॥ গোলাপ মুনীর ॥
যারা আওয়ামী লীগ করেন, তিনি নেতাই হোন কিংবা হোন কর্মী-সমর্থক, তাদের একটি বদ্ধমূল ধারণাÑ তারাই হচ্ছে এ দেশের অভিজাত সম্প্রদায়, বাকিরা সব হীন-নীচু-অস্পৃশ্য। এ দেশে যা কিছু ভালো, তার সবই করেছে এবং করে আওয়ামী লীগ। আর যারা অন্য দল করে তারা কখনোই কোনো ভালো কাজ করতে পারে না। আওয়ামী লীগ মনে করে, সে দলটি যারা করে তারাই এ দেশের মুক্তিযোদ্ধা, বাকিরা স্বাধীনতাবিরোধী। অনেক নেতা আছেন, যারা প্রতিদিন আওয়ামী-বহির্ভূতদের স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিবাজ ইত্যাদি বলে কষে গালাগাল না দিলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। আওয়ামীপন্থীরা স্বীকার করতে চান না, দলমত নির্বিশেষে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে অর্জিত হয়েছে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই তো এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে যার পরিচয় স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব সূচনায় যার অবদান অসমান্তরাল, সেই জিয়াউর রহমানকে আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই মানতে নারাজ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে তাই আমাদের শুনতে হয়Ñ জিয়া মুক্তিযোদ্ধা নন, স্বাধীনতার ঘোষক নন, ছিলেন পাকিস্তানের চর। ইতিহাস চুরি আর কাকে বলে!
আওয়ামী নেতাদের এ ধরনের একটি ইতিহাস চুরির এক অবাক করা কাণ্ড সম্প্রতি পবিত্র জাতীয় সংসদে ঘটিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। তিনি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘বিএনপি ভারতের সাথে একটিও পানিচুক্তি করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম ভারতের সাথে গঙ্গার পানিচুক্তি করেছে।’ তার এই বক্তব্য শুনে মানুষ হেসেছে। কারণ দেশের মানুষের স্মরণশক্তি এতটা ভোঁতা হয়ে যায়নি যে, বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ভারতের সাথে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তিটির কথা বেমালুম ভুলে যাবে। আমরা শুনে অবাক হই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দীপু মনি কী করে এমন একটি রাষ্ট্রীয় প্রকাশ্য ও বহুল আলোচিত চুক্তির কথা অস্বীকার করতে পারলেন। আমরা জানি না, এটি তার নির্জলা কোনো মিথ্যাচার, না অজ্ঞতা?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ভুলে গেলেও দেশের মানুষ ভালো করেই জানে, ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। তাই এ দেশের মানুষ মনে করে, দীপু মনির এ বক্তব্য লাগামছাড়া একটি বক্তব্য। এই লাগামছাড়া বক্তব্য দিতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক নেতাই যে বেশ অভ্যস্ত, তা আজ সবাই স্বীকার করেন। সে যা-ই হোক, দীপু মনি জিয়াউর রহমানের আমলে সম্পাদিত যে চুক্তিটির অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চাইছেন, সেটিকে এ দেশের মানুষ সবচেয়ে কার্যকর পানিবণ্টন চুক্তি বলেই জানে। কারণ পাঁচ বছর মেয়াদি এ চুক্তিতে গ্যারান্টি কজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু দীপু মনি ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সম্পাদিত যে চুক্তি নিয়ে গর্ব করতে চাইছেন, যে চুক্তিতে যেমনি ছিল না কোনো গ্যারান্টি কজ, তেমনি ছিল অনেক ফাঁকফোকর। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির আরো জানা দরকার, জিয়ার আমলে সম্পাদিত গঙ্গাচুক্তিতে গ্যারান্টি কজ থাকার কারণে তখন বাংলাদেশ এর মাধ্যমে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় নিশ্চিত করতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের চুক্তির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা যায়নি এই গ্যারান্টি কজের অভাবে। আমরা আরো জানি, জিয়ার আমলের পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে জেনারেল এরশাদের আমলে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে দুইবার ভারতের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই সমঝোতা স্মারক অনেকটা চুক্তির মতোই। অতএব ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানিবণ্টন ছাড়া বিএনপির আমলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কোনো পানিচুক্তিই হয়নি, এমন বক্তব্য কী করে মেনে নেয়া যেতে পারে!
১৯৭৭ সালটি কোনো দূর অতীত নয়। তখন এই চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন পানি বিশেষজ্ঞ বি এম আব্বাস। তখন পানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার নাম-ডাক ছিল প্রবাদসম। তিনি ‘ফারাক্কা ব্যারাজ ও বাংলাদেশ’ শিরোনাম দিয়ে একটি বইও লিখে গেছেন। এই বইটিতে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের করা পানিবণ্টন চুক্তির প্রেক্ষাপটসহ এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। আমাদের দীপু মনির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই বইটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না, তেমনটি ভাবতেও অবাক লাগে।
এই বইটিই আমাদের জানিয়ে দেয়, ১৯৭৭ সালের গঙ্গাচুক্তি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ চুক্তি সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের তদানীন্তন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দুই সরকারের প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ও মি. মোরারজি দেশাইয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও দৃঢ় সঙ্কল্পের জন্য। গঙ্গার পানিবণ্টন বিষয়ে এটিই দুই দেশের মধ্যে প্রথম পানিচুক্তি। চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইন্দিরা গান্ধী ভারতের ক্ষমতায় ফিরে আসেন। চুক্তিটি নবায়ন করার পরিবর্তে একটি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে পানিবণ্টন ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। কিন্তু স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের প্রাপ্য ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য যে গ্যারান্টি কজ ছিল তা বাদ দেয়া হয়।
পানি বিশেষজ্ঞ বি এম আব্বাস আমাদের আরো জানিয়েছেন, ১৯৭৪ সালে ফারাক্কার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে ভারত গঙ্গার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। পরীক্ষামূলক যে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করা হয়, সে বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে থাকে। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইন্তেকালের পর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত পানি প্রত্যাহার পুরোদমেই অব্যাহত রাখে। এতে বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালের শুকনো মওসুমে এক গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে জেনারেল জিয়াউর রহমান বিষয়টি জাতিসঙ্ঘে নিয়ে যান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি জাতিসঙ্ঘে উত্থাপিত হয়। জাতিসঙ্ঘ বিভিন্ন পর্যায়ে ও কমিটিতে আলোচনার পর কয়েকটি জোটনিরপেক্ষ দেশের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও ভারত একটি সমঝোতা বিবৃতিতে সম্মত হয়। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত গঙ্গাচুক্তিতে ভারত গঙ্গা নদীর আন্তর্জাতিক চরিত্র স্বীকার করে নেয় এবং আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষম বণ্টনের নীতিতে সম্মত হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই চুক্তিতে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টনের স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা ও শুকনো মওসুমে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। বাংলাদেশের পানি পাওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চুক্তিতে এই মর্মে একটি ধারা সংযুক্ত করা হয়। ফারাক্কায় গঙ্গার পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে বাংলাদেশকে যে পানি দেয়া হবে, তা চুক্তিতে নির্দেশিত পরিমাণের ৮০ শতাংশের কম হবে না।
১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে। এই সময়ে পানিবণ্টন নিয়ে ভারতীয় মনোভাব আগের চেয়ে আরো কঠিন হয়। এবং পানি আলোচনায় এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হন। পরের বছরের ২৪ মার্চ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭৭ সালের গঙ্গার পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১৯৮২ সালের ৪ নভেম্বর।
এই চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি। ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর নতুন দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এই স্মারক পরবর্তী দুই শুকনো মওসুমের জন্য ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন ব্যবস্থা রাখা হয়। এবং যৌথ নদী কমিশনের ১৮ মাসের মধ্যে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বাড়ানোর প্রশ্নেও সুপারিশ পেশের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৮২ সালের স্মারকের মেয়াদ শেষ হয় ১৯৮৪ সালের ৩১ মে। কিন্তু ভারত তা নবায়নে রাজি হয়নি। উল্টো ১৯৮০ সালের শুকনো মওসুম থেকে ভারত তাদের ইচ্ছেমতো পানি প্রত্যাহার করতে থাকে। তবে এ বছর গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাক্ষরিত হয় পানিবণ্টন সম্পর্কিত সর্বশেষ চুক্তিটি।
এই হলো ভারতের সাথে বাংলাদেশের গঙ্গার পানিবণ্টন সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই ইতিহাস অস্বীকার করে দীপু মনি যা করেছেন, তাকে কী বলা যায়? এটি কি কোনো মিথ্যাচার, না, জেনেও না জানার ভান করা? কিন্তু দীপু মনিকে উপলব্ধিতে রাখতে হবে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, সত্যকে অসত্য বলে প্রমাণ করা, কার্যত নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই শামিল।
সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে তার এক বক্তব্যের মাধ্যমে বাস্তবতাকেই অস্বীকার করতে দেখা গেছে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে ১০ সিটও পাবে না। এ ধরনের বক্তব্যে বাস্তবতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া যে নেই, তা যে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সব সময় দাবি করে, এ দেশে একমাত্র আওয়ামী লীগই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়, বাকি দলগুলো দেশে নিয়ে আসে অবৈধ, সংবিধানবহির্ভূত সামরিক শাসন। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের সামনে হাজির করে অন্য চিত্র। বেগম খালেদা জিয়া যখন বিরামহীনভাবে অবৈধ সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে প্রায় ৯ বছর একাই লড়াই করে আপসহীন নেত্রীতে পরিণত, তখন শেখ হাসিনা ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’ বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন এরশাদের ক্ষমতা দখলকে। পাশাপাশি এরশাদ আমলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যত স্বৈরশাসনকেই দীর্ঘায়িত করার সুযোগ করে দিয়েছে। তা ছাড়া শেখ হাসিনা মইনউদ্দিন-ফকরুদ্দীনের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে কার্যত গণতন্ত্রকেই ঠেলে দিয়েছিলেন পেছনে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ বাকশালী একনায়কতন্ত্র চালু করেও কি গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরেনি?
সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিদার আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার কতটুকু সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তা এ দেশের মানুষ দেখে চলেছে। গলাবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি কোন মাত্রায় কতটুকু চলছে, তা মাপার ক্ষমতা এ দেশের মানুষ রাখে।
মানুষ বোঝে এ সরকার মৌল সমস্যা সমাধানে মনোযোগী না। মনোযোগী শুধু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে। যদি তা না হতো, আজ আমাদের এমন সব খবর পড়তে হতো না যেÑ দেশের ৫০ শতাংশ শিশু মারা যাচ্ছে পুষ্টির অভাবে; প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলাকায় ভাত নেই, পানি নেই সর্বত্র হাহাকার; বাজার চলে গেছে সিন্ডিকেটের দখলে, মন্ত্রী-সচিবের দুর্নীতির কারণে বন্ধ হলো পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ইত্যাদি ধরনের হাজারো উদ্বেগজনক খবরের শিরোনাম।
আসলে যেকোনো সরকারের সাফল্য নির্ভর করে, সে সরকার কতটুকু বাস্তবতা স্বীকার করতে প্রস্তুত, সে সরকার কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা বলতে চায় কি না, সে সরকার সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী চিন্তাধারা থেকে কতটুকু ওপরে উঠতে পারল; সে সরকার জনগণকে কতটুকু আস্থার মধ্যে রাখতে পারল এবং সর্বোপরি সে সরকারের উপলব্ধিতে দেশ-জাতি-সমাজচিন্তা কতটুকু প্রবল ইত্যাদির ওপর। অন্য কিছুর ওপর নয়। তাই আসুন কালোকে কালো বলি, আর সাদাকে সাদা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন