শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

দুর্নীতিতে স্বপ্নভঙ্গ পদ্মা সেতুর : যমুনা সেতুর স্বপ্নপূরণ হয় যেভাবে



সৈয়দ আবদাল আহমদ
দেশে যে বেশুমার দুর্নীতি চলছে তার সর্বশেষ নিদর্শন—পদ্মা সেতু প্রকল্পের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতির অভিযোগে এর আগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত করেছিল। সংস্থাটি সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করার অনুরোধ করেছিল। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার কিছুই শোনেনি। ফলে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতির দায়ে ডুবল পদ্মা সেতু। দুর্নীতিতেই স্বপ্নভঙ্গ হলো পদ্মা সেতুর।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিলের পর এডিবিও ঋণ সহায়তা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। জাইকাসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাও হয়তো একই পদক্ষেপ নেবে। এর ফলে প্রকল্পটির আপাতত সম্ভাবনা যে আর নেই, এটা জোর গলায়ই বলা যায়। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুধু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই ছিল না, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সরকারের মন্ত্রী-আমলাসহ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির অভিযোগের কারণে উজ্জ্বল একটি সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটল।
এত বড় ঘটনার পর সরকারকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়ার দরকার ছিল। সেটা তো করেইনি, উল্টো দুর্নীতিকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংককেই দোষারোপ করেছে সরকার। অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত পরপর তিন দিনই তার বক্তব্যে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের জন্য বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিককে দায়ী করে বলেছেন, তার একক সিদ্ধান্তেই চুক্তি বাতিল হয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম জানিয়ে দেন, পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত একদম সঠিক। দুর্নীতি করাকে বিশ্বব্যাংক কখনোই প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু তাতেও সরকারের টনক নড়েনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন—বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। তার পরিবারের কেউ কমিশন খায়নি।
পদ্মা সেতু ছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৩টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ৪৬০ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। দেশে দুর্নীতির যে অবস্থা, এসব প্রকল্পে যাতে আর দুর্নীতির অভিযোগ না ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। যদি এসব প্রকল্পেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে তাহলে বাংলাদেশকে যে চরম খেসারত দিতে হবে, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।
এখনও সময় আছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে ফের ঋণচুক্তিটি করার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে আবেদন করার পরামর্শ এসেছে বিরোধী দলসহ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। কিন্তু সরকার এখনও বড় বড় কথা বলতেই ব্যস্ত রয়েছে। মালয়েশিয়ার ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু করব, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করব ইত্যাদি। এটা অবাস্তব চিন্তা নয় কি? বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে সতর্ক করেছেন, মালয়েশিয়ার ঋণ নিলে যে বিপুল পরিমাণ সুদ দিতে হবে তার ভার বাংলাদেশ বইতে পারবে না। আর নিজস্ব অর্থায়ন করতে গেলে জনগণের ওপর যে কত বড় খড়গ নেমে আসবে তা বলাই বাহুল্য। তদুপরি পুরো বিষয়টি আরও বেশি লেজে-গোবরে অবস্থার মতো হয়ে যেতে পারে।
যমুনা সেতুর স্বপ্নপূরণ হয় যেভাবে
যমুনা সেতু নির্মাণের সুন্দর উদাহরণ চোখের সামনে ছিল । যমুনা সেতুও ছিল তখনকার সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এর সঙ্গেও বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা জড়িত ছিল। সেই প্রকল্প নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তত্কালীন নেতৃত্ব স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার জন্য সেদিন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে যমুনা সেতুর স্বপ্নপূরণ হয়েছিল। সেটা কীভাবে হয়েছিল সে কাহিনীই শোনা যাক :
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য জনগণের কাছে অঙ্গীকার করেছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠিত হয়। সরকারে আসার পর বিএনপি জনগণকে দেয়া তার নির্বাচনী অঙ্গীকার মোতাবেক যমুনা সেতু নির্মাণের যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।
যমুনা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে। বিএনপি সরকার যাতে এ সেতু নির্মাণে হাত দিতে না পারে সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই চালানো হয় নানা ষড়যন্ত্র। তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই নানা বিরোধিতা করে। আওয়ামী লীগ যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছিল। স্বার্থান্বেষী একটি মহলকে দিয়ে এ সেতুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল। স্বার্থান্বেষী মহলটি যমুনা সেতুর পরিবর্তে ব্রহ্মপুত্র ব্যারাজ নির্মাণের কৌশলী প্রচার চালিয়েছিল। দুটি ইংরেজি পত্রিকার মাধ্যমে যমুনা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিবন্ধ ও নিউজ আইটেম প্রচার করা হয়েছিল। তখন স্বার্থান্বেষী মহলটি প্রচার চালিয়েছিল, যমুনা সেতু অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাব্য নয়। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার সরকার এ সেতু নির্মাণে দৃঢ়তা প্রদর্শন করে এবং যমুনা সেতু নির্মাণকে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে। ওই সময়টিতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উপ-প্রেস সচিব হিসেবে খুব কাছে থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছি।
সরকারে আসার তিন মাসের মধ্যেই ১৯ মে ’৯১ জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদ (একনেক) বৈঠকে যমুনা সেতু প্রকল্পের ছক (পিপি) অনুমোদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে সরকার সেতু প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রি-বার্ষিক আবর্তক বিনিয়োগ কর্মসূচিতে কোর প্রকল্প হিসেবে একে অন্তর্ভুক্ত করে এবং চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ প্রকল্পের জন্য মোট ২,২৫০ কোটি টাকার সংস্থান রাখে। তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
যমুনা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ জোগানের জন্য উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোকে রাজি করাতে বিশেষ উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া। তার নির্দেশে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিশেষ দূত মোরশেদ খান বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট মি. লুই প্রেস্টনকে বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদ বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের বৈঠক হয়। তিনি যমুনা সেতু এলাকাও পরিদর্শন করেন। সরকারের আমন্ত্রণে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপানের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। যমুনা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কয়েকবার সমীক্ষা চালানো হয়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও বিশেষ দূত মোরশেদ খান এ প্রকল্পে জাপানকে রাজি করাতে ১৩ নভেম্বর ’৯৩ থেকে ১৯ নভেম্বর ’৯৩ পর্যন্ত জাপান সফর করেন। তারা জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং প্রকল্পের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন। ১৯৯৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও স্বয়ং দ্বিপাক্ষিক সফরে জাপান সফর করেন এবং যমুনা সেতুতে অর্থ জোগান দিতে জাপানকে সম্মত করান। ওই জাপান সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে থাকার আমারও সৌভাগ্য হয়। সব প্রচেষ্টার পর বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপান যমুনা সেতুতে অর্থ জোগান দিতে রাজি হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ’৯৪ তারিখে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে যমুনা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি ’৯৪ আইডিএ’র সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এডিবির সঙ্গে ১৮ মার্চ ’৯৪ তারিখে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার ব্যাপারে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৯ মার্চ ’৯৪ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাপান সফরকালে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৮ জুন ’৯৪ ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার ও জাপানের ওইসিএফএর মধ্যে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যমুনা সেতুর পূর্বপ্রস্তুতিমূলক কাজ হিসেবে ৪,৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসেই যমুনা সেতুর পূর্ব তীরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
অর্থ জোগান থেকে শুরু করে যমুনা সেতু প্রকল্পের সব আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার ২১ মার্চ ’৯৪ সেতুর জন্য চারটি কন্ট্রাক্ট দরপত্রের সম্মতিপত্র ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করে এবং ২৭ এপ্রিল ’৯৪ তাদের কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১০ এপ্রিল ’৯৪ যমুনা নদীর দুই তীরে যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা, দৃঢ় ইচ্ছা ও আন্তরিকতার ফলে যখন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের একটি বড় স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে, তখন এর কৃতিত্ব নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা শুধু কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাই নয়, যমুনা সেতু নিয়ে নির্জলা মিথ্যাচার চালায়। যমুনা সেতুর নাম বদল করে দিয়ে তাদের প্রয়াত নেতার নামে নামকরণ করে। যারা এ সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেছে, হরতাল করেছে অথচ কৃতিত্ব নিতে এবং নিজেদের নামে নামকরণ করতে তাদের বিবেকে এতটুকু বাধেনি। রেডিও-টেলিভিশনে নির্লজ্জভাবে একের পর এক অনুষ্ঠানে তারা মিথ্যাচার করে।
যমুনা সেতুর স্বপ্ন সারা বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। এ স্বপ্ন এক শতাব্দীর। এ স্বপ্ন বিচ্ছিন্ন কোনো এক নেতার ছিল না। জনগণের এ স্বপ্নের কথা ১৯৫৩ সালে প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। তিনি তখন বলতেন, যমুনা নদীর ওপর সেতু হলে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের দুরবস্থা ঘুচে যাবে। দু’ আনার পটল ঢাকায় দু’টাকায় খেতে হতো না। ১৯৫৪ সালে তিনি যমুনা সেতুর কথা প্রকাশ্যে জনসভায় বলেছেন। এরপর ১৯৬৪ সালে তত্কালীন পার্লামেন্টে সাইফুর রহমান নামে একজন সদস্য যমুনা সেতুর কথা উচ্চারণ করেন। পরে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান এ সেতুর কথা চিন্তা করেন। কিন্তু যমুনা সেতু বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় যমুনা সেতু নিয়ে নোংরা রাজনীতি আর চালাকিই করা হয়েছে। শুধু ১৯৮৫ সালের জুলাই মাসে জারিকৃত অধ্যাদেশ বলে যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ সেতুর নামে সারচার্জ ও লেভি প্রবর্তন করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা উঠানো হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এ টাকা এরশাদ সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেয়ার কাজে লাগায়। তখন যমুনা সেতু প্রকল্পের ওপর সমীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এতে দ্বিমত পোষণ করে। তাছাড়া ওই সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তোষজনক না থাকায় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো এই ব্যয়বহুল প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়নি।
বিএনপি সরকারই টাকার সংস্থান করে কার্যকরভাবে এ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে এবং তার সরকারের সময় পর্যন্ত ৮০ ভাগেরও বেশি কাজ সম্পন্ন করে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও কাজ শুরুর পর এ সেতুর কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য বেশ কয়েকবার যমুনা সেতু এলাকা পরিদর্শনে যান। প্রায় প্রতি মাসেই তিনি সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে যমুনা সেতুর অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। যমুনা সেতুর নামকরণের ব্যাপারে তখন দুটি দাবি ছিল। একটি দাবি হচ্ছে— এ সেতু মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নামে নামকরণ। অন্য দাবিটি ছিল হজরত এনায়েতপুরী (রহ.)-এর নামে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ সংক্রান্ত উভয় দাবির ব্যাপারে আলোচনার পর বলেছিলেন, উনারা দু’জনই সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তাদেরকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখলেই ভালো হয়। কারণ তাদের একজনের নামে সেতু হলে অপর তীরের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবে। তাতে তারা বিতর্কিত হবেন। এর চেয়ে যেহেতু নদীর ওপর সেতু হচ্ছে, নদীর নামে হলেই ভালো হয়। সেদিনই এ সেতুর নামকরণ করা হয় যমুনা সেতু। কিন্তু এ মহত্ সিদ্ধান্তটিও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করে দিয়ে নিজেদের নেতার নামে এ সেতুর নামকরণ করেছে।
১৯৯৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জাপান সফরের একটি অভিজ্ঞতার কথা এখনও মনে পড়ে। ২৯ মার্চ ’৯৪ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ছিল জাপানি প্রধানমন্ত্রী মি. হোসোকাওয়ার সরকারি বাসভবনে। এ বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এবং প্রধানমন্ত্রী হোসোকাওয়া জাপানি দলের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এক ঘণ্টার এই বৈঠক শেষে সফরসঙ্গী হিসেবে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পরম আনন্দে বৈঠক থেকে বের হচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান (মরহুম) এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত মোরশেদ খানও আনন্দিত। তারা বৈঠক থেকে বেরিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ আমরা সফরসঙ্গীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমতে জাপান যমুনা সেতুতে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। তারা তখন বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকার কথাও বলছিলেন। এরপরই লনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যমুনা সেতুতে ঋণ দেয়ার বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর জাপানি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৈশভোজে আমরা অংশ নিই।
১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল সকালে যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সেদিন হরতাল ছিল। ঢাকা থেকে সব রাষ্ট্রদূত, বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের হেলিকপ্টারে করে যমুনা সেতু এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যমুনা নদীর উভয় তীরে অর্থাত্ সিরাজগঞ্জ জেলার সাইদাবাদ ইউনিয়নের বড় শিমুলিয়ায় ও টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার শ্যামশৈল মৌজায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যমুনা সেতুর সফল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেদিন হরতাল উপেক্ষা করে দুই তীরের হাজার হাজার মানুষ এই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে ছুটে এসেছিলেন। তিন ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে নদীর দু’পাড়ে পৃথক দুটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেতুর উদ্বোধন করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘এই যমুনা সেতু হবে দেশের সামগ্রিক সুষম উন্নয়ন এবং জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মহামিলনের সেতু। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি স্মরণীয় ঘটনা ও দেশের উন্নয়নে যমুনা সেতু একটি মাইলফলক। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের শতাব্দীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। ইনশাআল্লাহ্ ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে।’ তিনি সেদিন এও বলেছিলেন, ‘জনগণের এত বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে আমি আনন্দিত। দেশের অর্থনীতিতে যমুনা সেতু উন্নয়নের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে।’
তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই কীর্তি এখন দীপ্যমান। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যমুনা সেতু নির্মাণ ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকেই সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি সরকারে থাকা অবস্থায়ই যমুনা সেতুর প্রায় আশি ভাগের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়। বাকি কাজ সম্পন্ন হয় আওয়ামী লীগের সময়। প্রতি বছর বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ থাকবে তাও বিএনপি সরকার ঠিক করে রেখেছিল।
১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রথম মেয়াদের বিএনপি সরকার দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়। ১৯৯৪ পর্যন্ত চার বছরে বিএনপি সরকার ৩১২টি সেতুই নির্মাণ করে। সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার করে ৬ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। ১৯৯৪ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তখনকার সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু মেঘনা-গোমতী সেতু উদ্বোধন করেন। ৩ সেপ্টেম্বর ’৯১ এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তিনি। ২৫৭ কোটি টাকার জাপানি অনুদানসহ এই সেতু নির্দিষ্ট সময়ের ১৩ মাস আগেই নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম সরাসরি সড়ক সংযোগ স্থাপিত হয়। এ সেতু উদ্বোধন করে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ এবং তামাবিল থেকে ভেটখালী পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কে আর কোনো ফেরি থাকবে না। অল্প সময়েই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাতায়াত সম্ভব হবে।’ যমুনা সেতু নির্মাণের পর খালেদা জিয়ার সে কথাই সবাই উপলব্ধি করেন। যমুনা সেতু দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। একটি সরকারের আন্তরিকতা, শ্রম ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার ফলেই সেদিন এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবের মুখ দেখেছিল। এই উদাহরণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সেটা কাজে লাগানো গেল না। এটা বর্তমান সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বড় ব্যর্থতা। আসলে পদ্মা সেতু নির্মাণের চেয়ে এ প্রকল্প থেকে কীভাবে কত তাড়াতাড়ি সুবিধা আদায় করা যাবে, সে চেষ্টাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। আর এটাই পদ্মা সেতুর স্বপ্নভঙ্গে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন