বদিউর রহমান
২ জুলাই সোমবার জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেয়া এক বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দাবি করেছেন যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতি হয়নি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল করে বিশ্বব্যাংকের দেয়া বিবৃতিতে বাংলাদেশকে অপমান করা হয়েছে মর্মেও তার দাবি। তিনি যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে অপবাদ দিয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই। উপরন্তু, বিশ্বব্যাংক যেভাবে চুক্তিটি বাতিল করেছে তা যথাযথ হয়নি মর্মেও অর্থমন্ত্রীর দাবি। অর্থমন্ত্রীর বিবৃতির উল্লেখিত তিনটা দাবির মধ্যে চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া যথাযথ না হওয়া বা দুর্নীতির অপবাদের ভিত্তি না থাকা গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলেও অতীব স্পর্শকাতর এবং মারাত্মকভাবে বিবেচ্য দাবিটি হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের দেয়া বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে অপমান করা। আমাদের স্মরণে আছে যে, আবুল মাল মুহিত সাহেব নিজেও তখনকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জিয়ার আমলে একজন জাঁদরেল সচিব ছিলেন। প্যারিস কনসোর্টিয়াম বৈঠক থেকে শুরু করে সকল ফোরামে তার দক্ষতা তখন স্বীকার্য ছিল। বেশি পরিমাণে ঋণ বা অনুদান আনার কলাকৌশল যে ইআরডি সচিবের বড় যোগ্যতা তা তার ছিল বলেই আমরা জানি। শুধু ইআরডি সচিব হিসেবেই নয়, পরবর্তীতে স্বৈরাচার খ্যাত সামরিক শাসক এরশাদের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি ইআরডি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাহলে আমরা কি বলতে পারি না যে, পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগে যে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে তা তিনি অতীত অভিজ্ঞতায় সঠিকভাবে মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছেন? তিনি কি বিশ্বব্যাংক এবং আই এমএফ’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানেন না? বিশ্বব্যাংক যে তাদের দেয়া অর্থের অপচয়ে এবং দুর্নীতিতে কঠিন হয় তাও তিনি জানেন। বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নিয়েও তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে বলেই আমরা জানি। অতএব চুক্তি বাতিল যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় না হয়ে থাকে তিনি সরকারের পক্ষে তা বিশ্বব্যাংকের বিবেচনার জন্য অবশ্যই তুলে ধরবেন। কিন্তু দুর্নীতির যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই তা তিনি কিভাবে নিশ্চিত করতে পারেন? দুদক এবং তার কথার মধ্যে সব সময়ে আমরা মিল খুঁজে পাই না। আবার দুদক এবং বিশ্বব্যাংকের কথার মধ্যেও আমরা যেন কখনো কখনো বেমিলের সুর পেয়ে থাকি। পদ্মা সেতুর কাজ নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়ে থাকলে তা অবশ্যই বের করা উচিত, এবং তা বের করতে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের সাথে একাত্ম হতে কী অসুবিধে ছিল?
প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ্বব্যাংককে তদন্তের সাথে জড়িত করলে আমাদের দুদকের কিংবা সরকারের সম্মান কমে যেতে পারে। একটা স্বাধীন দেশ এভাবে নিজের সম্মান সামান্য (?) একটা ঋণের জন্য বিকিয়ে দিতে পারে না। অবশ্যই এটা ন্যায্য প্রশ্ন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আমরা যদি এতই নিশ্চিত হই যে, পরামর্শক নিয়োগের জন্য প্রাক্তন যোগাযোগ মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠান কিংবা মন্ত্রীর বা তার নিজের কেউ কিংবা সেতু বিভাগের সচিব বা প্রকল্প পরিচালক কেউ দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে কোনভাবেই জড়িত নন তাহলে আমরা বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে রাজি হলাম না কেন? আমার মনে যদি ভয় না থাকে এবং আমার যদি টাকার প্রয়োজন হয় তবে তো আমি এমন প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হবো। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো অন্তত তদন্তের এ শর্তে রাজি হলে? বুঝলাম তাতে আমাদের আত্মসম্মানে লাগবে, তাতে দুদকের ওপর আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু এমনিতেই কি আমরা দুদককে নিয়ে খুব একটা আস্থাশীল রয়েছি? গত সাড়ে তিন বছরে দুদক কী এমন ভাবমূর্তি অর্জন করেছে যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নিয়ে আমরা দুদককে ভরসা করতে পারি? সুরঞ্জিতকে দেয়া দুদকের সার্টিফিকেট কী জনমনে প্রশ্ন তোলেনি? খোদ দুদক চেয়ারম্যানের ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রের’ কথাতো মনে আছে।
বড় প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কোন পথে যেতে চেয়েছি। আমরা কি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সুরাহা করায় বেশি মনোযোগী ছিলাম, না বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নিয়ে হরেক রকম বক্তব্য দেয়ায় মেতে উঠেছিলাম; আমরা কি নিজেদের রাজনৈতিক ‘গোঁ’ বহাল রাখার জন্য মন্ত্রিত্ব থেকে তখন আবুলকে সরাতে চাইনি, না প্রকৃতই কোন দুর্বলতা টের পেয়েছিলাম; আমরা কি তখন বিশ্বব্যাংকের ঋণের সত্যিকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম, না সহজভাবে বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তায় বাহবা নেয়ার প্রত্যাশায় ছিলাম। আমি যে ক্ষমতা রাখি না সে ক্ষমতা নিয়ে আগাম বড় কথা বলা আমি পছন্দ করি না। পদ্মা ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কথাবার্তায়, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও সময়ে সময়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের সুরাহার চেয়ে তার প্রতিবাদের মধ্যে বেশি গুরুত্ব লক্ষ্য করা গিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ’র ক্রস-কন্ডিশন এবং অহেতুক ক্ষমতা প্রদর্শন একদমই পছন্দ করি না, অনেক অপমানজনক শর্তও যে থাকে তাতো বলার অপেক্ষাই রাখে না। এ ক্ষেত্রে বড় বিবেচ্য হলো, দাতাদের এসব খবরদারি মেনে নিয়ে দেশ ঋণ নেবে, উন্নয়ন কাজ করবে; নাকি সম্মানবোধ অটুট রেখে নিজ সামর্থ্যে উন্নয়নে এগুবে। সম্মানজনকভাবে সব সময় ‘ভিক্ষা’ পাওয়া যায় না, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক শর্ত মেনে নিয়ে ঋণ নেয়ার সময়ে কি আমরা অপমানিত বোধ করিনি? তা যদি হয় তাহলে দুর্নীতির অভিযোগ এলে, তাতে তদন্তে বিশ্বব্যাংকের টিমও থাকলে অপমানিত হওয়ার কী আছে? আমরা যদি মনে করি যে বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে আমরা পদ্মা সেতু করতে পারবো, অথবা পদ্মা সেতু না হলেও আমরা ‘অপমানিত’ হতে ইচ্ছুক নই, তাহলে বিশ্বব্যাংক বাতিল করার আগে আমাদের অর্থমন্ত্রী কেন ঋণ চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নিলেন না? যে অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে, অনুরূপভাবে বিশ্বব্যাংকের কথিত অযাচিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কেন এ চুক্তি বাতিলের ভূমিকা নিতে পারলো না? অবাক লাগে এমন প্রশ্নে, তাই না? যেহেতু আমরা গরীব, অতএব আমাদের অনেক কিছু মানতে হবে—এই যদি ধারণা হয় তাহলে বিশ্বব্যাংকের শর্ত মানাইতো উত্তম ছিল, নাকি?
এখন সবচে’ বড় প্রশ্ন হলো বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বাংলাদেশকে অপমান করা হয়েছে মর্মে অর্থমন্ত্রীর দাবি যথার্থ কিনা। আচ্ছা, অর্থমন্ত্রী যে শেয়ার বাজারকে দুষ্টু বাজার বলেছেন তাতে কি শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্টদের অপমান করেছেন তিনি? আচ্ছা, অর্থমন্ত্রী যে বাজারে কম যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তখন কি তিনি দেশবাসীকে অপমান করেছিলেন? তিনি যে কথায় কথায় রাবিশ, অল বোগাস বলেন তখন কি তিনি কাউকে অপমান করেন? একটা চুক্তি হলো দ্বিপক্ষীয় বা পক্ষভুক্তদের মধ্যে শর্ত সাপেক্ষ সমঝোতা। কোন পক্ষ তার বিবেচনায় সে সমঝোতা ব্যাহত হচ্ছে ভাবলে চুক্তির শর্ত মোতাবেক সে চুক্তি বাতিল করতেই পারে। অপরপক্ষ যদি মনে করে যে চুক্তি বাতিল করা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যথাযথ হয়নি, তাহলে ওই সংক্ষুব্ধ পক্ষ উপযুক্ত আদালতের আশ্রয়ও নিতে পারে। অর্থমন্ত্রী বা আমাদের সরকার কি তেমন কিছু ভাববেন? ভেতরের শক্তি যদি দুর্বল হয়, আইনত ন্যায্য হলেও দুর্বল যদি বিচার বঞ্চিত হবে ভাবে তবে তো সেভাবেই চলতে হবে, সয়ে যেতে হবে, মেনে নিতে হবে, নচেত্ ছাড় দিয়ে হলেও আপস করতে হবে। অর্থমন্ত্রী এবং সরকার কোনটি করবেন তা তারা ভালো বুঝবেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক অপমান করেছে বলে অর্থমন্ত্রী যে দাবি করেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। কার নিকট কোনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা যার যার বিবেচনা। অর্থমন্ত্রীর যেমন বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিকে অগ্রহণযোগ্য বলার অধিকার রয়েছে, বিশ্বব্যাংকেরও তাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় সরকারের যুক্তি অগ্রহণযোগ্য বলার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বাংলাদেশকে অপমান করা হয়েছে বলার অধিকার অর্থমন্ত্রীর নেই। দেশকে অপমান করা হয়েছে বলে এক্ষেত্রে সস্তা সহানুভূতি পাওয়ার বা সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার কোন প্রচেষ্টা নেয়া মোটেই কাম্য নয়। বিশ্বব্যাংকের সাথে ফয়সালা করতে ব্যর্থ হলে সরকার হয়েছে, দেশ হয়নি। বাংলাদেশকে অপমান করা হয়েছে মর্মে দাবি করে বরং অর্থমন্ত্রীই দেশকে অপমান করেছেন। তার ভাষায় বললে এটাও তার একটা ‘রাবিশ’ বক্তব্য। এমন সস্তা আবেগ-উত্তেজক বক্তব্য থেকে বিরত থাকাই সবচে’ উত্তম, দেশের মান এত হালকা নয়।
n লেখক :সাবেক সচিব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন