রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১২

যদি আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এখন থেকে একশ’ বছর পরে, অথবা এক হাজার বছর পরে, কিংবা আরও পরে, যদি তখনও মানুষ থাকে পৃথিবীতে, কেউ না কেউ প্রশ্ন করবে আমাদের সময় ও জীবন নিয়ে—ন্যায়, নীতি, সততা, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব, বিচার ও প্রেমহীন একটি সময়ে ওই লোকগুলো বেঁচে ছিল কীভাবে? তাদের উদ্দেশে এই হানাহানি, বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসম্প্রীতি ও অবিবেচনায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সময়ের পত্রহীন, পুষ্পহীন, বাষ্পহীন, অনুতাপহীন প্রান্তর থেকে বলে রাখছি, যদি এই লেখা তাদের কাছে পৌঁছে আমাদের অনেক কিছু ছিল না, এ কথা সত্য। বন্য শুয়োরের কাদা ঘাঁটার মতো সীমিত, সংকীর্ণ ও নোংরা হয়ে পড়েছিল আমাদের জীবন। তারপরও আমরা বেঁচেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, আনন্দ ও বেদনার নুনপানিতে ভেসেছিলাম শুধু একটি কারণে—আমাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন। কবি আল মাহমুদ ছিলেন। মাত্র একজন কবি ছিলেন বলেই আমাদের প্রতিদিনের রুমালগুলো সূচিকর্মহীন ছিল না।
আজকের এই দিনে, এখনও যাদের মানুষ হিসাবে ধরে নেয়া যায়, এখনও যারা সাদা আর কালোর পার্থক্য কিছুটা হলেও ধরতে পারেন, তাদের বলি, আল মাহমুদ আমাদের মধ্যে আছেন বলেই আমরা আছি। যে কয়টি সংবাদ আমাদের প্রতিটি সূর্যোদয়কে সম্ভাবনাময় করে তোলে তার অন্যতম আল মাহমুদের বিচরণশীলতা। তাঁর সচলতা ও সক্ষমতা। তার বহমান সৃষ্টিশীলতা। তিনি আছেন বলেই আমাদের দিনগুলো কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে যায় না। ডুবতে ডুবতেও ডুবে যায় না, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শিশুর গালে চুমু খায়। আর রাতগুলো কালো হতে হতেও পুরো কালো হয় না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস তার নীরবতাকে চুরমার করলেও সে কিছুটা উদ্বেগহীনতার মধ্যে আরাম খোঁজে। তারপর স্বপ্ন দেখে ডাবের মতো চাঁদ, ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
দুই
বাংলা সাহিত্যে মীরদের প্রথম আবির্ভাব ১৮৪৭ সালে মীর মশাররফ হোসেনের মধ্য দিয়ে। প্রথম এবং অসাধারণ ছিলেন সেই মীর। ১৮৮৫-তে যদি তার বহু বিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ নাও প্রকাশিত হতো তাহলেও তাকে নিয়ে আজ আমরা যা বলছি, তার ব্যত্যয় ঘটত না। যে কোনো বিচারেই তিনি আমাদের নবজাগরণের অগ্রদূত। এই মীরের জন্মের ৮৯ বছর পর ১৯৩৬ সালে দেশের আরেক প্রান্তে দ্বিতীয় মীরের জন্ম। এই মীর আল মাহমুদ। কবি আল মাহমুদ।
প্রথম মীরের সঙ্গে দ্বিতীয় মীরের মিল ও অমিল অনেক। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের পর আর যদি কিছু নাও লিখতেন, তাহলেও আল মাহমুদ আল মাহমুদই থাকতেন।
দুই মীরের বাড়ি দুই নদীর তীরে। একজন গড়াই কূলের। অন্যজন তিতাস তীরের। একজনের বিষাদ সিন্ধু এবং অন্যের সোনালী কাবিন—সমান মাত্রা ও শব্দবন্ধের। ‘স’ ও ‘ব’ তাদের মধ্যে সাধারণ। তবে অমিলটা হলো একজন মীর লিখতেন নামের আগে, অন্যজন মীর উপাধি কখনোই ব্যবহার করেননি।
কাজী আবদুল ওদুদ অবশ্য এই দুই মীরকে নিয়ে তার বিখ্যাত ‘মীর পরিবার’ গল্প গ্রন্থ লেখেননি। তবুও আহমদ মীর, মোস্তফা মীর, আশরাফ মীর এঁরা ‘মীর’ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন।
তিন
আসলেই ‘মীর’ বর্জনকারী আল মাহমুদ আমাদের জসীমউদ্দীন। আমাদের নকশিকাঁথার মাঠ। আমাদের সোজন বাদিয়ার ঘাট। আমাদের বালুচর।
তিনি আমাদের জীবননানন্দ। আমাদের মহা পৃথিবী। আমাদের সাতটি তারার তিমির।
তিনি নজরুলের সকালবেলার পাখি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাত সঙ্গীত।
তিনি আছেন আমাদের জাগরণে। আমাদের স্বপ্নে। আমাদের মনে। আমাদের দেহে। আমাদের তিনশত চল্লিশ নদীর বাঁকে বাঁকে। তিনি আছেন আমাদের পানিউড়ি পাখির ছতরে। তিনি আছেন ওপাড়ার সুন্দরী রোজেনার সর্ব অঙ্গের ঢেউয়ে। মকতবের মেয়ে আয়শা আখতারের খোলা চুলে। তিনি আছেন আমাদের ইসবগুলের দানার মতো জলভরা চোখে। আছেন শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশের চিকচিকে বালুতে।
আল মাহমুদ আছেন আমাদের সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে। পাহাড়পুরে। তিতাসে। ড্রেজার বালেশ্বরে। আছেন মুক্তিযুদ্ধে। আছেন বিরামপুরে। আছেন আমাদের খড়ের গম্বুজে। আমাদের প্রত্যাবর্তনের লজ্জায়। স্বপ্নের সানু দেশে। আল মাহমুদ আছেন আমাদের ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে। তিনি আছেন নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটিতে। তিনি আছেন ‘ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান’-এ। আছেন আমাদের চিন্তায়। চেতনায়। আমাদের সৃষ্টিশীলতায়।
চার
আল মাহমুদ আছেন বলেই এখনও স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আল মাহমুদ আছেন বলেই আমরা এখনও হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি। আল মাহমুদ আছেন বলেই ড. ইউনূস বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মৌলিক মৃত্তিকা হয়ে ওঠেন। উঁচুতে তুলে ধরেন দেশের সম্মান ও মর্যাদা। আল মাহমুদ আছেন বলেই মুসা ইব্রাহীম, এমএ মুহিত, নিশাত আর ওয়াসফিয়া এভারেস্টের ওপর পা রাখেন। আর সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার।
নোংরা, সংকীর্ণ, মূর্খ ও স্বার্থপর কিছু প্রাণীকে এখনও যে এদেশের মানুষ কবি বলে সম্মান করে, সে তো শুধু এই কারণে যে আল মাহমুদ এখনও বেঁচে আছেন।
পাঁচ
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যে কথাগুলো লিখলাম তা পড়ে অনেকের গা জ্বলে যাবে। শরীর চুলকাবে। আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মতো যারা একটু বেশি শয়তান, তারা বলবে আবেগের দোকানদারি করা হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করা হচ্ছে।
তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি থাকবে। আমরা তাদের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দেব। তারপর বলব, তোমাদের জীবন হলো নর্দমার ধারে। হাজারীবাগের ট্যানারির পচা পানিতে হয় তোমাদের অবগাহন। তোমাদের জীবন দুর্নীতি নিয়ে। তোমাদের সকাল হয় দুর্নীতির মাধ্যমে। দিন কাটে দুর্নীতি করে করে। রাতে ঘুমাও দুর্নীতির বিছানায়। স্বপ্নও দেখো দুর্নীতি নিয়ে। সাহিত্য তোমাদের মতো ‘হারামখোর’দের বিষয় নয়। আর কবিতা, সে তোমাদের সইবে না। ‘সুসংবদ্ধ কথামালা’ নিয়ে স্বপ্নের সওদাগরি যারা করে, তাদের ভাষা বোঝার জন্য নতুন চরের মতো হৃিপণ্ড চাই।
স্বপ্নের কথা বলতে বলতেই আমার চোখের চারদিকে তৈরি হচ্ছে ঘোর। এক ধরনের মায়াবী পর্দা উঠছে দুলে। কাজলের ছোঁয়ায় জেগে উঠছে প্রাণ। ভোরের মোরগের ডাক কানে আসছে। মোহনা কাছাকাছি বলেই বোধ করি শুনছি নোনা দরিয়ার ডাক। প্রিয় পাঠক, আসুন সেই সম্ভাবনা আর স্বপ্নের কথা তেলাওয়াত করি।
ছয়
জীবদ্দশায় আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পাবেন কিনা আমি জানি না। মরণোত্তর নোবেল দেয়ার বিধানও চালু হয়নি। যা হোক, পেলে ভালো। না পেলে না পাবেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য তো আর আল মাহমুদ কবিতা লেখেননি। এখন নোবেল পেলে আল মাহমুদের আর কী যায় আসবে। তবে আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। না পেলেও বাংলাভাষীরা আল মাহমুদ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে তাদের ঘর ও অন্তর।
তবে আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে তিনি বিশ্ব কবি সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বাংলাদেশ ও এশিয়ার সীমা তো তিনি ছাড়িয়েছেন সেই ১৯৭৩-এ সোনালি কাবিনের যুগেই। এখন দরকার বাদবাকি বিশ্বের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আল মাহমুদ নেবেন কেন। নেব আপনি, আমি, আমরা।
তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়াও এক মহা বিড়ম্বনার ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের দেশে। নোবেল লরিয়েটের জীবনকে অতিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীদের জুড়ি মেলা ভার। যেন নোবেল পাওয়াটা এক ধরনের ক্রিমিনাল অফেন্স। এই জন্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক জিল্লতি। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে নোবেল কমিটি পুরস্কারের অপমান করেছেন, এমন কথা বলার লোক সেদিনের কলকাতায় অভাব ছিল না। যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গালাগাল করার ক্ষেত্রে আমাদের যদুমধুরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। অমর্ত্য সেন ও প্রফেসর সালামের মতো যারা একটু অপ্রভাবশালী শুধু তারাই কিছুটা রেহাই পেয়েছেন।
যা হোক, সম্ভাবনার শেষ নেই। সম্ভাবনার কথা বলার মধ্যেও কোনো দোষ নেই। তাছাড়া সব ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হবে, এমন কোনো কথাও নেই। তো যদি আল মাহমুদ সৌভাগ্যক্রমে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান তাহলে কী হবে? এই কী হবের কোনো শেষ নেই। তার চেয়ে আমরা বরং ‘আল মাহমুদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি-উত্তর প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে কিছু অগ্রিম বাক্যাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখি। এই সব কাল্পনিক প্রতিক্রিয়া সত্য হোক, তা আমি চাই না। মিথ্যা হলে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেব।
প্রতিক্রিয়া ১ : সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ সামাদ, খন্দকার আশরাফ হোসেন, রবীন্দ্র গোপ, তসলিমা নাসরিন, সালাম আজাদ, মিনা ফারাহ, মাসুদা ভাট্টি, আসলাম সানি, লুত্ফর রহমান রিটনসহ আরও অনেকে নোবেল কমিটিকে চিঠি লিখবেন—মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে থাকা একজন মৌলবাদী কবিকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে মূলত বাংলাদেশকেই অপমান করা হয়েছে। অবিলম্বে এই পুরস্কার প্রত্যাহার করা হোক।
প্রতিক্রিয়া ২ : কবি মোহন রায়হান, নাসির আহমদ বলবেন—নোবেল পুরস্কার পান আর যাই পান, তিনি স্বৈরাচারী এরশাদের দালাল ছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ৩ : সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলবেন—এর ফলে দেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতা বৃদ্ধি পাবে। তাদেরই আশকারা দেয়া হলো। আমরা জানি কীভাবে নোবেল দেয়া হয়। আগে মদ খেতে হতো। এখন শরাব খেলেই পাওয়া যায়।
প্রতিক্রিয়া ৪ : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলবেন—নোবেল পুরস্কার পেলেই কেউ একজন কবি হয়ে যায় না। কবি হতে হলে রবীন্দ্রনাথের মতো ৮০ বছর বাঁচতে হয়। সংবিধানকে বুঝতে হয়।
প্রতিক্রিয়া ৫ : আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা আসবে তার কলামে—‘হাসান হাফিজুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, শামসুর রাহমান মরার আগে আমাকে বলে গেছেন, তাদের মৃত্যুর ২০ বছর পর যেন আমি বলি ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদের লেখা নয়। এটার একটা অংশ লিখেছিলেন শহীদ হুমায়ুন আজাদ এবং অন্য অংশ লিখেছিলেন আর একজন মরহুম এতাজ ইউসুফী।
প্রতিক্রিয়া ৬ : আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলবেন—নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটিতে মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ঢুকে পড়েছে।
প্রতিক্রিয়া ৭ : মতিয়া চৌধুরী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানাবেন—আল মাহমুদ তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা নির্মলেন্দু গুণের ধারে-কাছে যাওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না। সে আবার কিসের কবি।
প্রতিক্রিয়া ৮ : মাহবুব উল আলম হানিফের কথা—একজন মুক্তিযোদ্ধা যত বড় ত্যাগই স্বীকার করেন, তিনি যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাই হতে পারেন না, যদি না তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন। একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকই যেমন সঠিক মুক্তিযোদ্ধা, তেমন একজন কবি তখনই যথার্থ কবি এবং নোবেল পাওয়ার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন, যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন।
প্রতিক্রিয়া ৯ : সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলবেন—দেশে এত ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’র সৈনিক থাকতে কেন আল মাহমুদের মতো লোকেরা নোবেল পায়, তা উদ্বেগের বিষয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার দিকটি আমার পুলিশ ও র্যাব খতিয়ে দেখছে।
প্রতিক্রিয়া ১০ : ড. সনজিদা খাতুন, শাহরিয়ার কবির কিংবা মুনতাসির মামুন বলবেন—তিনি মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধ চাননি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ১১ : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং ড. আবুল বারাকাত বলবেন—আল মাহমুদের নোবেল প্রাপ্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মোটেও বাড়বে না, বাড়বে না জিডিপি। তা হলে এ পুরস্কার ধুয়ে কি পানি খাব?
প্রতিক্রিয়া ১২ : ‘তিনি জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাসাসের সভাপতি ছিলেন। সে সময় তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করেছিলেন কিনা তা দেখার জন্য মহামান্য আদালতের কাছে রুলনিশি জারির আবেদন করছি।’ এই আবেদনকারী হয়তো হবেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
প্রতিক্রিয়া ১৩ : ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, কিছু সাহিত্য সংঘের মাধ্যমে হয়তো গড়ে উঠবে একটি ‘আল মাহমুদের নোবেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে সামনে টানা কয়েকদিন মানববন্ধন করবে। সেখানে বক্তারা বলবেন—দেশে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। ড. ইউনূসের পর এবার যারা কবি আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন তারা দেশদ্রোহী। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা ‘র’-এর ভাড়াটে চর। এদের আক্কেলদাঁত উপড়ে ফেলা আজ জাতীয় কর্তব্য। দাঁত ওঠাতে সমস্যা থাকলে প্রত্যেকের একটি করে ঠ্যাং ভেঙে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নিন।
প্রতিক্রিয়া ১৪ : মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলবেন—আই অ্যাম একদম ফেড আপ। অল আর রাবিশ। নোবেল কমিটি এখন দুষ্টু কমিটি, ওটা একটা ফটকা বাজার।
প্রতিক্রিয়া ১৫ : হাসানুল হক ইনু বলবেন—আল মাহমুদের সঙ্গে মৌলবাদী মানবতাবিরোধীদের সম্পর্ক আছে। সেজন্য তাকে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলা সাহিত্য থেকে মাইনাস করতে হবে। তিনি যদি নিজে নিজে মাইনাস না হন, তাহলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে আমরাই তাকে মাইনাস করে দেব। কাউকে মাইনাস করার ক্ষেত্রে আমাদের যে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, তার পুরোটাই এক্ষেত্রে প্রয়োগ করব আমরা।
প্রতিক্রিয়া ১৬ : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হয়তো হাসতে হাসতে বলবেন—আল মাহমুদ নোবেল পেয়েছে তো কী হয়েছে? আগে পেয়েছিলেন একজন সুদখোর এবং এবার পেয়েছেন একজন ধর্মখোর।
প্রতিক্রিয়া ১৭ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলবেন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নোবেল পুরস্কার শোভা পাবে। আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার ভেতর দিয়ে সেই স্বপ্নই কিছুটা পূরণ হলো। এই নোবেল প্রাপ্তি দেশরত্ন বিশ্বনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারেরই একটি সাফল্য। আমরা এর আগে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বিজয় অর্জন করেছিলাম। তারপর চ্যাম্পিয়ন হয়েছি সমুদ্রবিজয়ে। এই চ্যাম্পিয়ন লাভের ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
প্রতিক্রিয়া ১৮ : কবি আল মাহমুদ যেসব বাড়িতে গেছেন, যাদের সঙ্গে মিশেছেন, তারা তড়িঘড়ি আল মাহমুদের সঙ্গে তোলা ছবি ড্রইং রুম ও অফিস কক্ষে বাঁধাই করে রাখবেন।
আর যেসব কবি-লেখক আল মাহমুদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পেরেছিলেন, তারা সেইসব সার্টিফিকেট ও ছবি নিয়ে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় বিপুল বেগে নাজিল হবেন।
সাত
এই ডামাডোলের মধ্যে কষ্টে কঁকিয়ে উঠবে দেশের আত্মা। সাধারণ মানুষ আহত হবেন, হবেন ক্ষুব্ধ। যারা সত্যিকার অর্থে সাহিত্যনিষ্ঠ, যারা সাহিত্যকে সাহিত্য দিয়েই বিচার করেন, তারা হবেন হতবাক। হবেন মহা বিরক্ত। কেউ কেউ হয়তো স্মরণ করবেন জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর কথা। তারপর ভেবে কূল পাবেন না, আমাদের এরা কোন ফার্মের বাসিন্দা।
শুধু কবি আল মাহমুদ থাকবেন নির্বিকার। কণ্ঠে হয়তো বড় জোর বাজতে পারে নিজেরই কয়েকটি চরণ—
‘বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য জাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাত্ পাল্টে গেল। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃণ্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনাজুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার?’
a_hyesikder@yahoo.com 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন