ইনাম আহমেদ চৌধুরী
বাংলাদেশের জনগণ আজ চরমভাবে অপমানিত ও বেদনাহত বোধ করছে, জাতির ভাবমূর্তি আজ বিশ্বসভায় কলঙ্কলিপ্ত, দেশের উন্নয়নপ্রবাহ বিপর্যস্ত। কিন্তু কেন এমন হলো? কে এর জন্য দায়ী?
অনস্বীকার্য যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এর অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছে। শুধু বিশ্বব্যাংকই প্রায় ১৬৮৫ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে। বর্তমানেও প্রায় ২৫১টি উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ৪৯০ কোটি ডলার ব্যয়িত হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘকাল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ছিলাম। আমার কার্যকালেই যমুনা বহুমুখী সেতু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার সঙ্গে। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রত্যেকের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতামূলক আচরণ পেয়েছি। তবে তাদের একটি বড় আশঙ্কা সবসময় থাকে যে, প্রাপক দেশ দুর্নীতির কোনো আশ্রয় নিচ্ছে কি-না। সেই সন্দেহ নিরসন করতে পারলেই তারা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালেও আমি বিশ্বব্যাংকের এই সহযোগিতামূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করেছি। একটি দাতা সংস্থায় (আইডিবি, জেদ্দা) ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে পাঁচ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছি। তখন দেখেছি সব আন্তর্জাতিক সংস্থাই সম্ভাব্য দুর্নীতির ব্যাপারে সতর্ক এবং সংবেদনশীল। কেননা অন্য দেশের অর্থ, অন্য দেশের জনগণের প্রদত্ত কর থেকে সঞ্চিত অর্থ একটি উন্নয়নকামী দেশে জড়ো করছে এবং তা যাতে সত্যিকার অর্থেই জনগণের কাজে লাগে, সেটিই থাকে ধ্যান ও ধারণা। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যে অকারণে কোনো বৈরী মনোভাব নেবে এটা অবিশ্বাস্য।
২০১১ সালের এপ্রিলে পদ্মা সেতু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পাঁচ মাসের মাথায়ই সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক জানাল_ হাঁউ মাঁউ খাঁউ, দুর্নীতির গন্ধ পাঁউ। তারা অনুসন্ধান করে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পেয়ে চিঠি ও যোগাযোগ মারফত কারণ বর্ণনা করে সাময়িকভাবে অর্থায়ন স্থগিত করল। কিন্তু তাদের কথামতো বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র অবসানে যথোপযুক্ত সাড়া বা সহায়তা পেল না। অথচ আরেকটি দেশ_ কানাডা, যারা একটি বিরাট ফার্ম এসএনসি লাভালিন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কাজ পাওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কানাডীয় সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করল।
সাধারণত উন্নত দেশগুলো তাদের ফার্মগুলোকে অন্য দেশে বিশেষ করে উন্নয়নকামী দেশগুলোয় কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য উৎসুক থাকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে কানাডীয় সরকার এসএনসি লাভালিনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করল। ওই ফার্মের সিইও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন। কানাডা সরকারের পুলিশ প্রতিনিধি দল ঢাকা পর্যন্ত সফর করে দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে অবহিত করল। ২০১২ সালের এপ্রিলে দুর্নীতির বিষয়ে দ্বিতীয় রিপোর্টও বিশ্বব্যাংক দিল। তার মানে, বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত 'বিনা মেঘে বজ্রপাত' নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার বুঝেও না বোঝার ভান করল।
দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল জনৈক প্রভাবশালী মন্ত্রী, যার দুর্নীতির ও যোগাযোগের কথা ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আগেই তার সরকারকে অবহিত করেছিলেন। তার এবং তার অন্য সহযোগীদের অপসারণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যে চিঠিপত্রের লেনদেন, তাতে দেখা গেল_ 'পাবলিক অফিসিয়াল' সবাইকে বাংলাদেশ তদন্তের আওতায় আনেনি। কোনো মন্ত্রীকে অপসারণ করল না। যদিও তারা পরিষ্কারভাবেই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিল।
রুটিন দফতর বণ্টনের মাধ্যমে সেই মন্ত্রীকে অন্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হলো। এটা কি কোনো শাস্তি বিধান হলো? এটা কি তদন্তের জন্য কোনো অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করল? না। কেননা তিনি সরকারের দায়িত্বশীল পদেই থেকে গেলেন। সেই মন্ত্রণালয়কে দু'ভাগ করা হলো। এর মধ্যে রেল বিভাগের দায়িত্বশীল মন্ত্রী একটি দুর্নীতির কেসে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন।
অন্যদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভিন্ন উপায়ে কিংবা বাণিজ্যিক অর্থ সংস্থানের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলতে শুরু করলেন। স্বভাবই বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতাদের ধারণা হলো, বাংলাদেশ দুর্নীতির বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চাইছে না। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক যে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিল তার কোনোটিই অগ্রহণযোগ্য ছিল না। পত্রিকান্তরে দেখেছি, বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে ওয়াশিংটনে গিয়ে আলোচনাও করেছেন। বিশ্বব্যাংক কী চায়, সে সম্পর্কে তাদের দ্বিধা বা সন্দেহ থাকা উচিত ছিল না। বহু আলাপ-আলোচনা এবং চিঠিপত্র আদান-প্রদানের পর বিশ্বব্যাংকের এই ধারণাই প্রবল হয়েছে_ বাংলাদেশ সরকার জনস্বার্থের ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই তো তারা এ চুক্তিকে নাকচ করে দিল। যদিও এ ধরনের সম্পাদিত চুক্তি নাকচ করে দেওয়া একটি বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা।
বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত শর্তাবলি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, দুর্নীতি প্রতিরোধে এগুলো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা ছিল। তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হতো না। অথচ আমাদের সরকার মালয়েশিয়ান সংস্থার পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে আলোচনা ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করে যথেষ্ট এগিয়ে নিয়েছিল। তাদের শর্ত ছিল সেতুর মালিকানা প্রায় ৪০ বছর তাদের থাকবে। সুদ অনেক বেশি হবে। টোল তারা নির্ধারণ করবে এবং তখন অন্য কোনো সেতু নির্মাণ করা যাবে না। তারা এটাও বলেছিল, বাংলাদেশের পরিবেশ সংক্রান্ত আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক দেবে না। এসব শর্ত কি বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য অনুকূল ছিল? মোটেই না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য জাতি আজ দুর্যোগের মুখোমুখি। বলা হয়েছিল, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জোয়েলিক ব্যক্তিগতভাবে নাখোশ হয়ে চুক্তি নাকচ করেছিলেন। নতুন প্রেসিডেন্ট অনুকূল সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে বিশ্বব্যাংক একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা এবং যেখানে ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি তার কার্যক্রম নির্দেশ করে না। নতুন প্রেসিডেন্ট শুধু যে চুক্তি বাতিলকে সমর্থন জানালেন তা নয়, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হলেন।
বস্তুতপক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করতে হলে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী সংস্থাগুলো অর্থায়ন ছাড়া আমাদের গ্রহণযোগ্য গতি নেই। নিজস্ব সম্পদে কিংবা বাণিজ্যিকভাবে এটার নির্মাণ জাতির জন্য শুধু কষ্টদায়কই হবে না বরং দুঃসাধ্যই হবে। তাছাড়া আজকে কলঙ্কের যে কালিমা লেপে দেওয়া হলো তা থেকে তো মুক্তি পেতে হবে। তা না হলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী পিছিয়ে যাবে অথবা ইতস্তত করবে।
সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, সব ভুলে গিয়ে জাতির স্বার্থেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। প্রশ্নাতীত লোক নিয়ে একটি নতুন টিম গঠন করুন, যেখানে পূর্বতন মন্ত্রী ও উপদেষ্টাবর্গের সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। তখনই বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দুর্নীতি দমনে সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কে আস্থাবান হবে। আমাদের দেখিয়ে দেওয়া উচিত হবে, তারা যা চায়, দুর্নীতি দমনে ও জনগণের স্বার্থে আমরা তার চেয়েও বেশি কিছু করতে আগ্রহী।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী :সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন