শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

জাতিরাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাগ্য নিয়ে তামাশা

সাদেক খান


সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শেষ মাস তথা এই ইংরেজি সালের জুন মাসটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগের। হাল আমলে নিত্যনৈমিত্তিক খুন, লাশ উদ্ধার আর গুমের খবরের মধ্যে জুন মাসের একুন ছিল ৪০৭ খুন, গুপ্তহত্যা বা গুমের লাশ ১২, ক্রসফায়ার বা র্যাব-পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ৫। দেরি করে পাওয়া খবরে ৩০ জুন খুন হওয়া ৯ লাশ উদ্ধার ওই হিসাবে আসেনি। ওই ৯ জনের মধ্যে ছিল ঢাকার নবাবগঞ্জে বিল থেকে উঠানো সাত বছরের মেয়ের লাশ, ফরিদপুরের সালথায় পাটক্ষেতে ফেলে যাওয়া নয় বছরের ছেলের লাশ, বড়াইগ্রাম আর ধামরাইয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অজ্ঞাত তরুণ-তরুণীর লাশ, চরফ্যাশনে সাগরে চুবিয়ে মারা জেলের লাশ, কুয়াকাটায় ছেলের হাতে খুন হওয়া বাবার লাশ, বালিয়াডাঙ্গা আর মিঠাপুকুরে যথাক্রমে যৌতুকের জন্য নির্যাতনে আর পরকীয়ার সন্দেহে দুই গৃহবধূ খুন আর ধামরাইয়ে জুয়ার টাকার ভাগ নিয়ে খুন হওয়া স্কুলছাত্রের লাশ। এভাবে প্রতিদিন গড়ে খুন হয়েছে ১৪ জনের বেশি। হিসাবে আরও ধরা হয়নি বেশকিছু লঞ্চ ও নৌকাডুবির মৃত্যু, অপঘাত মৃত্যুর সংখ্যাও ধরা হয়নি। যেমন ৩০ জুনেরই শুধু খবর : সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত চার, আহত দশ, বন্যার পানিতে ডুবে মরেছে দুজন, সেপটিক ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসে মৃত পাঁচ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরেছে একজন, ট্রেনে কাটা পড়ে একজন, আর আত্দহত্যা করেছে এক স্কুলছাত্র, চাঁদাবাজদের হামলায় আহত হয়েছে ১০ জন, আর সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হয়েছে এক ছাত্রনেতা।

জুনে সারা মাসে দেশে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪ জন নারী ও ৬৪ জন শিশু। সারা দেশে একজন সাংবাদিক নিহত ও ১৪ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। এ ছাড়া ৩২ জন ইভ টিজিং এবং আটজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। ওদিকে হঠাৎ বন্যায় আর ভারতের আসাম-মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির ঢলে নদীস্ফীতিতে অস্থির দেশের এক-পঞ্চমাংশ। মফস্বলে জলাবদ্ধতায় পানিবন্দী মানুষ বিপন্ন, রাজধানীতে মহানগরগুলোতে খাবার পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের হাহাকার। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী নির্বিকারচিত্তে একটা মনগড়া বিশাল ঋণনির্ভর বাজেট পেশ করে দলীয় এমপিদের বাহবা কুড়ালেন, যারা হাততালি দিলেন তারাও জানেন ওই বাজেট বাস্তবায়ন হবে না, গলাবাজি আর ভোটারদের মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার বুলি জোগাবে মাত্র। আর সাধারণ মানুষের ভাগ্যে বাজেট পেশের দিন থেকেই শুরু হলো বিড়ম্বনা। বাজেট প্রস্তাব পেশের দিন যে দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করেছে, তা আর থামার লক্ষণ নেই। বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে শেয়ারবাজারে দরপতনের কোনো প্রভাব অর্থনীতিতে বর্তায় না বলে তিনি যে ফতোয়া দিলেন, তার ফলে সারা মাস শেয়ারবাজারের অধঃপতন আর থামল না। শেয়ারবাজার ডুবলেও বাজেটে যে কালো টাকা বিনিয়োগ (আর কালো টাকা তৈরিরও) ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে 'অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হতে চলেছে' বলে আপ্তবাক্য শোনালেন অর্থমন্ত্রী। আর যত দোষ নন্দ ঘোষ এই থিওরি অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদরা বলতে থাকলেন : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই উন্নয়ন, আর বিএনপি দেশকে শুধু হত্যা, ষড়যন্ত্র আর লাশ উপহার দিতে পারে, পদ্মা সেতুতে গোড়ায় বিএনপি-ই দুর্নীতি করেছিল বলে বিশ্বব্যাংকের অনুদান বন্ধ ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তির গেরো খুলেছে। এমন সময় নতুন সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শেষ দিনে বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, 'বিনা মেঘে বজ্রপাত' ঘটাল বিশ্বব্যাংক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশকদের অনলাইনে এবং বিবিসি রেডিও টেলিভিশনে ৩০ জুন ভোরে বহুভাষিক বিশ্বসংবাদে দুনিয়াকে জানান দেওয়া হলো_ বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক যে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল, দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দীর্ঘ বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সেই ঋণ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে জারি করা বিশ্বব্যাংকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় ওই ঋণচুক্তি বাতিল করা হয়েছে। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের মধ্যে যোগসাজশে বিভিন্ন সূত্র থেকে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের হাতে এসেছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে এসব তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়। তাদের প্রদত্ত তথ্য-প্রমাণ সম্পর্কে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছিল বিশ্বব্যাংক। বলেছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সরিয়ে দিতে এবং অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করতে। বিশ্বব্যাংকের এই অবস্থান ব্যাখা এবং বাংলাদেশ সরকারের জবাবের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিল না। বিশ্বব্যাংক একটি প্রকল্পে তখনই অর্থায়ন করতে পারে যখন তারা সেই প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যক্রমের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। 

এমন 'বজ্রাঘাতেও' সবজান্তা অর্থমন্ত্রীর বাক পারুষ্যের দম কমেনি। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল ঘোষণার সাত দিন আগে বুকের পাটা জাহির করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বললেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আমি কোনো বক্তব্য রাখতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে পারি, অপ্রমাণিত বিষয় নিয়ে (দুর্নীতির) কথা উঠছে। আমি একসময় বিচারিক হাকিমের দায়িত্ব পালন করেছি। তাই জানি, প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলা যায় না। প্রমাণ ছাড়া কারও নাম প্রকাশ করা নির্বুদ্ধিতা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তদন্তের) ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না। কিছু এলে ওখানেই পাঠিয়ে দেই। তবে আমি এ কথা বলব, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়ে একটি অভিযোগও আসেনি। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চুক্তিই অনুমোদন করে রেখেছে। কিন্তু কাজ বন্ধ। যেহেতু সবার একসঙ্গে কাজ করার কথা।

শেয়ারবাজার নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কমিটির প্রতিবেদনেও কিছু নাম এসেছিল। কিন্তু সাক্ষী নেই। একই জিনিস হয়েছে পদ্মার বেলায়। কিছু নাম এসেছে। প্রমাণের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রমাণ আমার কাছে নাথিং (কিছুই না)। 

এখন পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর তিনি কয়দিন ধরে সকালে এক কথা, বিকালে এক কথা, আজ এক রায়, কাল আরেক রায় দিয়ে চলেছেন, যার মূল কথা তার কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কোনো দোষ নেই। সব দোষ বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রধান কর্মকর্তা রবার্ট জোয়েলিকের। নতুন প্রধান কর্মকর্তা মি. কিমের কাছে চিঠি লিখে তিনি সব ঠিক করে ফেলবেন। প্রথমেই তিনি বললেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি 'সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য'। বিশ্বব্যাংকের কায়দা-কানুন রীতিনীতি বা ভেতরের খবর তার নখদর্পণে এমন এক ভঙ্গি নিয়ে তিনি বললেন, (বিশ্বব্যাংকের) বিবৃতিতে যে ভাষা এবং ভাব ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক সে রকম বিবৃতি তাদের কোনো সদস্য দেশ সম্পর্কে দিতে পারে কি না, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, এটি বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য নয়। এটি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী সভাপতি রবার্ট জোয়েলিকের ব্যক্তিগত মন্তব্য। পরদিন কিছুটা স্বর খাটো করে 'পদ্মাসেতু বিষয়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে সরকারের বক্তব্য' পেশ করতে গিয়ে তিনি বললেন, 'বিশ্বব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করে পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি দস্তখত করেছিল, সেটি বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে একটি অভিযোগ করা হয়েছে, একটি দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এতে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চেয়েও তারা পায়নি।

শনিবার আমি এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রদানের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছি এবং সে জন্য তাদের বিজ্ঞপ্তিটি অগ্রহণযোগ্য মনে করেছি। আমি আরও বলেছি, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা তুলে ধরেছে এবং সে সম্বন্ধে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেইনি'_ এ কথাটিও সঠিক নয়। তার পর পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বিগত বিএনপি সরকারের দুর্নীতির কারণেই বন্ধ রেখেছিল, সরকারিভাবে এই দাবি করে তার প্রচেষ্টায় কি করে ঋণচুক্তি সম্পাদিত হলো সেই কৃতিত্বের বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের কাছে বার্তা দিলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও রহস্যজনক। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি জারি করা অসম্মানজনক। বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমরা তাদের পুনর্বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করব। 

পরদিন জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিয়ে আবারও বিশ্বব্যাংকের ওপর দোষারোপ করে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, আমি জোরগলায় বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোথাও কোনো অপচয় বা দুর্নীতি হয়নি। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, এই অর্থবছরেই আমরা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করব। বিশ্বব্যাংক অসমর্থিত বা অসম্পূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশকে এভাবে অপবাদ দিতে পারে না বা সে দেশের জনগণের মর্যাদাহানি করতে পারে না। 

অর্থমন্ত্রীর কর্তৃত্বাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে সাংবাদিকদের বেনামি ব্রিফিং দেওয়া হলো_ পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমই এখন ভরসা, এ ভাবনা মাথায় রেখে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে। কিন্তু সেই আশারও বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বিশ্বব্যাংকের নয়া প্রধান জিম ইয়ং কিম ৩ জুলাই সরাসরি বলে দিয়েছেন, পদ্মা সেতু বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের মঙ্গলের বিষয়ে আমরা সজাগ। কিন্তু বিশ্বব্যাংক কখনো দুর্নীতি সহ্য করে না। সেটাও দেখতে হবে।

দেশবাসীর প্রতিক্রিয়ার নমুনা প্রতিবেদনে এক সংবাদ ভাষ্যকার লিখেছেন, এক বছর ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর সরকার যে অবস্থান নিয়েছিল বা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে বলে দাবি করেছে, তা আমাদের জনগণের কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম, আমাদের 'স্বাধীন' দুর্নীতি দমন কমিশন পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে খুবই দ্রুততার সঙ্গে একটি তদন্ত করল। এত দ্রুত এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক দুর্নীতির তদন্ত করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার 'সক্ষমতার' জন্য 'করিৎকর্মা' হিসেবে আমরা দুদকের প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু তদন্তের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নয়। ফলে দুদক যে তদন্ত করেছে এবং যে রায় দিয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের কাছেই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বিশ্বব্যাংক তো অনেক পরের ব্যাপার!

দুর্নীতির তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তিনটি শর্ত, সন্দেহভাজনদের সাময়িক 'ছুটি' (বরখাস্ত নয়) দিয়ে দূরে রাখা, দুদকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ টিম গঠন করা এবং বিশ্বব্যাংক নিযুক্ত একটি উপদেষ্টা প্যানেলকে তদন্তের সর্ববিষয়ে অবহিত রেখে পরামর্শ নেওয়া, সে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী সংসদে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছেন, এ প্রস্তাবগুলোতে সমস্যা হচ্ছে যে, আমরা কোনো কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই দুর্নীতির দায় স্বীকার করে নিচ্ছি।

প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যে কোনো দুর্নীতির তদন্তে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম যে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের তদন্তের স্বার্থে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে দুর্নীতি স্বীকার করে নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে দুদকের তদন্ত যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, বিষয়টি যে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিশেষভাবে তদন্ত করা উচিত, সে দাবি তো দেশের ভেতর থেকেই উঠেছে। আর আন্তর্জাতিক যে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে এবং যে প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তারা সেখানে স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এ তিনটি শর্তের ভিত্তিতে তদন্ত করে যদি প্রমাণ করা যেত বাংলাদেশে কোনো দুর্নীতি হয়নি, সেটাই কি সবচেয়ে ভালো পথ ছিল না? বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশ অপমানিত হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই অপমানের দায় কার? অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমি জোরগলায় বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোথাও কোনো অপচয় বা দুর্নীতি হয়নি। তা-ই যদি হয়, তবে দেশের ভেতরেই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে যে বিচারিক তদন্তের দাবি উঠেছে, তা মানতে সমস্যা কোথায়?

এসব প্রশ্নের সদুত্তর নেই। তবে মিডিয়ায় বাগযুদ্ধে মোটেও পিছপা হননি অর্থমন্ত্রী ও অন্যান্য ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীরা। যোগাযোগমন্ত্রী বললেন, পদ্মা সেতু নিয়ে 'চমক' আছে, 'সারপ্রাইজ'-এর অপেক্ষা কর। পরে বিশ্বব্যাংকের নয়া প্রধান জিম ইয়ং কিমের মুখে 'ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক' এ কথা শোনার পর যোগাযোগমন্ত্রী বললেন, 'সারপ্রাইজ' কথাটা বলা ভুল হয়েছে। বিরোধী দলনেতা বেগম জিয়া সাফ বললেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার জড়িত বলেই এত গড়িমসি, পদ্মা সেতু হতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে এক আওয়ামী শীর্ষ নেতার হুমকি_ ওই কথা ফিরিয়ে নিন, না হলে সারা দেশে জেলায় জেলায় একসঙ্গে দলের ওস্তাদ মামলাবাজরা মানহানির মামলা ঠুকে হয়রানির চূড়ান্ত করবে। বিএনপির এক শীর্ষনেতা জবাবে বললেন, মুরাদ থাকে তো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করুন। দেশের লোক ভাবছে, জাতিরাষ্ট্রের ভাগ্য নিয়ে কি তামাশা ফেঁদেছে রাজনীতিকরা!

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন