॥ আযম মীর ॥
আশরাফ, হানিফ, কামরুলের পর সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগের মুখপাত্রদের তালিকায় নতুন একটি নাম সংযোজিত হয়েছে। কয়েক দিন আগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ হাসিনা নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক যুবলীগ নেতা ও এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানককে। তিনি এখন চেষ্টা করছেন পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হতে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে যখন বাংলাদেশের নাম ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তটস্থ, তখন নানক বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। কারণ বেগম জিয়া অভিযোগ করেছেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত। নানকের দাবি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খালেদা জিয়া তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে সারা দেশে মামলা করা হবে। এ মামলা কারা করবে তা-ও তিনি ঘোষণা করেছেন। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কর্মীরাই এ মামলা করবে।
এমন মামলা সারা দেশে করা হলে কী হবেÑ নানক বিলক্ষণ জানেন। তিনি চান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমন জারি হোক, তিনি সারা দেশে ঘুরে ঘুরে হাজিরা দিয়ে বেড়ান। কিন্তু এরপর যখন শত মুখে এই অভিযোগ উচ্চারিত হবে, তখন কী করে সামলাবেন নানক? ক’জনের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। মুখ বন্ধ করবেন কতজনের?
অনেক রাখঢাক করার চেষ্টা তো হয়েছিল। শেষ রক্ষা তো হলো না। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগসংবলিত চিঠির সবটাই তো গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেছে। এ জন্য সরকার যারপরনাই ক্ষিপ্ত। ক্ষিপ্ত দুদকের ওপর। সরকারের ধারণা, দুদক থেকেই তথ্য ফাঁস হয়েছে। মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালকের ১০ শতাংশ ঘুষ দাবিসহ আর যেসব অভিযোগ এবং যাদের নাম চিঠিতে আছেÑ সবই ফাঁস হয়ে গেছে। নখদন্তহীন দুদক তাই বেজায় ক্ষিপ্ত মিডিয়ার ওপর। এর আগে কেউ কোনো দিন যা করতে সাহস পায়নি, দুদক তাই করে বসেছে। দুদকে মিডিয়াকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমতিপত্র বা পরিচয়পত্র নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো দফতরে প্রবেশে বাধা নেই। তথ্য অধিকারের এ যুগে দুদক গণমাধ্যমকে কোথায় সঠিক তথ্য জানাবে, তা না করে গণমাধ্যমকেই দুদকে নিষিদ্ধ করেছে। এই গণমাধ্যমকেই দুদকের যে সবার আগে দরকার তার প্রমাণ দিতে বেশি সময় লাগেনি। এক সপ্তাহের মধ্যেই দুদক গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হয়েছে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতির প্রতিবাদ করতে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়া বিবৃতির এক দিন পর দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। গণমাধ্যমকর্মীরা পেশাদার। তাই ঠিকমতোই হাজির হয়েছিলেন সবাই। যথাযথভাবে দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য প্রচারও করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাকোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব জব্ধ ও ভ্রমণবৃত্তান্ত সংগ্রহের কথা বলেছিল। সেই সাথে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তকালে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের উপস্থিত রাখার দাবি জানিয়েছিল। এসব দাবি পূরণ নাকি দুদক আইনে করা সম্ভব ছিল না। দুদক চেয়ারম্যানের কাছে গণমাধ্যমকর্মীরা বারবার জানতে চেয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত তথ্য। তখন নানা অজুহাত ও গোপনীয়তার কথা বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ এখন দুদক সেসব তথ্যই দিচ্ছে সব হারানোর পর। দুদক চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক, অনভিপ্রেত ও অন্যায্য’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। দুদক কি এমন মন্তব্য করতে পারে? না তার এখতিয়ার? এ বিষয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ার সরকারের থাকতে পারে, দুদকের নয়। দুদক শুধু তার তদন্ত সম্পর্কিত বিষয় নিয়েই প্রতিক্রিযা জানাতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি, দুদকের ভূমিকা একটি সরকারি সংস্থার মতো। এর চেয়ারম্যান সরকারি আমলা বা মন্ত্রীদের মতো রাজনৈতিক আচরণ করেছেন। এখন অভিযোগের কাঠগড়ায় সরকারের পাশাপাশি দুদকও। এখন দুদক যতই সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করুক, তার ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল এমন দাবি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব নয়। প্রশ্নবিদ্ধ এই ভূমিকার জন্য ভবিষ্যতেও দুদকের বর্তমান দায়িত্বশীলদের একসময় জবাবদিহি করতে হতে পারে।
একের পর এক ভুল
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যখন চিঠি দিলো, তখন তিনি একে ‘বোগাস’ ইত্যাদি শব্দ ছুড়ে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন মনে হয়েছিল, বিশ্বব্যাংককে সরকার থোড়াই কেয়ার করে। ব্যাপারটাকে বিশিষ্টজনেরা ভালো চোখে দেখেননি। তারা বলেছিলেন, অভিযোগগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করতে এবং প্রতিটি অভিযোগের জবাব থাকলে তাও বিশ্বব্যাংককে দেয়ার পাশাপাশি জনগণকে জানাতে। এতে জনগণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হতো। ভারতের সাম্প্রতিক থ্রিজি টেলিকম কেলেঙ্কারি বা অতীতের বোফর্স কেলেঙ্কারির সময় তাই করা হয়েছিল। যাদের নাম এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিল, তারা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে বা তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও একই রেওয়াজ। ভিন্নতা করা হলো পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে। বিশ্বব্যাংকের সাথে আমাদের দাতাগোষ্ঠী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয় সারা দুনিয়া জানে। সেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গ্রামীণ ব্যাংক প্রশ্নে সরকার বিরোধে জড়িয়েছে অনেক আগেই। কূটনীতির ঘোরপ্যাঁচ খুব বেশি না বুঝেও যেকেউ বলতে পারে, বাংলাদেশের মতো পরনির্ভরশীল একটি গরিব দেশের কোনো সরকারের পক্ষে খুব বেশি দেমাগ নিয়ে চলা কঠিন। বিশেষ করে নিজেদের কোনো অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা যদি থাকে। বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করল, তখনই সরকারের উচিত ছিল এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব যাচাই করা। তাদের কোনো ভূমিকা আছে কি না তার খোঁজখবর করা। সেসব না করে বিশ্বব্যাংককেই চ্যালেঞ্জ করে বসল সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কঠোর সমালোচনায় নামলেন। অর্থমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা তারচেয়ে বেশি কঠোর ভাষায় বিশ্বব্যাংকের মুণ্ডুপাত করা শুরু করেছিলেন। এমনকি সরকার চুক্তি বাতিলের উদ্যোগও গ্রহণ করে। পাশাপাশি বিকল্প সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মালয়েশিয়ার একটি সংস্থার সাথে এ জন্য সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বব্যাংককে প্রমাণ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক যখন তথ্য-প্রমাণ পেশ করল, তখন প্রথমে তা গোপন করে সরকার। পরে বিষয়টি প্রকাশিত হলে অর্থমন্ত্রী বললেন, কোনো প্রমাণ এতে নেই। তার পরও দুদককে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। দুদক অবশ্য তার আগেই একদফা তদন্ত করে ঘোষণা করেছে, কোনো দুর্নীতির প্রমাণ মেলেনি। তথ্যপ্রমাণ যা-ই দিক না কেন, সরকারের নাকউঁচা ভাব কিন্তু আগের মতোই ছিল। সেই আগের মতো থোড়াই কেয়ার মনোভাব। সরকার হয়তো ভেবেছিল, হুমকি-ধমকি দিলে বিশ্বব্যাংক আর সামনে এগোবে না। অর্থ না দিলে না দিক। সরকার এই ঝামেলাটির রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার দিকটি যে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি, তা নেতানেত্রীদের কথাবার্তা থেকেই স্পষ্ট ছিল। সময় থাকতে এ ঝামেলার নিষ্পত্তি সরকার করেনি। সরকারের বাঘা বাঘা উপদেষ্টারা কী করেছেন তাও বোধগম্য নয়। অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো বিশ্বব্যাংক বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করল, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করেছে। দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়ার কথাও জানায় বিশ্বব্যাংক।
এই বিবৃতি দেয়ার সাথে সাথে অর্থমন্ত্রী মুহিত অগ্রপশ্চাৎ ভেবেছেন কি না বোধগম্য নয়। তিনি একে বিশ্বব্যাংক নয়, সংস্থার সাবেক প্রধানের বিবৃতি বলে মন্তব্য করে বসেন। সোমবার তিনি সংসদে দেয়া বিবৃতিতেও বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্টকে দোষারোপ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যারা অবহিত, তারা সহজেই বুঝবেন এ বিবৃতি কতটা আত্মঘাতী। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য আরো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘কুচ পরোয়া নেহি।’ আমরা এর চেয়েও কম টাকায় সেতুর অর্থায়নের ব্যবস্থা করব।
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত শুধু দুঃখজনকই নয়, রহস্যজনকও। অভিযোগ আসা মানেই দুর্নীতি প্রমাণ হয়ে যায় না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, এ প্রকল্পে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মিলেছে।
অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আগের সব প্রতিক্রিয়ার মতো যে আবেগপ্রসূত ছিল, তা বোঝা যায় দুই দিন পরের বক্তব্যে। রোববার দুই উপদেষ্টা ও পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী একটু সুর নরম করে বিশ্বব্যাংককে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে সংস্থায় নিয়োজিত নির্বাহী পরিচালক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান। মন্ত্রী জানান, দুর্নীতি তদন্তের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংককে ছয়টি চিঠি দিয়েছে। তিনি চিঠিগুলো প্রকাশ করেন। এ দিন তিনি আর বলেননি যে, বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিটি সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়োলিকের নিজস্ব। আর ওবায়দুল কাদের তার আগের বক্তব্য সংশোধন করে বলেছেন, মালয়েশিয়া সেতু নির্মাণে যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে খরচ বাড়বে না কমবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। এ ইস্যুতে সরকারি নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য আগাগোড়া স্ববিরোধিতায় পূর্ণ এবং সমন্বয়হীন। বিষয়ের গভীরতা আঁচ না করেই সরকার বিশ্বব্যাংকের সাথে লড়াইয়ে নেমে এমন এক বিরাশি শিককার ঘা খেয়েছে যে, এর চোট সামলাতে পারছে না।
ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘটনাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটল সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে। সরকার যতই নিজেদের নিষ্কলুষ দাবি করুক, বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করতে পারবে না। আগামী নির্বাচনে এটি নিঃসন্দেহে একটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। আর গুজবের এই দেশে তার যে কত ডালপালা গজাবে তার ইয়ত্তা নেই। এখন দেখার বিষয়, কিভাবে সরকার ও সরকারি দল এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। তারা যদি নানকের মতো সারা দেশে মামলার পথ ধরে, তবে তা হবে মোটাবুদ্ধির পরিচয়। মনে রাখা দরকার, সরকারের এখন ভাটার টান। মাথা গরম করা হবে নতুন আরেকটি ভুল।
azammir2003@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন