রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

স্মৃতিময় ধানগড়া



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম
২১ মে ‘স্মৃতিময় ধানগড়া’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেন, কীভাবে এক অনাত্মীয়ের বাড়ি ধানগড়াতে গিয়েছিলেন তা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমসাময়িক কিছু ঘটনার কারণে গত কয়েক পর্বে সেই করুণ কাহিনী আর লেখা হয়নি। পাঠকরা হয়তো মনে করবেন আমি তাদের এক গভীর অন্ধকারে ফেলে দিয়েছি। আসলে দোষ-গুণ যাই বলুন, আমি একজন বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ। শত্রুকেও বিশ্বাস করা আমার স্বভাব। নিজে জেনে-শুনে চোখে দেখে অহেতুক একটা পিঁপড়েও মারার চেষ্টা করিনি কোনোদিন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সখিপুরের নলুয়ায় একদিন আমার গায়ে একটি বড় পিঁপড়ে উঠেছিল। গ্রামে যাকে বলে মাঞ্জাইল। কামড় খুবই শক্ত। নলুয়ার রাসেল আমায় মামা বলে ডাকে। ভারতে নির্বাসনের সময় বহু চিঠি লিখেছে। এখন সে একজন বেশ বড়সড় ভালো স্বভাব কবি। ছুটে এসে মাঞ্জাইলটি মারতে যাচ্ছিল। ছোট বলেই আমার গায়ে হাত লাগাতে সাহস করেছিল। বড়রা তখন বড় বেশি সমীহ করত। আমার গা ছোঁয়া ছিল তাদের জন্য সাত রাজার ধন মানিক পাবার মতো ব্যাপার। ওই ধরনের পিঁপড়ে কামড় দিলে ভীষণ জ্বালা করে, সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ওঠে। তাই সে অত ব্যাকুল হয়ে মাঞ্জাইলটি মারতে চাচ্ছিল। তাকে বলেছিলাম, ওকে মেরো না, আমি ওর কোনো ক্ষতি করিনি, ও-ও আমার ক্ষতি করবে না। আপনাআপনি চলে যাবে। সেদিনও গায়ে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, কালো মুজিব কোট ছিল। কেন জানি কোনো কামড় না দিয়ে সত্যি-সত্যিই পিঁপড়েটি চলে গিয়েছিল। লেখালেখির ব্যাপারে পাঠকরা আজ আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, শত জনমের আরাধ্য ধন। আমার লেখা তাদের পছন্দ, না পছন্দ হতে পারে। আমি ভুল ভাবতে পারি। ভুল লিখতে পারি, ভুল করতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে করে কাউকে বিভ্রান্ত করতে পারি না। চালাকি করতে পারি না।
বংশাই নদীর পাড়ে এক নিরিবিলি ছোট্ট গ্রাম ধানগড়া। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল আড়াই দূরে হবে। কিন্তু ওর আগে কোনোদিন যাইনি। তবে নদীপথে পার্কী, মরিচা, মৈষবাতান, ডাবাইল, রতনগঞ্জ যাওয়ার পথে আগেও দেখেছি। বেশ কয়েকটি আমগাছ আর বাঁশঝাড়ের পাশে বসেছিলাম। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ, ভীষণ বাতাস বইছিল। মন ছিল খুবই ভারাক্রান্ত। তবে ২০-২৫ দিন পর মা-বাবা, ভাই-বোনদের পেয়ে আর মুক্ত বাতাসে বসে থেকে মনের চাপ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর নদীর পাড় থেকে বাড়ি গিয়ে খাবার খেলাম। খুবই সাধারণ খাবার, চামারা চালের ভাত, ভাজি, শাক-সবজি আর ছোট মাছের ঝোল। এখন আর তেমন রান্না হয় না, সে স্বাদ পাওয়া যায় না। ডিজিটাল দেশে স্বাদের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল প্রভাব পড়েছে। মা-বাবা, ভাই-বোন কেন ধানগড়ায় এসেছে। ভাই-বোনদের কাছ থেকে কিছুটা জেনেছিলাম। কিন্তু তাতে তেমন বুঝতে পারিনি। খাবার পর বাবা বললেন সেই করুণ কাহিনী। ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহরে হানাদার বাহিনীর প্রবেশের আগ পর্যন্ত গ্রামে তারা রাজ-রাজড়ার মতোই ছিলেন। কিন্তু যেই পাকিস্তান হানাদাররা টাঙ্গাইল প্রবেশ করে বদিউজ্জামান খান এমপি, আসাদুজ্জামান খান ও আমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দেয় তখন থেকেই ছাতিহাটি গ্রামে উত্তেজনা শুরু হয়। লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকীর বাবা-মা গ্রামে আছে এটা জানলে পাকিস্তান হানাদাররা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। তাই তাদের গ্রামে না থাকাই ভালো। বাইরের মানুষ হয়তো কথাটা মনে মনে ভেবেছে কিন্তু প্রকাশ করেনি। গ্রামের সবাই সবসময়ই আমাদের ভালোবেসেছে। চরম বিপদে তারা ভয় পেতে পারে। কিন্তু তাতে আমাদের প্রতি মায়া, মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কোনোদিন কমতি হয়নি। সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল খুবই ভয়াবহ অস্বাভাবিক। আজকাল সেই সময় অনুধাবন করা বা চিন্তা করা সে যতই মেধাশীল হৃদয়বান হোক প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবীর কোথাও হয়তো এর আগে আর কখনও অমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি। এখন যখন তখন কোথাও কিছু হলেই কেউ কেউ বলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চাইতেও খারাপ হয়েছে। তখন তাদের প্রতি বড় বেশি ঘৃণা জাগে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা এত সস্তা করে ফেলতে কেন চেষ্টা করেছেন, ভাবলেই অবাক লাগে। গ্রামের বাড়িতে আমাদের নিজেদের কোনো ঘর ছিল না। আমাদের বিরাট পুব দুয়ারী ঘর ’৫৮-’৬০ সালে এক মারাত্মক ঝড়ে ভেঙে গিয়েছিল। গ্রামে কেউ থাকতাম না বলে আমাদের ভিটায় আর ঘর তোলা হয়নি। কিন্তু ’৭১-এর মার্চে বাবা পরিবার-পরিজন নিয়ে যখন গ্রামে যান তখন অবশ্যই নিজেদের ঘর থাকলে কথা হতো এক রকম, বাপ-দাদার ভিটায় নিজেদের ঘর ছিল না বলে ঘটনা ঘটেছিল অন্য রকম। আমাদের ঘর না থাকলেও তখনও বাড়িতে বিরাট বিরাট ৩-৪টি ঘর ছিল। বরং থাকার মানুষই কম ছিল। কদাচিত্ গ্রামে গেলে আমরা মাঐ মা’র ঘরে থাকতাম। আমি আমার বাবার মা দাদীকে দেখিনি। কিন্তু বাবার বাবার মা মানে মাঐ মা’কে দেখেছি। শিশুকালে তিনিই ছিলেন আমার সব বিপদ আপদের আশ্রয়স্থল। তাঁর মস্তবড় ঘরে আমরা থাকতাম। সিদ্দিকী পরিবারে আমার মাঐ মা ছিলেন সব থেকে সম্পদশালী। তাঁর অনেক জমি-জমা, টাকা-পয়সা ছিল। ষাটের দশকে তিনি মারা গেলে তাঁর ঘর বাবা নিজের ঘরের মতোই ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ঘরেই বাবা-মা উঠেছিলেন। তখন প্রতিদিনই গ্রামে নতুন নতুন খবর যেত, রাস্তাঘাটে কত মানুষ মেরেছে তার খবর, কত ঘর-দুয়ার পুড়েছে তার খবর, স্বাধীনতার পক্ষের কাকে কোথায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে তার খবর। আসলে মানুষের কোনো স্বস্তি ছিল না। চারদিকে ভয় আর ভয়। ভয়ে ভয়ে মানুষ ছিল জড়সড়। মনে হয় ১০-১২ তারিখের পর গ্রামের পরিবেশ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আমাদের বাড়ির পাশেই আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারদের বাড়ি। তারা কেউ বাড়িতে ছিল না। সে বাড়িতে ওয়্যারলেস ছিল। সেট ওপেন করলেই নানা দিকের খবর আসত। মানুষ তাতে আরও শঙ্কিত হতো। মনে হয় ১৪-১৫ তারিখের দিকে ছোট চাচা একেবারে অধৈর্য হয়ে পড়েন। বাবা আর একদিন গ্রামে থাকুক তা তিনি চাচ্ছিলেন না। আকার-ইঙ্গিতে দু’চারবার বলেছেন। কিন্তু কোথায় যাবেন, কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বাবা তখন বড়ই অসহায়। এমনিতে তাঁর মতো সাহসী মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি। কিন্তু তারপরও নিজের পরিবার পরিজনের জন্য সবারই কমবেশি দুর্বলতা থাকে। খুব সম্ভবত ১৫ তারিখ দুপুরের দিকে আর্মি আসতে পারে খবর পেয়ে ছোট চাচা একেবারে উন্মাদ হয়ে যান। বাবাকে বলেন, এখনই আপনারা গ্রাম ছেড়ে চলে যান। আপনারা থাকলে আপনাদের খোঁজে আর্মি এসে আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। আরজু, বজ্রের জন্য আমরা আমাদের বাড়িঘর জ্বালাতে-পোড়াতে পারব না। শুধু কথায়ই নয়, কাজেও তা প্রমাণ করতে শুরু করেন। বাবা-মা’র বাক্স, ড্যাকস, পোঁটলা-পুঁটলি উঠানে ফেলে দেন। মা অবাক বিস্ময়ে ছোট দেবরের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকেন। কারণ ছোট চাচা আমাদের টাঙ্গাইলের বাসায় থেকে সারাজীবন পড়াশোনা করেছেন। মা-বাবা তাকে সবসময় সন্তানের মতোই দেখতেন। জিনিসপত্র ফেলে দিতে দেখে ভাই-বোনেরা কান্না জুড়ে দেয়। ধানগড়া থেকে আমাদের খোঁজে আসা নাজির, সিরাজ, হামিদ এবং নাজির হোসেন নাদুর ছেলে শাহজাহান ভেবাচেকা খেয়ে যায়। একসময়ে তারা ফেলে দেয়া পোঁটলা-পুঁটলি কাঁধে তুলে বাবা-মাকে বলে, চাচা মিয়া, চাচী বিবি আমরা গরিব মানুষ, আমাদের তেমন বাড়ি-ঘর নেই, তাই পোড়ার ভয়ডরও নেই। চলেন আমাদের বাড়ি। যেভাবে পারি সেভাবে রাখব। সত্যিই তারা তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের সেই দুঃসময়ে আশ্রয় দেয়ার ঋণ আমরা কে কতটা শোধ করেছি বা করতে পেরেছি। আমাদের কৃতজ্ঞতার বড়ই অভাব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার বিরাট বিরাট ধনী, বিদ্বান, বুদ্ধিমানরা গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক বড় হয়েছেন। অঢেল বিত্তবৈভব হয়েছে। তারা অনেকেই দুঃসময়ের সেই আশ্রয়দাতাদের আর চিনতে পারেনি। সম্মান দেখাননি, খোঁজ-খবরও নেননি। আমি স্পর্শকাতর একজন মানুষ। আমি আমার পরিবার-পরিজনদেরই যে আচরণ দেখেছি বা এখনও দেখছি তাতে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। অন্যের কথা আর কি বলব? ১৬ আগস্ট ধলাপাড়ার মাকড়াইয়ে সম্মুখ যুদ্ধে হাতে-পায়ে গুলি লেগে গুরুতর আহত হলে আমার পরিবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। রহিমা, শুশুমা, শাহানা, মুরাদ, আজাদকে নিয়ে মা আসেন ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। বাবুল, বেল্লাল এবং বাবাকে নিয়ে আমি যাই সীমান্তের দিকে। সেখানে বেল্লালই সব থেকে ছোট, তার দশ-এগারো বছর বয়স ছিল। জামালপুর, নরন্দির পর সে আর হাঁটতে পারেনি। কমান্ডার মনিরুল ইসলাম, হুমায়ুন বাঙাল, আবুল কাশেম ও সাইদুর তাকে প্রায় চল্লিশ মাইল কাঁধে করে ভারত সীমান্ত পার করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই বেল্লালকে তাদের প্রতি যতটা কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা ছিল তা দেখিনি। এখন ওরা কেউ লন্ডন, কেউ আমেরিকা, কেউ আবার কানাডায় থাকে। এখন তো কেউ কাউকে চিনবেই না। ধানগড়া এবং সুরিরচালা মিলে ওরা প্রায় ৫ মাস ছিল। ধানগড়ায় যেমন নাজির, সুরিরচালায় আবু সাইদ চৌধুরীর খামার বাড়িতে মৈশাল, ফরহাদ যারা ওদের দেখাশোনা করেছে তাদের কাউকেই বাবা-মা ছাড়া আর কেউ যথাযথ সম্মান করেনি। বাবা বড় কঠিন মানুষ ছিলেন। ’৯০-এর পর নাজির কিংবা হামিদ অথবা মৈশাল এলে বলতেন, আমরা মারা গেলে তোমাদের আর কেউ খবর নেবে না। বজ্র যতদিন আছে ততদিন ওর কাছে যেতে পারবে। তারপর না তোমরা ছায়া পবে, না তোমাদের ছেলেমেয়েরা পাবে। বাবা-মা’র কথাই সত্য হয়েছে। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের প্রথম সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে ছিলেন। এখানকার দুঃখ-কষ্ট, দৈনিন্দ্য কিছুই দেখেননি। বাবা-মা, ভাই-বোনদের যারা সে সময় সাহায্য করেছেন তাদের একজনেরও কোনো খোঁজ-খবর কখনও নেননি। এখনও গা করেন না। মেনে নিলাম বড় ভাই দুঃসময়ে ছিলেন না, তাই গা করেন না। কিন্তু যারা ছিল রহিমা, শুশুমা, শাহানা, বাবুল, বেল্লাল, মুরাদ, আজাদ তারা? ওদেরকে তো খেতে দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে, ওদের বোঝা অন্যে বয়ে বেরিয়েছে। এখন তো নিজের চোখেই দেখি, সুরিরচালার মৈশাল যখন আসে আমার ভাই-বোনরা কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে না। রহিমা রেডক্রিসেন্টে বেশ বড় চাকরি করে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়। মাঝে-মধ্যেই দেশে আসে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ওকে একবারও সুরিরচালা বা ধানগড়ার কথা বলতে শুনিনি। এই তো কয়েক মাস হলো সেলিনা খান শুশুর ছেলের বৌ-ভাত হলো। কতজনকে দাওয়াত করল, কতজনকে হলুদের জন্য শাড়ি দিল কিন্তু একবারও ধানগড়ার নাজিরদের কথা, সিরাজদের কথা, হামিদদের কথা মুখে আনল না। প্রায় একনাগাড়ে ওরা ৪ মাস সুরিরচালায় ছিল। সেখানকার কথা এখন হয়তো ওদের মনেই হয় না। ঠিক আছে, ওরা না হয় দেশে থাকে না। আজাদ, মুরাদ, বাবুল ওরা তো থাকে। সবাই বড় হয়েছে। ওরা তো কেউ কোনোদিন আশ্রয়দাতাদের কথা সম্মানের সঙ্গে মনে করে না। যেমনটা আজকাল দেশের বিত্তবানরা, নেতা-অভিনেতারা, যারা দেশ বানিয়েছে সেই দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বিন্দুবিসর্গও মনে করে না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় হয়েছে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিড়ম্বনার এক কারখানা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কিছু কিছু লোকের আখের গোছানোর একটা সুযোগ। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট মর্জিমত নিজের কল্যাণ নিয়েই ব্যস্ত। এই রকম অবস্থায় কোনো জাতি কখনও এগুতে পারে না। আর কৃতজ্ঞতাবোধহীন কেউ তো মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। মনে হয় তাই আজ আমাদের মাঝে এমন চরম অশান্তি। বুঝতে পারছি স্মৃতিময় ধানগড়া থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছি। ইচ্ছে ছিল ঐদিনই দূরে কোথাও চলে যাব। কারণ পাকিস্তান হানাদাররা হন্যে হয়ে খুঁজছিল আমাকে, পুরস্কার ঘোষণা করেছিল লক্ষ টাকা। আমি ধানগড়ায় আছি সে খবর পৌঁছলে আর্মিরা সেদিকে আসতে পারে, তাই থাকতে চাইনি। কিন্তু ছোট ভাই-বোনদের পীড়াপীড়িতে ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ আমাকে ধানগড়াতেই থাকতে হলো। ওই গ্রামের কে যেন একটা থ্রি-ব্র্যান্ডের রেডিও-কাম টেপরেকর্ডার এনেছিল। হিতাচী টেপরেকর্ডার। সেই ছেলেবেলা থেকে গানের পোকা ছিলাম। লোকটি টেপরেকর্ডার বিক্রি করবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক’টাকা হলে বেচবে?’ ‘৭০০ টাকা।’ বললাম, ‘৬০০ টাকায় দেবে?’ প্রথম প্রথম রাজি হলো না। বিকালে ৬২৫ টাকায় টেপটি আমাকে দিয়ে গেল। হয়তো ওই টাকায় বেচতো না কিন্তু ক্যাসেট কভারটি ভাঙা থাকায় দেখতে ভালো ছিল না। খুঁত ছিল বলেই হয়তো সেটি আমার কাছে বেচেছিল। থ্রি-ব্র্যান্ডে রেডিওসহ ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা, ৭-৮ ইঞ্চি উঁচু হিতাচী টেপরেকর্ডার ঢাকাতে ৭০০-৮০০ টাকাতেই পাওয়া যেত। আর তখনকার সময়ে ৭০০-৮০০ টাকায় গ্রামগঞ্জের দুই পাখি জমি কেনা যেত। যা এখন কম করেও ১৪-১৫ লাখ টাকা। সে যাক, অর্থনীতি বদলে গেছে। আয়-ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। কবে আবার বিশ্বময় অর্থনীতির একটা স্থিতিশীলতা আসবে বলা যায় না। টাঙ্গাইল সংগ্রাম পরিষদের দেয়া হাজার তিনেক টাকা তখনও আমার কাছে ছিল। যত চেষ্টাই করি দু’জনে সারাদিনে ২-৩ টাকার বেশি খরচ করার উপায় ছিল না। তাই ধানগড়া গিয়েই মা’কে এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ১০০ টাকার নোটগুলো ছোট করে নিও। কারণ পাকিস্তান সরকার বড় টাকা বাতিল করে দিতে পারে। এমনিতেই মা’র রান্না ছিল অমৃত। মা মা’ই, মা’র কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমি মা’কে হারিয়ে বড় কষ্টে আছি। সেই খাবার আর পাই না, জীবনে কোনোদিন আর পাবও না। অনেক কিছু না পাওয়া মানুষ আমি, তারপরও আমার কাছে মা’র রান্না খাবার ছিল দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। দুপুরে এবং রাতে বড় ভালো করে তৃপ্তিসহকারে খেয়েছিলাম। গরিব বাড়ি হলেও খাওয়ার আয়োজনে কোনো কমতি ছিল না। ৫-৬ টাকার বাজার করলে ৫০ জন খাওয়া যেত। রাতের খাবার খেয়ে অনেক গল্পগুজব করে পাশের মোস্তফা কামালের ঘরে শুতে গিয়েছিলাম। মোস্তফা কামাল আমায় নানা বলে ডাকে। ওর সে সময় জন্ম হয়েছিল কিনা জানি না। এখন সৌদি আরবে থাকে। একজন স্বভাব কবি। কিন্তু ’৭১-এর ১৮ এপ্রিলের রাত ওদের ঘরে কাটাতে পারিনি। ১২ কিংবা ১টার দিকে কয়েকজন এসে হাজির। ব্যাপার কি? কালিহাতী মুক্তিবাহিনী এসেছে। তাই লতিফ ভাই উপলদিয়ার ফজলু, রতনপুরের ফারুক আর পাকুটিয়ার মংলাকে আমার খোঁজে পাঠিয়েছেন। আর থাকি কী করে? প্রায় ১৫ দিন বড় ভাইকে তীর্থের কাকের মতো খুঁজছি। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো তিনি এসে গেছেন। ওর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য তখন আর কী হতে পারে। তখনই ছুটলাম কালিহাতী। ধানগড়া থেকে কালিহাতী ৮ মাইল। রাস্তাঘাট ভালো না। তাই পথ ফুরাতে চায় না। কামার্তিতে আসতে আসতেই ফজরের আজান হয়ে গেল। সাইদুরদের বাড়ি উঠলাম। সাইদুর এবং তার ছোট ভাই সাত্তার বাড়ি ছিল না। ওরা আগেই কালিহাতী চলে গেছে। কারণ তখন আমাদের সবার নেতাই লতিফ সিদ্দিকী। লাল মিয়ার খোঁজ করলাম। সেও নেই। সাইদুর আর আমি করটিয়া কলেজে একসঙ্গে পড়তাম। ছাত্র রাজনীতিও করতাম একসঙ্গে। আমাদের সময় আমাদের বন্ধু-বান্ধবের মা-বাবারা নিজের মা-বাবার মতোই আচরণ করতেন। সাইদুর না থাকলেও ওর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই ছুটে এলো। হাত-মুখ ধোয়ার পানি দিল। আমরা ছিলাম ৪ জন। খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি দিল। তৃপ্তিসহকারে খেয়ে এলাম কালিহাতীতে। তখন ছয়-সাড়ে ছয়টা বাজে। ৭টার দিকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হলো। দেখলাম ৩ এপ্রিল সাটিয়াচরা, নাটিয়াপাড়া থেকে যে ইপিআররা পিছিয়ে এসেছিল ওটা তাদেরই একটা অংশ। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন