বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

ইতিহাসের আয়নায় ধর্ম বনাম রাষ্ট্রের মৈত্রী ও বৈরিতা



খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ : 
ড. কবি ইকবাল বলেছিলেন, ‘‘জালালে পাদশাহী হো; কে জমহুরি তামাশা হো- জুদা হো দীঁ' সিয়াসত ছে, তু রেহ জা'তিহে চেঙ্গিজী'' অর্থাৎ- ‘ক্ষমতার তাপও থাকে গণতন্ত্রের তামাশাও, ধর্মবিহীন রাষ্ট্রনীতির পুরোটাই ফ্যাসিবাদ।' দার্শনিক ইকবালের প্রজ্ঞাপূর্ণ এই অমর পংক্তি বিশেষ কাল বা সময়কে নয় পুরো মানবেতিহাসকে আওতাভুক্ত করেছে। কবি ইকবাল এই কবিতায় ‘দীন' বা জীবনব্যবস্থা বলে উর্ধ্বলোকের ওহিভিত্তিক জ্ঞান আর ‘সিয়াসত' শব্দে ক্ষমতা ও রাষ্ট্রশক্তি উদ্দেশ্য করেছেন। বুনিয়াদী বিবেচনায় ধর্মের বাহু (পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা অর্থে) দু'টি-একটি হল, আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা ওহিভিত্তিক জ্ঞান যাতে মানুষ ও সৃষ্টিনিচয় সম্পর্কিত যাবত নির্দেশনা পরিব্যক্ত হয়েছে। শ্রেণীগত বিন্যাসে এটি তত্ত্বীয়। তবে তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যটি ধর্মের কেবল একটি দিক। দ্বিতীয় দিকটি হল- তত্ত্বীয় জ্ঞানকে মানুষের জীবনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন। সরল ভাষায় ‘কথাকে কাজে পরিণত করা।' এ-দিক থেকে বুঝতে চাইলে বলতে হবে- ধর্ম বস্তুত চিন্তা ও কর্মের এরূপ সমন্বয় যেখানে চিন্তা ও ‘আমল' একটি অবিভাজ্য একক। প্রভুকে মেনে নেয়াই কেবল ধর্ম নয় বরং মানুষের কাজ হলো কর্মের মধ্য দিয়ে প্রভুত্বের কাছে সার্থকরূপে আত্মনিবেদন করে দেখানো। সে নিজেকে কেবলই ‘বান্দা' দাবি করেই  কর্তব্য শেষ করে না বরং জীবনে এ দাবির ব্যবহারিক প্রতিফলন ঘটিয়ে এই বাস্তবতার পক্ষে স্বাক্ষরও স্থাপন করে। অন্যভাবে বলি- আপাদমস্তক বান্দায় পরিণত হয়ে দেখিয়ে দেয় যে, সে প্রকৃতই বান্দা- খোদার আনুগত্যে সর্বস্ব সমর্পিত।
কিন্তু চিন্তা ও কর্মের মাঝে সংযোগ-দুর্বলতার কারণে মানুষ বিশ্বাস ও ভাবনায় আল্লাহর প্রতি অনুগত হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে পড়ে। ক্রমাগত এর মাত্রা অবাধে বাড়তে থাকায় এক পর্যায়ে ইতিহাসের ক্যানভাসে ভেসে উঠে ফেরাউন-নমরূদরূপী ক্ষমতাদর্পী দাম্ভিক মানুষ। ফেরাউন-নমরূদ এর আবির্ভাব বন্দেগি ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি অবস্থা। কিন্তু তাদের খোদায়ী দাবি করা দুর্বোধ্য নয়। ফেরাউন-নমরূদের সমকালীন প্রেক্ষাপটের মূল কথা হল- তখন তত্ত্বীয় বা প্রায়োগিক উভয়দিক থেকে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছিল অবলুপ্ত। অতএব, ক্ষমতা বা শক্তিই ছিল সর্বেসর্বা। ক্ষমতার ধর্ম হলো সে নিজেকে স্রেফ শক্তিই ভাবে না বরং সে বিশ্বাস করে সে-ই জ্ঞান, সে-ই প্রজ্ঞা, মেধা-প্রতিভা, পবিত্রতা, সভ্যতা সবকিছুই সে। মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ক্ষমতাকে এই বলে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম নয় যে, তুমি কেবলই এক অন্ধ শক্তি এর অতিরিক্ত আর কিছুই নও। যেহেতু ক্ষমতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয় না; তাই সে শুধু মানবজাতি নয় পুরো সৃষ্টিজগতের প্রতি হাত বাড়াতে চায়। তার কাছে মনে হয় সমগ্র সৃষ্টিজগত তার করতলগত। এরূপ অমূলক ধারণায় আক্রান্ত হয়ে ‘ক্ষমতা' ইতিহাসের নানা বাঁকে খোদায়ী দাবি করতে দ্বিধান্বিত হয়নি। ফলে সময়ের গতিধারায় এক পর্যায়ে এসে মুখ থুবড়েও পড়েছে।
ইতিহাস বলে ক্ষমতার ‘খোদায়ী' দাবিকে কেবল নবী-রাসূল (আ.) ও তাঁদের আদর্শিক উত্তরাধিকারীগণই চ্যালেঞ্জ করেছে। ক্ষমতার ‘ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা'কে অঙ্গুলি নির্দেশ করার সাহসও দেখিয়েছে তারাই। শক্তির চোখে চোখ রেখে তাকে জানিয়ে দিয়েছে তার আকার-অবয়ব কী। হযরত ইবরাহিম (আ.) যখন নমরূদের খোদায়ীকে চ্যালেঞ্জ করলেন; জবাবে নমরূদ বলল, তোমার খোদার এমন কী আছে যা আমার নেই? ইবরাহিম (আ.) তাকে এভাবে জব্দ করলেন যে, সে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। তিনি বললেন, ‘‘আমার প্রভু সুর্যকে পূর্বাচল থেকে উদিত পৃথিবীর পশ্চিমে অস্তমিত করেন। তুমি পারলে এর ব্যতিক্রম করে দেখাও!'' ফেরাউনের খোদায়ী ছিল যাদুনির্ভর। কিন্তু মুসার লাঠি ফেরাউনের যাদুকে মুহূর্তে এতই অসহায় করে ছাড়লো যে, খোদ ফেরাউন যাদুকরদেরই বিপক্ষে চলে গেলো। সে যাদুকরদের উপর অপবাদ দিলো যে, তারা মুসার (আ.) সঙ্গে অাঁতাত করেছে।
সক্রেটিস ও প্লেটোর যুগ ঈসা (আ.) প্রায় পৌনে তিনশ' বছর আগে। এ দু'জন ব্যক্তিত্বের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ধর্মের বাণী কিছু হলেও তাদের কাছে পৌঁছেছিল। তারা বৈশ্বিক পরিসরে আবহমান তাসাউফ বা অধ্যাত্মচেতনার প্রবক্তা ছিলেন। সক্রেটিস শাসক বা প্রশাসক ছিলেন না। তিনি চাইলেও কার্যকরভাবে রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মের সম্মিলন ঘটাতে সক্ষম হতেন না। কিন্তু সমাজে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে শুদ্ধতার লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। সক্রেটিসের যাবতীয় চেষ্টা-প্রয়াস যদিও ছিল পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ। তিনি লোকজনকে দর্শনশাস্ত্রের পাঠদানের অতিরিক্ত কিছুই করছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীন শক্তির ঠিকই জানা ছিল যে, জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর এই নৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে বৃহৎ ঐক্যের প্লাটফরমে সমবেত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাই সমকালীন ক্ষমতাসীন শক্তি তাঁর শান্তিপূর্ণ তৎপরতার জবাব দিলেন অত্যন্ত নির্মম-কঠোর ভাষায়। সক্রেটিসকে অপবাদ দেয়া হল তিনি যুবকদের বিদ্রোহের জন্য উস্কানি দিচ্ছেন। এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড! অতএব সে যুগের নিয়মমাফিক তাঁকে বিষ পান করিয়ে প্রাণদন্ড দেয়া হল। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো ছিলেন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি আমাদের আধুনিক পরিভাষায় ধর্ম ও রাষ্ট্র তখনকার পরিভাষায় ‘জ্ঞান' ও ‘শক্তি'-এর সহাবস্থানের সমর্থক ছিলেন। প্লেটো স্পষ্ট করেই লিখেছেন, রাজনীতির এই সঙ্কট সমাধানের একটিই পথ- ‘হয়তো শাসককে দার্শনিক হতে হবে নয়তো দার্শনিককে শাসক হতে হবে।' প্লেটো গণতন্ত্রের শিরোনামে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেছেন, সেখানে শাসকের মাঝে জ্ঞান ও শক্তির (অন্য কথায়- ধর্ম ও রাজনীতির) সমন্বিত অবয়বই ভেসে উঠে। তবে প্লেটোর গণতন্ত্র একটি স্বপ্নই থেকে গেছে। যা কখনও আলোর মুখ দেখেনি। এর কারণ হল, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমশ প্রশ্রয় পেতে থাকায় ধর্ম ও রাজনীতির সহাবস্থান কার্যকরভাবে রূপায়িত করা দুষ্কর হয়ে পড়া। কিন্তু জ্ঞান ও শক্তির অভূতপূর্ব বাস্তব রূপটি অস্তিত্বমান হবার সময় প্লেটোর সময়কাল থেকে খুব বেশি দূরেও ছিল না।
বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এর ব্যক্তিত্ব ছিল মানবেতিহাসের ক্যানভাসে ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতির পরিপূর্ণতম সমন্বয়ের আদর্শচিত্র। তিনি মহান দিগ্বিজয়ী যেমন ছিলেন; একই সঙ্গে মানবীয় বিনয়ের শ্রেষ্ঠ আদর্শও ছিলেন। গোটা পৃথিবীর রাশিরাশি সম্পদ তাঁর পায়ের কাছে পড়েছিল কিন্তু তাঁর আমল ও রাষ্ট্রে আল্লাহর ওপর কারও মর্যাদার অস্তিত্বই ছিল না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মাঝে সংহতির এই ধারাবাহিকতা খেলাফতে রাশেদার যুগে বহাল ছিল। ফলে কেবল ৫০ বছরে ইসলাম অর্ধ পৃথিবী জয় করেছে। এই বিজয়ের পেছনে ধর্মের ভূমিকা ছিল মুখ্য; শক্তি বা রাজনীতির ভূমিকা ছিল গৌণ। এই কারণেই মুসলমানরা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই ইসলামি সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। ইসলাম যদি ‘শক্তির জোরে' বিস্তার লাভ করতো তাহলে দেশ জয় করা যেত বটে কিন্তু সেখানে ইসলামি কৃষ্টি-সভ্যতার গোড়াপত্তন করা সম্ভব হতো না। ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতির মাঝে মৈত্রীর ফলেই যেখানেই ইসলামের আগমন ঘটেছে সেখানকার মাটি, মানুষ ও স্থানীয় বাস্তবতাকে আত্মস্থ করে নেবার সহজাত ক্ষমতা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশমান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। মুসলমানরা ভারতীয় উপমহাদেশ, স্পেন, সমরকন্দ, বোখারা, মধ্যএশিয়া, চীন (কাশগর) ও আফ্রিকায় তা করে দেখিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপ ধর্ম ও রাষ্ট্রের মাঝে ঐক্য-চর্চা করে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। এর মৌলিক কারণ ছিল দু'টি : প্রথমত, খ্রিস্টবাদের বিকৃতি ঘটেছিল। উপরন্তু এর দ্বিতীয় কারণ ছিল সেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে প্রাধান্য ছিল রাজনীতির। অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর সুবিধামতো ধর্মের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছিল। অথচ দরকার ছিল শাসকদের সুবিধা ও প্রয়োজনকে ধর্মের ছাঁচে ঢেলে সাজানো। অন্য কথায় ধর্মের অনুসরণ প্রশ্নে শাসকদের আত্মসমর্পিত থাকা।
ইউরোপে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার পর মানুষ আরও ভয়ানক নৈরাজ্যের অভিজ্ঞতা লাভ করে। যে ইউরোপীয়গণ এক ধর্মের অনুসারী ও একটি জাতি ছিল রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা হবার পর পুরো ইউরোপে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বলে উঠে। ইউরোপের প্রত্যেকটি রাষ্ট্র আলাদা আলাদা জাতীয়তার নিশানবরদারে পরিণত হয়। এই জাতীয়তাবাদ পূজা ইউরোপকে দু'টি বিশ্ব যুদ্ধ উপহার দিয়েছে। এই অন্ধ জাতীয়তাবাদপ্রীতি হিটলারের জন্ম দিয়েছে। বলা যায়, কমিউনিজম নতুন দর্শন হাজির করেছে তবে এই মতবাদ আল্লাহ ও ধর্মবিদ্বেষী হওয়ায় তার নতুন দর্শন বিষাক্ত এবং মানবতাবিধ্বংসী প্রমাণিত হয়। কমিউনিস্ট বিপ্লব রাশিয়া ও চীনে লাখো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কোটি কোটি মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসা-জিঘাংসায় মেতে উঠে। আর কমিউনিজম পুরো মানবসমাজকে ‘মানুষ' নয় কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডারে পরিণত করে। এটি ছিল চেঙ্গিজী বা ফ্যাসিবাদের নতুন প্রকার। যার মাথায় পরানো ছিল নতুন দর্শনের মুকুট হাতে ছিল মানবতা ও মানবাধিকারের পতাকা। ইউরোপের বিগত ষাট/সত্তর বছরের ইতিহাসে সেক্যুলারিজম বা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক রাখার ইতিহাস। এই সময়কাল ইউরোপীয় শাসন ও নেতৃত্বের মানদন্ডকে খুবই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। তা সত্ত্বেও সেক্যুলারিজমের পরিমন্ডলে জ্ঞান ও কর্মের তাৎপর্য হল যখন ইউরোপে জ্ঞান কর্মের সমন্বিত রূপ বাস্তবতার মুখ দেখেছে তখনই তা বিস্ময়কর ফলাফল তুলে এনেছে। এর একটি উদাহরণ হল জাঁ পল সার্টার। তিনি জ্ঞানীদের আখ্যায়িত করতেন- ‘অস্থির অনুভূতি' নামে। যদিও তিনি নিজেই এর একটি নমুনা ছিলেন। তিনি নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও নিজের মতাদর্শের অনুসারী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, আলজেরিয়ায় ফ্রান্সের দখল জবরদস্তিমূলক এবং এর অবসান জরুরি। সার্টার একাধারে দার্শনিক, সাহিত্যিক ও Political activist (রাজনীতিক) ছিলেন। সমাজের ওপর তার বেশ প্রভাবও ছিল। তিনি একাই আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সকে বিতাড়নের চেষ্টা চালিয়ে যান।
তখন ফ্রান্সের শাসক ছিলেন জেনারেল ড্যাগলের যুগ। পরামর্শকগণ জেনারেল ড্যাগলকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, সার্টার দেশদ্রোহী, তাকে গ্রেফতার করা হোক। কিন্তু জেনারেল বললেন, সার্টার ‘ফ্রান্সের প্রাণ'। তাকে আটক করা সম্ভব নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হল, সার্টারের তৎপরতা আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সের বিদায় ত্বরান্বিত করেছিল। সার্টারের জ্ঞান ও জ্ঞানীসুলভ চিন্তাধারা ফ্রান্স সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। শেষে তাকে হাত গুটিয়ে পিছু হটতে বাধ্যও করেছে।
হিন্দুত্ববাদে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সহাবস্থান আদতেই অসম্ভব। কারণ হিন্দুসমাজ বিশ শতক পর্যন্ত সময় অতিক্রমণের ব্যবধানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার পশ্চিমা দর্শন মনেপ্রাণে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ধর্মের নাম উহ্য রেখেই ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একত্র করেছিলেন। তিনি ‘অহিংস মতবাদ' আবিষ্কার করেছিলেন যাকে এক ধরনের আধ্যাত্মিক রূপও দিয়েছেন। তার সরলতা যদিও বস্তুত একটি সামাজিক বাস্তবতা ছিল, তবে তা ছিল হিন্দুদের সামাজিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু গান্ধীজির সরলতা এক প্রকার অধ্যাত্ম সাধনার রূপ পরিগ্রহ করে এবং হিন্দুসমাজকে খুবই ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। আর গান্ধীজির দর্শন গান্ধীবাদ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্মিলন তত্ত্বের ফলেই বিশ্বের বুকে পাকিস্তান নামে একটি অন্যতম বৃহৎ মুসলিম দেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় সেই তত্ত্ব একটি বড় জনস্রোতকে একটি জাতিতে, একটি ভৌগোলিক সীমারেখাকে রাষ্ট্রে এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে কায়েদে আযমে রূপান্তরিত করে। কায়েদে আযমের ব্যক্তিত্বে অনেকের দৃষ্টিতে ধর্ম দৃশ্যমান নয়। বাহ্যিক বিচারে এটা হয়তো ঠিক। এতটুকুতেই তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। কারণ তাঁর চরিত্রে এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ছিল যা ধর্ম ব্যতিরেকে অন্য কোনও উৎস থেকে আসতে পারে না। যথা- কায়েদে আযম ছিলেন প্রচারবিমুখ বা অন্তর্মুখী স্বভাবের। পদ-পদবীর প্রয়োজন তিনি কখনও অনুভব করেননি। শত্রুরাও তাঁর ঈমানদারী বা প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুণ সম্পর্কে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। কেউ কখনও তাঁকে মিথ্যা বলতে দেখেন নি। কারও উপর অপবাদ চাপানো তাঁর ধাতে ছিল না। তিনি মিতবাক ছিলেন। আল্লামা ইকবাল, আল্লামা শবিবর আহমদ ওসমানী, বাহাদুর ইয়ার জঙ্গ-এর মতো ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গকে তিনি সর্বাধিক শ্রদ্ধা করতেন। এ-সব নৈতিকতা কেবল ধর্মীয় শিক্ষার ফসলই হতে পারে। ইতিহাসের আলোয় এ পর্যন্তের আলোচনার মর্ম এটা বৈকি যে, মানবতার অস্তিত্ব, নিরাপত্তা, সাফল্য নিশ্চিত করা, ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থার একত্রীকরণের মাধ্যমেই সম্ভব। এতদ্ব্যতীত রাষ্ট্রশক্তি ফেরাউন-নমরূদ ও চেঙ্গিস-হালাকুর ফ্যাসিবাদে পরিণত হতে বাধ্য।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, জাগৃতি লেখক ফোরাম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন