মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : বল্গাহীন দুর্নীতি ও ম্রিয়মাণ টিআইবি



মাহমুদুর রহমান
২০০৯ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সহকর্মী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম. আবদুল্লাহ্ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কিছু কাগজপত্র হাতে খানিকটা উত্তেজিত হয়েই আমার অফিস কক্ষে এলেন। কাগজ-পত্র ঘেঁটে দেখলাম, পাঁচ মিলিয়ন ডলার (৪১ কোটি টাকা) ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে। অভিযোগের তীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের মন্তব্যসহ আমি সংবাদটি ছাপার অনুমতি দিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তখন দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্র চালাচ্ছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের মধুচন্দ্রিমার উষ্ণতা তখনও পুরোপুরি শীতল হয়নি। বেশ ক’জন সহকর্মী সংবাদটি ছাপানোর বিপদ সম্পর্কে আমাকে সাবধান করেছিলেন। সত্য কথা বলা এবং লেখায় কারও সাবধানবাণীতে কর্ণপাত করা বরাবরই আমার স্বভাববিরুদ্ধ। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে মহাজোট আমলের প্রথম দুর্নীতি সংক্রান্ত সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হলো। খবর ছাপা হওয়া মাত্র মৌচাকে ঢিল পড়ল। জেলায় জেলায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং কুশপুত্তলিকা দাহের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো। আগে জানতাম, মানহানির মামলা কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই করতে পারেন এবং সেটাও একটিমাত্র মামলাই। ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের জামানায় আমার জানাটা ভুল প্রমাণিত হতে সময় লাগল না। একে একে একই অভিযোগে ছাব্বিশটি মামলা দায়েরের বিশ্ব রেকর্ড তৈরি হলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লিখিত নির্দেশে প্রশাসনের তাবত্ অংশ একসঙ্গে আমাকে জন্মের মতো শিক্ষা দেয়ার অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পরের ইতিহাস দেশবাসী জানেন।
আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ এবং আমাকে জেলে পুরে সরকার এদেশে দুর্নীতিবিরোধী সব কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। প্রশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরাও আমাকে নজিরবিহীনভাবে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন আমার করুণ পরিণতি দেখার পর বাংলাদেশের আর কোনো নাগরিক অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসী হবে না। কিন্তু, তারা ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে গিয়েছিলেন। সরকারের সাড়ে তিন বছর অন্তে আজ দেখা যাচ্ছে, আমি জেল খেটেছি বটে, তবে মহাজোট সরকারের যাবতীয় অপকর্মের কেচ্ছা সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অবশ্য মন্ত্রী-এমপিরা জনগণের অর্থ নির্বিচারে লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়লেও বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই কেবল রাজস্ব ব্যয় মেটানোর জন্যই দেশ-বিদেশে ভিক্ষাপাত্র হাতে অর্থমন্ত্রীকে ঘুরে বেড়াতে হবে। ভবিষ্যত্ উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নের হাল পদ্মা সেতুর অবস্থা থেকেই সবার বোঝা উচিত।
অনেক টানাপড়েনের পর গত শনিবার দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মা সেতু অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করতে বলা চলে একরকম বাধ্যই হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি তদন্তে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে কানাডীয় পুলিশ সেদেশের বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের অফিসে অভিযান চালিয়ে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতির বিষয়ে সম্যক অবহিত করেছিল। সরকার বা বিশ্বব্যাংক কোনো পক্ষই সেই দুর্নীতিতে বাংলাদেশের কারা কারা জড়িত সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত সরাসরি মুখ না খুললেও বিভিন্ন সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছিল, কেবল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনই নন, ঘুষ দাবি অথবা লেনদেন প্রক্রিয়ায় সরকারের আরও ওপরের ক্ষমতাশালীরাও জড়িত। ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরামর্শক নিয়োগে মোটামুটি দশ শতাংশ ঘুষের নাকি রফা হয়েছিল। ঘুষের এই হারকে ক্ষমতাসীনদের স্ট্যান্ডার্ড ধরে হিসেব কষলে এক পদ্মা সেতু থেকেই প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
বিএনপির দুর্নীতিবাজদের মতো আওয়ামী লীগ যে ছিটেফোঁটায় সন্তুষ্ট হয় না, সেটা এবারের সাড়ে তিন বছরের মেয়াদে তারা বহু ঘটনায় জনগণের কাছে প্রমাণ দিয়েছে। মাশাল্লাহ্ গলার জোরও যে আওয়ামী নেতাদের অনেক বেশি, সে বিষয়টি বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতিদিনই টেলিভিশনে দেখাচ্ছেন। বিএনপি আমলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন গ্যাস কোম্পানি নাইকো’র কাছ থেকে কেবল একটি গাড়ি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। এর বাইরে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অপ্রমাণিত অভিযোগ হলো, বিদেশ ভ্রমণকালে ওই কানাডীয় কোম্পানির কাছ থেকেই তিনি নাকি মাত্র ৫ হাজার ডলার (চার লাখ টাকা) রাহা খরচ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এতেই দুদকের লাফালাফি দেখে কে!
অপরদিকে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস রাতদুপুরে ঘুষের ৭০ লাখ টাকা (দুষ্ট লোকে বলে টাকার প্রকৃত অংক কয়েক কোটি) মন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার সময় গাড়ি চালকের সাহসিকতায় বমাল ধরা পড়লেও এককালের বাম নেতা এখনও জনগণের টাকায় মন্ত্রীর ফ্ল্যাগ উড়িয়ে চলেছেন। দুই কান কাটাদের আধিক্যের ফলেই রাজনীতির আজ এই হতশ্রী দশা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুপুত্র মাত্র ষাট হাজার টাকা নিজের পুঁজি নিয়ে (!) নগদ পাঁচ কোটি টাকায় টেলিকম লাইসেন্স নিয়েছেন। মন্ত্রীপুত্রের দাবি, লোকজন তাকে নাকি শুধু ভালোবেসে এই বিপুল অংকের অর্থ ঋণ দিয়েছে। সরকারের লেজুড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ ‘স্বাধীন’ দুদক সুরঞ্জিতপুত্রের সেই ভালোবাসার দাবি মেনে নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রীকে সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দেয়ার আয়োজনও প্রায় সম্পন্ন করেছে। একই দুদক অবশ্য এর আগে পদ্মা সেতু ইস্যুতেই মন্ত্রী আবুল হোসেনকেও সততার সার্টিফিকেট দিয়েছে। আমার পরিচিত এক অধ্যাপক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের দুদককে ‘আওয়ামী লীগের ধোপা’ নামকরণ করেছেন। ক্ষমতাসীন দলটির মন্ত্রী-এমপিদের গায়ে লেগে থাকা দুর্নীতির কালিমাগুলো পরিষ্কার করে তাদের সাদা করে দেয়াই নাকি প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান কাজ। অধ্যাপক মহোদয়ের রসবোধে আমি চমত্কৃত হয়েছি।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বিশ্বব্যাংক যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তার মর্মার্থ অর্থাত্ ইংরেজিতে যাকে between the line meaning বলা হয়ে থাকে সেটি বুঝতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ ভেবে যে কোনো নাগরিক আতঙ্কিত বোধ করবেন। সেই বিবৃতি থেকে কয়েকটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করছি :
* The world bank has credible evidence corroborated by a variety of sources which points to a high level corruption conspiracy...
(বিশ্বব্যাংকের কাছে কয়েকটি উত্স দ্বারা সমর্থিত বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে যে উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে ...)
* The world bank provided evidence from two investigations to the Prime minister, as well as the minister of Finance and the Chairman of the Anti Corruption Commission of Bangladesh (ACC) in September 2011 and April 2012.
(বিশ্বব্যাংক দুটি ভিন্ন তদন্তের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সেপ্টেম্বর ২০১১ এবং এপ্রিল ২০১২ তারিখে হস্তান্তর করে)
* In an effort to go the extra mile, we sent a high level team to Dhaka to fully explain the Bank’s position and receive the Government’s response. The response has been unsatisfactory.
(বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ছাড় হিসেবে এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ব্যাংকের অবস্থান ব্যাখ্যা এবং সরকারের জবাব পাওয়ার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সরকারের জবাব সন্তোষজনক হয়নি।)
* The World Bank cannot, should not, and will not turn a blind eye to evidence of corruption. We have both an ethical obligation and fiduciary responsibility to our shareholders and IDA donor countries.
(দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয় এবং থাকবে না। আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং ব্যাংকের অংশীদার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর কাছে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।)
বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে এ দেশের শাসকগোষ্ঠীর ওপর মহলের হাত রয়েছে এবং প্রায় এক বছর আগেই দুর্নীতির প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কাজেই পদ্মা চুক্তি অর্থায়ন বাতিলের দায় দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গসহ এই তিন ব্যক্তি এড়াতে পারেন না। এখন মুখরক্ষার জন্য সরকার বায়বীয় মালয়েশীয় বিনিয়োগ নিয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। মালয়শিয়ার প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য প্রচণ্ড ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য দাবি করছেন যে, বিশ্বব্যাংক ঋণের চেয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশীয় অর্থায়ন নাকি সাশ্রয়ী হবে। বাণীর রাজা নামে খ্যাত এই মন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণকে সম্ভবত একেবারেই মূর্খ ও নির্বোধ বিবেচনা করেন। বিশ্বব্যাংকের যে কোনো ঋণে সর্বোচ্চ সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ এবং সচরাচর ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। একমাত্র সরাসরি অনুদান ছাড়া অন্য কোনো সূত্র থেকে এর চেয়ে সুলভে ঋণ পাওয়ার অন্য কোনো উপায় আমার অন্তত জানা নেই। তথাকথিত মালয়েশীয় বিনিয়োগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে দেশের সব অর্থনীতিবিদই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ওদের শর্ত মেনে নিলে পদ্মা সেতুর ব্যয় তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পাবে। এতদিন সততার ডঙ্কা বাজিয়ে ওবায়দুল কাদের অবশেষে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন।
এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পদ্মা সেতু ইস্যুতে সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা এক তাত্ক্ষণিক বিবৃতিতে শাসকগোষ্ঠীর বল্গাহীন দুর্নীতির সমালোচনার পরিবর্তে বিশ্বব্যাংককেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান এই প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থায়ন বন্ধ করে সরকার ও দেশের মানুষকে কষ্ট দেয়ার অধিকার বিশ্বব্যাংকের নেই। টিআইবি পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই টিআইবিই গত বছর তাদের এক প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের ‘মর্যাদা’ দান করেছিল। সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের লোকজন দিয়ে দুর্নীতি তদন্তের দাবির চেয়ে স্ববিরোধী প্রস্তাব আর কী হতে পারে?
আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা? মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিচার বিভাগের যাবতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগে রাজনৈতিক দলীয়করণ এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে বিরোধী দলের লোকজন কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সুবিচার প্রাপ্তির আর কোনো পরিবেশ অবশিষ্ট নেই। এহেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের পরিণাম স্বাধীন দুদকের তদন্তের চাইতে ভিন্নতর কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাঝখান থেকে মন্ত্রী আবুল হোসেনের ফুলের মতো চরিত্রের আরও একটি সনদপ্রাপ্তির সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। দেশের অধিকাংশ নাগরিক যখন সরকারের দুর্নীতির বহরে লজ্জায় অধোবদন, সেই সময় বিভ্রান্তিকর সব প্রস্তাব উত্থাপন করে টিআইবি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অবশ্য টিআইবি’র বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ড সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাদের বিবৃতি অথবা দুর্নীতিপরায়ণ মহাজোট সরকারের ত্রাতার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামানের অবতীর্ণ হওয়ার পেছনের কারণ বুঝে ফেলা শক্ত নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বর্তমান চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল চক্রবর্তী আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই সারাদেশে সুপরিচিত। তিনি ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিরূপে ড. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই সরকার থেকে পদত্যাগকারী চারজন উপদেষ্টার অন্যতম ছিলেন সুলতানা কামাল চক্রবর্তী। সেই পদত্যাগের পথ ধরেই এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের আর একজন প্রভাবশালী সদস্যের নাম অ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ। বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট আইনজীবীর আরও একটি পরিচয় হলো, তিনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনির স্বামী। আপন স্ত্রী যে সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেই সরকারের দুর্নীতির বিষয়ে তার ভূমিকা কী হতে পারে সেটি নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। একই ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন সাবেক চিফ ইলেকশন কমিশনার ড. শামসুল হুদা। ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের এই প্রধান ব্যক্তি মইনউদ্দিন জামানায় বিএনপিকে বিভক্ত করার ‘মহত্’ কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সাবেক এই আমলা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে চারদলীয় জোট সরকারের প্রতি গণমাধ্যমের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তার মেধার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করেনি। এহেন একজন দলবাজ টিআইবিতে থেকে যে আওয়ামী লীগের স্বার্থের পক্ষেই প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করবেন, সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। টিআইবি’র বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি জেনারেল, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের আওয়ামী লীগ প্রীতির ব্যাপারটিও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মোটামুটি জানা রয়েছে। এই ক’জন ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডে অন্য যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যেও আওয়ামীপন্থীদের সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মতো। সুতরাং বিএনপি সরকারের সময় টিআইবি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতখানি আদর্শিক ও নৈতিক অবস্থান প্রদর্শন করেছিল, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সেটি তাদের কাছে আশা করাটাই বোকামি। তাছাড়া স্মরণে রাখা দরকার, টিআইবিতে এখনও ড. মোজাফফর আহমেদের মতো ব্যক্তির শূন্যতা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজের এক বিরাট গোষ্ঠীর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণেই এদেশে সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট পাশ্চাত্যের মতো বিকশিত হতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুশীল (?) সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালালেও এই কারণেই আজ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা দেশের সাধারণ নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি’র এবারের বিতর্কিত অবস্থান কেবল সুশীল (?) সমাজকেই যে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করবে তাই নয়, এদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকেও দুর্বল করে ফেলবে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে যদি টিআইবি’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সমস্যা হয়, তাহলে সবিনয়ে অন্তত তাদেরকে নীরব থাকতেই অনুরোধ জানাব। মহাজোট সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের অপশাসনকালে টিআইবিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের তুলনায় নিষ্ক্রিয় ঠেকেছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদের বাকি দেড় বছরও তারা একটি দীর্ঘ শীতকালীন নিদ্রা (যরনবত্হধঃরড়হ) দিলে সবারই মঙ্গল হবে। বাংলাদেশের সচেতন দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী দুর্নীতিপরায়ণ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে টিআইবি মার্কা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়াই ইন্শাআল্লাহ বিজয় লাভ করবে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন