শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি : যথেষ্ট নয় সাফাই গাওয়া



আহমদ আশিকুল হামিদ :
 ঝামেলা ভালোই পাকিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এমন এক সময়ে এসে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করেছে সংস্থাটি, জাতীয় সংসদে যখন বাজেট সবে পাস হয়েছে। অনেকে ধারণা করেছিলেন, এই বাজেটের বিরুদ্ধে বিরোধী দল সম্ভবত আন্দোলনে নামবে। আওয়ামী স্টাইলে হরতাল না করলেও দু-একটি মিছিল-সমাবেশ অন্তত করবে। অমন ধারণার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল। অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করতে না করতেই সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। যেসব পণ্যের ওপর নতুন কর ধরা হয়েছে সেগুলোর শুধু নয়, যেগুলোর ওপর কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলোরও দাম বেড়েছে। ওষুধ থেকে ইলেকট্রনিক সামগ্রী পর্যন্ত হেন পণ্যের নাম বলা যাবে না যেগুলোর দাম না বাড়িয়েছিল ব্যবসায়ীরা। আপত্তি উঠেছিল এজন্য যে, অর্থমন্ত্রীর তথা সরকারের দায়িত্ব কেবল বাজেট পেশ করা নয়, বাজারও নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী কেবল বাজেট পেশ করেই খালাস হয়ে গেছেন। এই সুযোগে পকেটের সঙ্গে মানুষের গলা কাটার ব্যাপারেও পাল্লায় নেমে পড়েছিল ব্যবসায়ীরা। সে পাল্লার তথা বাজেটের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য জনগণ যখন বিরোধী দলের দিকে আশায় তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল, ঠিক তেমন এক সময়েই বিশ্বব্যাংক হঠাৎ পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে বেঁচে গেছে শেখ হাসিনার সরকার (কে জানে, সব জেনে-বুঝেই বিশ্বব্যাংক ‘বাপের কাজ' করেছে কি না!)।
সঙ্গে সঙ্গে ময়দানে নেমে পড়েছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রথম দু-তিনদিন পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সোচ্চার দেখা যাচ্ছিল। তারপর দৃশ্যপটে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোনো একজনই রাগ গোপন করেননি, রাগ সামালও দিতে পারেননি। সাংবাদিকদের সামনে তো বটেই, জাতীয় সংসদেও তারা এমনভাবেই বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিশ্বব্যাংক বিএনপি বা জামায়াতের মতো বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল! বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিককে তো নাম ধরেই তুলোধুনো করেছেন তারা। শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছেন যেন রবার্ট জোয়েলিক তাদের কাছে দু-চার লাখ ডলার ঘুষ চেয়েছিলেন কিন্তু তারা রাজি হননি বলেই বিদায় নেয়ার আগে লোকটি ঋণ বাতিল করে গেছেন! বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম অবশ্য উল্টো কথাই শুনিয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তিনি তার পূর্বসুরীর সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুর নরম হয়নি ক্ষমতাসীনদের। বিশ্বব্যাংককে তুলোধুনো করার এবং এক হাত নেয়ার ব্যাপারেও যথারীতি অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। ৪ জুলাই জাতীয় সংসদের ভাষণে তিনি আগুন ঝরিয়েছেন।
ক্ষমতাসীনদের এমন প্রতিক্রিয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, বিশ্বব্যাংক শুধু তীরের কাছাকাছি এসে নৌকাই ডুবিয়ে দেয়নি, রাজনৈতিক অর্থে থাপ্পড়ও কষেই মেরেছে। জনগণের নাকের সামনে বহুদিন ধরে এই একটি মাত্র মূলার মতো মূলা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তাছাড়া টাকার পরিমাণও তো সামান্য নয়- ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। মে ও জুন মাসে চুক্তি হয়েছিল আইডিবি, এডিবি ও জাইকার সঙ্গে। সব মিলিয়ে ঋণ পাওয়া যেতো তিনশ' কোটি মার্কিন ডলারের মতো। বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণের পরও বিপুল পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শোনা গেছে, আওয়ামী লীগ নাকি নির্বাচনের তহবিলও এই টাকা থেকেই তৈরি করতো। সে সম্ভাবনা তো নস্যাৎ হয়েছেই, পাশাপাশি আবার কলংকের বিরাট একটা তিলকও লেগেছে। গোটা জাতি অসম্মানিত হলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের কারণ, তার কেবল সিঁদুর ও চন্দনের তিলক লাগানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুর্নীতির- তাও এত বড় দুর্নীতির তিলক তার জন্য হজম করা কঠিনই হওয়ার কথা! কিন্তু সেটাই লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এজন্যই সংসদে ভাষণ দেয়ার সময় খুবই উত্তেজিত দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীকে। কথায়ও তিনি সংযত থাকতে পেরেছেন বলা যাবে না। যেমন রাগে-দুঃখে বিশ্ব্যাংককে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। কিছু উদাহরণও দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্য করেননি যে, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অনেক পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত তথা স্বীকৃতও বটে। একই কারণে প্রশ্ন উঠেছে, সব জেনেও তারা কেন দুর্নীতিপরায়ণ একটি সংস্থার কাছেই ভিখেরীর মতো হাত পেতেছিলেন? এখানে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আনু মুহাম্মদের একটি কথার উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে যেসব পত্র লেখা হয়েছে, সেগুলো আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। কাকুতি-মিনতি ও হাতজোড় তাতে কম নেই। দুর্নীতির মধ্য দিয়ে যারা নৈতিকভাবে পরাজিত, দাসত্ব আর মেরুদন্ডহীনতাই যাদের সম্বল, তাদের গলায় জোর থাকবে কী করে?' (দৈনিক প্রথম আলো, ৪ জুলাই, ২০১২) অর্থাৎ ধাক্কা খাওয়ার ও অপমানিত হওয়ার পর লম্বা অনেক কথা বললেও ক্ষমতাসীনরা একই বিশ্বব্যাংকের কাছেই ভিক্ষার জন্য ‘হাতজোড়' করে আবেদন-নিবেদন করেছিলেন। টাকাটা পাওয়ার জন্য দেন-দরবারও তারা করেননি।
সংসদে দেয়া ৪ জুলাইয়ের ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী যথারীতি চারদলীয় জোট সরকারকে ধরে টানাটানি করেছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে পাকড়াও করতে চেয়েছেন। বিশ্বব্যাংক যে জোট সরকারের সঙ্গেও কয়েকটি চুক্তি বাতিল করেছিল সে কথাটা তিনি বিশেষ ইঙ্গিত সহকারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে তার সরকারের লজ্জা ও ব্যর্থতার সমালোচনা করার আগে বিরোধী দল মাত্র সেদিনের ইতিহাস মনে রাখে। কথাটার মধ্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ‘প্লাস পয়েন্ট' অর্জন করতে পারেননি। কারণ, শেখ হাসিনা যতো চিৎকার করেই বলুন না কেন, ইতিহাসের সত্য হচ্ছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলপ্রসূ উদ্যোগ প্রথমে নিয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ২০০৪ সালে জাপানী সংস্থা জাইকাকে দিয়ে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে বিস্তারিত সমীক্ষাও জোট সরকারই করিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছিল বিশ্বব্যাংক এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। জাইকাসহ অন্য দু-একটি সংস্থা ও রাষ্ট্রও পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছিল।
সংসদের ওই ভাষণে অন্য কিছু কথা বলেও তাক লাগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি নিজেই নিজের সার্টিফিকেট দিয়েছেন তিনি, এজন্য দুদকের সাহায্য নেননি। বলেছেন, তার পরিবার বলতে তিনি নিজে, বোন রেহানা এবং দু'জনের পাঁচ সন্তানকে বোঝায়। কথাটা কিন্তু না বললেও চলতো। কারণ, এটুকু সবই জানেন। জনগণ যা জানে না এবং যা জানতে খুবই আগ্রহী তা হলো, তার বোন রেহানা এবং সুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়সহ পাঁচ সন্তানের কে ঠিক কোন কাজ করেন অর্থাৎ তাদের আয় আসে কোত্থেকে? এমন প্রশ্নের কারণ, সবাই তারা বিদেশে থাকেন- কেউ লন্ডনে, কেউ ওয়াশিংটনে, কেউ আবার কানাডার টরন্টোতে। শোনা যায়, প্রত্যেকে থাকেনও আবার চরম বিলাসিতার মধ্যে, বিত্ত-বৈভবও নাকি যথেষ্ট। প্রশ্ন ওঠে, এত বিপুল টাকা তারা পান কোথায়? তাদের কেউই তো নাকি উল্লেখযোগ্য এমন কোনো চাকরি বা ব্যবসা করেন না, যা থেকে এত বিপুল টাকার আয় আসতে পারে। অন্য একটি প্রশ্নও উঠেছে। পরিবার সম্পর্কে জানানই যখন দিয়েছেন তখন প্রধানমন্ত্রীর একথাটাও জানানো উচিত ছিল, দু' বোনের ছেলেরা ঠিক কোন দেশের এবং কোন ধর্মের মেয়েদের বিয়ে করেছেন? ছেলের ও ভাগ্নের বৌরা কি সবাই মুসলমান নাকি ইহুদী ও খৃস্টান? বলা বাহুল্য, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেই বহুদিন ধরে এ ধরনের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কোনো জবাব দেননি। সে কারণে সত্য ও কল্পনা মিলিয়ে নানা কথাও প্রচলিত রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। 
ওদিকে অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীকে দিয়ে সাফাই গাওয়ানোর পর নিজে দৃশ্যপটে এসেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জনমনে আস্থা তৈরি করতে পারেননি। কারণ, যে-কোনো ব্যাখ্যা বা পর্যালোচনায় দেখা যাবে, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক বর্তমান সংকট ও লজ্জা-অপমানের জন্য সর্বতোভাবে দায়ী শেখ হাসিনার সরকার। সেতু নির্মাণের মাধ্যমে জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে নিজেদের আখের গোছানোর উদ্দেশ্য প্রধান হয়ে ওঠায় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। ঘুষ-দুর্নীতির পথে গোপন আয়োজনের মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক প্রতিষ্ঠানের দরপত্র বাতিল করে সরকার কাজ দিয়েছিল কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে। দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল তখনই। দুর্নীতির প্রথম তথ্য ফাঁস করেছিল দুনিয়া কাঁপানো ওয়েবসাইট ‘উইকিলিকস'। ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ‘উইকিলিকস' জানিয়েছিল, বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ‘সততায় ঘাটতি আছে'। সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠেছিল বিশ্বব্যাংক। অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও যোগাযোগ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ হারে ঘুষ দাবি করেছিলেন। ঘুষের এই বাণিজ্যে বিশেষ কারো কারো প্রবাসী স্বজনসহ প্রভাশালীদের নামও এসেছিল- যারা ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' করেছিলেন। বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক প্রথমে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিল। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা সে সময় অভিযুক্তদের পক্ষেই সাফাই গেয়েছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলে বসেছিলেন, টাকাই যেখানে আসেনি সেখানে ঘুষ খাওয়ার ও দুর্নীতি করার প্রশ্ন আসে কিভাবে? মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সততার সার্টিফিকেট দিয়ে দুদকও জবরই দেখিয়েছিল।
অসন্তুষ্ট বিশ্বব্যাংক তখন কানাডা সরকারকে তদন্ত করার আহবান জানিয়েছিল। গোপন তথ্যও তখনই ফাঁস হতে শুরু করেছিল। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন। এর দু'জন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাদের কাছ থেকেই জানা গেছে, যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবসহ তিনজন ১০ শতাংশ হারে ঘুষ দাবি করেছিলেন এবং এসএনসি-লাভালিনও ঘুষ দিতে সম্মত হয়েছিল। এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এক প্রয়াত ফুফাত ভাইয়ের ছেলে। ওয়াশিংটন ও লন্ডনসহ বিদেশে বসবাসরত বিশিষ্ট আরো জনাকয়েকের নামও প্রকাশিত হয়েছিল। এসব ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক তাগিদ দিয়েছিল সরকারকে। সংস্থাটি তাদের তদন্ত রিপোর্টও পাঠিয়েছিল। অন্যদিকে সরকারের পাশাপাশি দুদকও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাই চালিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সংস্থাটির রিপোর্টে যেহেতু ‘প্রভাবশালী' অনেকের নাম এসেছে সে কারণে দুদকের পক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। এজন্যই বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করেছে। বিশ্বব্যাংক কিন্তু কানাডীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘুষ-দুর্নীতিকেই একমাত্র কারণ বানায়নি। তথ্য-প্রমাণসহ বরং বলেছে, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি হয়েছে আরো অনেকভাবেই। একটি উদাহরণ হিসেবে সেতু নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কর্মকান্ডে চুরি, জালিয়াতি ও দুর্নীতির কথা এসেছে। পদ্মা সেতুর জন্য সরকার দু'হাজার ৭২০ দশমিক ৭৩ একর জমি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশেরও বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, পরিকল্পিত সেতুর এলাকা সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে নালজমিকে ভিটেবাড়ি হিসেবে দেখিয়ে, কোথাও একজনকে অন্যের জমির মালিক সাজিয়ে এবং কোথাও বা খাস জমিতে রাতারাতি বাড়িঘর নির্মাণ করেও বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। লোপাট করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন।
সর্বব্যাপী এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারই তাগিদ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবসহ দু-চারজন কর্মকর্তাকে বদলি করার বাইরে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। এর মধ্যদিয়েও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার কয়েকজন এবং বিদেশে বসবাসরত তাদের স্বজনরা দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় সরকার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়নি। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ৩০ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল করেছে। সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের অসহযোগিতার উল্লেখ করেছে। বলেছে, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা এবং কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা ও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ' পাওয়া গেছে। এসবের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের পরিচালিত তদন্তের দুটি রিপোর্ট ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ব্যাপারে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া ও জবাব ‘সন্তোষজনক' ছিল না। কোনো পদক্ষেপও নেয়নি সরকার। সে কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে ‘চোখ বুজে থাকা' সম্ভব হয়নি। যে কোনো প্রকল্প স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য বিশ্বব্যাংক তার দাতাদের কাছে দায়বদ্ধ বলেই সংস্থাটি পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল করেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য প্রচন্ড অসম্মান হিসেবেই এসেছে। এমন দুর্নাম জাতির ভবিষ্যতের জন্য শুধু ভয়ংকরই নয়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকেও অতি ধ্বংসাত্মক। যেহেতু বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে সরকার মনে করে, সেহেতু ক্ষমতাসীনদের উচিত বিশ্বব্যাংকের অসন্তোষ দূর করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠা। সত্যি পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সদিচ্ছা থাকলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং ওবায়দুল কাদেরের মতো ‘অতি যোগ্য' মন্ত্রীদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীরও উচিত জিহবা সামাল দেয়া। একই সঙ্গে সরকারের উচিত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ও দুটি রিপোর্টসহ প্রকৃত সকল ঘটনা প্রকাশ করা। দুর্নীতিতে জড়িত হিসেবে বিশ্বব্যাংক যাদের নাম বলেছে তারা কারা- সে পরিচিতি অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। অভিযুক্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারো স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা রয়েছেন কি না তা যেমন জানানো দরকার তেমনি দরকার অন্য একটি জিজ্ঞাসারও জবাব দেয়া- বিশ্বব্যাংক কেন ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' কথাটা বলেছে? এসবের জবাব না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গি-সাথীরা যদি নতুন পর্যায়েও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তিক্ততা বাড়াতে থাকেন তাহলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যাবে না। ক্ষমতাসীনরা আদৌ স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করবেন কি না সে বিষয়ে অবশ্য ইতোমধ্যেই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দলগুলো যখন জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন তুলেছে তখন জবাব দেয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা উল্টো দলীয় কর্মী ও ক্যাডারদের দিয়ে মিছিল করাচ্ছেন। তারা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হুংকার দিতে শুরু করেছে। জনগণ অবশ্যই এমন কর্মকান্ড দেখতে চায় না। প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে, তাদের দুর্নীতির কারণে মাটিতে মিশে যাওয়া দেশের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা না গেলে জাতিকেই শুধু মাথা নিচু করে থাকতে হবে না, অর্থনীতিও সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিজেরা সত্যি ‘ক্লিন' কি না সে কথাটা প্রমাণ করার জন্য হলেও শেখ হাসিনার উচিত অবিলম্বে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন