শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

জনপ্রশাসনকে ভুল বার্তা দেবে

আলী ইমাম মজুমদার 


প্রশাসনকে বিরাজনীতিকীকরণের অঙ্গীকার আমাদের প্রধান দলগুলো করে থাকে। আর ক্ষমতায় এসে করে তার উল্টোটি। মহাজোট সরকারও এর ব্যতিক্রম করেনি। তবু তাদের কিছু কাজে শুরুতে আশান্বিত হয়েছিল অনেকে। গণহারে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া থেকে তারা বিরত রয়েছে। প্রায় দুই বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পাদনে প্রতিবন্ধকতা অপসারণের উদ্দেশ্যে সিভিল সার্ভিস আইন ২০১১-এর একটি খসড়াও ওয়েবসাইটে এসেছিল। কিছু অপূর্ণতা সত্ত্বেও কিছু ভালো বিধান এতে ছিল। যেমন বিনা কারণে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার সুযোগ বন্ধ, যুগ্ম সচিব পর্যায় পর্যন্ত সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে পদোন্নতি ইত্যাদি প্রশাসন দলীয়করণের সুযোগ কমাতে পারত। সুধীজন বেশ কিছু সংশোধন বা সংযোজনের প্রস্তাব রাখে। এখন মনে হচ্ছে, গোটা বিষয় হিমাগারে পাঠিয়ে আইনটির খসড়া তৈরি হয়েছে। 
বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে এ খসড়ার বিধানগুলো। সরকার এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। তাই ধরে নিতে হয় খসড়াটি বিবেচনায় রয়েছে। এতেও অবশ্য সিভিল সার্ভিস আইনের মতোই বিনা কারণে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। তবে সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে যুগ্ম সচিব পর্যায় পর্যন্ত পদোন্নতির বিধানটি নেই। তাই নিশ্চিতভাবেই এটা পশ্চাৎমুখী। 
নতুন খসড়ার একটি বিধান খবরের কাগজ আর জনপ্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। খবরের কাগজের ভাষ্য অনুযায়ী, সে বিধানটি হচ্ছে, ‘সরকার প্রয়োজন মনে করিলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রেণী, প্রকৃতি বা কর্মের সেবা সম্পূর্ণ বা আংশিক লইতে পারিবে...।’ উল্লেখ্য, বিবেচ্য আইনে সরকারি কর্মচারীর সংজ্ঞার পরিসর অনেক বৃহৎ। তদুপরি এতদবিষয়ক অন্য যেকোনো আইনের চেয়ে এই আইন প্রাধান্য পাবে বলে খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। একুশ শতকের বিশ্বে সরকারি কাজে কিছু কিছু আউটসোর্সিং ধারণা নতুন নয়। তবে আশঙ্কা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে যে আইন করে এ ধরনের বিধান করলে এর রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে অপব্যবহার হতে পারে। পদোন্নতির অপেক্ষমাণ যোগ্য ব্যক্তি থাকতে সচিবালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর—যেকোনো স্তরে ‘আউটসোর্সিংয়ের বাঁকা পথে উঁচু পদে বসে পড়তে পারেন। গত ১০ জুনের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর প্রধান শিরোনামাধীন সংবাদটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ এবং ওপরে বর্ণিত আশঙ্কাকে দৃঢ় করে। এতে বলা হয়েছে, প্রশাসনকে গতিশীল ও দক্ষ করতে সচিবের কিছুসংখ্যক পদে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হবে। খবরটিতে একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল প্রবীণ মন্ত্রীর উদ্ধৃতিও দেওয়া হয়েছে। 
উল্লেখ করা আবশ্যক, এমনিতেই রাষ্ট্রপতির কোটায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান রয়েছে। এ ধরনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত বেশ কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন সরকারি পদে আছেন। সচিব পদে এভাবে কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেওয়া চলে। অতীতেও তা হয়েছে। তবে তাঁরা খুব কমই সফল হয়েছেন। আবার নিজ কর্মক্ষেত্রেও অত্যন্ত সফল এবং জনগণের কাছে নন্দিত কোনো কোনো ব্যক্তিও সচিব পদে এসে সফল হননি। নিয়োগকারী সরকারই ফেরত পাঠিয়েছে। সচিব পদটা মূলত বিশেষজ্ঞের নয়। সচিব তাঁর কাজে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন। সে পরামর্শ অনুযায়ী কোনো প্রকল্প প্রস্তাব অথবা আইন বা বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সচিবকে আরও অনেকগুলো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দ্বারস্থ হতে হবে কার্যপ্রণালি বিধিমালা (রুলস অব বিজনেস) অনুসারে। সুতরাং, সরকার কীভাবে পরিচালিত হয় এর ওপর ব্যাপক ধারণা থাকা একজন সচিব হওয়ার পূর্বশর্তই বটে। তা ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে মূল ভূমিকায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সচিবের ব্যক্তিগত সম্পর্ক সে কাজটি সম্পাদনে অত্যন্ত সহায়ক হয়। সচিব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টিং অফিসার। নিজ কার্যালয় ছাড়াও তাঁর অধীনে সংস্থা, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, করপোরেশন ইত্যাদির বরাবরে বরাদ্দ করা অর্থ বিধিবিধান অনুসরণে ব্যয়ের নিশ্চয়তার দায়িত্বও সচিবের। জাতীয় সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতেও জবাবদিহি তাঁরই। তাই আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়েও সচিবের ব্যাপক ধারণা থাকা আবশ্যক। প্রশাসনসহ অন্য সব ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতির পর সচিব হওয়ার পথে যাত্রা শুরু। নানা ঘাট পেরিয়ে গুটি কয়েকের ভাগ্যেই এটা জোটে। সেসব ঘাটের অভিজ্ঞতা আর পারস্পরিক চেনাজানার মাধ্যমে সচিব পদে নিয়োজিত ব্যক্তি সম্পাদন করা তাঁর দায়িত্ব। কেউ কেউ রাষ্ট্রপতির কোটায় সরাসরি সচিব হচ্ছেন বটে। তবে দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত তাঁরা প্রায়ই নিষপ্রভ থেকে যান।
সরকারের কাজে গতি আনার জন্য কোনো কোনো পদে বিশেষজ্ঞ নিয়োগের যে প্রয়াস, তা অনেকটাই অতীতে যাঁরা কাজ করেছেন বা বর্তমানে করছেন, তাঁদের দক্ষতার প্রতি অনেকটা আস্থাহীনতাই বটে। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, গত ৪০ বছরে এ দেশের যে অর্জন, তাতে সরকারি কর্মচারীদেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে, তেমনি যা কিছু ব্যর্থতা তার অংশীদারও তাঁরাই। 
নিয়োগে মেধা আর বদলি পদোন্নতি ও পদায়নে নির্মোহভাবে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে দলীয়করণের বলয় থেকে জনপ্রশাসনকে বের করতে পারলে সরকারের কাজে আরও গতি আসবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। আউটসোর্সিং করে খুঁটিনাটি ভার লাঘব করা যায়—তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দক্ষতা কতটা বৃদ্ধি পাবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি পদে চুক্তি ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে ফলাফল দেখা যেতে পারে। আউটসোর্সিংয়ের আইনি বিধান এখনই আবশ্যক বলে মনে হচ্ছে না। বরং এ সুযোগটির অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের আইন প্রণয়নের বার্তা জনপ্রশাসনের বিশাল অংশ ভালোভাবে নেওয়ার কথা নয়। সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ দিকে এসে কেন এ ভুল বার্তা?
 আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন