এহসানুল হক জসীম
জাতির এক সঙ্কট মুহূর্তে আশাহীন-দিশাহীন জাতিকে মুক্তির নেশায় উজ্জীবিত করতে, পূর্ববাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছিয়ে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বঙ্গভঙ্গের ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে নিতে যে বিশ্ববিদ্যালয়, সময়ের ব্যবধানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ভূমিকায় ’৪৭-এর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। সন্দেহ নেই ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।
ঢাকাকে রাজধানী করে ‘বাংলা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশ নিয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামের প্রদেশটি কার্যকর হয়। শিক্ষাদীক্ষাসহ সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ‘বঙ্গভঙ্গ’ ছিল এগিয়ে যাওয়ার একটি সোপান। হিন্দু নেতাদের বড় অংশটি ছিল এর প্রচণ্ড বিরোধী। ‘বঙ্গভঙ্গ’ কার্যকর করার পর থেকে তারা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য করে। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘দিল্লির দরবার’ চলাকালে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষিত হলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ হতভম্ব হয়ে পড়েন। এ খবর পূর্ব বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত মুসলমানদের কাছে ছিল যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বঙ্গভঙ্গের ফলে সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে মুসলিম সমাজে সার্বিক যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, এ ঘোষণায় তা কর্পূরের মতো উবে যায়। মুসলিম সমাজ তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুসলিম যুবসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মুসলমানদের মাঝে বিক্ষোভের এ তীব্রতা আঁচ করতে পেরে পরিস্থিতি সামাল দিতে তত্কালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের এক সফরে ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকসহ ১৯ মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধি দল ৩১ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেন। তারা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা সব দিক থেকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বঙ্গভঙ্গের আগেও এ এলাকা ছিল অবহেলিত, অনুন্নত। বঙ্গভঙ্গের পরে মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিকতাসহ বিভিন্ন দিক থেকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করছিল। এ অবস্থায় বঙ্গভঙ্গ আবার চালু করা হোক, না হয় এর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কমপক্ষে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক—এর জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন : ্তুঞযব এড়াবত্হসবহঃ ড়ভ ওহফরধ ত্বধষরংবফ ঃযধঃ বফঁপধঃরড়হ ধিং ঃযব ঃত্ঁব ংধষাধঃরড়হ ড়ভ ঃযব গঁংষরসং ধহফ ঃযধঃ ঃযব এড়াবত্হসবহঃ ড়ভ ওহফরধ, ধং ধহ বধত্হবংঃ ড়ভ ঃযবরত্ রহঃবহঃরড়হং, ড়িঁষফ ত্বপড়সসবহফ ঃড় ঃযব ঝবপত্বঃধত্ু ড়ভ ঝঃধঃব ভড়ত্ ঃযব পড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ টহরাবত্ংরঃু ড়ভ উধপপধ.্থ
ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাত্ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার এ ঘোষণা এবং পদক্ষেপ বিশাল বিতর্কের সৃষ্টি করে। আবারও বাধার সৃষ্টি করেন বর্ণ-হিন্দু নেতারা। তাদের কাছে এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা এর বিরোধিতা করতে থাকে, প্রচণ্ড বিরোধিতা। তারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার মতো এর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ তার ‘বঙ্গভঙ্গ : তত্পরর্তী সমাজ ও রাজনীতি’ বইয়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করেন। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জি, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অম্বিকা চরণ মজুমদার, কিশোরী মোহন চৌধুরী প্রমুখ। তারা গভর্নর জেনারেলের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা হয়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন : ‘The Muslim of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a university.’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ক্ষেত্রে অন্যান্য হিন্দু নেতাদের মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে একটি সভা হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য হিন্দু নেতার বিরোধিতার বিষয়টি জাতীয় অধ্যাপক ইন্নাছ আলী তার ‘সমাজ ও রাজনীতি’ বইয়ে স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্রূূপ করা শুরু করেন।
যাহোক, বিরোধিতা সত্ত্বেও এবং বিরোধিতা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তদানীন্তন ভারত সরকার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তা যথাসময়ে লন্ডনের ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক গৃহীত হয়। এরই ফলে সরকার ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল এক পত্রে বাংলা গভর্নরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক খতিয়ানসহ একটি পরিপূর্ণ স্কিম প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেন। এই পত্রে বাংলার মুসলিমদের স্বার্থ ও প্রয়োজন মেটানোর দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বিশেষ নির্দেশ ছিল। ভারত সরকারের এ পত্রে এ মর্মে একটি নির্দেশও ছিল, যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের ধর্মীয় তাহজিব ও তমদ্দুন রক্ষায় সফল হয়। সেই লক্ষ্যে বলা হয় : ্তুঞযবত্ব সরমযঃ নব ধ ভধপঁষঃু ড়ভ অত্ধনরপ ধহফ ওংষধসরপ ঝঃঁফরবং রহ ঃযব টহরাবত্ংরঃু.্থ
ভারত সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলা সরকার ১৯১২ সালের ২৭ মে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার আর নাথানের নামে এর নাম হয় ‘নাথান কমিটি’। এ কমিটি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বাংলা সরকারের কাছে পেশ করে।
নাথান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪৫০ একর জমিবিশিষ্ট একটি মনোরম এলাকারও সুপারিশ করে। জনসাধারণের মতামত যাচাইয়ের লক্ষ্যে ১৯১৩ সালে এ কমিটির এ রিপোর্ট সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক এই রিপোর্ট চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটে স্কিমটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময়ে ১৯১৫ সালে সংক্ষিপ্তভাবে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার জন্য আবারও প্রস্তাব করা হয়। ফলে ১৯১৬ সালে ভারত সরকার বাংলা সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সর্বনিম্ন খরচের সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেয়। এই সংশোধিত পরিকল্পনাটি ভারত সরকার ও ভারত সচিব কর্তৃক গৃহীত হয়।
প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হতে থাকায় মুসলিম নেতাদের মনে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ফলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ রাজকীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং ২০ মার্চ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন, যেখানে তিনি অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি জানান। এ প্রস্তাব পেশের পর এই রাজকীয় আইন পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ২৩ এপ্রিল অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আশ্বাস দেয়া হয় : ‘The promise made by Lord Hardinge that the University would be founded in Dacca.’
উল্লেখ করা প্রয়োজন, নাথান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না—এমন অজুহাতেও এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। এগিয়ে আসেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তিনি তার জমিদারির বড় অংশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ত্যাগ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেন। জমি অধিগ্রহণের পাশাপশি আর্ির্থক সঙ্কট নিরসনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যে ভূমিকা রাখেন তাও অবিস্মরণীয়। তিনি টাঙ্গাইলে তার জমিদারির একটি বিরাট অংশ বিক্রি করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
এদিকে ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড চেমসফোর্ড তার চ্যান্সেলরের ভাষণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানা ধরনের অসুবিধা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এই কমিশনের কাছে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি বিজ্ঞ মতামত ও পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত নাথান কমিটির রিপোর্টটি যথাযথভাবে পর্যালোচনার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে রিপোর্ট প্রদান করে। নাথান কমিটির পেশ করা সুপারিশের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের মতানৈক্য দেখা দেয় যে এটা কি কেবল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে, না ‘টিচিং’ এবং ‘অ্যাফিলিয়েটেড’ থাকবে। এই বিতর্কের সময়ে জনমত যাচাইয়ের জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন একবার রাজশাহীতে আসে। তখন একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল তাদের সঙ্গে দেখা করে এই দাবি করে যে, পুর্ববাংলার সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘অ্যাফিলিয়েটেড’ বা সংযুক্ত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে টিচিং কাম অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় না হতে পারে, সেজন্য হিন্দু নেতারা বিরোধিতা করতে থাকেন। অবশ্য কিছুসংখ্যক উদার মনোভাবাপন্ন হিন্দু নেতা এর সপক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। নাথান কমিটির সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন এ মত পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবলই একটি সরকারশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে না, বরং তা হবে স্বায়ত্তশাসিত।
যাহোক অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামত এবং নাথান কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বিল প্রণীত হয়, যা ১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করা হয়। বিলটি আইন আকারে পাস হয় ১৯২৯ সালের ২৩ মার্চ। শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার মুলমানরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নেয়, তা আজ ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ভারত ও বাংলা সরকার এবং নাথান কমিটি এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন তা সব জাতি ও শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য একটি আরবি ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগ খোলা হবে। এ প্রেক্ষিতে কমিশন যে বক্তব্য তুলে ধরে, তা স্মরণীয় : ্তুডব ফড় হড়ঃ ভড়ত্মবঃ ঃযধঃ ঃযব পত্বধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঁহরাবত্ংরঃু ধিং ষধত্মবষু ফঁব ঃড় ঃযব ফবসধহফ ড়ভ গঁংষরস পড়সসঁহরঃু ড়ভ ঊধংঃবত্হ ইবহমধষ ভড়ত্ মত্বধঃবত্ ভধপরষরঃরবং ভড়ত্ যরমযবত্ বফঁপধঃরড়হ.্থ
বঙ্গভঙ্গের আগে এবং তা রদের পরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উচ্চশিক্ষার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। অধিকাংশ কলেজ কলকাতা বা তার আশপাশেই অবস্থিত ছিল। পূর্ববাংলায় কলেজ কম ছিল। উচ্চশিক্ষার জন্যে গোটা আসামে মাত্র দুটি কলেজ ছিল—সিলেটের মুরারী চাঁদ বা এমসি কলেজ এবং গৌহাটির কটন কলেজ। গৌহাটিতে তখন একটি ল’ কলেজও ছিল। উল্লেখ্য, আজকের সিলেট তখন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর আসাম ও পূর্ববাংলা নিয়েই ছিল বঙ্গভঙ্গ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা পূর্ববঙ্গের পশ্চাত্পদ দরিদ্র মুসলমান কৃষক সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে একটি সম্ভাবনাময় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থানের বছর কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বাই—এই প্রধান শহরগুলোয় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সিপাহি অভ্যুত্থানে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যোগ দেয়নি। আর ইংরেজরা এ বিষয়টিকেই সামনে রেখে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য তারা চেয়েছিল ভারতীয়দের একাংশকে সভ্যতা ও ভব্যতার শিক্ষা দিয়ে ‘মহত্ বর্বরে’ রূপান্তরিত করতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের ক্ষতিপূরণ। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেয়ে ছাত্ররা সন্তুষ্ট থাকবে, স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেবে না—এমন নিশ্চয়তা ছিল না। ইংরেজদের সে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন গতিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকে। জাতির মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য শুধু রক্তই ঝরায়নি, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এ জাতিকে স্বাধীনতার সোনালি সকালটিও উপহার দিয়েছে।
ehsan.jasim@yahoo.com
ঢাকাকে রাজধানী করে ‘বাংলা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশ নিয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামের প্রদেশটি কার্যকর হয়। শিক্ষাদীক্ষাসহ সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ‘বঙ্গভঙ্গ’ ছিল এগিয়ে যাওয়ার একটি সোপান। হিন্দু নেতাদের বড় অংশটি ছিল এর প্রচণ্ড বিরোধী। ‘বঙ্গভঙ্গ’ কার্যকর করার পর থেকে তারা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য করে। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘দিল্লির দরবার’ চলাকালে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষিত হলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ হতভম্ব হয়ে পড়েন। এ খবর পূর্ব বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত মুসলমানদের কাছে ছিল যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বঙ্গভঙ্গের ফলে সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে মুসলিম সমাজে সার্বিক যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, এ ঘোষণায় তা কর্পূরের মতো উবে যায়। মুসলিম সমাজ তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুসলিম যুবসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মুসলমানদের মাঝে বিক্ষোভের এ তীব্রতা আঁচ করতে পেরে পরিস্থিতি সামাল দিতে তত্কালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের এক সফরে ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকসহ ১৯ মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধি দল ৩১ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেন। তারা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা সব দিক থেকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বঙ্গভঙ্গের আগেও এ এলাকা ছিল অবহেলিত, অনুন্নত। বঙ্গভঙ্গের পরে মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিকতাসহ বিভিন্ন দিক থেকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করছিল। এ অবস্থায় বঙ্গভঙ্গ আবার চালু করা হোক, না হয় এর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কমপক্ষে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক—এর জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন : ্তুঞযব এড়াবত্হসবহঃ ড়ভ ওহফরধ ত্বধষরংবফ ঃযধঃ বফঁপধঃরড়হ ধিং ঃযব ঃত্ঁব ংধষাধঃরড়হ ড়ভ ঃযব গঁংষরসং ধহফ ঃযধঃ ঃযব এড়াবত্হসবহঃ ড়ভ ওহফরধ, ধং ধহ বধত্হবংঃ ড়ভ ঃযবরত্ রহঃবহঃরড়হং, ড়িঁষফ ত্বপড়সসবহফ ঃড় ঃযব ঝবপত্বঃধত্ু ড়ভ ঝঃধঃব ভড়ত্ ঃযব পড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ টহরাবত্ংরঃু ড়ভ উধপপধ.্থ
ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাত্ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার এ ঘোষণা এবং পদক্ষেপ বিশাল বিতর্কের সৃষ্টি করে। আবারও বাধার সৃষ্টি করেন বর্ণ-হিন্দু নেতারা। তাদের কাছে এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা এর বিরোধিতা করতে থাকে, প্রচণ্ড বিরোধিতা। তারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার মতো এর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ তার ‘বঙ্গভঙ্গ : তত্পরর্তী সমাজ ও রাজনীতি’ বইয়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করেন। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জি, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অম্বিকা চরণ মজুমদার, কিশোরী মোহন চৌধুরী প্রমুখ। তারা গভর্নর জেনারেলের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা হয়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন : ‘The Muslim of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a university.’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ক্ষেত্রে অন্যান্য হিন্দু নেতাদের মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে একটি সভা হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য হিন্দু নেতার বিরোধিতার বিষয়টি জাতীয় অধ্যাপক ইন্নাছ আলী তার ‘সমাজ ও রাজনীতি’ বইয়ে স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্রূূপ করা শুরু করেন।
যাহোক, বিরোধিতা সত্ত্বেও এবং বিরোধিতা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তদানীন্তন ভারত সরকার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তা যথাসময়ে লন্ডনের ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক গৃহীত হয়। এরই ফলে সরকার ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল এক পত্রে বাংলা গভর্নরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক খতিয়ানসহ একটি পরিপূর্ণ স্কিম প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেন। এই পত্রে বাংলার মুসলিমদের স্বার্থ ও প্রয়োজন মেটানোর দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বিশেষ নির্দেশ ছিল। ভারত সরকারের এ পত্রে এ মর্মে একটি নির্দেশও ছিল, যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের ধর্মীয় তাহজিব ও তমদ্দুন রক্ষায় সফল হয়। সেই লক্ষ্যে বলা হয় : ্তুঞযবত্ব সরমযঃ নব ধ ভধপঁষঃু ড়ভ অত্ধনরপ ধহফ ওংষধসরপ ঝঃঁফরবং রহ ঃযব টহরাবত্ংরঃু.্থ
ভারত সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলা সরকার ১৯১২ সালের ২৭ মে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার আর নাথানের নামে এর নাম হয় ‘নাথান কমিটি’। এ কমিটি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বাংলা সরকারের কাছে পেশ করে।
নাথান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪৫০ একর জমিবিশিষ্ট একটি মনোরম এলাকারও সুপারিশ করে। জনসাধারণের মতামত যাচাইয়ের লক্ষ্যে ১৯১৩ সালে এ কমিটির এ রিপোর্ট সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক এই রিপোর্ট চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটে স্কিমটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময়ে ১৯১৫ সালে সংক্ষিপ্তভাবে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার জন্য আবারও প্রস্তাব করা হয়। ফলে ১৯১৬ সালে ভারত সরকার বাংলা সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সর্বনিম্ন খরচের সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেয়। এই সংশোধিত পরিকল্পনাটি ভারত সরকার ও ভারত সচিব কর্তৃক গৃহীত হয়।
প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হতে থাকায় মুসলিম নেতাদের মনে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ফলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ রাজকীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং ২০ মার্চ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন, যেখানে তিনি অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি জানান। এ প্রস্তাব পেশের পর এই রাজকীয় আইন পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ২৩ এপ্রিল অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আশ্বাস দেয়া হয় : ‘The promise made by Lord Hardinge that the University would be founded in Dacca.’
উল্লেখ করা প্রয়োজন, নাথান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না—এমন অজুহাতেও এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। এগিয়ে আসেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তিনি তার জমিদারির বড় অংশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ত্যাগ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেন। জমি অধিগ্রহণের পাশাপশি আর্ির্থক সঙ্কট নিরসনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যে ভূমিকা রাখেন তাও অবিস্মরণীয়। তিনি টাঙ্গাইলে তার জমিদারির একটি বিরাট অংশ বিক্রি করে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
এদিকে ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড চেমসফোর্ড তার চ্যান্সেলরের ভাষণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানা ধরনের অসুবিধা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এই কমিশনের কাছে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি বিজ্ঞ মতামত ও পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত নাথান কমিটির রিপোর্টটি যথাযথভাবে পর্যালোচনার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে রিপোর্ট প্রদান করে। নাথান কমিটির পেশ করা সুপারিশের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের মতানৈক্য দেখা দেয় যে এটা কি কেবল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে, না ‘টিচিং’ এবং ‘অ্যাফিলিয়েটেড’ থাকবে। এই বিতর্কের সময়ে জনমত যাচাইয়ের জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন একবার রাজশাহীতে আসে। তখন একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল তাদের সঙ্গে দেখা করে এই দাবি করে যে, পুর্ববাংলার সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘অ্যাফিলিয়েটেড’ বা সংযুক্ত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে টিচিং কাম অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় না হতে পারে, সেজন্য হিন্দু নেতারা বিরোধিতা করতে থাকেন। অবশ্য কিছুসংখ্যক উদার মনোভাবাপন্ন হিন্দু নেতা এর সপক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। নাথান কমিটির সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন এ মত পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবলই একটি সরকারশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে না, বরং তা হবে স্বায়ত্তশাসিত।
যাহোক অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামত এবং নাথান কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বিল প্রণীত হয়, যা ১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করা হয়। বিলটি আইন আকারে পাস হয় ১৯২৯ সালের ২৩ মার্চ। শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার মুলমানরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নেয়, তা আজ ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ভারত ও বাংলা সরকার এবং নাথান কমিটি এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন তা সব জাতি ও শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য একটি আরবি ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগ খোলা হবে। এ প্রেক্ষিতে কমিশন যে বক্তব্য তুলে ধরে, তা স্মরণীয় : ্তুডব ফড় হড়ঃ ভড়ত্মবঃ ঃযধঃ ঃযব পত্বধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঁহরাবত্ংরঃু ধিং ষধত্মবষু ফঁব ঃড় ঃযব ফবসধহফ ড়ভ গঁংষরস পড়সসঁহরঃু ড়ভ ঊধংঃবত্হ ইবহমধষ ভড়ত্ মত্বধঃবত্ ভধপরষরঃরবং ভড়ত্ যরমযবত্ বফঁপধঃরড়হ.্থ
বঙ্গভঙ্গের আগে এবং তা রদের পরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উচ্চশিক্ষার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। অধিকাংশ কলেজ কলকাতা বা তার আশপাশেই অবস্থিত ছিল। পূর্ববাংলায় কলেজ কম ছিল। উচ্চশিক্ষার জন্যে গোটা আসামে মাত্র দুটি কলেজ ছিল—সিলেটের মুরারী চাঁদ বা এমসি কলেজ এবং গৌহাটির কটন কলেজ। গৌহাটিতে তখন একটি ল’ কলেজও ছিল। উল্লেখ্য, আজকের সিলেট তখন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর আসাম ও পূর্ববাংলা নিয়েই ছিল বঙ্গভঙ্গ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা পূর্ববঙ্গের পশ্চাত্পদ দরিদ্র মুসলমান কৃষক সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে একটি সম্ভাবনাময় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থানের বছর কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বাই—এই প্রধান শহরগুলোয় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সিপাহি অভ্যুত্থানে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যোগ দেয়নি। আর ইংরেজরা এ বিষয়টিকেই সামনে রেখে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য তারা চেয়েছিল ভারতীয়দের একাংশকে সভ্যতা ও ভব্যতার শিক্ষা দিয়ে ‘মহত্ বর্বরে’ রূপান্তরিত করতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের ক্ষতিপূরণ। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেয়ে ছাত্ররা সন্তুষ্ট থাকবে, স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেবে না—এমন নিশ্চয়তা ছিল না। ইংরেজদের সে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন গতিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকে। জাতির মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য শুধু রক্তই ঝরায়নি, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এ জাতিকে স্বাধীনতার সোনালি সকালটিও উপহার দিয়েছে।
ehsan.jasim@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন