॥ সাকিব মুকতাসিদ ॥
ভূকম্পনটা রিখটার স্কেলে পরিমাপ করা যায়নি, কিন্তু এর ঝাঁকুনি বেশ লেগেছে এবং এখনো এর চোট যায়নি; কত দিন চোটটা থাকবে এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আমরা সব কিছুই সহজে ভুলে যাই। বোধ করি সে জন্যই অতি দ্রোহে বিদায় দিয়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে একই দলকে মতায় বসাই। এক দিন সাগর-রুনি, ইলিয়াসÑ এসবও ভুলে যাবো। কিন্তু এ কম্পনটা একটু ভিন্ন মাত্রার, ধাক্কাও সুদূরপ্রসারী। সুতরাং এ প্রচণ্ড ধাক্কাটা ভুলে গেলেও এর ত থেকে যাবে অনেক দিন। সচেতনদের জন্য এর রেশ অনেক দিন থাকবে আর অর্থনীতির ওপর এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়া গেছে। ফলে সচেতন মানুষ এই কম্পনে নড়েচড়ে বসেছে। তবে সরকারকে কতটা নড়াতে পেরেছে তা এখনো বোঝা যাবে না। এই নিয়ে এখনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর মন্তব্য পাওয়া যায়নি। অর্থমন্ত্রীর সংসদে বিস্তারিত বিবৃতি কী হতে পারে তা ঠিক ঠিক না হলেও একটা অনুমান তো করাই সম্ভবÑ হয়তো স্বভাবসুলভভাবেই বলবেন, ফেডআপ, একদম ফেডআপ; নয়তো রাবিশ, অ্যাগেইন রাবিশ; অথবা এ যাবৎ এ নিয়ে সরকারপ্রধান, অর্থমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী আর সেতু বিভাগের বক্তব্যের একটা মিলিত গদ্যই তিনি সংসদে উপহার দেবেন বলে আশা করতে অসুবিধে নেই। হয়তো অনেক যুক্তি কিংবা সাফাই থাকবে সরকারের তরফে, কিন্তু যে বার্তাটি সাধারণ মানুষ পেয়ে গেছে, তার নিরসন হবে না। এমনকি সরকারপ্রধান, অর্থমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রী যতই সুললিত কণ্ঠে আর যুক্তিতে সাফাই গান না কেন তাতে আমাদের সেতুর একটিও স্প্যান নির্মিত হবে না। দেশের মানুষ এ জন্য উৎকণ্ঠিত।
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং অনেক দিন পর সব দৈনিক পত্রিকা একটি বিষয়কে প্রধান করে ট্রিটমেন্ট করেছেÑ বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ দিচ্ছে না। সে দিনের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আলোচনায়ও এই একটি বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। আমরা সবাই আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর জন্য অপোয়। কবে এর কাজ শুরু হবে, কবে এটি শেষ হবে; কেবল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নই নয়, আমাদের অর্থনীতির সাথে এই সেতুর সম্পর্ক হচ্ছে রক্তের সাথে হার্টের সম্পর্কের মতোই। বোধ করি সে জন্য নানা দেশের কাগজেও খবরটা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। বিশ্ব এই বার্তাই পেয়েছে যে, দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক একটি দেশে অর্থসাহায্য প্রত্যাহার করেছে।
বিশ্বব্যাংকের সরে পড়া নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কিন্তু আমজনতা একটাই জানে, আর তা হলোÑ এই সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে না; মানুষের এই ধারণা দূরীভূত করা সরকারের জন্য খুবই কঠিন হবে এবং এটিই আগামী নির্বাচনের নিয়ামক হবে বলে অনেকেই মনে করে। যদিও এখনো অনেকে আশাবাদী যে, সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। সেটি শেষ অবধি হলেই ভালো, দল-মত নির্বিশেষে সবাই পদ্মা সেতু চাই।
অনেকেই বলছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে সামরিক শাসক কিংবা স্বৈরাচারী সরকারকে অর্থ প্রদানের নজির বিশ্বব্যাংকের অনেক বেশি। এ কথা আগেও শোনা গেছে, এখন কণ্ঠ একটু উচ্চকিত হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক আর্থিক কার্যক্রমের চেয়ে রাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক কাজে অধিক মনোনিবেশ করছে। এটিও পুরনো কথা। কেউ বলছেন, সদস্যরাষ্ট্রের চাঁদার হিসাবও সঠিকভাবে দেয় না বিশ্বব্যাংক। আবার অর্থমন্ত্রী এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এটি বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব কোনো ঘোষণা নয়, বরং বিদায়ী প্রেসিডেন্টের একক সিদ্ধান্তের ফল। অর্থমন্ত্রীর এ কথার কোনো সারবত্তা নেই। এর সবই বিশ্লেষণের দাবিদার। কিন্তু কোনো কিছুই সেতুর জন্য অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে না। বিশ্বব্যাংকের সব কিছু জেনে এবং মেনেই পদ্মা সেতুর জন্য ঋণচুক্তি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাংকের হাজারটা শর্ত এবং অনেক শর্ত মানহানিকরও বটেÑ মেনেই আমরা সাহায্য নিচ্ছি, আগামীতেও নিতে হবে। বর্তমান প্রেসিডেন্টের কোনো সিদ্ধান্ত আগামী প্রেসিডেন্ট এসে বাতিল করবেন, এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই। আর তিনিই বা কী কারণে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে গেলেন? এটি সরকারের একধরনের ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। আমাদের বুঝতে হবে, বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ঠিক করে আমেরিকা। তাই আমেরিকার পলিসি রা করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। আরো দেখতে হবে, বিশ্বব্যাংক অন্য সব আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্তা। বিশ্বব্যাংক মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার অর্থই হচ্ছে আর সব পথেও বাধা সৃষ্টি করা। আমাদের তা হতে দেয়া কতটা ঠিক হবে সেটিও ভাবতে হবে। আপাতত মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে এই সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ লণীয় নয়, বরং সরকারের আগের পলিসিই রেকর্ড হয়ে বাজছে যেন। গ্রামে একটা কথা আছে, ডিঙি চড়ে জাহাজের সাথে বোঝাপড়া করা যায় না, কিংবা টিনের ঘরে শুয়ে পাশের ১৩ তলার সাথে যুদ্ধ করা যায় না। আমরা নানা েেত্রই এটি মেনে নিচ্ছি, রাষ্ট্রীয় পলিসির েেত্রও এর ব্যত্যয় কম দেখা যায়। বিশ্বব্যাংকের নির্বাহীরা ছয়-সাত অঙ্কে বেতন নিলেও আমাদের বেতন বৃদ্ধির সময়ে তাদের বাগড়া আমরা প্রতিবারই মেনে নেই, ওখানে একটি চাকরি জন্য সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করি, তাদের অর্থায়নে প্রজেক্ট পেতে এ রাষ্ট্র মরিয়া, প্রশাসনিক ও আর্থিক সংস্কারেও ওরা প্রধান পরামর্শকÑ এখন কী হলো, বিশ্বব্যাংক খুব খারাপ!
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগটি সরকার খুব গুরুত্বের সাথে নেয়নি। বিভিন্ন আলোচনা এবং পত্রিকার মতামত থেকে এটিই প্রতিভাত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক যে তিনটে শর্ত দিয়েছিল তা মেনে নেয়া রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ কোনো তিকরও ছিল না। তার পরও কী এমন হয়েছিল! ক’জন নির্বাহী বা আমলাকে সরিয়ে দিতে না পারার খেসারত জাতি এভাবে কেন দেবে, তার কী জবাব সরকার দেবে তা বোঝা যাচ্ছে না (আমআদমি সে জবাব খেলেই হয়)। দুদক এমনিতেই তদন্ত করছিল। একটি বিশেষ টিম করলে কী হতো। ভয় একটা আছেÑ হয়তো কঠিন সত্য ( সত্য সর্বদাই কঠিন) বেরিয়ে আসত, যা হয়তো কেউ কেউ চায়নি। আর সে কারণে বিশ্বব্যাংকের তৃতীয় শর্তও মানা সম্ভব হয়নি। ফলাফল জাতির চরম খেসারত।
এখন অনেকেই বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে টেবিল চাপড়াচ্ছে। বলছে এ দেশে বিশ্বব্যাংকের নানা প্রকল্পে অনিয়মের কথা। এর জবাব বিশ্বব্যাংকই দেবেÑ তবে এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশও জড়িত থাকে। অন্য দিকে পদ্মা সেতু একটি বিশাল প্রজেক্ট, আমাদের দেশের মতো অর্থনীতিতে এ রকম প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী সাহায্য পেতে কিছু ছাড় দিতেই হবে। কিন্তু আমরা একজন মন্ত্রী এবং ক’জন আমলাকে আপাতত কাজবিযুক্ত করতেই সাহস করলাম নাÑ কী এমন কারিশমা এই ক’জনের মধ্যে! আমাদের রাজনীতি একটা চক্রের মধ্যে দোল খাচ্ছে। দলের প্রধান রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে গেছেন, দু’টি বড় দলের জন্যই তা সত্য। তাই দেখি, প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসকে কিছু বললে সভাসদরা পাঁচ গুণ বাড়িয়ে বলেন। প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ভালো বললে অন্যরা কয়েক গুণ এগিয়ে কথা বলেন, দুদকও প্রত্যয়ন দিয়ে দেয় অতি অনায়াসেই। কেউ টকশোকে ‘টক’ বললে, তার মন্ত্রী টকশোর আলোচকদের ‘মূর্খ’ বলেন নির্দ্বিধায়। হায়, মাতৃভূমি! বিশ্বব্যাংক এবং পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এই কাণ্ডটিই ঘটেছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবকে কেবল উপো আর তাচ্ছিল্যই করা হয়নি, চিহ্নিত অভিযুক্তদের রা করার অপকৌশলও করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংককে পাশ কাটিয়ে দুবাই, চীন আর মালয়েশিয়া দৌঁড়ে গেছি আমরা। অর্থও নাকি পেয়ে গেছি। তাহলে এখন এত হাপিত্যেশ কেন? কই, এখনো তো যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, জানুয়ারিতেই ভিত্তি দাঁড়িয়ে যাবে, কিন্তু কবে শেষ হবে, কে কী শর্তে টাকা দেবে, সেটি চেপে যাচ্ছেন। আমাদের মাননীয়রা সাধারণ মানুষকে যতটা বোকা ঠাওড়াচ্ছেন, মানুষ হয়তো এতটা বোকা আর নেই। তাবৎ বোদ্ধারা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ। আমরা দুই বছর ধরে বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেটি কেবল আমাদের একগুঁয়েমির জন্য। আজ তা প্রমাণিত হলো।
প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংককে দূরে রাখলাম, অন্যান্য েেত্র কী হবে? আমরা কি নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংককে বয়কট করে টিকতে পারব? এ প্রশ্নের জবাব হয়তো সহজ নয়, আবার সরকার যেভাবে বিশ্বব্যাংককে নিয়েছে তাতে ‘খুবই সহজ’। কেউ কেউ বলছেন, রেলসংযোগ বাদ দিলে নিজেদের অর্থায়নেই এ সেতু করা সহজ হতো। এ কথা এখন কেন বলা হচ্ছে? যদি তাই হয় তবে ৩০-৪০ বছর পরে কবে রেল চালু হবে তা নিয়ে এখনই কেন সঙ্কটের দিকে যেতে হলো?
যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, বিনা মেঘে বজ্রপাত। বিচিত্র সেলুকাস! তিনি তো অনেক আগেই অন্যত্র টাকার জন্য দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন, তবে কি না জেনেই? সরকারকে খুব কম সময় দেয়নি বিশ্বব্যাংক। সুতরাং হঠাৎ করেই এ সিদ্ধান্ত হয়নি। যারা এখন এ কথা বলছেন, তারা বরং আগে ভাগে সরকারকে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব তিনটা অনুযায়ী অগ্রসর হতে সরকারের ওপর চাপ দেয়ার চেষ্টা করতে পারতেন। বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত নোবেল বিজয়ীর ওপর দিয়েও হয়তো কম যাবে না। ড. ইউনূস এ ব্যাপারে প্রত্য ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মানুষ বিশ্বাস করে না। তবে তার প্রতি বর্তমান সরকার যে আচরণ করেছে বা করছে তা আন্তঃজালের মাধ্যমে সারা বিশ্বই জানে। এর ফলে কিছু ঘটা অন্তত বিচিত্র নয়। কিন্তু এ জন্য তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো আরো একটি বড় ভুল হবে। আর এ ধরনের ভুলের মাশুল আবার দিতে হতে পারে। রাষ্ট্র কেন এই নোংরা খেলায় মেতে উঠবে!
বিশ্বব্যাংকের সাথে আমাদের সন্তোষজনক সমাধানই নানা প্রশ্নের সহজ সমাধান। এখনো সেটি সম্ভবÑ বিশ্বব্যাংকের সাথে আলোচনায় বসে তাদের দেয়া প্রস্তাবত্রয় মেনে নেয়াই আমাদের স্বপ্নের সেতুর জন্য একমাত্র প্রতিবিধান। অর্থছাড় কিংবা লেনদেন ছাড়াও অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। কাউকে খুন না করে খুন করতে চাইলেও এই দেশের আইনে অপরাধ হয়। ঘুষ চাইলেও এ দেশে অপরাধ হয়। কেন জানি টকশো দেখে শুনে মনে হয়, আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা এখনো এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারছেন না। কেন পারছেন না সে কথা আগেই বলা হয়েছে। সুতরাং এখন ছাড়ের ইচ্ছাটা স্বয়ং সরকারপ্রধানকেই করতে হবে। আগামী নির্বাচনে পদ্মা সেতু ইস্যুতে কোন দলের আসন বাড়বে বা কমবে সেটি আমজনতার বিবেচনার নয়। মহাজাট সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক সরে গেল। এই একটিই মেসেজ মানুষের কানে বাজছে এবং এটাই মানুষ বিশ্বাস করবে। আরো বলতে হয়Ñ এক আবুল হোসেনের দায় সরকার কেন নেবে, এক আবুল হোসেনের জন্য রাষ্ট্র কেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিপ হবেÑ সেই প্রশ্নের খোলাসা জবাব চায় জনগণ। কারণ দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আর কিছু নয়; আবুল হোসেনদের রা করাই যেন পদ্মা সেতুর চেয়ে বড় হয়ে আছে। সেখানে রাষ্ট্র, জনগণ কিংবা দেশের কোনো কূটনীতি একেবারেই তুচ্ছ।
লেখক : উন্নয়ন কর্মী
ভূকম্পনটা রিখটার স্কেলে পরিমাপ করা যায়নি, কিন্তু এর ঝাঁকুনি বেশ লেগেছে এবং এখনো এর চোট যায়নি; কত দিন চোটটা থাকবে এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আমরা সব কিছুই সহজে ভুলে যাই। বোধ করি সে জন্যই অতি দ্রোহে বিদায় দিয়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে একই দলকে মতায় বসাই। এক দিন সাগর-রুনি, ইলিয়াসÑ এসবও ভুলে যাবো। কিন্তু এ কম্পনটা একটু ভিন্ন মাত্রার, ধাক্কাও সুদূরপ্রসারী। সুতরাং এ প্রচণ্ড ধাক্কাটা ভুলে গেলেও এর ত থেকে যাবে অনেক দিন। সচেতনদের জন্য এর রেশ অনেক দিন থাকবে আর অর্থনীতির ওপর এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়া গেছে। ফলে সচেতন মানুষ এই কম্পনে নড়েচড়ে বসেছে। তবে সরকারকে কতটা নড়াতে পেরেছে তা এখনো বোঝা যাবে না। এই নিয়ে এখনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর মন্তব্য পাওয়া যায়নি। অর্থমন্ত্রীর সংসদে বিস্তারিত বিবৃতি কী হতে পারে তা ঠিক ঠিক না হলেও একটা অনুমান তো করাই সম্ভবÑ হয়তো স্বভাবসুলভভাবেই বলবেন, ফেডআপ, একদম ফেডআপ; নয়তো রাবিশ, অ্যাগেইন রাবিশ; অথবা এ যাবৎ এ নিয়ে সরকারপ্রধান, অর্থমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী আর সেতু বিভাগের বক্তব্যের একটা মিলিত গদ্যই তিনি সংসদে উপহার দেবেন বলে আশা করতে অসুবিধে নেই। হয়তো অনেক যুক্তি কিংবা সাফাই থাকবে সরকারের তরফে, কিন্তু যে বার্তাটি সাধারণ মানুষ পেয়ে গেছে, তার নিরসন হবে না। এমনকি সরকারপ্রধান, অর্থমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রী যতই সুললিত কণ্ঠে আর যুক্তিতে সাফাই গান না কেন তাতে আমাদের সেতুর একটিও স্প্যান নির্মিত হবে না। দেশের মানুষ এ জন্য উৎকণ্ঠিত।
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং অনেক দিন পর সব দৈনিক পত্রিকা একটি বিষয়কে প্রধান করে ট্রিটমেন্ট করেছেÑ বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ দিচ্ছে না। সে দিনের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আলোচনায়ও এই একটি বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। আমরা সবাই আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর জন্য অপোয়। কবে এর কাজ শুরু হবে, কবে এটি শেষ হবে; কেবল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নই নয়, আমাদের অর্থনীতির সাথে এই সেতুর সম্পর্ক হচ্ছে রক্তের সাথে হার্টের সম্পর্কের মতোই। বোধ করি সে জন্য নানা দেশের কাগজেও খবরটা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। বিশ্ব এই বার্তাই পেয়েছে যে, দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক একটি দেশে অর্থসাহায্য প্রত্যাহার করেছে।
বিশ্বব্যাংকের সরে পড়া নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কিন্তু আমজনতা একটাই জানে, আর তা হলোÑ এই সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে না; মানুষের এই ধারণা দূরীভূত করা সরকারের জন্য খুবই কঠিন হবে এবং এটিই আগামী নির্বাচনের নিয়ামক হবে বলে অনেকেই মনে করে। যদিও এখনো অনেকে আশাবাদী যে, সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। সেটি শেষ অবধি হলেই ভালো, দল-মত নির্বিশেষে সবাই পদ্মা সেতু চাই।
অনেকেই বলছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে সামরিক শাসক কিংবা স্বৈরাচারী সরকারকে অর্থ প্রদানের নজির বিশ্বব্যাংকের অনেক বেশি। এ কথা আগেও শোনা গেছে, এখন কণ্ঠ একটু উচ্চকিত হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক আর্থিক কার্যক্রমের চেয়ে রাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক কাজে অধিক মনোনিবেশ করছে। এটিও পুরনো কথা। কেউ বলছেন, সদস্যরাষ্ট্রের চাঁদার হিসাবও সঠিকভাবে দেয় না বিশ্বব্যাংক। আবার অর্থমন্ত্রী এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এটি বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব কোনো ঘোষণা নয়, বরং বিদায়ী প্রেসিডেন্টের একক সিদ্ধান্তের ফল। অর্থমন্ত্রীর এ কথার কোনো সারবত্তা নেই। এর সবই বিশ্লেষণের দাবিদার। কিন্তু কোনো কিছুই সেতুর জন্য অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে না। বিশ্বব্যাংকের সব কিছু জেনে এবং মেনেই পদ্মা সেতুর জন্য ঋণচুক্তি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাংকের হাজারটা শর্ত এবং অনেক শর্ত মানহানিকরও বটেÑ মেনেই আমরা সাহায্য নিচ্ছি, আগামীতেও নিতে হবে। বর্তমান প্রেসিডেন্টের কোনো সিদ্ধান্ত আগামী প্রেসিডেন্ট এসে বাতিল করবেন, এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই। আর তিনিই বা কী কারণে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে গেলেন? এটি সরকারের একধরনের ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। আমাদের বুঝতে হবে, বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ঠিক করে আমেরিকা। তাই আমেরিকার পলিসি রা করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। আরো দেখতে হবে, বিশ্বব্যাংক অন্য সব আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্তা। বিশ্বব্যাংক মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার অর্থই হচ্ছে আর সব পথেও বাধা সৃষ্টি করা। আমাদের তা হতে দেয়া কতটা ঠিক হবে সেটিও ভাবতে হবে। আপাতত মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে এই সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ লণীয় নয়, বরং সরকারের আগের পলিসিই রেকর্ড হয়ে বাজছে যেন। গ্রামে একটা কথা আছে, ডিঙি চড়ে জাহাজের সাথে বোঝাপড়া করা যায় না, কিংবা টিনের ঘরে শুয়ে পাশের ১৩ তলার সাথে যুদ্ধ করা যায় না। আমরা নানা েেত্রই এটি মেনে নিচ্ছি, রাষ্ট্রীয় পলিসির েেত্রও এর ব্যত্যয় কম দেখা যায়। বিশ্বব্যাংকের নির্বাহীরা ছয়-সাত অঙ্কে বেতন নিলেও আমাদের বেতন বৃদ্ধির সময়ে তাদের বাগড়া আমরা প্রতিবারই মেনে নেই, ওখানে একটি চাকরি জন্য সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করি, তাদের অর্থায়নে প্রজেক্ট পেতে এ রাষ্ট্র মরিয়া, প্রশাসনিক ও আর্থিক সংস্কারেও ওরা প্রধান পরামর্শকÑ এখন কী হলো, বিশ্বব্যাংক খুব খারাপ!
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগটি সরকার খুব গুরুত্বের সাথে নেয়নি। বিভিন্ন আলোচনা এবং পত্রিকার মতামত থেকে এটিই প্রতিভাত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক যে তিনটে শর্ত দিয়েছিল তা মেনে নেয়া রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ কোনো তিকরও ছিল না। তার পরও কী এমন হয়েছিল! ক’জন নির্বাহী বা আমলাকে সরিয়ে দিতে না পারার খেসারত জাতি এভাবে কেন দেবে, তার কী জবাব সরকার দেবে তা বোঝা যাচ্ছে না (আমআদমি সে জবাব খেলেই হয়)। দুদক এমনিতেই তদন্ত করছিল। একটি বিশেষ টিম করলে কী হতো। ভয় একটা আছেÑ হয়তো কঠিন সত্য ( সত্য সর্বদাই কঠিন) বেরিয়ে আসত, যা হয়তো কেউ কেউ চায়নি। আর সে কারণে বিশ্বব্যাংকের তৃতীয় শর্তও মানা সম্ভব হয়নি। ফলাফল জাতির চরম খেসারত।
এখন অনেকেই বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে টেবিল চাপড়াচ্ছে। বলছে এ দেশে বিশ্বব্যাংকের নানা প্রকল্পে অনিয়মের কথা। এর জবাব বিশ্বব্যাংকই দেবেÑ তবে এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশও জড়িত থাকে। অন্য দিকে পদ্মা সেতু একটি বিশাল প্রজেক্ট, আমাদের দেশের মতো অর্থনীতিতে এ রকম প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী সাহায্য পেতে কিছু ছাড় দিতেই হবে। কিন্তু আমরা একজন মন্ত্রী এবং ক’জন আমলাকে আপাতত কাজবিযুক্ত করতেই সাহস করলাম নাÑ কী এমন কারিশমা এই ক’জনের মধ্যে! আমাদের রাজনীতি একটা চক্রের মধ্যে দোল খাচ্ছে। দলের প্রধান রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে গেছেন, দু’টি বড় দলের জন্যই তা সত্য। তাই দেখি, প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসকে কিছু বললে সভাসদরা পাঁচ গুণ বাড়িয়ে বলেন। প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ভালো বললে অন্যরা কয়েক গুণ এগিয়ে কথা বলেন, দুদকও প্রত্যয়ন দিয়ে দেয় অতি অনায়াসেই। কেউ টকশোকে ‘টক’ বললে, তার মন্ত্রী টকশোর আলোচকদের ‘মূর্খ’ বলেন নির্দ্বিধায়। হায়, মাতৃভূমি! বিশ্বব্যাংক এবং পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এই কাণ্ডটিই ঘটেছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবকে কেবল উপো আর তাচ্ছিল্যই করা হয়নি, চিহ্নিত অভিযুক্তদের রা করার অপকৌশলও করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংককে পাশ কাটিয়ে দুবাই, চীন আর মালয়েশিয়া দৌঁড়ে গেছি আমরা। অর্থও নাকি পেয়ে গেছি। তাহলে এখন এত হাপিত্যেশ কেন? কই, এখনো তো যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, জানুয়ারিতেই ভিত্তি দাঁড়িয়ে যাবে, কিন্তু কবে শেষ হবে, কে কী শর্তে টাকা দেবে, সেটি চেপে যাচ্ছেন। আমাদের মাননীয়রা সাধারণ মানুষকে যতটা বোকা ঠাওড়াচ্ছেন, মানুষ হয়তো এতটা বোকা আর নেই। তাবৎ বোদ্ধারা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ। আমরা দুই বছর ধরে বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেটি কেবল আমাদের একগুঁয়েমির জন্য। আজ তা প্রমাণিত হলো।
প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংককে দূরে রাখলাম, অন্যান্য েেত্র কী হবে? আমরা কি নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংককে বয়কট করে টিকতে পারব? এ প্রশ্নের জবাব হয়তো সহজ নয়, আবার সরকার যেভাবে বিশ্বব্যাংককে নিয়েছে তাতে ‘খুবই সহজ’। কেউ কেউ বলছেন, রেলসংযোগ বাদ দিলে নিজেদের অর্থায়নেই এ সেতু করা সহজ হতো। এ কথা এখন কেন বলা হচ্ছে? যদি তাই হয় তবে ৩০-৪০ বছর পরে কবে রেল চালু হবে তা নিয়ে এখনই কেন সঙ্কটের দিকে যেতে হলো?
যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, বিনা মেঘে বজ্রপাত। বিচিত্র সেলুকাস! তিনি তো অনেক আগেই অন্যত্র টাকার জন্য দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন, তবে কি না জেনেই? সরকারকে খুব কম সময় দেয়নি বিশ্বব্যাংক। সুতরাং হঠাৎ করেই এ সিদ্ধান্ত হয়নি। যারা এখন এ কথা বলছেন, তারা বরং আগে ভাগে সরকারকে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব তিনটা অনুযায়ী অগ্রসর হতে সরকারের ওপর চাপ দেয়ার চেষ্টা করতে পারতেন। বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত নোবেল বিজয়ীর ওপর দিয়েও হয়তো কম যাবে না। ড. ইউনূস এ ব্যাপারে প্রত্য ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মানুষ বিশ্বাস করে না। তবে তার প্রতি বর্তমান সরকার যে আচরণ করেছে বা করছে তা আন্তঃজালের মাধ্যমে সারা বিশ্বই জানে। এর ফলে কিছু ঘটা অন্তত বিচিত্র নয়। কিন্তু এ জন্য তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো আরো একটি বড় ভুল হবে। আর এ ধরনের ভুলের মাশুল আবার দিতে হতে পারে। রাষ্ট্র কেন এই নোংরা খেলায় মেতে উঠবে!
বিশ্বব্যাংকের সাথে আমাদের সন্তোষজনক সমাধানই নানা প্রশ্নের সহজ সমাধান। এখনো সেটি সম্ভবÑ বিশ্বব্যাংকের সাথে আলোচনায় বসে তাদের দেয়া প্রস্তাবত্রয় মেনে নেয়াই আমাদের স্বপ্নের সেতুর জন্য একমাত্র প্রতিবিধান। অর্থছাড় কিংবা লেনদেন ছাড়াও অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। কাউকে খুন না করে খুন করতে চাইলেও এই দেশের আইনে অপরাধ হয়। ঘুষ চাইলেও এ দেশে অপরাধ হয়। কেন জানি টকশো দেখে শুনে মনে হয়, আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা এখনো এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারছেন না। কেন পারছেন না সে কথা আগেই বলা হয়েছে। সুতরাং এখন ছাড়ের ইচ্ছাটা স্বয়ং সরকারপ্রধানকেই করতে হবে। আগামী নির্বাচনে পদ্মা সেতু ইস্যুতে কোন দলের আসন বাড়বে বা কমবে সেটি আমজনতার বিবেচনার নয়। মহাজাট সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক সরে গেল। এই একটিই মেসেজ মানুষের কানে বাজছে এবং এটাই মানুষ বিশ্বাস করবে। আরো বলতে হয়Ñ এক আবুল হোসেনের দায় সরকার কেন নেবে, এক আবুল হোসেনের জন্য রাষ্ট্র কেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিপ হবেÑ সেই প্রশ্নের খোলাসা জবাব চায় জনগণ। কারণ দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আর কিছু নয়; আবুল হোসেনদের রা করাই যেন পদ্মা সেতুর চেয়ে বড় হয়ে আছে। সেখানে রাষ্ট্র, জনগণ কিংবা দেশের কোনো কূটনীতি একেবারেই তুচ্ছ।
লেখক : উন্নয়ন কর্মী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন