বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

এবার লড়াই বিশ্বব্যাংকের সাথে


॥ আলফাজ আনাম ॥


আওয়ামী লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এই শক্তি নিঃসন্দেহে আরো বেড়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় শক্তি সামর্থ্য দক্ষতা যা-ই থাকুক না কেন, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা বা মন্ত্রীদের লড়াকু মানসিকতার কোনো অভাব নেই। ইতোমধ্যে প্রধান বিরোধী দলকে একরকম নাস্তানাবুদ করে ফেলা হয়েছে। প্রথম সারির সব নেতাকে লাল দালানে পাঠিয়ে সরকার বিরোধিতার পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার কাজটিও সম্পন্ন হয়েছে। শক্তিশালী দলের জন্য চাই শক্ত প্রতিপক্ষ। বলতেই হবে আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি একটি দুর্বল দল। এ জন্য দলটি শক্ত প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। সেটি আর কেউ নয়, বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আওয়ামী লীগের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এখন সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। এখন লড়াই শুরু হয়েছে মার্কিন প্রভাবাধীন বিশ্বব্যাংকের সাথে। এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সাবেক চাকুরে ও বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞের দাবিদার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সামনের সারিতে তার পাশে আছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন। তাদের পেছনে বেসরকারি লোকজনও আছে বলে মনে করে লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ বিশ্বব্যাংক। 

যেভাবে তৈরি হয় লড়াইয়ের ক্ষেত্র 
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি করেছিল ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল। বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পরের মাসে ২৮ মে জাইকা ৪১ কোটি ডলার এবং ১ মে আইডিবি ১৪ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর পরের মাসে ৬ জুন এডিবির সাথে ৫৩ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার চুক্তি হয়। এসব চুক্তি স্বাক্ষরের পর ৬ মাস না যেতেই ২১ সেপ্টেম্বর সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন পেশ করে বিশ্বব্যাংক। অর্র্থমন্ত্রী এই প্রতিবেদন পাওয়ার এক মাস পর ১৩ অক্টোবর এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে জানান পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তার যুক্তি সেতুর কাজ শুরুই হয়নি দুর্নীতি কিভাবে হলো। অর্থমন্ত্রী আরো জানান, এখন পর্যন্ত এ সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজ স্বচ্ছভাবেই হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দাবি প্রত্যাখ্যান করে দেয়া তার এ বক্তব্যের মধ্যেও ছিল অসঙ্গতি। দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে আগেই কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়, যেমন ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। এর তিন দিন পর ১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সরকারের এসব পদক্ষেপে সন্তুষ্ট না হওয়ায় অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতা সংস্থাগুলো ঋণ সহায়তা স্থগিত করে। দেখা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রী এক দিকে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, দুর্নীতি হয়নি, অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছেন। কিন্তু সরকারের নেয়া এসব পদক্ষেপে বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ফলে বিশ্বব্যাংকের সাথে টানাপড়েন বাড়তে থাকে। 

দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের রূপ 
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিবরণ দিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে যেসব প্রতিবেদন পাঠিয়েছে তাতে কিভাবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হচ্ছে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাংকের দেয়া প্রতিবেদন অনুসারে, সেতু নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার। পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া এবং পদ্মা সেতুর সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এনএসসি-লাভালিনের সাথে প্রতিযোগী ছিল যুক্তরাজ্যের হালক্রো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের একম অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান হাই পয়েন্ট রেনডাল। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে বলেছে, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী তার আত্মীয় জিয়াউল হককে (বাংলাদেশে এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধি) নিয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে সেতু ভবনে পদ্মা সেতু সম্পর্কিত এক বৈঠকে অংশ নেন। জিয়াউল হকের লালমাটিয়ার এ ব্লকের ৭/৪ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট কোম্পানি (ইপিসি) কমিশন চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ছিল। আরেকজন মধ্যস্থতাকারী ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরী। কানাডা ও বাংলাদেশে কখন কোথায় এ ব্যক্তিদের স্বাক্ষর ও বৈঠক হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থার মতে, রিতা কনস্ট্রাকশনের মালিক নিক্সন চৌধুরীর সাথে মন্ত্রী, সচিব, প্রকল্প পরিচালক ও এসএনসির জিয়াউল হকের সাক্ষাৎ শুরু হয় পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের টেন্ডার আহ্বানের পরপরই। বিশ্বব্যাংক প্রথমবারের মতো অভিযোগ উত্থাপন করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সে সময় অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে এ দুর্নীতির সাথে সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান সাকোর কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানানো হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণ জানানো হয়। এরপর সরকার মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে অন্যত্র সরিয়ে দিলেও আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সৈয়দ আবুল হোসেন এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী। দায়ীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বিশ্বব্যাংক আবারো চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল চিঠি দেয়। তাতেও সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি লোকদেখানো তদন্ত করে দুর্নীতি হয়নি বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু তা গ্রহণ করেনি বিশ্বব্যাংক। সব শেষ গত মাসে আবারো একটি চিঠি পাওয়ার পর দুদক আবারো তদন্ত শুরু করে।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে নিক্সন চৌধুরী জানান, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ইসমাইলের কথায় সম্মত হয়ে তিনি মধ্যস্থতার কাজ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে নিক্সন চৌধুরী জানান, কানাডায় বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক রমেশ চন্দ্র এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইসমাইলকে দায়িত্ব দেন। এরপর ইসমাইল যোগাযোগ করেন তার (নিক্সন চৌধুরী) সাথে। এ নিয়ে ইসমাইলের সাথে তার কয়েক দফা বৈঠক হয়। এসএনসি-লাভালিনের অফিস তল্লাশির সময় তার ডায়েরিতে পাওয়া যায় কাকে কত টাকা দিতে হবে তার তালিকা। যেখানে আরো অনেকের নাম পাওয়া যায়। 
বিশ্বব্যাংক চেয়েছিল মন্ত্রী আবুল হোসেন ও দুই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হোক। একই সাথে তার ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করার কথাও বলে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সরকার তাতে সম্মত হয়নি। 

বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি 
ঋণ বাতিল করে বিশ্বব্যাংক যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে দুর্নীতিপ্রক্রিয়ার পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। সেই বিবৃতিটি পর্যালোচনা করলে যে দিকগুলো আসছে : 
১.পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছে রয়েছে।
২. বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যানের কাছে দু’টি তদন্তের তথ্য-প্রমাণ প্রদান করেছে। 
৩. কানাডায় যেখানে এসএনসি-লাভালিনের সদর দফতর অবস্থিত সেখানে বিশ্বব্যাংকের রেফারেন্সের ভিত্তিতে ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসেস কয়েকটি সার্চ ওয়ারেন্ট তামিল করে এবং এক বছরব্যাপী তদন্ত চালিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট দুইজন সাবেক এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করেছে। তদন্ত ও বিচার কাজ অব্যাহত রয়েছে। আদালতে পেশকৃত তথ্য এই ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
৪. বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল সেগুলো হচ্ছে ক. যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছুটি প্রদান; খ. এই অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ এবং গ. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি প্রদান যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে। 
৫. বিশ্বব্যাংকের অবস্থান ব্যাখ্যা করা এবং সরকারের জবাব জানার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চপর্যায়ের দল পাঠিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিল না।
৬. বিশ্বব্যাংক স্পষ্টভাবে বলছে, দুর্নীতির ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি চোখ বুজে থাকতে পারে না, তা উচিত নয় এবং থাকবেও না। বাংলাদেশ সরকার থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সহায়তায় ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে। 
বিশ্বব্যাংকের এই বিবৃতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে শুধু সরকারি কর্মকর্তা নয়, দুর্নীতির সাথে আরো কিছু বেসরকারি লোক জড়িত তারা কারা এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সেই ব্যক্তিদের নামগুলো কি বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করবে? সেই বেসরকারি ব্যক্তিদের সাথে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা কতখানি তা এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে অনুমান করা যায়, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন বা সচিবদের চেয়েও তাদের সরকারের শীর্ষব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠতা কম নয়। 

মুহিত-জোয়েলিক-কিম 
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলের পর অর্থমন্ত্রী এক বিবৃতিতে জানান, এই বিবৃতি বিশ্বব্যাংকের নয়, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের বিবৃতি। তিনি পদ্মা সেতুতে ঋণসুবিধা বাতিলের এই সিদ্ধান্তের জন্য সরাসরি রবার্ট জোয়েলিককে দায়ী করেন। জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, সম্ভবত বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তার মেয়াদকালে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিশেষভাবে বিপর্যস্ত করেছে। তিনি তার বক্তব্য শেষ করেছেন এভাবেÑ আমরা যেকোনো মুহূর্তে বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় লিপ্ত হব বলে আশা রাখি। আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে এই অর্থবছরে আমরা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করব। অর্থমন্ত্রী এই আশাবাদ প্রকাশ করার ১২ ঘণ্টা না যেতেই বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম জানিয়ে দেন পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক। দায়িত্ব নেয়ার পর সাংবাদিকদের সাথে তিনি আলাপে এ কথা বলেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের মঙ্গলের বিষয়ে আমরা সজাগ কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে বিশ্বব্যাংক কখনোই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না। কিমের এই বক্তব্যের পর জোয়েলিকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করে আবার ঋণ আনতে পারবেন তেমন আশা নেই। বিশ্বব্যাংকের সাথে আলোচনায় লিপ্ত হওয়ার চেয়েও তাকে হয়তো এখন আরো বেশি বিতর্কে লিপ্ত হতে হবে। অর্থমন্ত্রী দুর্নীতির অভিযোগকে দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর না ভেবে শুধু ঋণচুক্তি বাতিলকে দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর বলছেন। অথচ দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করত না। এই সত্যটি অর্থমন্ত্রীসহ সরকার স্বীকার করতে চাইছে না। ফলে বিশ্বব্যাংকের সাথে জটিলতা আরো বাড়ছে।

মন্ত্রীবচন ও গণমাধ্যম 
পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের পর মন্ত্রীরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই সিদ্ধান্তকে প্রথম দিন বজ্রাঘাত বলে উল্লেখ করলেও পরের দিন বলেন, বিশ্বব্যাংকের চেয়েও সহজ শর্তে পদ্মা সেতু হবে। সেটা হবে একটি চমক। এরপর তিনি বলেন, তদন্তের আগে শাস্তি দেয়া যায় না। বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক ও রহস্যজনক। তদন্ত চলা অবস্থায় বিশ্বব্যাংক এটা করে একটি দেশকে দুর্নীতিবাজ বলতে পারে না। এর পরও আগামী আট মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন বিশ্বব্যাংক পুনর্মূল্যায়ন করবে। যোগাযোগমন্ত্রী এর পরদিন জানান, চমক দেয়ার কথা বলা তার ঠিক হয়নি। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এই প্রকল্পটি দেশীয় ষড়যন্ত্র ও বিদেশী কূটকচালের শিকার। দুদক চেয়ারম্যানের মতে, বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য। আর অর্থমন্ত্রী তো রবার্ট জোয়েলিককে দায়ী করে বলেছেন, দুদক তদন্ত করছে বলে তিনি মাথা ঘামাননি। দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রীরা দুর্নীতির অভিযোগকে ষড়যন্ত্রের প্রলেপে ঢেকে দিতে চাইছেন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, পদ্মা সেতু এই সরকারই করবে। কারো দিকে তাকাবে না। এর আগে ২০১২ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। যদি প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে দাতাদের কাছ থেকে আমরা পদ্মা সেতুর জন্য কোনো অর্থ নেব না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বিশ্বব্যাংকের সাথে আর আলোচনার অবকাশ আছে কি? ঋণ বাতিলের পর বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দুর্নীতির সাথে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত রয়েছে। আর মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, মন্ত্রী আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেয়া উচিত ছিল। তিনি মূলত ঋণ বাতিলের জন্য মন্ত্রী আবুল হোসেনকে দায়ী করেছেন। 
তবে মজার ব্যাপার হলো, সরকার সমর্থক গণমাধ্যম পদ্মা সেতুর দুর্নীতির চেয়ে বিশ্বব্যাংক কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান তা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশে ব্যস্ত ছিল। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের খবরের সাথে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির খবর সমানভাবে প্রচার করে। অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের সাথে যখন যুদ্ধে লিপ্ত সে সময় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামে সরকার সমর্থক গণমাধ্যম। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রচারণাযুদ্ধ চলে সমানতালে। বিশ্বব্যাংকের নীতি-কৌশল বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বহু দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এগুলো নতুন কোনো তথ্য নয়। বহু দেশে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি বা অনিয়মের খবরও নতুন নয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আগে কখনোই এসব খবর প্রচার করা হয়নি। 

স্বাধীন দুদক!
পদ্মা সেতুর এই দুর্নীতির পুরো প্রক্রিয়া সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের জানানোর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকেও জানানো হয়েছে। বিশ্বব্যাংক দুদককে প্রস্তাব দিয়েছিল তদন্ত প্রক্রিয়ায় তাদের একজন কর্মকর্তাকে রাখতে। দুদক সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। 
একই সাথে দুদক জানায়, এ নিয়ে তদন্ত এখনো চলছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিলের ঘোষণা দেয়ার পর দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বিশ্ব্যব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য ও অন্যায্য। প্রশ্ন হলো, দুদকের তদন্ত শেষ হয়নি। দুদক কিভাবে নিশ্চিত হলো দুর্নীতি হয়নি এবং বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। 
দেখা যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের ধরার চেয়ে আড়াল করার কাজে দুদক এখন বেশি ব্যস্ত। ইতোমধ্যে দুদক দুর্নীতির কালো বিড়ালদের সাদা করেছেন। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে তাদের নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট প্রদান করার প্রধান দায়িত্ব এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের। রেল কেলেঙ্কারির মতো পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও একই ভূমিকা নিয়েছে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। 

পরিণতি কী 
বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ সহায়তার বড় উৎস বিশ্বব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ সহায়তার নীতি-কৌশল নিয়ে দুনিয়াজুড়ে বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষা করা বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোর বৈদেশিক সহায়তার প্রধান উৎস বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ আসে বিশ্বব্যাংক থেকে। অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি যে বাজেট ঘোষণা করেছেন তাতে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ঋণ আসবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ৩৫টির মতো নানা ধরনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। এখন মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই বাংলাদেশ চলতে পারবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক হচ্ছে লিড ডোনার। প্রতিষ্ঠানটি সাহায্য প্রত্যাহার করলে বা সাহায্য দিতে অস্বীকার করলে অন্য সংস্থা বা দাতা একই নীতি গ্রহণ করে থাকে। যে কারণে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের সাথে সাথে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাইকা ও আইডিবি সরাসরি নাকচ না করলেও ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। বিশ্বব্যাংক শুধু পদ্মাসেতু নয়, হাইটেক পার্ক স্থাপনসহ আরো দুটো প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন নাজুক। এর মধ্যে দাতা সংস্থার সাথে লড়াইয়ে নেমেছে সরকার। এই লড়াইয়ের খেসারত দিতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকে। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন শুধু ধূলিসাৎ হলো না, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর যে প্রভাব পড়বে তাতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। 
alfazanambd@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন