প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ্
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন আমার নজর কাড়ে। এতে ফুটে উঠেছিল অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটি চিত্র। এই চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে দেখলেই গা শিউড়ে ওঠে। দেশজুড়ে অজ্ঞাত লাশের ছড়াছড়ি। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ। রাস্তার পাশে, বিলে-ঝিলে, রেললাইনে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের লাশ। খুনের পর বস্তাবন্দি করে ডাস্টবিন, ঝিল, হাওর, জঙ্গলে ফেলে রেখে লাশ গুমের অপচেষ্টা চালানো হয়। বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ পাওয়ার পর অনেকের পরিচয়ও মেলে না। এ ধরনের নাম-পরিচয়হীন লাশের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব হত্যার তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও কূটনৈতিক। গত ৬ মাসে ৯১৯টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাবে মাত্র সাড়ে তিন মাসেই প্রায় ৩০ জনকে গুম করা হয়েছে। উপর্যুপরি গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা রাজনীতিসহ সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং আমাদের সমাজ ভয়াবহ অসুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত সোয়া তিন বছরেই মহাজোট সরকার ব্যর্থতার বিরাট পাহাড় বানিয়েছে। সে পাহাড়ের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে পড়া জনগণের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই সরকারের পদ্মা সেতু আর রেলমন্ত্রীর অর্থ দুর্নীতির কথা আপনাদের সবারই জানা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরনো আওয়ামী কৌশল গুম ও গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর রাজনীতি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের গুম ও গুপ্তহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী মহাজোট সরকার গুম ও গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে! পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ৩০ জন, ২০১১ সালে ৭০ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ৩০ জন। অর্থাত্ মহাজোট সরকারের গত সোয়া দু’বছরে গুম হয়েছে ১৩০ ব্যক্তি। এ হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে, যা মিডিয়াতে আসছে না। এখন আর চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী নন, এখন এর শিকার হচ্ছেন রাজনীতিকসহ সাধারণ মানুষ। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দেশপ্রেমিক এম ইলিয়াস আলী।
গুম আর গুপ্তহত্যার পেছনে আসলে কারা রয়েছে, কার বা কাদের ইন্ধনে এসব বলিখেলা চলছে, সেটা আর হিসেব কষে মেলাতে হয় না। শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই কেন শিকার বানানো হচ্ছে—এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এরই মধ্যে সাধারণ জনগণ জেনে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে খুন ও নির্যাতন বাংলাদেশে মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মতে নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশ সরকার।
বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘ দু’বছর ধরে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলামকে এর এক বছর আগে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত হন যশোরের ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের সালনায়। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। র্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। বরিশালের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানকে ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে গুম করা হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে। মিরপুরের ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী মাসুম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান ওরফে সোয়েল ও ঢাকা মহানগর ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেনকে ২৮ নভেম্বর হাতিরপুল থেকে অপহরণ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে দুটি লাশ পাওয়া যায়। এর একটি ইসমাইল হোসেনের বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। সোহেল ও মাসুম এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। সাভারের কলমা এলাকার ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম স্বপন প্রায় ৯ মাস ধরে নিখোঁজ। অনেকের ধারণা শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা খুন হয়েছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একসঙ্গে ৬ ব্যক্তিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করা হয়। এদের মধ্যে আসাদ সিকদার নামে একজনকে পথিমধ্যে নামিয়ে দেয়া হলেও এখনও ৫ জন নিখোঁজ আছেন। মাদারীপুর থেকে দেলোয়ার হোসেনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কারোই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মূলত এ কারণেই আমরা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমাদের দেশ কি সোমালিয়া হয়ে গেছে, নাকি ভারত অধিকৃত কাশ্মীর কিংবা ন্যাটোর দখলে চলে যাওয়া আফগানিস্তানে পরিণত হয়েছে যে, কোনো নাগরিক গুম ও গুপ্তহত্যা হলে তার হদিস পাওয়া যাবে না? এমন অবস্থা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দেশে সুয়োমোটো জারিকারী উচ্চ আদালত থাকা সত্ত্বেও একের পর এক মানুষ গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। সরকার এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেকের ধারণা, সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী দেশি-বিদেশি অপশক্তির সহযোগিতায় ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছে।
আমরা মনে করি, কারও সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে, রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষকে এভাবে শাস্তি দেয়া যায় না। গুমের দায়িত্ব এ সরকারকেই নিতে হবে। আর এ প্রবণতা যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন যারা এতে সমর্থন দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও এর শিকার হবেন না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! গুম ও গুপ্তহত্যা দুটোই জঘন্য এবং ভয়াবহ অপরাধ। একের পর এক গুম হওয়ার বিষয়টি দেশ এবং জাতির জন্য সুখকর নয়। এ ধরনের রহস্যজনক নিখোঁজ ও গুপ্তহত্যা ঘটনার রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না, যা সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতি বিকাশের জন্য একটি হুমকি। এভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েছে এবং বাংলাদেশ সমাজ একটি ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে।
আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর মতো দেশপ্রেমিক নেতাকে নিয়ে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মশকরা করছেন এবং তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আরও মনে করি, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকেই গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে। এটা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে বের না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই ধরে নেয়া হবে। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মূলত সরকারের নিজস্ব দুর্বলতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরকার নিজে মদত দেয়ার কারণে। বিচারব্যবস্থা দলীয়করণের ফলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অন্যায় জুলুম-নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’র ঘটনাও রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাত্ যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়-দায়িত্ব সরকারের। মহাজোট সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তার পরিচয় দিচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং যখন দেশে একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে, তখন গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ গুমের রহস্য দ্রুত উদঘাটন করে ইলিয়াস আলীকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। এটি যদি সরকার করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, অথবা সরকার নিজেই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ দুটো বিষয়ের কোনোটিই কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি অশনি সংকেত।
দেশপ্রেমিক জননেতা ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর ফেরত আসার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব জড়িত। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের ভেতর যে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগ্রত হয়েছে, সেটি নিরসনে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সমাজ আজ ভয়াবহ অসুস্থ, রাষ্ট্র আজ মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূল ধারাগুলো আজ ভূলুণ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ও একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ত্যাগী সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে বর্তমান সরকার এবং দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে ততই এদেশের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়বে এবং একসময় বাংলাদেশের অস্বিত্বও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিভিন্ন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাবে মাত্র সাড়ে তিন মাসেই প্রায় ৩০ জনকে গুম করা হয়েছে। উপর্যুপরি গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা রাজনীতিসহ সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং আমাদের সমাজ ভয়াবহ অসুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত সোয়া তিন বছরেই মহাজোট সরকার ব্যর্থতার বিরাট পাহাড় বানিয়েছে। সে পাহাড়ের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে পড়া জনগণের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই সরকারের পদ্মা সেতু আর রেলমন্ত্রীর অর্থ দুর্নীতির কথা আপনাদের সবারই জানা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরনো আওয়ামী কৌশল গুম ও গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর রাজনীতি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের গুম ও গুপ্তহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী মহাজোট সরকার গুম ও গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে! পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ৩০ জন, ২০১১ সালে ৭০ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ৩০ জন। অর্থাত্ মহাজোট সরকারের গত সোয়া দু’বছরে গুম হয়েছে ১৩০ ব্যক্তি। এ হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে, যা মিডিয়াতে আসছে না। এখন আর চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী নন, এখন এর শিকার হচ্ছেন রাজনীতিকসহ সাধারণ মানুষ। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দেশপ্রেমিক এম ইলিয়াস আলী।
গুম আর গুপ্তহত্যার পেছনে আসলে কারা রয়েছে, কার বা কাদের ইন্ধনে এসব বলিখেলা চলছে, সেটা আর হিসেব কষে মেলাতে হয় না। শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই কেন শিকার বানানো হচ্ছে—এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এরই মধ্যে সাধারণ জনগণ জেনে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে খুন ও নির্যাতন বাংলাদেশে মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মতে নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশ সরকার।
বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘ দু’বছর ধরে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলামকে এর এক বছর আগে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত হন যশোরের ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের সালনায়। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। র্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। বরিশালের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানকে ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে গুম করা হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে। মিরপুরের ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী মাসুম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান ওরফে সোয়েল ও ঢাকা মহানগর ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেনকে ২৮ নভেম্বর হাতিরপুল থেকে অপহরণ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে দুটি লাশ পাওয়া যায়। এর একটি ইসমাইল হোসেনের বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। সোহেল ও মাসুম এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। সাভারের কলমা এলাকার ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম স্বপন প্রায় ৯ মাস ধরে নিখোঁজ। অনেকের ধারণা শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা খুন হয়েছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একসঙ্গে ৬ ব্যক্তিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করা হয়। এদের মধ্যে আসাদ সিকদার নামে একজনকে পথিমধ্যে নামিয়ে দেয়া হলেও এখনও ৫ জন নিখোঁজ আছেন। মাদারীপুর থেকে দেলোয়ার হোসেনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কারোই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মূলত এ কারণেই আমরা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমাদের দেশ কি সোমালিয়া হয়ে গেছে, নাকি ভারত অধিকৃত কাশ্মীর কিংবা ন্যাটোর দখলে চলে যাওয়া আফগানিস্তানে পরিণত হয়েছে যে, কোনো নাগরিক গুম ও গুপ্তহত্যা হলে তার হদিস পাওয়া যাবে না? এমন অবস্থা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দেশে সুয়োমোটো জারিকারী উচ্চ আদালত থাকা সত্ত্বেও একের পর এক মানুষ গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। সরকার এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেকের ধারণা, সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী দেশি-বিদেশি অপশক্তির সহযোগিতায় ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছে।
আমরা মনে করি, কারও সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে, রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষকে এভাবে শাস্তি দেয়া যায় না। গুমের দায়িত্ব এ সরকারকেই নিতে হবে। আর এ প্রবণতা যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন যারা এতে সমর্থন দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও এর শিকার হবেন না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! গুম ও গুপ্তহত্যা দুটোই জঘন্য এবং ভয়াবহ অপরাধ। একের পর এক গুম হওয়ার বিষয়টি দেশ এবং জাতির জন্য সুখকর নয়। এ ধরনের রহস্যজনক নিখোঁজ ও গুপ্তহত্যা ঘটনার রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না, যা সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতি বিকাশের জন্য একটি হুমকি। এভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েছে এবং বাংলাদেশ সমাজ একটি ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে।
আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর মতো দেশপ্রেমিক নেতাকে নিয়ে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মশকরা করছেন এবং তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আরও মনে করি, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকেই গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে। এটা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে বের না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই ধরে নেয়া হবে। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মূলত সরকারের নিজস্ব দুর্বলতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরকার নিজে মদত দেয়ার কারণে। বিচারব্যবস্থা দলীয়করণের ফলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অন্যায় জুলুম-নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’র ঘটনাও রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাত্ যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়-দায়িত্ব সরকারের। মহাজোট সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তার পরিচয় দিচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং যখন দেশে একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে, তখন গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ গুমের রহস্য দ্রুত উদঘাটন করে ইলিয়াস আলীকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। এটি যদি সরকার করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, অথবা সরকার নিজেই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ দুটো বিষয়ের কোনোটিই কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি অশনি সংকেত।
দেশপ্রেমিক জননেতা ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর ফেরত আসার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব জড়িত। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের ভেতর যে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগ্রত হয়েছে, সেটি নিরসনে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সমাজ আজ ভয়াবহ অসুস্থ, রাষ্ট্র আজ মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূল ধারাগুলো আজ ভূলুণ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ও একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ত্যাগী সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে বর্তমান সরকার এবং দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে ততই এদেশের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়বে এবং একসময় বাংলাদেশের অস্বিত্বও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন