণ করা হয়নি। সরকারি তহবিল তছরুপ করে তার অ্যাকাউন্টে মন্ত্রীর বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে। এটা এক জঘন্য দুর্নীতি। ব্যক্তিগত স্বাক্ষর ছাড়া এক মাসের বেতন-ভাতাও কাউকে দেয়া যায় না। তাহলে এই অনিয়ম কী করে সম্ভব? দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যখন সোহেল তাজ সংসদ সদস্যপদে ইস্তেফা দিয়েছে, তখন সেটা গ্রহণেও গড়িমসি চলছে, এটা ভালো কথা নয়। পণ্ডিতি করে লাভ কী? কত শত অনিয়ম হচ্ছে, অশুদ্ধ কাজ হচ্ছে। সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র তার ইচ্ছে অনুসারে গ্রহণ করলে আর কত কী ক্ষতি হবে? মাননীয় স্পিকার ওটা গ্রহণ করে ফেলুন। মোচড়ামুচড়ি করে লাভ নেই। বাপের বেটা বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদের পুত্র সোহেল তাজ, তারা থুথু ফেলে থুথু চাটার বংশ নয়। সংসদের কার্যপ্রণালীর ১৭৭ বিধির (১) এ বলা হয়েছে, ‘সংসদের আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক কোনো সদস্য এই মর্মে স্পিকারকে সম্বোধন করিয়া স্বহস্তে লিখিতভাবে জ্ঞাপন করিবেন যে, তিনি তাহার আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক।’ মাননীয় সংসদ সদস্য সোহেল তাজ স্বহস্তে স্বাক্ষর করেছেন। পুরো লেখাটি তিনি স্বহস্তে লেখেননি, এই অজুহাতে ক’দিন তার পদত্যাগপত্র ঠেকিয়ে রাখা যাবে। লাউয়ের নাম যেমন কদু, ঘাড়ের নাম গর্দান—ঠিক তেমনি যতটুকু লেখাপড়া জানলে স্বহস্তে উপরের কথাগুলো লেখা যায় ততটুকু লেখাপড়া এবং সত্ সাহস মনে হয় সোহেল তাজের আছে। এটা সবার ভালো করেই জানা। লেবু বেশি চিপলে তেতো হয়। সোহেল তাজের ব্যাপার নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে তেতোর চাইতে ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। তাই অত মুরব্বিপনা না করে সময় থাকতে সাবধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। না হলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।