অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার
সৈয়দ আশরাফ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গত ২০ জুন বলেছেন, বিএনপির কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আদালতের আশ্রয় নেয়া উচিত। গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। কথাটা অতি পুরনো। দেশের সব অঞ্চলের মানুষই এই প্রবাদটি সম্পর্কে ধারণা রাখেন। আদালতের আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়ার কারণেই আমার ভীষণ ইচ্ছা হলো এ বিষয়ে দু’চার কথা লিখতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্বসূরি এবং সরকার নিজে রাজনৈতিক সরকারকে যখন তখন আদালতে যাওয়ার মন্ত্র বা কৌশল শিখিয়েছেন বলে আমার মনে হয়। কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করে, তা আদালতের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টাটাই যে একটা অপচেষ্টা, এরই মধ্যে তা বেশ প্রমাণিত। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
শেখ মুজিব হত্যা মামলার আসামিদের ইমিউনিটি দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার করা যাবে না। সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে ওই সংশোধনটি, যেটি সংবিধানের মৌলিক চরিত্র হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তা বাতিল করা হলো। সংবিধান মতে, সংবিধানের মূল বা মৌলিক চরিত্রকে ঝরসঢ়ষব গধলড়ত্রঃু দিয়ে সংশোধন করা যায় না। কিন্তু আদালতে যাওয়ার পর দেখা গেল এবং আদালত বলেছিলেন, ঝরসঢ়ষব গধলড়ত্রঃু দ্বারা সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি যা ওই আইনে জবঢ়বধষ করা হলো, আদালতের আদেশে তাকে সঠিক বলে রায় দিলেন। অথচ সবাই জানেন, সংবিধানের মূল চরিত্র অনংড়ষঁঃব গধলড়ত্রঃু ব্যতিরেকে সংশোধন করা যায় না। অথচ করা হলো তাই। ওই রায়ের পর শেখ মুজিব হত্যার এজাহার দায়ের হয় ২৫ বছর পর। বিচার সম্পন্ন করা হয়। অনেকের ফাঁসির আদেশ হয়। কেউ কেউ পলাতক। কারও কারও ফাঁসি এরই মধ্যে কার্যকরও হয়ে গেছে। একটি অধ্যায়ের শেষ হলো আদালতের মাধ্যমে। তবে এটা ঠিক, হত্যা কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় আসা বিবেকবানদের কাছে বা আইনের দৃষ্টিতে কাম্য নয়। হত্যার বিচার আইনের মাধ্যমে হয়, রাজনীতি দ্বারা নয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো অপরাধের আইনে বিচার না হয়ে রাজনীতি দ্বারা তার বিচার করার চেষ্টা চলছে। মনে রাখা দরকার, আইনের বিকল্প আইন, অন্য কিছু নয়। যাহোক, আদালতের মাধ্যমেই একটি ইস্যুর সমাধান আবারও ঘটল। তাই বলছিলাম, রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি, আইন নয়।
একটি সিনেমা হলের মালিকানার জটিলতা নিরসনের জন্য কোনো এক ব্যক্তিকে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। ওই মামলার আদেশ হলো জিয়াউর রহমানের শাসনকাল অবৈধ। শুনেছি গরুকে নদীতে ফেলে রচনা লিখেছিলেন কোনো এক ছাত্র তার পরীক্ষার খাতায়। ওই ছাত্র যদি জীবিত থেকে থাকেন, আর এই ঘটনা প্রবাহ অবলোকন করে থাকেন, তাহলে হয়তো নিজেকে আগে যদি লজ্জিত মনে করে থাকেনও, এখন নিঃসন্দেহে গর্ববোধ করছেন তিনি। যা হোক আদালতের মাধ্যমে আবারও একটি রাজনৈতিক ইস্যুর সমাপ্তি ঘটল।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেব তার শাসনকালে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালতের সার্কিট বেঞ্চ বসার পরিবর্তে ঢাকার বাইরে উচ্চ আদালত স্থাপন করা হবে এবং এরশাদ সেটা করেছিলেন। এরশাদের মতে, জনগণ নাকি তার সুফল পাচ্ছিল। এরশাদের আমলে উপজেলা সৃষ্টি করে অধস্তন বিচার ব্যবস্থাকেও উপজেলায় স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু ভালো-মন্দ বিচার না করেই এবং জনগণের মতামতের কোনো রকম ধার না ধেরেই উচ্চ আদালত ঢাকার বাইরে স্থানান্তর ও উপজেলার বিচার ব্যবস্থা উপজেলায় স্থানান্তর সংবিধানের মূল চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় তা কেন্দ্রে অর্থাত্ ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো। তবে উপজেলা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেনি। বিলুপ্ত হয়েছে উপজেলার বিচার ব্যবস্থা।
উপজেলার নাম দিয়ে জেলা শহরে এখন সেই বিচার ব্যবস্থা চলছে। যাহোক আদালতের মাধ্যমে উচ্চ আদালত ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। চলে এলো উপজেলার বিচার ব্যবস্থা জেলা শহরে। আদালতের মাধ্যমেই কেন্দ্রের বাইরে আদালত স্থানান্তরের বিষয়টির সমাধান হলো। আবারও একটি রাজনৈতিক ইস্যু আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলো।
১/১১-এর অবৈধ সরকার যখন ক্ষমতায় আরোহণ করলেন, তখন তারা নিত্যনতুন কথা বলতেন। হঠাত্ একদিন বলে ফেললেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। একটি দালাল গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলল উভয় দলেই। পরে যদিও ওই গোষ্ঠীর প্রায় সবাই আবার মূল ধারায় মিশে গেছেন। যা হোক, বিএনপির একটি গোষ্ঠী নিজেরা বিএনপির মূলধারা হিসেবে দাবি করে ফেলল। বিষয়টির সৃষ্টি হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের সংলাপকে কেন্দ্র করে। শেষ পর্যন্ত সংলাপে নির্বাচন কমিশন কাকে ডাকবেন তা সুরাহার জন্য বিষয়টি নিয়ে যাওয়া হলো আদালতের দোরগোড়ায়। সিদ্ধান্ত হলো ১/১১-এর তৈরি অংশই বৈধ অংশ। এমনকি ওই অংশের অতি প্রবীণ নেতা তার ভুল বুঝতে পেরে, আদালতে হলফনামা সম্পাদন করে পিছুটান দেয়া সত্ত্বেও আদালত রায় দিলেন তাদের পক্ষে, যারা বিএনপির কেউই নন। বেগম খালেদা জিয়ার নিয়োগ দেয়া মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে ডাকলেন না সংলাপে। বিএনপির সংবিধানে এবং কাউন্সিলে প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই বেগম খালেদা জিয়া খোন্দকার দেলোয়ারকে মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে সেই আদালতই আর একটি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিলেন!
বেগম খালেদা জিয়ার স্বামী শহীদ জিয়া দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। দুই নাবালক পুত্রসন্তানসহ তিনি দারুণ অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলেন। শহীদ জিয়ার দেশ ও মানুষের প্রতি অবদানের কথা বিবেচনায় রাষ্ট্র বেগম খালেদা জিয়াকে দুই এতিম ও নাবালক সন্তান নিয়ে বসবাসের জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের যে বাসায় তিনি বসবাস করতেন, সেই বাড়িটির মালিকানা দলিলমূলে হস্তান্তর করে। দীর্ঘ ৪০ বছর সময়কাল সন্তানদের নিয়ে তিনি বাসবাস করলেন ওই বাসায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়াকে ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নোটিশ প্রদান করল। বেগম জিয়া অতি আইন মান্যকারী নাগরিকের মতো আদালতের আশ্রয় নিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়াকে ৪০ বছর যে বাড়িতে বসবাস করলেন, সেই বাড়ি থেকে তাদের মতে আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ করা হলো। শুনেছি মানুষ অবৈধভাবেও যদি কোনো স্থানে একটি যুক্তিসঙ্গত সময়কাল বসবাস করেন, তাহলে তার একটা অধিকার জন্মায়। অথচ বেগম খালেদা জিয়া ৪০ বছর বৈধভাবে মালিক হয়ে বসবাস করার পরও তার কোনো বৈধ অধিকার জন্মাল না। আরও একটি অধ্যায় আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি ঘটল!
কোনো একটি বিষয়ে মামলা হলো। আদালত রায় দিলেন যে, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা থাকা ঠিক নয়। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও দুটি জাতীয় সাধারণ নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। কারণ হিসেবে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ এখনও দেশে তৈরি হয়নি। এটাকে সরকার লুফে নিল। সংসদে বিল এনে আদালতের রায়ের কথা বলে সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার আইনটি সংশোধনের দ্বারা বাতিল করে দিল। পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশ পায়নি। তা সত্ত্বেও কেয়ারটেকার সরকারের আইনটি বাতিল হয়ে গেল। আদালত দেশের আর একটা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এভাবে দিলেন। প্রশ্ন হলো, সমস্যার কি সমাধান হলো, না সমস্যা বেড়ে গেল? যা হোক জনাব আশরাফ বললেন, বিএনপি যদি আইন মানে তাহলে কেয়ারটেকার সরকারের দাবি নিয়ে আদালতে যেতে পারে। এখন সব বিবেকবান মানুষ নিজ নিজ বিবেকের কাছে যদি প্রশ্ন করেন যে, কেয়ারটেকার সরকারের দাবি নিয়ে বিএনপি আদালতে গেলে ফলাফল কী হতে পারে? নিশ্চয়ই আপনারা উত্তর পেয়ে যাবেন।
আশরাফ সাহেব হঠাত্ বিএনপিকে পরামর্শ দিতে আরম্ভ করলেন কেন তা বুঝতে পারলাম না। বিএনপির প্রতি তাদের এমন কী ঋণ আছে জানি না। হয়তো কিছু একটা ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে ঋণী থাকতে পারে। আর তা হয়তো, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব মৃত্যুর আগে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশালের জন্ম দিয়েছিলেন। শহীদ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে একদলীয় ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেন, ফলে আওয়ামী লীগ আবার নতুনভাবে বাকশালের গর্ভ থেকে জন্ম নিল। আশরাফ সাহেব হয়তো সে কারণে বিএনপির কাছে তার দলকে ঋণী ভাবছেন। যাক একটা কৃতজ্ঞতা বোধ থাকার জন্য অন্তত ধন্যবাদ দিতে হয় জনাব আশরাফকে। কিন্তু সমস্যা হলো, বিএনপি তো এমন কোনো পরামর্শ আশরাফ সাহেব বা তার দলের কাছে চায়নি? তাহলে তিনি এমন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী সাজলেন কেন বিএনপির? কে যে কখন কার শুভাকাঙ্ক্ষী সাজে তা বোঝা বড় কঠিন হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি অঙ্ক করতে খুবই ভয় পেতাম। অঙ্কের শিক্ষক পড়াতে এলে ভাবতে পারতাম না কী করব। মা এগিয়ে এসে প্রতিদিন বলতেন, বাবা তুমি ড্রামের আড়ালে গিয়ে পালাও। আমি মায়ের কথায় প্রতিদিন ড্রামের কাছে পালাতাম। আর আমার শিক্ষক এসে প্রতিদিন ওখান থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পড়তে বসাতেন। আমি প্রতিদিনই একই জায়গায় পালাতাম। আর একই জায়গা থেকে মাস্টার মশাই আমাকে রোজ ধরে নিয়ে যেতেন। বিষয়টি বুঝতে আমার অনেক বড় হতে হয়েছে। জানি না আশরাফ সাহেব হঠাত্ করে মাস্টার মশাই সেজে আমাদের অঙ্ক শেখাতে ব্যস্ত হলেন কেন? বিএনপির দর্শন সহজ ও সরল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, এটা ঠিক। তবে আপনি সহজ-সরল দেখে যতটা বোকা মনে করেছেন বিএনপিকে, বিএনপি তা কিন্তু নয়। পোড় খেতে খেতে বিএনপির বুদ্ধিতে এখন অনেকটা পাক ধরেছে। বিএনপিকে দয়া করে আপনার ‘আশরাফি দাওয়াখানা’ থেকে বিনে পয়সায় পরামর্শ দেয়া বন্ধ করুন। বিএনপি জানে, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা যেভাবে অর্জিত হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই পুনঃঅর্জন করতে হবে। যেভাবে বাদ দেয়া হয়েছে সে পথে যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন হবে না, তা বিএনপি ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তাই বলছিলাম কি, বিএনপির প্রতি আপনাদের ঋণ শেষ হয়ে গেছে। যদি পারেন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনার নিজের দলকে পরামর্শ দিন যে, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা যেভাবে বিলুপ্ত করেছে, আপনার দলীয় সরকার সেভাবেই যেন পুনর্বহাল করে। আর তাতে আপনার দলই বেশি লাভবান হবে। হয়তো দেশবাসী উপকৃত হবে, দেশ রক্ষা পাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির হাত থেকে। মনে রাখবেন, কোনো স্বৈরাচারই জনগণকে উপেক্ষা করে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। আপনারাও পারবেন না। যত তাড়াতাড়ি শুভবুদ্ধির উদয় হয়, ততই মঙ্গল। কোনো রাজনৈতিক ইস্যু আদালতে নিয়ে তা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করলে আদালতের নিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এরূপ চেষ্টা অপচেষ্টার রূপ ধারণের আগেই তা বাদ দিতে পারা উত্তম। যদিও এরই মধ্যে অনেক দূর চলে গেছেন, তবে ফিরে আসা ভালো। রাজনৈতিক ইস্যু আদালতে বারবার নিয়ে গেলে তার দ্বারা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই বারবার ফুটে ওঠে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থারই অপর নাম। একথা ভুলে না যাওয়াই কাম্য। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে বিব্রত না করাই সভ্যতা। আর বিচার বিভাগকে যদি কোনো দল মনে করে নিজেদের, তা বোধকরি আর বেশিদিন চলবে না। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কিন্তু অনেক ঐতিহ্য আছে, এ কথাটি ভুললেও চলবে না।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্বসূরি এবং সরকার নিজে রাজনৈতিক সরকারকে যখন তখন আদালতে যাওয়ার মন্ত্র বা কৌশল শিখিয়েছেন বলে আমার মনে হয়। কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করে, তা আদালতের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টাটাই যে একটা অপচেষ্টা, এরই মধ্যে তা বেশ প্রমাণিত। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
শেখ মুজিব হত্যা মামলার আসামিদের ইমিউনিটি দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার করা যাবে না। সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে ওই সংশোধনটি, যেটি সংবিধানের মৌলিক চরিত্র হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তা বাতিল করা হলো। সংবিধান মতে, সংবিধানের মূল বা মৌলিক চরিত্রকে ঝরসঢ়ষব গধলড়ত্রঃু দিয়ে সংশোধন করা যায় না। কিন্তু আদালতে যাওয়ার পর দেখা গেল এবং আদালত বলেছিলেন, ঝরসঢ়ষব গধলড়ত্রঃু দ্বারা সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি যা ওই আইনে জবঢ়বধষ করা হলো, আদালতের আদেশে তাকে সঠিক বলে রায় দিলেন। অথচ সবাই জানেন, সংবিধানের মূল চরিত্র অনংড়ষঁঃব গধলড়ত্রঃু ব্যতিরেকে সংশোধন করা যায় না। অথচ করা হলো তাই। ওই রায়ের পর শেখ মুজিব হত্যার এজাহার দায়ের হয় ২৫ বছর পর। বিচার সম্পন্ন করা হয়। অনেকের ফাঁসির আদেশ হয়। কেউ কেউ পলাতক। কারও কারও ফাঁসি এরই মধ্যে কার্যকরও হয়ে গেছে। একটি অধ্যায়ের শেষ হলো আদালতের মাধ্যমে। তবে এটা ঠিক, হত্যা কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় আসা বিবেকবানদের কাছে বা আইনের দৃষ্টিতে কাম্য নয়। হত্যার বিচার আইনের মাধ্যমে হয়, রাজনীতি দ্বারা নয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো অপরাধের আইনে বিচার না হয়ে রাজনীতি দ্বারা তার বিচার করার চেষ্টা চলছে। মনে রাখা দরকার, আইনের বিকল্প আইন, অন্য কিছু নয়। যাহোক, আদালতের মাধ্যমেই একটি ইস্যুর সমাধান আবারও ঘটল। তাই বলছিলাম, রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি, আইন নয়।
একটি সিনেমা হলের মালিকানার জটিলতা নিরসনের জন্য কোনো এক ব্যক্তিকে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। ওই মামলার আদেশ হলো জিয়াউর রহমানের শাসনকাল অবৈধ। শুনেছি গরুকে নদীতে ফেলে রচনা লিখেছিলেন কোনো এক ছাত্র তার পরীক্ষার খাতায়। ওই ছাত্র যদি জীবিত থেকে থাকেন, আর এই ঘটনা প্রবাহ অবলোকন করে থাকেন, তাহলে হয়তো নিজেকে আগে যদি লজ্জিত মনে করে থাকেনও, এখন নিঃসন্দেহে গর্ববোধ করছেন তিনি। যা হোক আদালতের মাধ্যমে আবারও একটি রাজনৈতিক ইস্যুর সমাপ্তি ঘটল।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেব তার শাসনকালে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালতের সার্কিট বেঞ্চ বসার পরিবর্তে ঢাকার বাইরে উচ্চ আদালত স্থাপন করা হবে এবং এরশাদ সেটা করেছিলেন। এরশাদের মতে, জনগণ নাকি তার সুফল পাচ্ছিল। এরশাদের আমলে উপজেলা সৃষ্টি করে অধস্তন বিচার ব্যবস্থাকেও উপজেলায় স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু ভালো-মন্দ বিচার না করেই এবং জনগণের মতামতের কোনো রকম ধার না ধেরেই উচ্চ আদালত ঢাকার বাইরে স্থানান্তর ও উপজেলার বিচার ব্যবস্থা উপজেলায় স্থানান্তর সংবিধানের মূল চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় তা কেন্দ্রে অর্থাত্ ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো। তবে উপজেলা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেনি। বিলুপ্ত হয়েছে উপজেলার বিচার ব্যবস্থা।
উপজেলার নাম দিয়ে জেলা শহরে এখন সেই বিচার ব্যবস্থা চলছে। যাহোক আদালতের মাধ্যমে উচ্চ আদালত ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। চলে এলো উপজেলার বিচার ব্যবস্থা জেলা শহরে। আদালতের মাধ্যমেই কেন্দ্রের বাইরে আদালত স্থানান্তরের বিষয়টির সমাধান হলো। আবারও একটি রাজনৈতিক ইস্যু আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলো।
১/১১-এর অবৈধ সরকার যখন ক্ষমতায় আরোহণ করলেন, তখন তারা নিত্যনতুন কথা বলতেন। হঠাত্ একদিন বলে ফেললেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। একটি দালাল গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলল উভয় দলেই। পরে যদিও ওই গোষ্ঠীর প্রায় সবাই আবার মূল ধারায় মিশে গেছেন। যা হোক, বিএনপির একটি গোষ্ঠী নিজেরা বিএনপির মূলধারা হিসেবে দাবি করে ফেলল। বিষয়টির সৃষ্টি হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের সংলাপকে কেন্দ্র করে। শেষ পর্যন্ত সংলাপে নির্বাচন কমিশন কাকে ডাকবেন তা সুরাহার জন্য বিষয়টি নিয়ে যাওয়া হলো আদালতের দোরগোড়ায়। সিদ্ধান্ত হলো ১/১১-এর তৈরি অংশই বৈধ অংশ। এমনকি ওই অংশের অতি প্রবীণ নেতা তার ভুল বুঝতে পেরে, আদালতে হলফনামা সম্পাদন করে পিছুটান দেয়া সত্ত্বেও আদালত রায় দিলেন তাদের পক্ষে, যারা বিএনপির কেউই নন। বেগম খালেদা জিয়ার নিয়োগ দেয়া মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে ডাকলেন না সংলাপে। বিএনপির সংবিধানে এবং কাউন্সিলে প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই বেগম খালেদা জিয়া খোন্দকার দেলোয়ারকে মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে সেই আদালতই আর একটি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিলেন!
বেগম খালেদা জিয়ার স্বামী শহীদ জিয়া দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। দুই নাবালক পুত্রসন্তানসহ তিনি দারুণ অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলেন। শহীদ জিয়ার দেশ ও মানুষের প্রতি অবদানের কথা বিবেচনায় রাষ্ট্র বেগম খালেদা জিয়াকে দুই এতিম ও নাবালক সন্তান নিয়ে বসবাসের জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের যে বাসায় তিনি বসবাস করতেন, সেই বাড়িটির মালিকানা দলিলমূলে হস্তান্তর করে। দীর্ঘ ৪০ বছর সময়কাল সন্তানদের নিয়ে তিনি বাসবাস করলেন ওই বাসায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়াকে ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নোটিশ প্রদান করল। বেগম জিয়া অতি আইন মান্যকারী নাগরিকের মতো আদালতের আশ্রয় নিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়াকে ৪০ বছর যে বাড়িতে বসবাস করলেন, সেই বাড়ি থেকে তাদের মতে আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ করা হলো। শুনেছি মানুষ অবৈধভাবেও যদি কোনো স্থানে একটি যুক্তিসঙ্গত সময়কাল বসবাস করেন, তাহলে তার একটা অধিকার জন্মায়। অথচ বেগম খালেদা জিয়া ৪০ বছর বৈধভাবে মালিক হয়ে বসবাস করার পরও তার কোনো বৈধ অধিকার জন্মাল না। আরও একটি অধ্যায় আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি ঘটল!
কোনো একটি বিষয়ে মামলা হলো। আদালত রায় দিলেন যে, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা থাকা ঠিক নয়। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও দুটি জাতীয় সাধারণ নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। কারণ হিসেবে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ এখনও দেশে তৈরি হয়নি। এটাকে সরকার লুফে নিল। সংসদে বিল এনে আদালতের রায়ের কথা বলে সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার আইনটি সংশোধনের দ্বারা বাতিল করে দিল। পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশ পায়নি। তা সত্ত্বেও কেয়ারটেকার সরকারের আইনটি বাতিল হয়ে গেল। আদালত দেশের আর একটা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এভাবে দিলেন। প্রশ্ন হলো, সমস্যার কি সমাধান হলো, না সমস্যা বেড়ে গেল? যা হোক জনাব আশরাফ বললেন, বিএনপি যদি আইন মানে তাহলে কেয়ারটেকার সরকারের দাবি নিয়ে আদালতে যেতে পারে। এখন সব বিবেকবান মানুষ নিজ নিজ বিবেকের কাছে যদি প্রশ্ন করেন যে, কেয়ারটেকার সরকারের দাবি নিয়ে বিএনপি আদালতে গেলে ফলাফল কী হতে পারে? নিশ্চয়ই আপনারা উত্তর পেয়ে যাবেন।
আশরাফ সাহেব হঠাত্ বিএনপিকে পরামর্শ দিতে আরম্ভ করলেন কেন তা বুঝতে পারলাম না। বিএনপির প্রতি তাদের এমন কী ঋণ আছে জানি না। হয়তো কিছু একটা ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে ঋণী থাকতে পারে। আর তা হয়তো, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব মৃত্যুর আগে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশালের জন্ম দিয়েছিলেন। শহীদ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে একদলীয় ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেন, ফলে আওয়ামী লীগ আবার নতুনভাবে বাকশালের গর্ভ থেকে জন্ম নিল। আশরাফ সাহেব হয়তো সে কারণে বিএনপির কাছে তার দলকে ঋণী ভাবছেন। যাক একটা কৃতজ্ঞতা বোধ থাকার জন্য অন্তত ধন্যবাদ দিতে হয় জনাব আশরাফকে। কিন্তু সমস্যা হলো, বিএনপি তো এমন কোনো পরামর্শ আশরাফ সাহেব বা তার দলের কাছে চায়নি? তাহলে তিনি এমন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী সাজলেন কেন বিএনপির? কে যে কখন কার শুভাকাঙ্ক্ষী সাজে তা বোঝা বড় কঠিন হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি অঙ্ক করতে খুবই ভয় পেতাম। অঙ্কের শিক্ষক পড়াতে এলে ভাবতে পারতাম না কী করব। মা এগিয়ে এসে প্রতিদিন বলতেন, বাবা তুমি ড্রামের আড়ালে গিয়ে পালাও। আমি মায়ের কথায় প্রতিদিন ড্রামের কাছে পালাতাম। আর আমার শিক্ষক এসে প্রতিদিন ওখান থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পড়তে বসাতেন। আমি প্রতিদিনই একই জায়গায় পালাতাম। আর একই জায়গা থেকে মাস্টার মশাই আমাকে রোজ ধরে নিয়ে যেতেন। বিষয়টি বুঝতে আমার অনেক বড় হতে হয়েছে। জানি না আশরাফ সাহেব হঠাত্ করে মাস্টার মশাই সেজে আমাদের অঙ্ক শেখাতে ব্যস্ত হলেন কেন? বিএনপির দর্শন সহজ ও সরল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, এটা ঠিক। তবে আপনি সহজ-সরল দেখে যতটা বোকা মনে করেছেন বিএনপিকে, বিএনপি তা কিন্তু নয়। পোড় খেতে খেতে বিএনপির বুদ্ধিতে এখন অনেকটা পাক ধরেছে। বিএনপিকে দয়া করে আপনার ‘আশরাফি দাওয়াখানা’ থেকে বিনে পয়সায় পরামর্শ দেয়া বন্ধ করুন। বিএনপি জানে, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা যেভাবে অর্জিত হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই পুনঃঅর্জন করতে হবে। যেভাবে বাদ দেয়া হয়েছে সে পথে যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন হবে না, তা বিএনপি ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তাই বলছিলাম কি, বিএনপির প্রতি আপনাদের ঋণ শেষ হয়ে গেছে। যদি পারেন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনার নিজের দলকে পরামর্শ দিন যে, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা যেভাবে বিলুপ্ত করেছে, আপনার দলীয় সরকার সেভাবেই যেন পুনর্বহাল করে। আর তাতে আপনার দলই বেশি লাভবান হবে। হয়তো দেশবাসী উপকৃত হবে, দেশ রক্ষা পাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির হাত থেকে। মনে রাখবেন, কোনো স্বৈরাচারই জনগণকে উপেক্ষা করে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। আপনারাও পারবেন না। যত তাড়াতাড়ি শুভবুদ্ধির উদয় হয়, ততই মঙ্গল। কোনো রাজনৈতিক ইস্যু আদালতে নিয়ে তা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করলে আদালতের নিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এরূপ চেষ্টা অপচেষ্টার রূপ ধারণের আগেই তা বাদ দিতে পারা উত্তম। যদিও এরই মধ্যে অনেক দূর চলে গেছেন, তবে ফিরে আসা ভালো। রাজনৈতিক ইস্যু আদালতে বারবার নিয়ে গেলে তার দ্বারা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই বারবার ফুটে ওঠে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থারই অপর নাম। একথা ভুলে না যাওয়াই কাম্য। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে বিব্রত না করাই সভ্যতা। আর বিচার বিভাগকে যদি কোনো দল মনে করে নিজেদের, তা বোধকরি আর বেশিদিন চলবে না। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কিন্তু অনেক ঐতিহ্য আছে, এ কথাটি ভুললেও চলবে না।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন