সোহরাব হাসান
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ার পর জনদরদি মহাজোট সরকার বিশ্বব্যাংক যে কত বড় দুর্নীতিবাজ, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। পৃথিবীর কোন দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন, কোন পত্রিকা কী প্রতিবেদন করেছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন মন্ত্রীরা। বিশ্বব্যাংক যদি এত খারাপ প্রতিষ্ঠানই হয়ে থাকে, তাহলে ঋণচুক্তি করার আগে কেন দেশবাসীকে সে সম্পর্কে কিছু জানানো হলো না? কেন জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হলো না, এই বদনামি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা ঠিক হবে কি না? ঋণচুক্তি বাতিলের পর জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন, ‘এক বেলা বাজার না করে সেই পয়সা দিয়ে পদ্মা সেতু করবেন।’ কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের আগে কেন এ আহ্বান জানালেন না তিনি? তখন যদি এক বেলা বাজার না করে (মাননীয়ার কাছে জানতে চাই, বাংলাদেশের কতজন মানুষ দিনে দুই বেলা বাজার করে?) নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলতেন, মানুষ বিশ্বাস করত। এখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বদেশপ্রেমের মশাল জ্বালালে তাতে ঘর আলোকিত হওয়ার চেয়ে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে যাঁরা আছেন, তাঁদের ধারণা, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল হওয়ায় দেশের মহাসর্বনাশ হয়ে গেছে। দেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কথাটি ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বব্যাংককে মানুষ একটি বেনিয়া প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিছু দেখে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের চিঠি গোটা দেশের জন্য অপমানকর। বিশ্বব্যাংকের চিঠি যদি অপমানকর হয়ে থাকে, চুক্তি সই করেও যাঁরা টাকা আনতে পারেননি, তাঁদের জন্য অপমানকর। সারা দেশের মানুষের জন্য নয়। এ অপমান তাঁদেরই প্রাপ্য, যাঁরা দুষ্কর্ম করেছেন বা করতে চেয়েছিলেন এবং যাঁরা তাঁদের রক্ষা করতে চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী জাতীয় সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা স্ববিরোধিতাপূর্ণ। একদিকে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যেহেতু এক পয়সাও দেয়নি, সেহেতু দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। বিশ্বব্যাংক কখনোই বলেনি যে ঘুষের লেনদেন হয়েছে। তারা বলেছে, কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে। আর ঘুষ যদি না-ই চাওয়া হবে, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবকে কেন সরালেন? প্রকল্প পরিচালককে কেন সরালেন? প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, যদি প্রমাণিত হয় মন্ত্রী দায়ী, তাঁকে অপসারণ করা হবে। তদন্তের পরই প্রমাণ পাওয়া যাবে মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন কি না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন। অতএব, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখুন। যদি তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আবার পুনর্বহাল হবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রীর পদে রেখে (তা যে মন্ত্রণালয়েই হোক না কেন) সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে না। এ কথাটি কেবল বিশ্বব্যাংকের নয়, বাংলাদেশের মানুষেরও। রেলওয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য যদি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে পারেন, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী পারবেন না কেন? মহাজোটের শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, সৈয়দ আবুল হোসেনের সরে দাঁড়ানো উচিত। তাঁরাও কি বিশ্বব্যাংকের দালাল?
তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পেলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যেসব দেশে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, সেসব দেশ ধ্বংস হয়ে যায়নি; বরং বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে, এ রকম উদাহরণই কম। তারা অনেক সময় এমন সব প্রকল্প চাপিয়ে দেয়, যা মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে। তাই বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করা নিয়ে বিরোধী দলের শোরগোল তোলার যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সেই ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠানটি যখন আমাদের সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে, তখন লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলেও সেতু নির্মাণের কাজ ঠেকে থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষের জন্য দরদ উথলে ওঠার জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, তারা ঋণ দেয় ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। বিশ্বব্যাংকের ঋণের পেছনে যে বড় রাজনীতি আছে, তাও ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের সরকারগুলো কখনোই মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারে না, তারা নির্দ্বিধায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ন্যায্য-অন্যায্য সব শর্তই মেনে নেয়।
সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলছেন। আমরা এ-ও জানি, এই সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি নিজস্ব অর্থায়নেও এ রকম একাধিক পদ্মা সেতু করতে পারেন। দেশি-বিদেশি ব্যাংকে সেই পরিমাণ অর্থ তাঁদের জমা আছে। কিন্তু তাতে বিশ্বব্যাংক সরকারের গায়ে যে কালিমা লেপন করল, তা মুছে যাবে না। অতএব, বিশ্বব্যাংক নয়, সরকার ও জনগণের স্বার্থেই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষ যে দলটিকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই দলটিই এখন মহাজোট সরকারকে মহাদুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছে। সরকারের পদত্যাগ চাইছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির মস্ত বড় ট্র্যাজিডিও বটে।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি বলে দাবি করেছেন। দুর্নীতি বলতে তিনি কি ঘুষের টাকার লেনদেন বোঝাচ্ছেন? বিশ্বব্যাংকও বলেনি যে ঘুষের টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের দাবি, ঘুষ চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো ভিত্তিই নেই, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, তাঁর সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরালেন কেন? এর মাধ্যমে নিশ্চয়ই তিনি বিশ্বব্যাংক-উত্থাপিত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, একজন মন্ত্রীকে স্বপদে (যে মন্ত্রণালয়েই তাঁকে বদলি করা হোক না কেন) বহাল রেখে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা যায় না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত খুব কম মন্ত্রী-আমলাই দুর্নীতির দায়ে শাস্তি ভোগ করেছেন। তাই বলে তাঁরা সৎ লোক হয়ে যাননি। সবার সততা আদালতেও প্রমাণিত হতে হয় না। বর্তমান সরকারে এমন মন্ত্রীও আছেন, যাঁর সম্পর্কে চরম শত্রুও দুর্নীতির অভিযোগ আনবেন না। আনলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রী হলফ করে বলতে পারেন না তাঁর মন্ত্রিসভার সবাই সাধু।
২.
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যখন বিপুল ভোটে জয়ী হলো, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থক তো বটেই, আওয়ামী ঘরানার বাইরেরও অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, দেশ এবার জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হবে। দুর্নীতি একেবারে উচ্ছেদ না হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসবে। স্বাধীনতার পর যাঁরা কখনোই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেননি, তাঁরাও সে সময় আওয়ামী লীগকে মন্দের ভালো বলে মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মহাজোটে বামপন্থীদের অবস্থান যত দুর্বলই হোক, সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, দেশটি প্রগতির ধারায়ই চলবে। এরপর শেখ হাসিনা যখন পুরোনোদের বাদ দিয়ে নবীনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখনো তাঁদের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে অভিজ্ঞতায় এঁরা কমতি হলেও সততা ও আন্তরিকতায় উতরে যাবেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই দেশবাসী হোঁচট খেতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত মিত্রদের দূরে ঠেলে দেওয়ার নীতি নেয়। দল ও জোটের মধ্যে যাঁরা এক-আধটু বাম চিন্তা করতেন, তাঁদের নানাভাবে অপদস্থ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছেন, যতই গালমন্দ করা হোক না কেন, তাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই। কেননা, আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি এবং তার ছায়াসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। প্রগতিশীল চিন্তার কোনো মানুষ তাদের সমর্থন করতে পারে না। গত সাড়ে তিন বছরে দলটি মুখে জনকল্যাণ ও প্রগতিশীলতার বুলি আওড়ালেও কাজে তার প্রমাণ দিতে পারেনি। ক্ষমতায় এসে বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি দুই দলের মধ্যে চরম বৈরিতা সত্ত্বেও দুই দলের সমর্থক অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে গভীর আঁতাত লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নামে তারা এমন এক সোনার পাথরবাটি তৈরি করেছে, যাতে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। তাহলে নূর হোসেন-তাজুলদের রক্তদান কি বৃথা গেল!
২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এল, তখন মানুষ আশা করেছিল, এবার আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও বদলাবে। সেই ধারণার অন্যতম কারণ ছিল, নির্বাচনে বিতর্কিত কোনো নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়া, বিশেষ করে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে যাঁরা দলের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছিলেন, সেই হামবড়া নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে শেখ হাসিনা দলের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। এখন আবার তাঁদের কেউ কেউ নাকি দলীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ পেতে শুরু করেছেন।
বিএনপির আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মহোৎসবের কারণে আওয়ামী ঘরানার বাইরের অনেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলেন এই আশায় যে ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। বাংলা ভাই বা শায়খ আবদুর রহমানের দৌরাত্ম্য কমবে, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফাালন দেখতে হবে না।
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির কতিপয় সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দলটিকে প্রায় একঘরে করে তুলেছিল, বিশেষ করে জঙ্গি উত্থানের ব্যাপারে তারা গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক পশ্চিমা দেশই বিএনপিকে গণতন্ত্রের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করত। ‘মধ্য ডান’ বিএনপি থেকে ‘মধ্য বাম’ আওয়ামী লীগই তাদের পছন্দের দল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অতি আস্থাশীল নেতৃত্ব এবং শেখ হাসিনার ‘পরিচ্ছন্ন মন্ত্রিসভা’ উল্টোরথে চলে। দেশের ভেতরে ও বাইরে যারা তাদের বন্ধু-সুহূদ ছিল, তাদের অনেকেই এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগ একটি কাজই সুচারুভাবে করেছে তা হলো, মিত্র-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের খেপিয়ে তোলা এবং বিএনপির ম্রিয়মাণ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ার পর জনদরদি মহাজোট সরকার বিশ্বব্যাংক যে কত বড় দুর্নীতিবাজ, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। পৃথিবীর কোন দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন, কোন পত্রিকা কী প্রতিবেদন করেছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন মন্ত্রীরা। বিশ্বব্যাংক যদি এত খারাপ প্রতিষ্ঠানই হয়ে থাকে, তাহলে ঋণচুক্তি করার আগে কেন দেশবাসীকে সে সম্পর্কে কিছু জানানো হলো না? কেন জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হলো না, এই বদনামি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা ঠিক হবে কি না? ঋণচুক্তি বাতিলের পর জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন, ‘এক বেলা বাজার না করে সেই পয়সা দিয়ে পদ্মা সেতু করবেন।’ কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের আগে কেন এ আহ্বান জানালেন না তিনি? তখন যদি এক বেলা বাজার না করে (মাননীয়ার কাছে জানতে চাই, বাংলাদেশের কতজন মানুষ দিনে দুই বেলা বাজার করে?) নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলতেন, মানুষ বিশ্বাস করত। এখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বদেশপ্রেমের মশাল জ্বালালে তাতে ঘর আলোকিত হওয়ার চেয়ে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে যাঁরা আছেন, তাঁদের ধারণা, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল হওয়ায় দেশের মহাসর্বনাশ হয়ে গেছে। দেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কথাটি ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বব্যাংককে মানুষ একটি বেনিয়া প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিছু দেখে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের চিঠি গোটা দেশের জন্য অপমানকর। বিশ্বব্যাংকের চিঠি যদি অপমানকর হয়ে থাকে, চুক্তি সই করেও যাঁরা টাকা আনতে পারেননি, তাঁদের জন্য অপমানকর। সারা দেশের মানুষের জন্য নয়। এ অপমান তাঁদেরই প্রাপ্য, যাঁরা দুষ্কর্ম করেছেন বা করতে চেয়েছিলেন এবং যাঁরা তাঁদের রক্ষা করতে চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী জাতীয় সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা স্ববিরোধিতাপূর্ণ। একদিকে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যেহেতু এক পয়সাও দেয়নি, সেহেতু দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। বিশ্বব্যাংক কখনোই বলেনি যে ঘুষের লেনদেন হয়েছে। তারা বলেছে, কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে। আর ঘুষ যদি না-ই চাওয়া হবে, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবকে কেন সরালেন? প্রকল্প পরিচালককে কেন সরালেন? প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, যদি প্রমাণিত হয় মন্ত্রী দায়ী, তাঁকে অপসারণ করা হবে। তদন্তের পরই প্রমাণ পাওয়া যাবে মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন কি না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন। অতএব, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখুন। যদি তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আবার পুনর্বহাল হবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রীর পদে রেখে (তা যে মন্ত্রণালয়েই হোক না কেন) সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে না। এ কথাটি কেবল বিশ্বব্যাংকের নয়, বাংলাদেশের মানুষেরও। রেলওয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য যদি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে পারেন, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী পারবেন না কেন? মহাজোটের শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, সৈয়দ আবুল হোসেনের সরে দাঁড়ানো উচিত। তাঁরাও কি বিশ্বব্যাংকের দালাল?
তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পেলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যেসব দেশে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, সেসব দেশ ধ্বংস হয়ে যায়নি; বরং বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে, এ রকম উদাহরণই কম। তারা অনেক সময় এমন সব প্রকল্প চাপিয়ে দেয়, যা মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে। তাই বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করা নিয়ে বিরোধী দলের শোরগোল তোলার যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সেই ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠানটি যখন আমাদের সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে, তখন লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলেও সেতু নির্মাণের কাজ ঠেকে থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষের জন্য দরদ উথলে ওঠার জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, তারা ঋণ দেয় ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। বিশ্বব্যাংকের ঋণের পেছনে যে বড় রাজনীতি আছে, তাও ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের সরকারগুলো কখনোই মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারে না, তারা নির্দ্বিধায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ন্যায্য-অন্যায্য সব শর্তই মেনে নেয়।
সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলছেন। আমরা এ-ও জানি, এই সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি নিজস্ব অর্থায়নেও এ রকম একাধিক পদ্মা সেতু করতে পারেন। দেশি-বিদেশি ব্যাংকে সেই পরিমাণ অর্থ তাঁদের জমা আছে। কিন্তু তাতে বিশ্বব্যাংক সরকারের গায়ে যে কালিমা লেপন করল, তা মুছে যাবে না। অতএব, বিশ্বব্যাংক নয়, সরকার ও জনগণের স্বার্থেই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষ যে দলটিকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই দলটিই এখন মহাজোট সরকারকে মহাদুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছে। সরকারের পদত্যাগ চাইছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির মস্ত বড় ট্র্যাজিডিও বটে।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি বলে দাবি করেছেন। দুর্নীতি বলতে তিনি কি ঘুষের টাকার লেনদেন বোঝাচ্ছেন? বিশ্বব্যাংকও বলেনি যে ঘুষের টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের দাবি, ঘুষ চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো ভিত্তিই নেই, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, তাঁর সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরালেন কেন? এর মাধ্যমে নিশ্চয়ই তিনি বিশ্বব্যাংক-উত্থাপিত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, একজন মন্ত্রীকে স্বপদে (যে মন্ত্রণালয়েই তাঁকে বদলি করা হোক না কেন) বহাল রেখে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা যায় না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত খুব কম মন্ত্রী-আমলাই দুর্নীতির দায়ে শাস্তি ভোগ করেছেন। তাই বলে তাঁরা সৎ লোক হয়ে যাননি। সবার সততা আদালতেও প্রমাণিত হতে হয় না। বর্তমান সরকারে এমন মন্ত্রীও আছেন, যাঁর সম্পর্কে চরম শত্রুও দুর্নীতির অভিযোগ আনবেন না। আনলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রী হলফ করে বলতে পারেন না তাঁর মন্ত্রিসভার সবাই সাধু।
২.
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যখন বিপুল ভোটে জয়ী হলো, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থক তো বটেই, আওয়ামী ঘরানার বাইরেরও অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, দেশ এবার জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হবে। দুর্নীতি একেবারে উচ্ছেদ না হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসবে। স্বাধীনতার পর যাঁরা কখনোই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেননি, তাঁরাও সে সময় আওয়ামী লীগকে মন্দের ভালো বলে মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মহাজোটে বামপন্থীদের অবস্থান যত দুর্বলই হোক, সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, দেশটি প্রগতির ধারায়ই চলবে। এরপর শেখ হাসিনা যখন পুরোনোদের বাদ দিয়ে নবীনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখনো তাঁদের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে অভিজ্ঞতায় এঁরা কমতি হলেও সততা ও আন্তরিকতায় উতরে যাবেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই দেশবাসী হোঁচট খেতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত মিত্রদের দূরে ঠেলে দেওয়ার নীতি নেয়। দল ও জোটের মধ্যে যাঁরা এক-আধটু বাম চিন্তা করতেন, তাঁদের নানাভাবে অপদস্থ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছেন, যতই গালমন্দ করা হোক না কেন, তাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই। কেননা, আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি এবং তার ছায়াসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। প্রগতিশীল চিন্তার কোনো মানুষ তাদের সমর্থন করতে পারে না। গত সাড়ে তিন বছরে দলটি মুখে জনকল্যাণ ও প্রগতিশীলতার বুলি আওড়ালেও কাজে তার প্রমাণ দিতে পারেনি। ক্ষমতায় এসে বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি দুই দলের মধ্যে চরম বৈরিতা সত্ত্বেও দুই দলের সমর্থক অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে গভীর আঁতাত লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নামে তারা এমন এক সোনার পাথরবাটি তৈরি করেছে, যাতে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। তাহলে নূর হোসেন-তাজুলদের রক্তদান কি বৃথা গেল!
২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এল, তখন মানুষ আশা করেছিল, এবার আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও বদলাবে। সেই ধারণার অন্যতম কারণ ছিল, নির্বাচনে বিতর্কিত কোনো নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়া, বিশেষ করে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে যাঁরা দলের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছিলেন, সেই হামবড়া নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে শেখ হাসিনা দলের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। এখন আবার তাঁদের কেউ কেউ নাকি দলীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ পেতে শুরু করেছেন।
বিএনপির আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মহোৎসবের কারণে আওয়ামী ঘরানার বাইরের অনেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলেন এই আশায় যে ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। বাংলা ভাই বা শায়খ আবদুর রহমানের দৌরাত্ম্য কমবে, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফাালন দেখতে হবে না।
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির কতিপয় সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দলটিকে প্রায় একঘরে করে তুলেছিল, বিশেষ করে জঙ্গি উত্থানের ব্যাপারে তারা গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক পশ্চিমা দেশই বিএনপিকে গণতন্ত্রের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করত। ‘মধ্য ডান’ বিএনপি থেকে ‘মধ্য বাম’ আওয়ামী লীগই তাদের পছন্দের দল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অতি আস্থাশীল নেতৃত্ব এবং শেখ হাসিনার ‘পরিচ্ছন্ন মন্ত্রিসভা’ উল্টোরথে চলে। দেশের ভেতরে ও বাইরে যারা তাদের বন্ধু-সুহূদ ছিল, তাদের অনেকেই এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগ একটি কাজই সুচারুভাবে করেছে তা হলো, মিত্র-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের খেপিয়ে তোলা এবং বিএনপির ম্রিয়মাণ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন