রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : এ দেশবাসীর উন্নয়নে যার অবদান অতুলনীয়



ডাঃ সুলতান আহমদ   :
 ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯২১ সালে এই দিনে অনেক বাধাবিপত্তি তথা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে জাতির কিছু ত্যাগী কর্মবীরের কর্ম প্রচেষ্টা ও ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশবাসীর উন্নয়নে অত্র বিশ্ববিদ্যালয় বলতে গেলে একক ও অতুলনীয় অবদান রেখে চলছে। আজ যে সমস্ত জ্ঞানী-গুণীজন দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই অত্র বিশ্ববিদ্যালয় হতে জ্ঞানের আলোকপ্রাপ্ত। অতীতেও অবস্থা একই রকম ছিল। একটা পশ্চাদপদ ও অনুন্নত জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিতে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে জাতির নতুন প্রজন্মকে বলা চলে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। মনে হয় এটা করা হচ্ছে অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই। বিশেষ করে অত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি সাধারণ মানুষ তো বটেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদেরও অনেকের অজানা। তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা এবং বিশেষ করে তখনকার অবহেলিত ও বঞ্চিত পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থে ঢাকাতে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের কিছু দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক নেতা ও সমাজ সেবককে কত কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল তা আমাদের অজানা। এমনকি জাতি আজ তাদের নামটা পর্যন্ত ভুলতে বসেছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য কখনও মংগলজনক হতে পারে না।
যাহোক ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার অধঃপতনের যুগ শুরু হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছর ইংরেজগণ এদেশ শাসন করেছে। যেহেতু ইংরেজগণ মুসলিম শাসককে পরাজিত করে এদেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সূচনা করে তাই মুসলিম জাতির  প্রতি ছিল তাদের সন্দেহ ও আক্রোশ। তদ্রূপ মুসলমানগণ ও ইংরেজদেরকে ঘৃণা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখত বলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রাম করে যেতে থাকে। ফলে এই দুই জাতির মধ্যে মারাত্মক ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এ সুযোগ গ্রহণ করে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় সর্ব ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে থাকে। বিশেষ করে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হলে মুসলমানগণ চিরস্থায়ীভাবে বঞ্চিত ও অবহেলিত হতে থাকে। এ অবস্থা দীর্ঘ দিন চলতে থাকে এবং মুসলমানগণ অধঃপতনের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এরই মাঝে ফকির বিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরাজী আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয় এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ইংরেজ বিতাড়নে প্রায় সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছিল। এ সকল বিদ্রোহেই নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলমানগণ। ফলে তাদের প্রতি ইংরেজদের আক্রোশ আরও বেড়ে যায় এবং মুসলমানদের দুঃখ-দুঃর্দশা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ব বাংলার অধঃপতিত জনগণের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের আমলে বঙ্গভঙ্গ করে পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে একটা নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। যেহেতু এ ব্যবস্থায় পূর্ব বাংলার জনগণের উন্নতি হবে বলে ধরে নেয়া হয় এবং পূর্ববাংলার অধিকাংশ জনগণ ছিল মুসলমান, তাই হিন্দু সম্প্রদায় এ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারে না। বরং বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। এমনকি হিন্দু বুদ্ধিজীবীগণ স্বীয় শ্রেণীস্বার্থে ও গোষ্ঠীস্বার্থে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাঙালী হিন্দু যুব সমাজকে ইংরেজবিরোধী সন্ত্রাসী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ইন্ধন জোগায়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বংভংগের বিপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা হলে হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে সারা পূর্ববাংলা ও আসামের রাজনৈতিক অংগন উত্তপ্ত করে তোলে। বিশেষ করে হিন্দু জমিদারগণ এ আন্দোলনে প্রত্যক্ষ মদদ দান করে। অপরপক্ষে স্বাভাবিক কারণেই পূর্ব বাংলা ও আসামের মুসলমানগণ বংগভংগের কারণে আনন্দিত হয়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘‘ঢাকা মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন’’ নামে একটা মুসলিম প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। নয়া প্রদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয় ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশই ছিলো এই সংস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য। সমস্ত মুসলমান জনগোষ্ঠী এমনকি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীও বংগভংগের ব্যবস্থাপনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ ধরনের এক চরম নৈরাজ্য কর ঐতিহাসিক পটভূমিতে সদ্য ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থনের হাত সম্প্রসারিত করেছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, ঘটনা প্রবাহ এমন দিকে গড়ালো যে, ইংরেজদের অনিচ্ছা সত্ত্বেবও ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে নতুন সরকারি সিদ্ধান্তে ‘বংগভংগ রদ' হয়ে পুনরায় যুক্তবাংলা ঘোষিত হল।
অনেকের মতে, বংগভংগের পক্ষে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এবং ময়মনসিংহের নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী যতটা আন্তরিক ছিলেন তৎকালীন অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ ততটা আন্তরিক ছিলেন না। বিশেষ করে আগা খানের ভূমিকা ছিলো এক্ষেত্রে সন্দেহজনক। ঘটনা প্রবাহের মাঝে ১৯০৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম লীগ' নামক সংগঠনের জন্ম হয়। বংগভংগ রদ হওয়ার কারণে মুসলমান সমাজের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বংগভংগের ফলে মুসলমানগণ বৃটিশ শাসনের সমর্থকে পরিণত হয়। কিন্তু বংভংগ সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়ায় তাদের মনে হতাশা দেখা দেয়। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হন। চতুর ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী মুসলমানদের এ মনোভাব আঁচ করতে পেরে তাদের সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশ্য ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করে। ১৯২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলার গবর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন ১৯২২ সালের ‘স্নাতক ডিগ্রি' প্রাপ্ত ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন, "I have already stated in public that in my opinion this university is Dacca's greatest possession and will do more than anything else to increase and spread the fame of Dacca beyond the limits of Bengal or even of India itself". এখানে উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন বৃটিশ সরকার পূর্ব বাংলার মুসলমানদের খুশি করা তথা তাদের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য আগ্রহী থাকলেও বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের এ কাজে সর্বদা বাধা সৃষ্টির কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সময় লাগে।
বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানদের অসন্তুষ্টি দূরীকরণ তথা মুসলমানদের ক্রম অগ্রসরমান আন্দোলন প্রশমনের জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা বৃটিশ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেন। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এসে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহী হন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দের একটি দল ভাইসরয়ের সাথে দেখা করে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার মাঝে ঢাকায় অন্ততঃ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ত্বড়িত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে তৎপর হয়। কিন্তু বর্ণহিন্দুগণ দারুণ বাধার সৃষ্টি করে এমনকি ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড: রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সাথে দেখা করে, বলেন, "The creation of a separate University at Dacca would be in the nature of an internal partition of Bengal". এমনকি তারা আরও অভিমত প্রকাশ করেন যে, "The Muslims of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a University". তবে এসব বলে তারা লর্ড হার্ডিঞ্জের ধারণা পাল্টাতে সক্ষম হননি। ফলে ভারত সরকার ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল এক পত্রে বাংলা সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক খতিয়ানসহ একটি পরিপূর্ণ স্কীম প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেন। ভারত সরকারের এ পত্রে এই মর্মে একটি নির্দেশও ছিল যাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের ধর্মীয় তাহজীব ও তমদ্দুন রক্ষায় সফল হয়। সেই লক্ষ্যে বলা হয়: "There might be a faculty of Arabic and Islamic Studies in the University".
পরবর্তীতে ১৯১২ সালের ২৭ মে ব্যারিস্টার আর নাথনিয়েলের নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। নাথান কমিটি শেষ পর্যন্ত একটা পূর্ণাংগ রিপোর্ট সরকারের নিকট পেশ করেন যা ১৯১৩ সালে সর্ব সাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয় এবং ঐ বছরের ডিসেম্বরে তা ভারত সরকার কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নানা কারণে বিশেষ করে আর্থিক সংকটের কারণে স্কীমটি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরে ভারত সরকারের প্রস্তাবে একটা সংশোধিত সর্বনিম্ন খরচের স্কীম পেশ হলে তা গৃহীত হয়। নানা কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ বিলম্বিত হতে থাকলে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ভারতীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং সরকারের পক্ষ হতে তাদের সদিচ্ছার কথা পূনব্যক্ত করা হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে নাথান কমিটি এবং ইতোমধ্যে গঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন যৌথভাবে মত পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সরকার শাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে না বরং তা হবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ভারত ও বাংলা সরকার এবং নাথান কমিটি এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্বববিদ্যালয় সব জাতির ও শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের জন্য উম্মুক্ত থাকবে। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য সেখানে একটি আরবী ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগ খোলা হবে। কমিশনের মতে, "We do not forget that the creation of the University was largely due to the demand of the Muslim community of Eastern Bengal for greater facilities for higher education." এ সময় শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানগণ এত পশ্চাৎপদ ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত কমিটিগুলোতে সদস্য করার মত মুসলিম শিক্ষাবিদ পাওয়া ছিল দুষ্কর। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এতদাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠে কলকাতাকে কেন্দ্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কালে পূর্ব বংগে মুষ্টিমেয় কয়েকটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এবং যেগুলো প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হত হিন্দু জমিদারদের দ্বারা। ফলে এ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা ছিল খুবই সীমিত। বাংলার মুসলিম সমাজ শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান গরিমায় সামনে অগ্রসর হউক তা বাংলার বর্ণহিন্দু শ্রেণীর বরদাশত হচ্ছিল না। ফলে তারা বংগ ভংগ রদ করেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি বরং ঢাকাতে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা দারুণভাবে বিরোধিতা করে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে বলতো: "Dacca University is Mecca University; fucca (hollow) University".
যাহোক শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার অবহেলিত বঞ্চিত মানুষেরা বিশেষ করে মুসলমানরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সক্ষম হয় এবং ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নেয় তা ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে আজ বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে। কায়েমী স্বার্থবাদীদের সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাভ করেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি, যশ ও মান। তাইতো একে বলা হয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ প্রাপ্ত হন মি. পি. জে. হারটগ সি.আই.ই। প্রথম রেজিস্ট্রার হিসাবে নিয়োগ পান খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদ এবং প্রথম ট্রেজারার নিযুক্ত হন মি. জে. এইচ. লিনডসে আই.সি.এস। একটা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয় যেখানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ স্থান পায়। শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন দেশী-বিদেশী নামকরা শিক্ষাবিদগণ যাদের অধিকাংশই ছিলেন অমুসলিম। বিভিন্ন ধার করা ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৬০০ একর জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। শুরুতে তিনটি হলের ব্যবস্থা করা হয় যেমন ঢাকা হল, মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল।
পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলের কম-বেশি জানা। আজ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় বৃটিশ যুগ এবং পাকিস্তানী আমল পার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে বসে দেশ ও জাতির খেদমত করে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনসহ সর্বশেষ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। তবে ইদানীং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে অতীত ঐতিহ্য পুরোপুরি রক্ষা করতে পারছে না। এ ব্যাপারে আমাদের সকলের দলমত, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে এগিয়ে আসা দরকার। যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন