রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদ ২৩শে জুন এবং ২রা জুলাই'র কথকতা


সাজজাদ হোসাইন খান

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্যোগে প্রথম পলাশী দিবস উদযাপিত হয়েছিল কলকাতায়। সাথে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মওলানা আকরম খাঁ। এ ব্যাপারে কবি নজরুলের একটি বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছিল দৈনিক আজাদ এবং মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ১৯৩৯ সালের জুনে। বিবৃতিতে নজরুলের আহবান ছিল ‘মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে কলিকাতায় সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশীর বন্ধন-শৃক্মখল হইতে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজের জীবনস্মৃতি হইতে যেন আমরা অনুপ্রাণিত হই। ইহাই আমার প্রার্থনা'। (২৯.০৬.১৯৩৯)।
এই প্রার্থনা বিফলে যায়নি। পলাশী দিবস প্রতি বছরই আসে। কখনো সরবে কখনো নীরবে। জাতীয় বীর সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ করে অনুপ্রাণিত হয়, ব্যথিত হয়। একথা সত্য, নবাব সিরাজ ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত বীর, দেশপ্রেমিক। চতুর্মুখি ষড়যন্ত্র তার উত্থানকে ব্যাহত করেছিল।
পরিশেষে করুণ পরিণতি। সিরাজকে হত্যা করা হয় ২রা জুন। এই হত্যাকান্ডের সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার ঘটে অবসান। যা উদ্ধারে সময় ব্যয় হয়েছিল প্রায় দু'শ বছর। পলাশীর দুর্বিপাক এবং সিরাজ উৎখাতের সাথে যেসব বিশ্বাসঘাতক জড়িত ছিল তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল। জীবনকালেই নানা গঞ্জনা-লাঞ্ছনার ঘূর্ণিপাক তাদের গ্রাস করেছিল। ইতিহাস এমন সত্যকেই উপস্থিত করেছে। বিশ্বাস-হন্তারকদের পরিণতি শুভ হয় না কখনো। দেশ এবং দেশের মানুষকে যারা প্রতারিত করে আখেরে তারা নিজেরাই প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়ে। কিন্তু ইতিহাসের এমন প্রমাণকে অনেকেই আমলে আনতে চায় না। যদিও শতাব্দীর পর শতাব্দী এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। বাংলার স্বাধীনতাকে যেসব কুলাঙ্গার বিদেশিদের হাতে সমর্পণ করেছিল নানা কায়দা-কৌশল করে, তাদের প্রতি দেশবাসীর ঘৃণা আর ধিক্কার জুটেছিল অবশেষে। হয়তো এই ধিক্কার এবং ঘৃণা কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। আসলে সর্বকালেই বিশ্বাস হন্তারকদের ভাগ্যে এমনটাই ঘটে। কেউ অনুভব করে কেউ করতে চায় না।
সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না বিদেশি ছিলেন, সাম্প্রতিক কিছু লেখায় এমন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন দু'একজন। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রশ্ন আসে, ভারত উপমহাদেশের কত সংখ্যক মানুষের স্থায়ী বসতি ছিল এখানে? অধিকাংশ লোকই তো বাইরে থেকে আসা। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী। এরা এখানে এসেছে শাসন করেছে। বিয়ে-শাদি করেছে, সন্তান-সন্তুতি নিয়ে বসবাস করেছে। তাদের শেষ আশ্রয়ও এ মাটিতেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলাও এদেরই একজন। ব্যতিক্রম কেবল বৃটিশ। এরা এসে সম্পদ লুণ্ঠন করে আবার নিজ দেশে ফিরে গেছে ধন-সম্পদ নিয়ে। এই যে বাংলা, বাংলাদেশের নামকরণ এবং সীমা সহরতওতো করেছিলেন সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ। তা-ও ১৩৩৮ সালের দিকে। তার রাজ্যের নাম ছিল সুবেহ বাঙ্গালা। তিনি বিশ্বদরবারে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন শাহে বাঙ্গালা নামে। তাহলে বাঙালি অবাঙালির ফারাকটা কোথায় গিয়ে ঠেকল? নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যারা বাঙালি-অবাঙালির বেড়াজালে ফেলতে চায় তারা আসলে মীরজাফর-জগৎশেঠদেরই উত্তরপ্রজন্ম। ক্লাইভ-হেস্টিংসদের তল্পিবাহক। নবাব সিরাজ ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি বাংলাকে ভালবেসেছিলেন, এদেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন। এদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন এটিই ইতিহাসের চরম সত্য। পরবর্তী সময় ইংরেজদের বেতনভুক কিছু কর্মচারী-চাটুকার ইতিহাস রচনা করেছিলেন, যে ইতিহাসে নবাবকে ‘অপরিণামদর্শী চরিত্রহীন' ইত্যাকার বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি চলমান।'
রজতকান্তি রায় ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ' শিরোনামে একটি পুস্তক রচনা করেছেন। প্রচুর পরিশ্রম করেছেন, সময় ব্যয় তো অবশ্যই হয়েছে। তবে রজত বাবু পূর্বসুরীদের পদাংকই অনুসরণ করেছেন তার সমগ্র গবেষণায়(?)। এসব পুস্তক রচনার একমাত্র উদ্দেশ্যই যেন সিরাজ-সিরাজের গোটা পরিবারের চরিত্র হনন। রজত বাবুও ইনিয়ে বিনিয়ে কায়দা কৌশলে এই ‘মহত' কর্মটি করেছেন। পলাশী ষড়যন্ত্রের মূল চক্রান্তকারী জগৎশেঠকে তিনি ‘ঋষি-যুধিষ্ঠি' রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন-দেওয়ানী বিভাগের প্রভাবশালী হিন্দু মুৎসুদ্দিয়ান এবং মুর্শিদাবাদ খাজাঞ্চীখানার অধিপতি জগৎশেঠ পরিবার আদপেই কোম্পানীর ধামাধরা ছিলেন না।' চমৎকার গবেষণা তো বটেই। রজত বাবু নবাব সিরাজের চরিত্রের উপর রাজ্যের কলঙ্ক চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সিরাজের আম্মা আমেনা বেগমের চরিত্র হননেও যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি লিখছেন-গহসেটি বেগম তাঁর প্রণয়ের পাত্র হোসেন কুলী খানের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। হোসেন কুলী খানের অপরাধ তিনি গহসেটি বেগমকে ত্যাগ করে তার ছোট বোন আমিনা বেগমের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন।' রজত বাবু আমেনা বেগমের পরিচয় প্রকাশ করতেও আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়েছেন। আমেনা বেগম কে? ‘আমিনা বেগম সিরাজের মা।' এগুলো আসলে রজত বাবুদের স্বভাবজাত অভ্যাস। সিরাজের প্রতি রাগ-গোস্যা থেকে উদ্গত। রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ হতে শুরু করে আজকের রজতকান্তি রায়দের চেহারা স্বভাবে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য হচ্ছে না। ক্লাইভের তস্য প্রজন্মরূপেই যেন এদের উপস্থিতি এবং উপছায়া। নবাব সিরাজের চরিত্র হনন করে এমন তথাকথিত গবেষণা পুস্তক রচিত হয়েছে অনেক। বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে যারাই সিরাজকে কলঙ্কিত করেছে শেষাবধি এরা নিজেরাই লজ্জিত হয়েছে, অপদস্থ হয়েছে। ইংরেজদের বিষয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাকি প্রায়শই বলতেন, ‘এদের শায়েস্তা করতে হলে একজোড়া পয়জার চাই, আর কিছু না'। নবাব সিরাজ যদি জীবিতাবস্থায় তাঁকে নিয়ে অর্বাচীনদের রচিত পুস্তকসমূহ পাঠ করার সুযোগ পেতেন তবে হয়তো তিনি এদের ব্যাপারেও উচ্চারণ করতেন -এইসব তথাকথিত গবেষকদের(?) শায়েস্তা করতে হলে একজোড়া পয়জার চাই। অর্থাৎ একজোড়া চটি।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধরগণ এখন ঢাকায়। এটি একটি আনন্দের বার্তা। আনন্দের বার্তা এজন্যে যে তারা ঢাকায় বসবাস করছেন। খোদানাখাস্ত যদি তারা কলকাতা বা ভারতের কোন এলাকায় বসবাস করতেন তবে তাদের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় দেখা দিত। কয়েক বছর আগে পত্রিকায় এসেছিল মহিশূরের বাঘ টিপুর বংশধররা এখন কলকাতায় রিকশা চালক। সে সব এলাকায় এরকম আরো অনেক ঐতিহ্যমন্ডিত পরিবার ধ্বংসের দরজায় উপনীত। সৌভাগ্য যে, নবাব সিরাজের পরিবার মূল বাংলার নাগরিক। যে বাংলার শাসক ছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা জং বাহাদুর। নবাব সিরাজ তো কেবল বাংলাই নয় বিহার এবং উড়িষ্যারও নবাব ছিলেন। বিহার ও উড়িষ্যায় সিরাজের অবস্থান কতটুকু? নবাব সিরাজের শাহাদাত দিবস আজ। সিরাজকে স্মরণ করলে বিশ্বাসঘাতকদের চেহারা উন্মোচিত হয়। স্বাধীনতার দুশমনদের চিহ্নিত করা যায়। তাই যত অধিক নবাব সিরাজকে স্মরণে আনা যায় ততই মঙ্গল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন