শা কি ল ও য়া হে দ
চার মাস পার হয়ে গেল। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী রাতে বাড়ি ফেরার পথে বনানীতে নিজ বাড়ির খুব কাছ থেকে তার নিজ গাড়ির চালক আনসারসহ অপহৃত হলেন। আজ পর্যন্ত তিনি বাড়ি ফিরলেন না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণমতে, দুটি গাড়ি ভর্তি সরকারি সংস্থার সাদা পোশাকধারী লোকজন ইলিয়াস আলীর গাড়িকে আটকে সেখান থেকে জোর করে তাকে ও তার গাড়িচালককে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আশপাশের বাড়ির দারোয়ানসহ হাতেগোনা কয়েকজন লোক দেখতে পান ঘটনাটি। তাদের কেউ কেউ পরদিন এ নিয়ে বলাবলিও করেন। তাদের দেখা ঘটনার বিবরণী ও পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, পাশেই টহলে থাকা গুলশান থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে কী হয়েছে জানতে এগিয়ে গেলে তাকে চুপচাপ সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়েছিল। সে রাতেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে চাঞ্চল্যকর সংবাদ বা ব্রেকিং নিউজ হিসেবে ইলিয়াস আলীর অপহৃত হওয়ার খবর প্রচার শুরু হয়ে যায়। পরদিন সকালে সব জাতীয় দৈনিকে প্রধান শিরোনাম হয়ে আসে ইলিয়াস আলীর অপহৃত হওয়ার ঘটনা।
নিন্দা আর সমালোচনার ঝড় ওঠে সারাদেশজুড়ে। ঘটনার রাতেই ইলিয়াস আলীর বাসায় ছুটে যান বিএনপি নেতারা। নির্ঘুম রাত কাটায় তার পরিবার ও স্বজনরা। তাদের কান্না আর আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়। পরদিন সকালে তার বাড়িটি সরগরম হয়ে ওঠে সহযোদ্ধা বিএনপি নেতাকর্মী আর দেশের সব গণমাধ্যমের সাংবাদিক-চিত্রগ্রাহকদের পদচারণায়। ছবি উঠতে থাকে ক্যামেরার ক্লিক-ক্লিক শব্দে। ভিডিওতে ধরা পড়তে থাকে স্ত্রী-পুত্র আর একমাত্র শিশুকন্যার কান্নাজড়িত মুষড়ে পড়া ছবি। সব গণমাধ্যমে হট আইটেম হিসেবে প্রচারিত হতে থাকে ইলিয়াস আলী অপহরণের চাঞ্চল্যকর সংবাদটি, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত টকশোগুলো সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। টকশোতে অংশগ্রহণকারী আলোচকরা সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এবং ইলিয়াস আলীর মতো একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদকে নিরাপত্তা দিতে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বেশুমার প্রশ্ন তুলতে থাকেন। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে ইলিয়াস আলীকে সরকার নিজেই অপহরণ করেছে বলে সরাসরি অভিযোগ তোলে এবং সুস্থাবস্থায় ইলিয়াস আলীসহ তার গাড়িচালককে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইলিয়াস আলীর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে যথাশীঘ্র সম্ভব তাকে খুঁজে বের করার আশ্বাস দিয়ে আসেন। এর মধ্যে অনলাইনে-ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে যেন। সেখানে নানারকম উদ্বেগ আর আশঙ্কার মধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে যে কথাটা উঠে আসছিল তা হলো এই যে, ইলিয়াস আলীর মতো একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদই যদি গুম হয়ে যান তবে আর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথায়? রাতভর টেলিভিশন দেখে, সকালে পত্রপত্রিকার খবরাখবর পড়ে আর মোবাইল ফোনে ফেসবুক সার্ফ করতে করতে আমি নিজেও বারবার শিউরে উঠছিলাম। হায় আল্লাহ, স্বাধীন দেশে এ কেমন গণতন্ত্র আমাদের?
ইলিয়াস আলী মূলত আশির দশকেই সাহসী একজন ছাত্রনেতা হিসেবে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। ১৯৮৫ সালে আমি এসএসসি পাস করে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই তখনই প্রথম ইলিয়াস আলীর নাম শুনেছিলাম। সেসময়ে ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সদস্য আমার কিছু সহপাঠী বন্ধুবান্ধব ছাত্রনেতা ইলিয়াস ভাইয়ের অনুসারী ছিল। তাদের কাছে ইলিয়াস আলীর নায়কোচিত নানা দুঃসাহসিকতার গুণমুগ্ধ বর্ণনা শুনতাম প্রায়ই। সারাক্ষণ সামরিক শাসকের গোয়েন্দা বাহিনীর নজর এড়িয়ে পালিয়ে বেড়ানো, রাতের আঁধারে হলের কোনো গোপন রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া, হঠাত্ তাড়া খেয়ে জানালা গলে চম্পট দেয়া, আবার সময়মত গেরিলা কায়দায় মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত হয়ে নেতৃত্ব দেবার মতো রোমাঞ্চকর অজস্র কাহিনী সহপাঠী বন্ধুরা যখন বর্ণনা করত, তখন খুব ইচ্ছে করত এই রূপকথার নায়কের সঙ্গে একবার অন্তত পরিচিত হই। সেই কঠিন সময়ে স্বৈরাচার এরশাদের হাজারো নিপীড়ন-নির্যাতন উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পতাকাতলে লক্ষ তরুণের সম্মিলন ঘটানোর ক্ষেত্রে ছাত্রনেতা ইলিয়াস আলীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বেগম খালেদা জিয়া তখন দল নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। তার দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা সেসময় সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের টোপ গিলে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছেন। সেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সারাদেশের তরুণ বয়সী ছাত্ররা। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তখন ছাত্রদল মনোনীত পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করছিল। মূলত বেগম খালেদা জিয়ার নিষ্কলুষ মোহময়ী নেতৃত্বের বিভায় আকৃষ্ট হয়েই দলে দলে ছাত্ররা ছাত্রদলে যোগ দিচ্ছিল। ছাত্রদলের অনুকূলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয় এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতে গড়া ছাত্রদলের সত্যিকারের বিকাশ ঘটে এই সময়েই। ছাত্রদলের এহেন জোয়ার সৃষ্টিতে সে সময়ে যে ক’জন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন ইলিয়াস ভাই ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সামগ্রিকভাবে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংঘটনে তার বীরোচিত ভূমিকা সর্বজনবিদিত। পরবর্তীকালে নব্বই দশকের শুরুর দিকে তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন রাকসু ভিপি হিসেবে খ্যাত ছাত্রনেতা রুহুল কবীর রিজভী, যিনি বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রিজভী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল এবং তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু ইলিয়াস আলীর সঙ্গে ২০০৭ সালের আগে আমার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হবার কোনো সুযোগ ঘটেনি।
২০০১ সালে ইলিয়াস আলী সিলেট-২ (বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিজের এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিককালে তার অপহরণ বা গুম হয়ে যাবার প্রতিবাদে বিশ্বনাথের আপামর জনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ পুলিশ প্রশাসন দমাতে গেলে যে মারমুখো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা ইলিয়াস আলীর প্রতি স্থানীয় জনগণের নিঃশর্ত ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণ করে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সাংবিধানিকভাবে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিকূল সময়ে ইলিয়াস আলী দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অধিকাংশ সিনিয়র নেতা ও সংসদ সদস্যদের আপসকামী সুবিধাবাদী আচরণের বিপরীতে তার ব্যতিক্রমী ভূমিকা এ সময়ে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। গ্রেফতার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, কিন্তু রাতের আঁধারে তত্কালে সাহসী ভূমিকা পালনকারী নেতা রিজভী আহমেদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ রাখতেন। এ ধরনের গোপন যোগাযোগগুলো হতো তাত্ক্ষণিকভাবে নির্ধারিত কোনো পরিচিতজনের বাসায়, কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কিংবা কোনো আড্ডায়। পরীবাগের গলিতে রিজভী ভাইয়ের নিয়মিত এক আড্ডাস্থলে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে এক সন্ধ্যায় হঠাত্ করে ইলিয়াস আলী এসে হাজির হলেন। চোখে কালো চশমা আর লাল-হলুদ মাফলারে মুখ ঢাকা ছিল তার। প্রথম ধাক্কায় সেই আগন্তুককে আড্ডায় উপস্থিত কেউই ঠিক চিনে উঠতে পারেননি। তার সঙ্গে আমার প্রথম আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটেছিল সেখানেই, পরীবাগের আড্ডায়। রিজভী ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারা দু’জনে আলাদাভাবে কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলেন বাতি নেভানো বারান্দায় বসে। আলাপ শেষে হুট করে কখন যে ইলিয়াস ভাই সরে পড়েছিলেন আমরা কেউ টেরও পাইনি। তার সঙ্গে এমনতর হুটহাট সাক্ষাত্ আমার আরও কয়েকবার হয়েছে মূলত সেই কঠিন সময়ে রিজভী ভাইয়ের সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবার সুবাদে। এরপর ২০০৮ সালের শেষদিকে দৈনিক আমার দেশ অধিগ্রহণের পর ইলিয়াস ভাই একদিন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে এলেন। মাহমুদ ভাইয়ের রুমে অন্য ক’জন অতিথি থাকায় সৌজন্যের অংশ হিসেবে আমার রুমে এনে তাকে বসিয়েছিলাম। সেদিনই বেশ কিছুটা সময় তার সঙ্গে একান্তে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল আমার। খুব ভালো লেগেছিল। অন্য অনেক কথার মাঝে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, তরুণ বয়সে তার সঙ্গে পরিচিত হবার রোমাঞ্চকর আগ্রহ থাকার কথা। তিনি শুনে হো হো করে হেসেছিলেন।
২০০৯ সালে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন ইলিয়াস ভাই। তত্পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকও নির্বাচিত হন তিনি। সাবেক জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ইলিয়াস আলী ধীরে ধীরে সিলেট বিভাগের অবিসংবাদিত নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার নেতৃত্বে ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। বিগত পৌর নির্বাচনগুলোতে সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ পৌরসভায় মেয়র পদে জয়লাভের ক্ষেত্রে ইলিয়াস ভাই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সংগঠকের ভূমিকায় তার যোগ্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিগত হবিগঞ্জের বাহুবল-নবীগঞ্জ আসনের উপ-নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই উপ-নির্বাচনে ঢাকা থেকে যাওয়া দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমারও যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ ইলিয়াস আলী এবং আমি এক গাড়িতে চড়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে হবিগঞ্জ গিয়েছিলাম। সেই নির্বাচনের প্রচারণায় ইলিয়াস আলী সার্বিকভাবে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সিলেট থেকে ইলিয়াস ভাইয়ের অনুসারী বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী শতাধিক মাইক্রোবাস আর মোটরসাইকেলে চড়ে এসে যোগ দিয়েছিল হবিগঞ্জের উপ-নির্বাচনের প্রচারণায়। দিনব্যাপী প্রচারণাসভায় তার সিলেটি ভাষায় দেয়া আবেগতাড়িত বক্তব্য উপস্থিত জনতাকে কেমন উদ্বেলিত করে তুলছিল, তা জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছি আমি। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মাঝেও সকাল থেকে গভীর রাত অবধি একের পর এক নির্বাচনী সভায় উপস্থিত হয়ে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন এবং নির্বাচনী উত্তাপ যেন ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন সর্বত্র। ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা এই আসনটিতে প্রথমবারের মতো একজন বিএনপি প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার সরব উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইলিয়াস ভাইয়ের নেতৃত্বের ক্যারিশমা বা মোহময় বৈশিষ্ট্য এই সময়টাতে খুব কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
খুব শীত পড়েছিল মাঝরাতের দিকে। ভারী কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল চারপাশ। তার ওপরে বইছিল কনকনে ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া। নেতা-কর্মী-ভোটার সবাই শীতে রীতিমত জবুথবু অবস্থায়। একাধিক শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়েও শীত নিবারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছিল তখন। আমি একটা নীল জ্যাকেট গলা পর্যন্ত জিপার টেনে শীত ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম গেস্ট হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ইলিয়াস ভাই সাধারণত ধূমপান করতেন না। কদাচিত্ একটা-দুটো সিগারেট হয়ত খেতেন কখনো ইচ্ছে হলে। আমাকে ধূমপান করতে দেখে তাকেও একটা সিগারেট দিতে বললেন তিনি। একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগও করে দিলাম। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইলিয়াস ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হালকা সুরে বললেন, ‘শাকিল, আপনার জ্যাকেটটা তো খুব সুন্দর। আমাকে দিয়ে দেন।’ আমি বললাম, ‘ধন্যবাদ, ইলিয়াস ভাই। এটা তো পাঁচ বছরের পুরনো। আপনাকে বরং আমি একটা নূতন জ্যাকেট উপহার দেব ঢাকায় ফিরে।’ ইলিয়াস ভাই বললেন, ‘নারে ভাই, তাহলে আর এই শীতে দরকার নাই। সামনের শীতে বরং দুই ভাই একই রকম দুইটা জ্যাকেট কিনে নেব। কী বলেন?’ আমি হেসে সম্মতি দিলাম, ‘ঠিক আছে, ইলিয়াস ভাই।’ রসিকতা করে তিনি বললেন, ‘কিন্তু একটা শর্ত আছে, ভাই। যেদিন আপনি পরবেন, আমাকে ফোন করে জানাবেন। আমি সেদিন পরব না।’ আমি পাল্টা রসিকতা করে বললাম, ‘না ভাই, বরং উল্টোটা করেন। যেদিন আপনি পরবেন, আমাকে ফোন করে জানাবেন। আমিও সেদিন পরব। দুই ভাই একই রকম জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াব।’ ইলিয়াস ভাই হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। তাই হবে।’ তিনি তার দলবল নিয়ে রাতেই সিলেটের উদ্দেশে চলে গেলেন। আমরা সেখানে রাত্রিযাপন করে পরদিন সকালে ঢাকা ফিরে এলাম।
সামনে শীত আসছে আবার। পুরনো সেই নীল জ্যাকেট পাল্টে নতুন জ্যাকেট হয়ত আসলেই কিনতে হবে। কিন্তু ইলিয়াস ভাই, আপনি এখন কোথায়? শিগগির ফিরে আসুন, ভাই। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে আপনার একমাত্র শিশুকন্যা নাওয়াল, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং পুত্রদ্বয়। অপেক্ষা করছেন আপনার গর্ভধারিণী মা, আপনার প্রাণপ্রিয় বিশ্বনাথবাসী। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন আপনার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আপামর নেতাকর্মীরা। দেশবাসীও আকুল অপেক্ষায় আছেন আপনার ফিরে আসার সুসংবাদটুকু শোনার জন্য। সরকারের হেফাজতে যদি থেকে থাকেন, আর সেখানে যদি এই লেখা পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে আপনাকে, তবে আর কালবিলম্ব না করে গেরিলা কায়দায় পালিয়ে হলেও এক্ষুনি ফিরে আসুন ঘরে। আমরা সবাই মিলে আপনাকে আগলে রাখব এবার থেকে। ফিরে এসে আমাদেরকে বলুন, ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? কোথায় কোথায় ছিলেন এতদিন? আর কেমনইবা ছিলেন? সরকারের ভেতরে কিংবা বাইরে কারা খেলছে এমন অমানবিক গুম গুম খেলা? এই সর্বনাশা খেলার অবসান হওয়া তো খুবই জরুরি, ইলিয়াস ভাই! জনমনে গুম আতঙ্কের অবসান না হলে আমরা ঘুমাব কী করে নিশ্চিন্তে? নীল জ্যাকেট পরে হিম শীতের রাতে ঘরের বাইরেই বা যাব কোন্ ভরসায়?
লেখক : সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিএনপি
নিন্দা আর সমালোচনার ঝড় ওঠে সারাদেশজুড়ে। ঘটনার রাতেই ইলিয়াস আলীর বাসায় ছুটে যান বিএনপি নেতারা। নির্ঘুম রাত কাটায় তার পরিবার ও স্বজনরা। তাদের কান্না আর আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়। পরদিন সকালে তার বাড়িটি সরগরম হয়ে ওঠে সহযোদ্ধা বিএনপি নেতাকর্মী আর দেশের সব গণমাধ্যমের সাংবাদিক-চিত্রগ্রাহকদের পদচারণায়। ছবি উঠতে থাকে ক্যামেরার ক্লিক-ক্লিক শব্দে। ভিডিওতে ধরা পড়তে থাকে স্ত্রী-পুত্র আর একমাত্র শিশুকন্যার কান্নাজড়িত মুষড়ে পড়া ছবি। সব গণমাধ্যমে হট আইটেম হিসেবে প্রচারিত হতে থাকে ইলিয়াস আলী অপহরণের চাঞ্চল্যকর সংবাদটি, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত টকশোগুলো সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। টকশোতে অংশগ্রহণকারী আলোচকরা সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এবং ইলিয়াস আলীর মতো একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদকে নিরাপত্তা দিতে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বেশুমার প্রশ্ন তুলতে থাকেন। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে ইলিয়াস আলীকে সরকার নিজেই অপহরণ করেছে বলে সরাসরি অভিযোগ তোলে এবং সুস্থাবস্থায় ইলিয়াস আলীসহ তার গাড়িচালককে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইলিয়াস আলীর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে যথাশীঘ্র সম্ভব তাকে খুঁজে বের করার আশ্বাস দিয়ে আসেন। এর মধ্যে অনলাইনে-ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে যেন। সেখানে নানারকম উদ্বেগ আর আশঙ্কার মধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে যে কথাটা উঠে আসছিল তা হলো এই যে, ইলিয়াস আলীর মতো একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদই যদি গুম হয়ে যান তবে আর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথায়? রাতভর টেলিভিশন দেখে, সকালে পত্রপত্রিকার খবরাখবর পড়ে আর মোবাইল ফোনে ফেসবুক সার্ফ করতে করতে আমি নিজেও বারবার শিউরে উঠছিলাম। হায় আল্লাহ, স্বাধীন দেশে এ কেমন গণতন্ত্র আমাদের?
ইলিয়াস আলী মূলত আশির দশকেই সাহসী একজন ছাত্রনেতা হিসেবে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। ১৯৮৫ সালে আমি এসএসসি পাস করে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই তখনই প্রথম ইলিয়াস আলীর নাম শুনেছিলাম। সেসময়ে ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সদস্য আমার কিছু সহপাঠী বন্ধুবান্ধব ছাত্রনেতা ইলিয়াস ভাইয়ের অনুসারী ছিল। তাদের কাছে ইলিয়াস আলীর নায়কোচিত নানা দুঃসাহসিকতার গুণমুগ্ধ বর্ণনা শুনতাম প্রায়ই। সারাক্ষণ সামরিক শাসকের গোয়েন্দা বাহিনীর নজর এড়িয়ে পালিয়ে বেড়ানো, রাতের আঁধারে হলের কোনো গোপন রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া, হঠাত্ তাড়া খেয়ে জানালা গলে চম্পট দেয়া, আবার সময়মত গেরিলা কায়দায় মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত হয়ে নেতৃত্ব দেবার মতো রোমাঞ্চকর অজস্র কাহিনী সহপাঠী বন্ধুরা যখন বর্ণনা করত, তখন খুব ইচ্ছে করত এই রূপকথার নায়কের সঙ্গে একবার অন্তত পরিচিত হই। সেই কঠিন সময়ে স্বৈরাচার এরশাদের হাজারো নিপীড়ন-নির্যাতন উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পতাকাতলে লক্ষ তরুণের সম্মিলন ঘটানোর ক্ষেত্রে ছাত্রনেতা ইলিয়াস আলীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বেগম খালেদা জিয়া তখন দল নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। তার দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা সেসময় সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের টোপ গিলে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছেন। সেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সারাদেশের তরুণ বয়সী ছাত্ররা। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তখন ছাত্রদল মনোনীত পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করছিল। মূলত বেগম খালেদা জিয়ার নিষ্কলুষ মোহময়ী নেতৃত্বের বিভায় আকৃষ্ট হয়েই দলে দলে ছাত্ররা ছাত্রদলে যোগ দিচ্ছিল। ছাত্রদলের অনুকূলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয় এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতে গড়া ছাত্রদলের সত্যিকারের বিকাশ ঘটে এই সময়েই। ছাত্রদলের এহেন জোয়ার সৃষ্টিতে সে সময়ে যে ক’জন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন ইলিয়াস ভাই ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সামগ্রিকভাবে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংঘটনে তার বীরোচিত ভূমিকা সর্বজনবিদিত। পরবর্তীকালে নব্বই দশকের শুরুর দিকে তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন রাকসু ভিপি হিসেবে খ্যাত ছাত্রনেতা রুহুল কবীর রিজভী, যিনি বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রিজভী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল এবং তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু ইলিয়াস আলীর সঙ্গে ২০০৭ সালের আগে আমার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হবার কোনো সুযোগ ঘটেনি।
২০০১ সালে ইলিয়াস আলী সিলেট-২ (বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিজের এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিককালে তার অপহরণ বা গুম হয়ে যাবার প্রতিবাদে বিশ্বনাথের আপামর জনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ পুলিশ প্রশাসন দমাতে গেলে যে মারমুখো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা ইলিয়াস আলীর প্রতি স্থানীয় জনগণের নিঃশর্ত ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণ করে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সাংবিধানিকভাবে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিকূল সময়ে ইলিয়াস আলী দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অধিকাংশ সিনিয়র নেতা ও সংসদ সদস্যদের আপসকামী সুবিধাবাদী আচরণের বিপরীতে তার ব্যতিক্রমী ভূমিকা এ সময়ে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। গ্রেফতার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, কিন্তু রাতের আঁধারে তত্কালে সাহসী ভূমিকা পালনকারী নেতা রিজভী আহমেদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ রাখতেন। এ ধরনের গোপন যোগাযোগগুলো হতো তাত্ক্ষণিকভাবে নির্ধারিত কোনো পরিচিতজনের বাসায়, কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কিংবা কোনো আড্ডায়। পরীবাগের গলিতে রিজভী ভাইয়ের নিয়মিত এক আড্ডাস্থলে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে এক সন্ধ্যায় হঠাত্ করে ইলিয়াস আলী এসে হাজির হলেন। চোখে কালো চশমা আর লাল-হলুদ মাফলারে মুখ ঢাকা ছিল তার। প্রথম ধাক্কায় সেই আগন্তুককে আড্ডায় উপস্থিত কেউই ঠিক চিনে উঠতে পারেননি। তার সঙ্গে আমার প্রথম আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটেছিল সেখানেই, পরীবাগের আড্ডায়। রিজভী ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারা দু’জনে আলাদাভাবে কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলেন বাতি নেভানো বারান্দায় বসে। আলাপ শেষে হুট করে কখন যে ইলিয়াস ভাই সরে পড়েছিলেন আমরা কেউ টেরও পাইনি। তার সঙ্গে এমনতর হুটহাট সাক্ষাত্ আমার আরও কয়েকবার হয়েছে মূলত সেই কঠিন সময়ে রিজভী ভাইয়ের সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবার সুবাদে। এরপর ২০০৮ সালের শেষদিকে দৈনিক আমার দেশ অধিগ্রহণের পর ইলিয়াস ভাই একদিন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে এলেন। মাহমুদ ভাইয়ের রুমে অন্য ক’জন অতিথি থাকায় সৌজন্যের অংশ হিসেবে আমার রুমে এনে তাকে বসিয়েছিলাম। সেদিনই বেশ কিছুটা সময় তার সঙ্গে একান্তে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল আমার। খুব ভালো লেগেছিল। অন্য অনেক কথার মাঝে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, তরুণ বয়সে তার সঙ্গে পরিচিত হবার রোমাঞ্চকর আগ্রহ থাকার কথা। তিনি শুনে হো হো করে হেসেছিলেন।
২০০৯ সালে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন ইলিয়াস ভাই। তত্পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকও নির্বাচিত হন তিনি। সাবেক জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ইলিয়াস আলী ধীরে ধীরে সিলেট বিভাগের অবিসংবাদিত নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার নেতৃত্বে ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। বিগত পৌর নির্বাচনগুলোতে সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ পৌরসভায় মেয়র পদে জয়লাভের ক্ষেত্রে ইলিয়াস ভাই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সংগঠকের ভূমিকায় তার যোগ্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিগত হবিগঞ্জের বাহুবল-নবীগঞ্জ আসনের উপ-নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই উপ-নির্বাচনে ঢাকা থেকে যাওয়া দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমারও যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ ইলিয়াস আলী এবং আমি এক গাড়িতে চড়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে হবিগঞ্জ গিয়েছিলাম। সেই নির্বাচনের প্রচারণায় ইলিয়াস আলী সার্বিকভাবে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সিলেট থেকে ইলিয়াস ভাইয়ের অনুসারী বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী শতাধিক মাইক্রোবাস আর মোটরসাইকেলে চড়ে এসে যোগ দিয়েছিল হবিগঞ্জের উপ-নির্বাচনের প্রচারণায়। দিনব্যাপী প্রচারণাসভায় তার সিলেটি ভাষায় দেয়া আবেগতাড়িত বক্তব্য উপস্থিত জনতাকে কেমন উদ্বেলিত করে তুলছিল, তা জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছি আমি। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মাঝেও সকাল থেকে গভীর রাত অবধি একের পর এক নির্বাচনী সভায় উপস্থিত হয়ে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন এবং নির্বাচনী উত্তাপ যেন ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন সর্বত্র। ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা এই আসনটিতে প্রথমবারের মতো একজন বিএনপি প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার সরব উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইলিয়াস ভাইয়ের নেতৃত্বের ক্যারিশমা বা মোহময় বৈশিষ্ট্য এই সময়টাতে খুব কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
খুব শীত পড়েছিল মাঝরাতের দিকে। ভারী কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল চারপাশ। তার ওপরে বইছিল কনকনে ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া। নেতা-কর্মী-ভোটার সবাই শীতে রীতিমত জবুথবু অবস্থায়। একাধিক শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়েও শীত নিবারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছিল তখন। আমি একটা নীল জ্যাকেট গলা পর্যন্ত জিপার টেনে শীত ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম গেস্ট হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ইলিয়াস ভাই সাধারণত ধূমপান করতেন না। কদাচিত্ একটা-দুটো সিগারেট হয়ত খেতেন কখনো ইচ্ছে হলে। আমাকে ধূমপান করতে দেখে তাকেও একটা সিগারেট দিতে বললেন তিনি। একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগও করে দিলাম। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইলিয়াস ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হালকা সুরে বললেন, ‘শাকিল, আপনার জ্যাকেটটা তো খুব সুন্দর। আমাকে দিয়ে দেন।’ আমি বললাম, ‘ধন্যবাদ, ইলিয়াস ভাই। এটা তো পাঁচ বছরের পুরনো। আপনাকে বরং আমি একটা নূতন জ্যাকেট উপহার দেব ঢাকায় ফিরে।’ ইলিয়াস ভাই বললেন, ‘নারে ভাই, তাহলে আর এই শীতে দরকার নাই। সামনের শীতে বরং দুই ভাই একই রকম দুইটা জ্যাকেট কিনে নেব। কী বলেন?’ আমি হেসে সম্মতি দিলাম, ‘ঠিক আছে, ইলিয়াস ভাই।’ রসিকতা করে তিনি বললেন, ‘কিন্তু একটা শর্ত আছে, ভাই। যেদিন আপনি পরবেন, আমাকে ফোন করে জানাবেন। আমি সেদিন পরব না।’ আমি পাল্টা রসিকতা করে বললাম, ‘না ভাই, বরং উল্টোটা করেন। যেদিন আপনি পরবেন, আমাকে ফোন করে জানাবেন। আমিও সেদিন পরব। দুই ভাই একই রকম জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াব।’ ইলিয়াস ভাই হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। তাই হবে।’ তিনি তার দলবল নিয়ে রাতেই সিলেটের উদ্দেশে চলে গেলেন। আমরা সেখানে রাত্রিযাপন করে পরদিন সকালে ঢাকা ফিরে এলাম।
সামনে শীত আসছে আবার। পুরনো সেই নীল জ্যাকেট পাল্টে নতুন জ্যাকেট হয়ত আসলেই কিনতে হবে। কিন্তু ইলিয়াস ভাই, আপনি এখন কোথায়? শিগগির ফিরে আসুন, ভাই। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে আপনার একমাত্র শিশুকন্যা নাওয়াল, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং পুত্রদ্বয়। অপেক্ষা করছেন আপনার গর্ভধারিণী মা, আপনার প্রাণপ্রিয় বিশ্বনাথবাসী। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন আপনার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আপামর নেতাকর্মীরা। দেশবাসীও আকুল অপেক্ষায় আছেন আপনার ফিরে আসার সুসংবাদটুকু শোনার জন্য। সরকারের হেফাজতে যদি থেকে থাকেন, আর সেখানে যদি এই লেখা পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে আপনাকে, তবে আর কালবিলম্ব না করে গেরিলা কায়দায় পালিয়ে হলেও এক্ষুনি ফিরে আসুন ঘরে। আমরা সবাই মিলে আপনাকে আগলে রাখব এবার থেকে। ফিরে এসে আমাদেরকে বলুন, ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? কোথায় কোথায় ছিলেন এতদিন? আর কেমনইবা ছিলেন? সরকারের ভেতরে কিংবা বাইরে কারা খেলছে এমন অমানবিক গুম গুম খেলা? এই সর্বনাশা খেলার অবসান হওয়া তো খুবই জরুরি, ইলিয়াস ভাই! জনমনে গুম আতঙ্কের অবসান না হলে আমরা ঘুমাব কী করে নিশ্চিন্তে? নীল জ্যাকেট পরে হিম শীতের রাতে ঘরের বাইরেই বা যাব কোন্ ভরসায়?
লেখক : সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিএনপি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন