বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব

॥ সিরাজুর রহমান ॥

১.
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, সরকার যদি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠির বিবরণ প্রকাশ করতে চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক আপত্তি করবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ
করে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সে চিঠির বয়ান প্রকাশ করবে না।
ইদানীং সরকার যেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। এমন দিন যায় না যেদিন শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন না। বহু বিবৃতির মধ্যে একটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক (তার সরকারকে) প্রতারণা করেছে। অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য এই ব্যাংক সম্বন্ধে অডিট করতে হবে। তার খাদ্যমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী আর মতিয়া চৌধুরী আত্মপ্রতারণা করছেন। তারা কি এতই শক্তিধর যে তাদের কথায় বাকি পৃথিবী বিশ্বব্যাংক সম্বন্ধে তদন্ত করবে? বিশেষ করে যখন বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ইমেজ ‘নেগেটিভ’। প্রকৃত ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বাংলাদেশের দিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ব্যাংক তারপর এ ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির বিবরণ সরকার গোপন রেখেছে, কিন্তু এক প্রতিবেদনে নাম ধরে এক মন্ত্রী, এক সচিব ও এক ডিরেক্টরের এবং নামোল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। ব্যাংক বলেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেন, অভিযোগ সম্বন্ধে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক হতাশ। অর্থাৎ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংক মঙ্গলবার আরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রতিবিধান করেনি বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্বন্ধে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সম্ভব নয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটা কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, অভিযুক্তরা এতই উচ্চাসনে উপবিষ্ট ও এতই শক্তিধর যে তাদের শাস্তিদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরং সে জন্য সরকার পদ্মা সেতুটি বিসর্জন দিতেও রাজি আছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার ও অন্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন।
‘নিজেদের সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের বহু আয়োজনও একই উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, দেশে নাকি ‘উদ্দীপনার‘ ঢল শুরু হয়েছে। কোন বালক নাকি তার টিফিনের পয়সা সেতু তৈরির জন্য দিতে চেয়েছে। নোয়াখালীর কোন স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। বিলম্ব না করে দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। এগুলোর একটি আবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকার আশা করছে যে প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে বিদেশী মুদ্রা জমা দেবেন।
২.
উদ্দীপনা কিংবা এক বালকের টিফিনের পয়সায় পদ্মার মতো জটিল নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা যায় না। লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে যেটুকু লক্ষ করেছি, আগাগোড়া দুর্নীতির চাদরে আবৃত বর্তমান সরকারের হাতে নিজেদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা তুলে দিতে প্রবাসীরা রাজি হবেন না। তারা জানেন সরকারকে দেয়া অর্থের বেশির ভাগই দুর্নীতির খোরাক জোগাতে লাপাত্তা হয়ে যাবে। সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ যে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর পকেটে যাবে, তার নমুনা দেখা গেছে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার এখন পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করেছে। তাতে বর্তমানে দেশজোড়া যে চাঁদাবাজি চলছে সেটাকেই বৈধতা দেয়া হবে। সে চাঁদাবাজির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র মারা গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে সেতুর অর্থায়ন সম্ভব হবে। শত দুঃখের মধ্যেও এ প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের হাস্যোদ্রেক করবে। পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের যথাসর্বস্ব শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। বহু হাজার কোটি টাকার সে লগ্নি সরকারের পৃষ্ঠপোষকেরা লুটেপুটে খেয়েছে। বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বাবদ জ্বালানি খাত থেকে আরো বহু হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। তেমনি লুটপাট করেছে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারের আওয়ামী লীগপন্থী সিন্ডিকেটগুলো। যদ্দুর জানা যায়, এই টাকার পাহাড় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেসব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সেতুর অর্থায়নের একটা অংশ সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে সেতু নির্মাণের জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে শেয়ারবাজারে লগ্নি করবে।
বলা হচ্ছে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অন্য মন্ত্রী দফতরগুলো থেকেও একই রকমভাবে টাকা নিয়ে সেতু নির্মাণ তহবিলে দেয়া হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সরকারের তহবিলে টাকা নেই। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্যও সরকারকে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হয়। শুনেছি, সরকারের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারীরা নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে সে টাকা ফেরত দেয়ার মতো তারল্য নাকি কোনো কোনো ব্যাংকের নেই। প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলে আমাদের প্রতিরক্ষা, আমাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করার কাজ অবশ্যই বিঘিœত হবে।
৩.
মাত্র দু-তিন দিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, দুই শ’রও বেশি ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশ এলাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কোস্ট গার্ডকে দেখা যায়নি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও সমানেই সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু মেরামত হয় না। মেঘনা সেতু ধসে পড়েছে বলে দক্ষিণ বাংলাদেশ ও চাঁদপুরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট আঘাত। বরাদ্দ অর্থের একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে ছিনিয়ে নেয়া হলে সড়ক আর সেতুগুলো চলাচলের উপযোগী থাকবে না।
সবচেয়ে বড় কথা দেশী টাকা বড়জোর মাটি কাটা ও জমির ক্ষতিপূরণ দানের কাজেই লাগতে পারে। মোট ব্যয়ের গরিষ্ঠ অংশই ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি বাবদ। সেই বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়া না হলে তারা টাকা দেবে না। তারা না দিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশও টাকা দিতে রাজি হবে না। ফলে দেখা যাবে যত টাকাই সরকার তুলুক না তাতে সেতু তৈরি হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সন্দেহ করেছেন, সংগৃহীত অর্থ আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার এবং ভোট কেনার কাজেই ব্যয়িত হবে।
পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, সেতুর আনুমানিক ব্যয় দুই হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেবে চীন এবং তারা তিন বছরের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে। চীন সাম্প্রতিক অতীতে উপহার হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একাধিক মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে, তাতে নদীর ওপারেও রাজধানীকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। চীনারা রাজধানীতে বিশাল চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রটিও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সর্বগ্রাসী দৃষ্টি পড়েছিল এই সম্মেলন কেন্দ্রের ওপর। তার কপালেও পাল্টানো নাম লিখে দিয়েছেন।
৪.
যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক চীনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা কারণ, নির্মাণব্যয়ের ১০ শতাংশ দক্ষিণা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হয়নি, চীনারা তো মোটেই দেবে না। আরো বড় কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা সে অনুমতি বর্তমান সরকারকে দেবে না। অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ পুরনো। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধও হয়েছিল। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিস্টরা’ (রণকৌশলবিশারদ) প্রায়ই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে অরুণাচলে চীনের সাথে বড় যুদ্ধ আসন্ন।
পলাশীর মতো ষড়যন্ত্র করে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্র্যানজিট, করিডোর ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দর দু’টি ব্যবহারের অধিকারও বর্তমান সরকার ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভারত এখন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতের দৃষ্টি মূলত চীনের সাথে বিরোধ। দুই দেশে যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যিই শুরু হয়, একমাত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ রণাঙ্গনে পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়। ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন যুদ্ধ শুরু হলে চীন প্রথম চোটেই জলপাইগুড়ির বাগদোগরা বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করবে এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের সরু সংযোগ পথটি বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত তার জঙ্গিবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ঘাঁটি চাইতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান সরকার যে আরো একটি ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নির্মাণ করতে উৎসাহী, তার কারণও ভারতের এ চাহিদা মেটানো।
চীন এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নম্বর পরাশক্তি। অদূর ভবিষ্যতে সে সমরশক্তিতেও এক নম্বরে উঠবে। ভারত আর তার নতুন পাওয়া মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই চীনকে ঘিরে একটা ব্যূহ রচনা করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে একটা নৌঘাঁটি লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এই হচ্ছে কারণ। চীন যদি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত পদ্মা সেতুিট তৈরি করে দেয় তাহলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা অঞ্চলে চীনের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সেটা ওয়াশিংটন কিংবা নয়াদিল্লির মুখরোচক হবে না।
(লন্ডন, ১৭.০৭.১২)
serajurrahman34@gmail.com

গুম, গুপ্তহত্যা এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব


প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ্
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন আমার নজর কাড়ে। এতে ফুটে উঠেছিল অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটি চিত্র। এই চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে দেখলেই গা শিউড়ে ওঠে। দেশজুড়ে অজ্ঞাত লাশের ছড়াছড়ি। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ। রাস্তার পাশে, বিলে-ঝিলে, রেললাইনে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের লাশ। খুনের পর বস্তাবন্দি করে ডাস্টবিন, ঝিল, হাওর, জঙ্গলে ফেলে রেখে লাশ গুমের অপচেষ্টা চালানো হয়। বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ পাওয়ার পর অনেকের পরিচয়ও মেলে না। এ ধরনের নাম-পরিচয়হীন লাশের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব হত্যার তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও কূটনৈতিক। গত ৬ মাসে ৯১৯টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাবে মাত্র সাড়ে তিন মাসেই প্রায় ৩০ জনকে গুম করা হয়েছে। উপর্যুপরি গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা রাজনীতিসহ সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং আমাদের সমাজ ভয়াবহ অসুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত সোয়া তিন বছরেই মহাজোট সরকার ব্যর্থতার বিরাট পাহাড় বানিয়েছে। সে পাহাড়ের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে পড়া জনগণের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই সরকারের পদ্মা সেতু আর রেলমন্ত্রীর অর্থ দুর্নীতির কথা আপনাদের সবারই জানা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরনো আওয়ামী কৌশল গুম ও গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর রাজনীতি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের গুম ও গুপ্তহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী মহাজোট সরকার গুম ও গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে! পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ৩০ জন, ২০১১ সালে ৭০ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ৩০ জন। অর্থাত্ মহাজোট সরকারের গত সোয়া দু’বছরে গুম হয়েছে ১৩০ ব্যক্তি। এ হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে, যা মিডিয়াতে আসছে না। এখন আর চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী নন, এখন এর শিকার হচ্ছেন রাজনীতিকসহ সাধারণ মানুষ। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দেশপ্রেমিক এম ইলিয়াস আলী।
গুম আর গুপ্তহত্যার পেছনে আসলে কারা রয়েছে, কার বা কাদের ইন্ধনে এসব বলিখেলা চলছে, সেটা আর হিসেব কষে মেলাতে হয় না। শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই কেন শিকার বানানো হচ্ছে—এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এরই মধ্যে সাধারণ জনগণ জেনে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে খুন ও নির্যাতন বাংলাদেশে মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মতে নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশ সরকার।
বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘ দু’বছর ধরে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলামকে এর এক বছর আগে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত হন যশোরের ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের সালনায়। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। র্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। বরিশালের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানকে ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে গুম করা হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে। মিরপুরের ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী মাসুম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান ওরফে সোয়েল ও ঢাকা মহানগর ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেনকে ২৮ নভেম্বর হাতিরপুল থেকে অপহরণ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে দুটি লাশ পাওয়া যায়। এর একটি ইসমাইল হোসেনের বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। সোহেল ও মাসুম এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। সাভারের কলমা এলাকার ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম স্বপন প্রায় ৯ মাস ধরে নিখোঁজ। অনেকের ধারণা শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা খুন হয়েছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একসঙ্গে ৬ ব্যক্তিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করা হয়। এদের মধ্যে আসাদ সিকদার নামে একজনকে পথিমধ্যে নামিয়ে দেয়া হলেও এখনও ৫ জন নিখোঁজ আছেন। মাদারীপুর থেকে দেলোয়ার হোসেনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কারোই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মূলত এ কারণেই আমরা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমাদের দেশ কি সোমালিয়া হয়ে গেছে, নাকি ভারত অধিকৃত কাশ্মীর কিংবা ন্যাটোর দখলে চলে যাওয়া আফগানিস্তানে পরিণত হয়েছে যে, কোনো নাগরিক গুম ও গুপ্তহত্যা হলে তার হদিস পাওয়া যাবে না? এমন অবস্থা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দেশে সুয়োমোটো জারিকারী উচ্চ আদালত থাকা সত্ত্বেও একের পর এক মানুষ গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। সরকার এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেকের ধারণা, সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী দেশি-বিদেশি অপশক্তির সহযোগিতায় ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছে।
আমরা মনে করি, কারও সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে, রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষকে এভাবে শাস্তি দেয়া যায় না। গুমের দায়িত্ব এ সরকারকেই নিতে হবে। আর এ প্রবণতা যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন যারা এতে সমর্থন দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও এর শিকার হবেন না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! গুম ও গুপ্তহত্যা দুটোই জঘন্য এবং ভয়াবহ অপরাধ। একের পর এক গুম হওয়ার বিষয়টি দেশ এবং জাতির জন্য সুখকর নয়। এ ধরনের রহস্যজনক নিখোঁজ ও গুপ্তহত্যা ঘটনার রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না, যা সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতি বিকাশের জন্য একটি হুমকি। এভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েছে এবং বাংলাদেশ সমাজ একটি ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে।
আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর মতো দেশপ্রেমিক নেতাকে নিয়ে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মশকরা করছেন এবং তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আরও মনে করি, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকেই গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে। এটা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে বের না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই ধরে নেয়া হবে। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মূলত সরকারের নিজস্ব দুর্বলতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরকার নিজে মদত দেয়ার কারণে। বিচারব্যবস্থা দলীয়করণের ফলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অন্যায় জুলুম-নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’র ঘটনাও রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাত্ যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়-দায়িত্ব সরকারের। মহাজোট সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তার পরিচয় দিচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং যখন দেশে একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে, তখন গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ গুমের রহস্য দ্রুত উদঘাটন করে ইলিয়াস আলীকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। এটি যদি সরকার করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, অথবা সরকার নিজেই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ দুটো বিষয়ের কোনোটিই কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি অশনি সংকেত।
দেশপ্রেমিক জননেতা ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর ফেরত আসার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব জড়িত। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের ভেতর যে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগ্রত হয়েছে, সেটি নিরসনে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সমাজ আজ ভয়াবহ অসুস্থ, রাষ্ট্র আজ মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূল ধারাগুলো আজ ভূলুণ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ও একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ত্যাগী সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে বর্তমান সরকার এবং দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে ততই এদেশের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়বে এবং একসময় বাংলাদেশের অস্বিত্বও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গুম, গুপ্তহত্যা এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব

প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ্
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন আমার নজর কাড়ে। এতে ফুটে উঠেছিল অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটি চিত্র। এই চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে দেখলেই গা শিউড়ে ওঠে। দেশজুড়ে অজ্ঞাত লাশের ছড়াছড়ি। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ। রাস্তার পাশে, বিলে-ঝিলে, রেললাইনে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের লাশ। খুনের পর বস্তাবন্দি করে ডাস্টবিন, ঝিল, হাওর, জঙ্গলে ফেলে রেখে লাশ গুমের অপচেষ্টা চালানো হয়। বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ পাওয়ার পর অনেকের পরিচয়ও মেলে না। এ ধরনের নাম-পরিচয়হীন লাশের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব হত্যার তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও কূটনৈতিক। গত ৬ মাসে ৯১৯টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাবে মাত্র সাড়ে তিন মাসেই প্রায় ৩০ জনকে গুম করা হয়েছে। উপর্যুপরি গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা রাজনীতিসহ সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং আমাদের সমাজ ভয়াবহ অসুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত সোয়া তিন বছরেই মহাজোট সরকার ব্যর্থতার বিরাট পাহাড় বানিয়েছে। সে পাহাড়ের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে পড়া জনগণের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই সরকারের পদ্মা সেতু আর রেলমন্ত্রীর অর্থ দুর্নীতির কথা আপনাদের সবারই জানা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরনো আওয়ামী কৌশল গুম ও গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর রাজনীতি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের গুম ও গুপ্তহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী মহাজোট সরকার গুম ও গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে! পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ৩০ জন, ২০১১ সালে ৭০ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ৩০ জন। অর্থাত্ মহাজোট সরকারের গত সোয়া দু’বছরে গুম হয়েছে ১৩০ ব্যক্তি। এ হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে, যা মিডিয়াতে আসছে না। এখন আর চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী নন, এখন এর শিকার হচ্ছেন রাজনীতিকসহ সাধারণ মানুষ। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দেশপ্রেমিক এম ইলিয়াস আলী।
গুম আর গুপ্তহত্যার পেছনে আসলে কারা রয়েছে, কার বা কাদের ইন্ধনে এসব বলিখেলা চলছে, সেটা আর হিসেব কষে মেলাতে হয় না। শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই কেন শিকার বানানো হচ্ছে—এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এরই মধ্যে সাধারণ জনগণ জেনে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে খুন ও নির্যাতন বাংলাদেশে মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মতে নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশ সরকার।
বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘ দু’বছর ধরে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলামকে এর এক বছর আগে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত হন যশোরের ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের সালনায়। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। র্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। বরিশালের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানকে ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে গুম করা হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে। মিরপুরের ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী মাসুম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান ওরফে সোয়েল ও ঢাকা মহানগর ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেনকে ২৮ নভেম্বর হাতিরপুল থেকে অপহরণ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে দুটি লাশ পাওয়া যায়। এর একটি ইসমাইল হোসেনের বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। সোহেল ও মাসুম এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। সাভারের কলমা এলাকার ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম স্বপন প্রায় ৯ মাস ধরে নিখোঁজ। অনেকের ধারণা শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা খুন হয়েছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একসঙ্গে ৬ ব্যক্তিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করা হয়। এদের মধ্যে আসাদ সিকদার নামে একজনকে পথিমধ্যে নামিয়ে দেয়া হলেও এখনও ৫ জন নিখোঁজ আছেন। মাদারীপুর থেকে দেলোয়ার হোসেনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কারোই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মূলত এ কারণেই আমরা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমাদের দেশ কি সোমালিয়া হয়ে গেছে, নাকি ভারত অধিকৃত কাশ্মীর কিংবা ন্যাটোর দখলে চলে যাওয়া আফগানিস্তানে পরিণত হয়েছে যে, কোনো নাগরিক গুম ও গুপ্তহত্যা হলে তার হদিস পাওয়া যাবে না? এমন অবস্থা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দেশে সুয়োমোটো জারিকারী উচ্চ আদালত থাকা সত্ত্বেও একের পর এক মানুষ গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। সরকার এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেকের ধারণা, সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী দেশি-বিদেশি অপশক্তির সহযোগিতায় ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছে।
আমরা মনে করি, কারও সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে, রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষকে এভাবে শাস্তি দেয়া যায় না। গুমের দায়িত্ব এ সরকারকেই নিতে হবে। আর এ প্রবণতা যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন যারা এতে সমর্থন দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও এর শিকার হবেন না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! গুম ও গুপ্তহত্যা দুটোই জঘন্য এবং ভয়াবহ অপরাধ। একের পর এক গুম হওয়ার বিষয়টি দেশ এবং জাতির জন্য সুখকর নয়। এ ধরনের রহস্যজনক নিখোঁজ ও গুপ্তহত্যা ঘটনার রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না, যা সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতি বিকাশের জন্য একটি হুমকি। এভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েছে এবং বাংলাদেশ সমাজ একটি ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে।
আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর মতো দেশপ্রেমিক নেতাকে নিয়ে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মশকরা করছেন এবং তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আরও মনে করি, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকেই গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে। এটা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে বের না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই ধরে নেয়া হবে। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মূলত সরকারের নিজস্ব দুর্বলতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরকার নিজে মদত দেয়ার কারণে। বিচারব্যবস্থা দলীয়করণের ফলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অন্যায় জুলুম-নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’র ঘটনাও রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাত্ যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়-দায়িত্ব সরকারের। মহাজোট সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তার পরিচয় দিচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং যখন দেশে একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে, তখন গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ গুমের রহস্য দ্রুত উদঘাটন করে ইলিয়াস আলীকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। এটি যদি সরকার করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, অথবা সরকার নিজেই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ দুটো বিষয়ের কোনোটিই কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি অশনি সংকেত।
দেশপ্রেমিক জননেতা ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর ফেরত আসার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব জড়িত। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের ভেতর যে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগ্রত হয়েছে, সেটি নিরসনে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সমাজ আজ ভয়াবহ অসুস্থ, রাষ্ট্র আজ মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূল ধারাগুলো আজ ভূলুণ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ও একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ত্যাগী সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে বর্তমান সরকার এবং দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে ততই এদেশের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়বে এবং একসময় বাংলাদেশের অস্বিত্বও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুরাদনগর ইউপি নির্বাচনের শিক্ষা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়

সৈয়দ আবদাল আহমদ
গত ১৬ জুলাই কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদে একটি উপনির্বাচন হয়ে গেল। এই উপনির্বাচনে দশজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন দলীয়ভাবে না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী ছিলেন ছয়জন এবং বিএনপি সমর্থক একজন। বাকিরা ছিলেন স্বতন্ত্র। র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ প্রশাসনের উপস্থিতিতে সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ইউনিয়নের ১১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলে। নির্বাচনটি পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকা থেকে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলও সেখানে যায়।
মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণ শেষে স্ব-স্ব কেন্দ্রে ভোটগণনার কাজও চলে। কেন্দ্রগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের এজেন্ট ও প্রতিনিধিদের সামনে প্রিজাইডিং অফিসার ভোটগণনার পর ফলাফল ঘোষণা করেন এবং রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করেন। এরপর প্রতিটি কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স নিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তারা উপজেলা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের দিকে রওনা দেন। কিন্তু ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ভুবনঘর এলাকায় পৌঁছলে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী বশীর আহমেদের ক্যাডাররা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্যালট বাক্সের বস্তা ছিনিয়ে নিয়ে গোমতী নদীতে ফেলে দেয়। রাত সোয়া আটটায় ১১টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন উপজেলা রিটার্নিং অফিসার। এতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল কালাম (মাইক প্রতীক) ভোট পান ৩ হাজার ৭২৬টি। অন্যদিকে তার নিকটতম আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বশীর আহমেদ (গরুর গাড়ি) ভোট পান ৩ হাজার ৩৭৭টি। একটি কেন্দ্রের ভোট ছিনতাই হওয়ায় ওই কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেননি রিটার্নিং অফিসার। স্থগিত কেন্দ্রের ১ হাজার ২৮০ ভোটের মধ্যে ৯৫৫ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল কালাম ৩৭৩ ভোট পান। তার নিকটতম প্রার্থী সাধন চন্দ্র পান ২৪৩ ভোট। যদিও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ওই ফল আগেই ঘোষণা হয়েছে এবং নির্বাচনী কর্মকর্তারা রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করে স্ব-স্ব এজেন্টকে কপিও দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীর ক্যাডাররা ব্যালট ছিনতাই করার কারণে রিটার্নিং অফিসার ইউপি চেয়ারম্যান পদের উপনির্বাচনের পুরো ফল ঘোষণাই স্থগিত রাখেন। অর্থাত্ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অন্যসব প্রার্থীর চেয়ে কয়েকশ’ ভোটে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়নি। পুরো ফলই স্থগিত রাখা হয়েছে। এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার ভাগ্য যে কী হয়, তা মুরাদনগর উপজেলার ১৬ নং ধামঘর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদের ওই উপনির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একটি ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারল না এবং প্রশাসন ব্যর্থ হলো, সেখানে জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তার অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
গত বছরের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এবং সেই নির্বাচনে দলীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই ঘটবে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের পর সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে হুশিয়ারি দিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে বিএনপি। তারা এ কথাও বলে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সরকারি সিদ্ধান্ত গণতন্ত্র ধ্বংস করার একটি মহাপরিকল্পনা। এটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে একদলীয় শাসন কায়েমের নীলনকশা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্যই এ কাজটি করছে। কিন্তু বিএনপির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও গত বছরের ৩০ জুন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ফলে বিএনপি আন্দোলনের পথে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে বিএনপি বেশ কয়েকটি হরতাল করেছে, গণমিছিল করেছে, গণঅনশন করেছে এবং ঢাকা চলো কর্মসূচি পালন করেছে। বিরোধী দলের এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার কঠোর অবস্থানে যায় এবং দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালায়। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে সরকার পরিস্থিতিকে এমন ঘোলাটে করে তোলে যে, বিরোধী দলের পক্ষে কঠোর আন্দোলন ধরে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়। তিন মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেল। আজও জানা যায়নি কোথায় আছেন ইলিয়াস আলী। তার সন্ধানের দাবিতে বিরোধী দল যখন হরতাল করে, ঠিক তখনই একটি গাড়ি পোড়ানোর মামলার অজুহাত সৃষ্টি করে সরকার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী জোটের ৪৫ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তারা মুক্ত। বিএনপি ১৮ দলীয় জোট গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন এখন তেমন জোরদার না হলেও বিরোধীদলীয় নেতা ও ১৮ দলীয় জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, ঈদের পর সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা হবে।
আওয়ামী লীগের এমপি সোহেল তাজ সম্প্রতি এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেক নাটকের পর অবশেষে স্পিকার তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। গাজীপুরের কাপাসিয়া আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। এ আসনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি গত ১৬ জুলাই স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এ উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী দল যে নির্বাচন করবে না, এ সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ।
দলীয় সরকার নয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই যে নির

মুরাদনগর ইউপি নির্বাচনের শিক্ষা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়



সৈয়দ আবদাল আহমদ
গত ১৬ জুলাই কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদে একটি উপনির্বাচন হয়ে গেল। এই উপনির্বাচনে দশজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন দলীয়ভাবে না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী ছিলেন ছয়জন এবং বিএনপি সমর্থক একজন। বাকিরা ছিলেন স্বতন্ত্র। র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ প্রশাসনের উপস্থিতিতে সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ইউনিয়নের ১১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলে। নির্বাচনটি পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকা থেকে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলও সেখানে যায়।
মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণ শেষে স্ব-স্ব কেন্দ্রে ভোটগণনার কাজও চলে। কেন্দ্রগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের এজেন্ট ও প্রতিনিধিদের সামনে প্রিজাইডিং অফিসার ভোটগণনার পর ফলাফল ঘোষণা করেন এবং রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করেন। এরপর প্রতিটি কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স নিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তারা উপজেলা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের দিকে রওনা দেন। কিন্তু ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ভুবনঘর এলাকায় পৌঁছলে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী বশীর আহমেদের ক্যাডাররা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্যালট বাক্সের বস্তা ছিনিয়ে নিয়ে গোমতী নদীতে ফেলে দেয়। রাত সোয়া আটটায় ১১টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন উপজেলা রিটার্নিং অফিসার। এতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল কালাম (মাইক প্রতীক) ভোট পান ৩ হাজার ৭২৬টি। অন্যদিকে তার নিকটতম আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বশীর আহমেদ (গরুর গাড়ি) ভোট পান ৩ হাজার ৩৭৭টি। একটি কেন্দ্রের ভোট ছিনতাই হওয়ায় ওই কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেননি রিটার্নিং অফিসার। স্থগিত কেন্দ্রের ১ হাজার ২৮০ ভোটের মধ্যে ৯৫৫ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল কালাম ৩৭৩ ভোট পান। তার নিকটতম প্রার্থী সাধন চন্দ্র পান ২৪৩ ভোট। যদিও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ওই ফল আগেই ঘোষণা হয়েছে এবং নির্বাচনী কর্মকর্তারা রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করে স্ব-স্ব এজেন্টকে কপিও দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীর ক্যাডাররা ব্যালট ছিনতাই করার কারণে রিটার্নিং অফিসার ইউপি চেয়ারম্যান পদের উপনির্বাচনের পুরো ফল ঘোষণাই স্থগিত রাখেন। অর্থাত্ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অন্যসব প্রার্থীর চেয়ে কয়েকশ’ ভোটে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়নি। পুরো ফলই স্থগিত রাখা হয়েছে। এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার ভাগ্য যে কী হয়, তা মুরাদনগর উপজেলার ১৬ নং ধামঘর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদের ওই উপনির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একটি ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারল না এবং প্রশাসন ব্যর্থ হলো, সেখানে জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তার অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
গত বছরের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এবং সেই নির্বাচনে দলীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই ঘটবে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের পর সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে হুশিয়ারি দিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে বিএনপি। তারা এ কথাও বলে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সরকারি সিদ্ধান্ত গণতন্ত্র ধ্বংস করার একটি মহাপরিকল্পনা। এটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে একদলীয় শাসন কায়েমের নীলনকশা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্যই এ কাজটি করছে। কিন্তু বিএনপির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও গত বছরের ৩০ জুন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ফলে বিএনপি আন্দোলনের পথে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে বিএনপি বেশ কয়েকটি হরতাল করেছে, গণমিছিল করেছে, গণঅনশন করেছে এবং ঢাকা চলো কর্মসূচি পালন করেছে। বিরোধী দলের এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার কঠোর অবস্থানে যায় এবং দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালায়। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে সরকার পরিস্থিতিকে এমন ঘোলাটে করে তোলে যে, বিরোধী দলের পক্ষে কঠোর আন্দোলন ধরে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়। তিন মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেল। আজও জানা যায়নি কোথায় আছেন ইলিয়াস আলী। তার সন্ধানের দাবিতে বিরোধী দল যখন হরতাল করে, ঠিক তখনই একটি গাড়ি পোড়ানোর মামলার অজুহাত সৃষ্টি করে সরকার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী জোটের ৪৫ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তারা মুক্ত। বিএনপি ১৮ দলীয় জোট গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন এখন তেমন জোরদার না হলেও বিরোধীদলীয় নেতা ও ১৮ দলীয় জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, ঈদের পর সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা হবে।
আওয়ামী লীগের এমপি সোহেল তাজ সম্প্রতি এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেক নাটকের পর অবশেষে স্পিকার তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। গাজীপুরের কাপাসিয়া আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। এ আসনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি গত ১৬ জুলাই স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এ উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী দল যে নির্বাচন করবে না, এ সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ।
দলীয় সরকার নয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই যে নির

গুম, গুপ্তহত্যা এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব



প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ্
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন আমার নজর কাড়ে। এতে ফুটে উঠেছিল অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটি চিত্র। এই চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে দেখলেই গা শিউড়ে ওঠে। দেশজুড়ে অজ্ঞাত লাশের ছড়াছড়ি। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ। রাস্তার পাশে, বিলে-ঝিলে, রেললাইনে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের লাশ। খুনের পর বস্তাবন্দি করে ডাস্টবিন, ঝিল, হাওর, জঙ্গলে ফেলে রেখে লাশ গুমের অপচেষ্টা চালানো হয়। বেওয়ারিশ হিসাবে লাশ পাওয়ার পর অনেকের পরিচয়ও মেলে না। এ ধরনের নাম-পরিচয়হীন লাশের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব হত্যার তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও কূটনৈতিক। গত ৬ মাসে ৯১৯টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাবে মাত্র সাড়ে তিন মাসেই প্রায় ৩০ জনকে গুম করা হয়েছে। উপর্যুপরি গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা রাজনীতিসহ সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং আমাদের সমাজ ভয়াবহ অসুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত সোয়া তিন বছরেই মহাজোট সরকার ব্যর্থতার বিরাট পাহাড় বানিয়েছে। সে পাহাড়ের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে পড়া জনগণের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই সরকারের পদ্মা সেতু আর রেলমন্ত্রীর অর্থ দুর্নীতির কথা আপনাদের সবারই জানা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরনো আওয়ামী কৌশল গুম ও গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর রাজনীতি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের গুম ও গুপ্তহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী মহাজোট সরকার গুম ও গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে! পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ৩০ জন, ২০১১ সালে ৭০ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত গুম হয়েছে ৩০ জন। অর্থাত্ মহাজোট সরকারের গত সোয়া দু’বছরে গুম হয়েছে ১৩০ ব্যক্তি। এ হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে, যা মিডিয়াতে আসছে না। এখন আর চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী নন, এখন এর শিকার হচ্ছেন রাজনীতিকসহ সাধারণ মানুষ। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দেশপ্রেমিক এম ইলিয়াস আলী।
গুম আর গুপ্তহত্যার পেছনে আসলে কারা রয়েছে, কার বা কাদের ইন্ধনে এসব বলিখেলা চলছে, সেটা আর হিসেব কষে মেলাতে হয় না। শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরই কেন শিকার বানানো হচ্ছে—এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এরই মধ্যে সাধারণ জনগণ জেনে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে খুন ও নির্যাতন বাংলাদেশে মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মতে নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশ সরকার।
বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘ দু’বছর ধরে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলামকে এর এক বছর আগে র্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত হন যশোরের ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের সালনায়। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। র্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। বরিশালের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানকে ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে গুম করা হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে। মিরপুরের ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী মাসুম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান ওরফে সোয়েল ও ঢাকা মহানগর ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেনকে ২৮ নভেম্বর হাতিরপুল থেকে অপহরণ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে দুটি লাশ পাওয়া যায়। এর একটি ইসমাইল হোসেনের বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। সোহেল ও মাসুম এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। সাভারের কলমা এলাকার ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম স্বপন প্রায় ৯ মাস ধরে নিখোঁজ। অনেকের ধারণা শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা খুন হয়েছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একসঙ্গে ৬ ব্যক্তিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করা হয়। এদের মধ্যে আসাদ সিকদার নামে একজনকে পথিমধ্যে নামিয়ে দেয়া হলেও এখনও ৫ জন নিখোঁজ আছেন। মাদারীপুর থেকে দেলোয়ার হোসেনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কারোই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মূলত এ কারণেই আমরা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমাদের দেশ কি সোমালিয়া হয়ে গেছে, নাকি ভারত অধিকৃত কাশ্মীর কিংবা ন্যাটোর দখলে চলে যাওয়া আফগানিস্তানে পরিণত হয়েছে যে, কোনো নাগরিক গুম ও গুপ্তহত্যা হলে তার হদিস পাওয়া যাবে না? এমন অবস্থা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দেশে সুয়োমোটো জারিকারী উচ্চ আদালত থাকা সত্ত্বেও একের পর এক মানুষ গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। সরকার এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেকের ধারণা, সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী দেশি-বিদেশি অপশক্তির সহযোগিতায় ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছে।
আমরা মনে করি, কারও সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে, রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষকে এভাবে শাস্তি দেয়া যায় না। গুমের দায়িত্ব এ সরকারকেই নিতে হবে। আর এ প্রবণতা যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন যারা এতে সমর্থন দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও এর শিকার হবেন না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! গুম ও গুপ্তহত্যা দুটোই জঘন্য এবং ভয়াবহ অপরাধ। একের পর এক গুম হওয়ার বিষয়টি দেশ এবং জাতির জন্য সুখকর নয়। এ ধরনের রহস্যজনক নিখোঁজ ও গুপ্তহত্যা ঘটনার রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না, যা সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতি বিকাশের জন্য একটি হুমকি। এভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েছে এবং বাংলাদেশ সমাজ একটি ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে।
আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর মতো দেশপ্রেমিক নেতাকে নিয়ে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মশকরা করছেন এবং তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আরও মনে করি, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকেই গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে। এটা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ইলিয়াস আলীকে বের না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই ধরে নেয়া হবে। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মূলত সরকারের নিজস্ব দুর্বলতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরকার নিজে মদত দেয়ার কারণে। বিচারব্যবস্থা দলীয়করণের ফলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অন্যায় জুলুম-নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’র ঘটনাও রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাত্ যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়-দায়িত্ব সরকারের। মহাজোট সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তার পরিচয় দিচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং যখন দেশে একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে, তখন গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ গুমের রহস্য দ্রুত উদঘাটন করে ইলিয়াস আলীকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। এটি যদি সরকার করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, অথবা সরকার নিজেই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ দুটো বিষয়ের কোনোটিই কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি অশনি সংকেত।
দেশপ্রেমিক জননেতা ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, ইলিয়াস আলীর ফেরত আসার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব জড়িত। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের ভেতর যে ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগ্রত হয়েছে, সেটি নিরসনে ইলিয়াস আলীকে ফেরত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সমাজ আজ ভয়াবহ অসুস্থ, রাষ্ট্র আজ মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূল ধারাগুলো আজ ভূলুণ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ও একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ত্যাগী সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে বর্তমান সরকার এবং দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে ততই এদেশের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়বে এবং একসময় বাংলাদেশের অস্বিত্বও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব


॥ সিরাজুর রহমান ॥

১.
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, সরকার যদি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠির বিবরণ প্রকাশ করতে চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক আপত্তি করবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ 
করে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সে চিঠির বয়ান প্রকাশ করবে না।
ইদানীং সরকার যেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। এমন দিন যায় না যেদিন শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন না। বহু বিবৃতির মধ্যে একটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক (তার সরকারকে) প্রতারণা করেছে। অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য এই ব্যাংক সম্বন্ধে অডিট করতে হবে। তার খাদ্যমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী আর মতিয়া চৌধুরী আত্মপ্রতারণা করছেন। তারা কি এতই শক্তিধর যে তাদের কথায় বাকি পৃথিবী বিশ্বব্যাংক সম্বন্ধে তদন্ত করবে? বিশেষ করে যখন বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ইমেজ ‘নেগেটিভ’। প্রকৃত ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বাংলাদেশের দিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ব্যাংক তারপর এ ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির বিবরণ সরকার গোপন রেখেছে, কিন্তু এক প্রতিবেদনে নাম ধরে এক মন্ত্রী, এক সচিব ও এক ডিরেক্টরের এবং নামোল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। ব্যাংক বলেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেন, অভিযোগ সম্বন্ধে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক হতাশ। অর্থাৎ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংক মঙ্গলবার আরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রতিবিধান করেনি বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্বন্ধে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সম্ভব নয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটা কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, অভিযুক্তরা এতই উচ্চাসনে উপবিষ্ট ও এতই শক্তিধর যে তাদের শাস্তিদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরং সে জন্য সরকার পদ্মা সেতুটি বিসর্জন দিতেও রাজি আছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার ও অন্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন।
‘নিজেদের সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের বহু আয়োজনও একই উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, দেশে নাকি ‘উদ্দীপনার‘ ঢল শুরু হয়েছে। কোন বালক নাকি তার টিফিনের পয়সা সেতু তৈরির জন্য দিতে চেয়েছে। নোয়াখালীর কোন স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। বিলম্ব না করে দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। এগুলোর একটি আবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকার আশা করছে যে প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে বিদেশী মুদ্রা জমা দেবেন।
২.
উদ্দীপনা কিংবা এক বালকের টিফিনের পয়সায় পদ্মার মতো জটিল নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা যায় না। লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে যেটুকু লক্ষ করেছি, আগাগোড়া দুর্নীতির চাদরে আবৃত বর্তমান সরকারের হাতে নিজেদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা তুলে দিতে প্রবাসীরা রাজি হবেন না। তারা জানেন সরকারকে দেয়া অর্থের বেশির ভাগই দুর্নীতির খোরাক জোগাতে লাপাত্তা হয়ে যাবে। সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ যে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর পকেটে যাবে, তার নমুনা দেখা গেছে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার এখন পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করেছে। তাতে বর্তমানে দেশজোড়া যে চাঁদাবাজি চলছে সেটাকেই বৈধতা দেয়া হবে। সে চাঁদাবাজির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র মারা গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে সেতুর অর্থায়ন সম্ভব হবে। শত দুঃখের মধ্যেও এ প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের হাস্যোদ্রেক করবে। পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের যথাসর্বস্ব শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। বহু হাজার কোটি টাকার সে লগ্নি সরকারের পৃষ্ঠপোষকেরা লুটেপুটে খেয়েছে। বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বাবদ জ্বালানি খাত থেকে আরো বহু হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। তেমনি লুটপাট করেছে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারের আওয়ামী লীগপন্থী সিন্ডিকেটগুলো। যদ্দুর জানা যায়, এই টাকার পাহাড় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেসব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সেতুর অর্থায়নের একটা অংশ সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে সেতু নির্মাণের জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে শেয়ারবাজারে লগ্নি করবে।
বলা হচ্ছে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অন্য মন্ত্রী দফতরগুলো থেকেও একই রকমভাবে টাকা নিয়ে সেতু নির্মাণ তহবিলে দেয়া হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সরকারের তহবিলে টাকা নেই। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্যও সরকারকে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হয়। শুনেছি, সরকারের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারীরা নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে সে টাকা ফেরত দেয়ার মতো তারল্য নাকি কোনো কোনো ব্যাংকের নেই। প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলে আমাদের প্রতিরক্ষা, আমাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করার কাজ অবশ্যই বিঘিœত হবে। 
৩.
মাত্র দু-তিন দিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, দুই শ’রও বেশি ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশ এলাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কোস্ট গার্ডকে দেখা যায়নি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও সমানেই সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু মেরামত হয় না। মেঘনা সেতু ধসে পড়েছে বলে দক্ষিণ বাংলাদেশ ও চাঁদপুরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট আঘাত। বরাদ্দ অর্থের একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে ছিনিয়ে নেয়া হলে সড়ক আর সেতুগুলো চলাচলের উপযোগী থাকবে না। 
সবচেয়ে বড় কথা দেশী টাকা বড়জোর মাটি কাটা ও জমির ক্ষতিপূরণ দানের কাজেই লাগতে পারে। মোট ব্যয়ের গরিষ্ঠ অংশই ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি বাবদ। সেই বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়া না হলে তারা টাকা দেবে না। তারা না দিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশও টাকা দিতে রাজি হবে না। ফলে দেখা যাবে যত টাকাই সরকার তুলুক না তাতে সেতু তৈরি হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সন্দেহ করেছেন, সংগৃহীত অর্থ আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার এবং ভোট কেনার কাজেই ব্যয়িত হবে।
পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, সেতুর আনুমানিক ব্যয় দুই হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেবে চীন এবং তারা তিন বছরের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে। চীন সাম্প্রতিক অতীতে উপহার হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একাধিক মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে, তাতে নদীর ওপারেও রাজধানীকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। চীনারা রাজধানীতে বিশাল চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রটিও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সর্বগ্রাসী দৃষ্টি পড়েছিল এই সম্মেলন কেন্দ্রের ওপর। তার কপালেও পাল্টানো নাম লিখে দিয়েছেন।
৪.
যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক চীনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা কারণ, নির্মাণব্যয়ের ১০ শতাংশ দক্ষিণা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হয়নি, চীনারা তো মোটেই দেবে না। আরো বড় কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা সে অনুমতি বর্তমান সরকারকে দেবে না। অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ পুরনো। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধও হয়েছিল। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিস্টরা’ (রণকৌশলবিশারদ) প্রায়ই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে অরুণাচলে চীনের সাথে বড় যুদ্ধ আসন্ন।
পলাশীর মতো ষড়যন্ত্র করে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্র্যানজিট, করিডোর ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দর দু’টি ব্যবহারের অধিকারও বর্তমান সরকার ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভারত এখন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতের দৃষ্টি মূলত চীনের সাথে বিরোধ। দুই দেশে যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যিই শুরু হয়, একমাত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ রণাঙ্গনে পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়। ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন যুদ্ধ শুরু হলে চীন প্রথম চোটেই জলপাইগুড়ির বাগদোগরা বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করবে এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের সরু সংযোগ পথটি বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত তার জঙ্গিবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ঘাঁটি চাইতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান সরকার যে আরো একটি ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নির্মাণ করতে উৎসাহী, তার কারণও ভারতের এ চাহিদা মেটানো।
চীন এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নম্বর পরাশক্তি। অদূর ভবিষ্যতে সে সমরশক্তিতেও এক নম্বরে উঠবে। ভারত আর তার নতুন পাওয়া মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই চীনকে ঘিরে একটা ব্যূহ রচনা করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে একটা নৌঘাঁটি লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এই হচ্ছে কারণ। চীন যদি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত পদ্মা সেতুিট তৈরি করে দেয় তাহলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা অঞ্চলে চীনের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সেটা ওয়াশিংটন কিংবা নয়াদিল্লির মুখরোচক হবে না। 
(লন্ডন, ১৭.০৭.১২) 
serajurrahman34@gmail.com

রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১২

যদি আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এখন থেকে একশ’ বছর পরে, অথবা এক হাজার বছর পরে, কিংবা আরও পরে, যদি তখনও মানুষ থাকে পৃথিবীতে, কেউ না কেউ প্রশ্ন করবে আমাদের সময় ও জীবন নিয়ে—ন্যায়, নীতি, সততা, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব, বিচার ও প্রেমহীন একটি সময়ে ওই লোকগুলো বেঁচে ছিল কীভাবে? তাদের উদ্দেশে এই হানাহানি, বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসম্প্রীতি ও অবিবেচনায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সময়ের পত্রহীন, পুষ্পহীন, বাষ্পহীন, অনুতাপহীন প্রান্তর থেকে বলে রাখছি, যদি এই লেখা তাদের কাছে পৌঁছে আমাদের অনেক কিছু ছিল না, এ কথা সত্য। বন্য শুয়োরের কাদা ঘাঁটার মতো সীমিত, সংকীর্ণ ও নোংরা হয়ে পড়েছিল আমাদের জীবন। তারপরও আমরা বেঁচেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, আনন্দ ও বেদনার নুনপানিতে ভেসেছিলাম শুধু একটি কারণে—আমাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন। কবি আল মাহমুদ ছিলেন। মাত্র একজন কবি ছিলেন বলেই আমাদের প্রতিদিনের রুমালগুলো সূচিকর্মহীন ছিল না।
আজকের এই দিনে, এখনও যাদের মানুষ হিসাবে ধরে নেয়া যায়, এখনও যারা সাদা আর কালোর পার্থক্য কিছুটা হলেও ধরতে পারেন, তাদের বলি, আল মাহমুদ আমাদের মধ্যে আছেন বলেই আমরা আছি। যে কয়টি সংবাদ আমাদের প্রতিটি সূর্যোদয়কে সম্ভাবনাময় করে তোলে তার অন্যতম আল মাহমুদের বিচরণশীলতা। তাঁর সচলতা ও সক্ষমতা। তার বহমান সৃষ্টিশীলতা। তিনি আছেন বলেই আমাদের দিনগুলো কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে যায় না। ডুবতে ডুবতেও ডুবে যায় না, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শিশুর গালে চুমু খায়। আর রাতগুলো কালো হতে হতেও পুরো কালো হয় না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস তার নীরবতাকে চুরমার করলেও সে কিছুটা উদ্বেগহীনতার মধ্যে আরাম খোঁজে। তারপর স্বপ্ন দেখে ডাবের মতো চাঁদ, ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
দুই
বাংলা সাহিত্যে মীরদের প্রথম আবির্ভাব ১৮৪৭ সালে মীর মশাররফ হোসেনের মধ্য দিয়ে। প্রথম এবং অসাধারণ ছিলেন সেই মীর। ১৮৮৫-তে যদি তার বহু বিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ নাও প্রকাশিত হতো তাহলেও তাকে নিয়ে আজ আমরা যা বলছি, তার ব্যত্যয় ঘটত না। যে কোনো বিচারেই তিনি আমাদের নবজাগরণের অগ্রদূত। এই মীরের জন্মের ৮৯ বছর পর ১৯৩৬ সালে দেশের আরেক প্রান্তে দ্বিতীয় মীরের জন্ম। এই মীর আল মাহমুদ। কবি আল মাহমুদ।
প্রথম মীরের সঙ্গে দ্বিতীয় মীরের মিল ও অমিল অনেক। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের পর আর যদি কিছু নাও লিখতেন, তাহলেও আল মাহমুদ আল মাহমুদই থাকতেন।
দুই মীরের বাড়ি দুই নদীর তীরে। একজন গড়াই কূলের। অন্যজন তিতাস তীরের। একজনের বিষাদ সিন্ধু এবং অন্যের সোনালী কাবিন—সমান মাত্রা ও শব্দবন্ধের। ‘স’ ও ‘ব’ তাদের মধ্যে সাধারণ। তবে অমিলটা হলো একজন মীর লিখতেন নামের আগে, অন্যজন মীর উপাধি কখনোই ব্যবহার করেননি।
কাজী আবদুল ওদুদ অবশ্য এই দুই মীরকে নিয়ে তার বিখ্যাত ‘মীর পরিবার’ গল্প গ্রন্থ লেখেননি। তবুও আহমদ মীর, মোস্তফা মীর, আশরাফ মীর এঁরা ‘মীর’ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন।
তিন
আসলেই ‘মীর’ বর্জনকারী আল মাহমুদ আমাদের জসীমউদ্দীন। আমাদের নকশিকাঁথার মাঠ। আমাদের সোজন বাদিয়ার ঘাট। আমাদের বালুচর।
তিনি আমাদের জীবননানন্দ। আমাদের মহা পৃথিবী। আমাদের সাতটি তারার তিমির।
তিনি নজরুলের সকালবেলার পাখি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাত সঙ্গীত।
তিনি আছেন আমাদের জাগরণে। আমাদের স্বপ্নে। আমাদের মনে। আমাদের দেহে। আমাদের তিনশত চল্লিশ নদীর বাঁকে বাঁকে। তিনি আছেন আমাদের পানিউড়ি পাখির ছতরে। তিনি আছেন ওপাড়ার সুন্দরী রোজেনার সর্ব অঙ্গের ঢেউয়ে। মকতবের মেয়ে আয়শা আখতারের খোলা চুলে। তিনি আছেন আমাদের ইসবগুলের দানার মতো জলভরা চোখে। আছেন শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশের চিকচিকে বালুতে।
আল মাহমুদ আছেন আমাদের সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে। পাহাড়পুরে। তিতাসে। ড্রেজার বালেশ্বরে। আছেন মুক্তিযুদ্ধে। আছেন বিরামপুরে। আছেন আমাদের খড়ের গম্বুজে। আমাদের প্রত্যাবর্তনের লজ্জায়। স্বপ্নের সানু দেশে। আল মাহমুদ আছেন আমাদের ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে। তিনি আছেন নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটিতে। তিনি আছেন ‘ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান’-এ। আছেন আমাদের চিন্তায়। চেতনায়। আমাদের সৃষ্টিশীলতায়।
চার
আল মাহমুদ আছেন বলেই এখনও স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আল মাহমুদ আছেন বলেই আমরা এখনও হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি। আল মাহমুদ আছেন বলেই ড. ইউনূস বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মৌলিক মৃত্তিকা হয়ে ওঠেন। উঁচুতে তুলে ধরেন দেশের সম্মান ও মর্যাদা। আল মাহমুদ আছেন বলেই মুসা ইব্রাহীম, এমএ মুহিত, নিশাত আর ওয়াসফিয়া এভারেস্টের ওপর পা রাখেন। আর সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার।
নোংরা, সংকীর্ণ, মূর্খ ও স্বার্থপর কিছু প্রাণীকে এখনও যে এদেশের মানুষ কবি বলে সম্মান করে, সে তো শুধু এই কারণে যে আল মাহমুদ এখনও বেঁচে আছেন।
পাঁচ
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যে কথাগুলো লিখলাম তা পড়ে অনেকের গা জ্বলে যাবে। শরীর চুলকাবে। আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মতো যারা একটু বেশি শয়তান, তারা বলবে আবেগের দোকানদারি করা হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করা হচ্ছে।
তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি থাকবে। আমরা তাদের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দেব। তারপর বলব, তোমাদের জীবন হলো নর্দমার ধারে। হাজারীবাগের ট্যানারির পচা পানিতে হয় তোমাদের অবগাহন। তোমাদের জীবন দুর্নীতি নিয়ে। তোমাদের সকাল হয় দুর্নীতির মাধ্যমে। দিন কাটে দুর্নীতি করে করে। রাতে ঘুমাও দুর্নীতির বিছানায়। স্বপ্নও দেখো দুর্নীতি নিয়ে। সাহিত্য তোমাদের মতো ‘হারামখোর’দের বিষয় নয়। আর কবিতা, সে তোমাদের সইবে না। ‘সুসংবদ্ধ কথামালা’ নিয়ে স্বপ্নের সওদাগরি যারা করে, তাদের ভাষা বোঝার জন্য নতুন চরের মতো হৃিপণ্ড চাই।
স্বপ্নের কথা বলতে বলতেই আমার চোখের চারদিকে তৈরি হচ্ছে ঘোর। এক ধরনের মায়াবী পর্দা উঠছে দুলে। কাজলের ছোঁয়ায় জেগে উঠছে প্রাণ। ভোরের মোরগের ডাক কানে আসছে। মোহনা কাছাকাছি বলেই বোধ করি শুনছি নোনা দরিয়ার ডাক। প্রিয় পাঠক, আসুন সেই সম্ভাবনা আর স্বপ্নের কথা তেলাওয়াত করি।
ছয়
জীবদ্দশায় আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পাবেন কিনা আমি জানি না। মরণোত্তর নোবেল দেয়ার বিধানও চালু হয়নি। যা হোক, পেলে ভালো। না পেলে না পাবেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য তো আর আল মাহমুদ কবিতা লেখেননি। এখন নোবেল পেলে আল মাহমুদের আর কী যায় আসবে। তবে আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। না পেলেও বাংলাভাষীরা আল মাহমুদ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে তাদের ঘর ও অন্তর।
তবে আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে তিনি বিশ্ব কবি সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বাংলাদেশ ও এশিয়ার সীমা তো তিনি ছাড়িয়েছেন সেই ১৯৭৩-এ সোনালি কাবিনের যুগেই। এখন দরকার বাদবাকি বিশ্বের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আল মাহমুদ নেবেন কেন। নেব আপনি, আমি, আমরা।
তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়াও এক মহা বিড়ম্বনার ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের দেশে। নোবেল লরিয়েটের জীবনকে অতিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীদের জুড়ি মেলা ভার। যেন নোবেল পাওয়াটা এক ধরনের ক্রিমিনাল অফেন্স। এই জন্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক জিল্লতি। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে নোবেল কমিটি পুরস্কারের অপমান করেছেন, এমন কথা বলার লোক সেদিনের কলকাতায় অভাব ছিল না। যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গালাগাল করার ক্ষেত্রে আমাদের যদুমধুরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। অমর্ত্য সেন ও প্রফেসর সালামের মতো যারা একটু অপ্রভাবশালী শুধু তারাই কিছুটা রেহাই পেয়েছেন।
যা হোক, সম্ভাবনার শেষ নেই। সম্ভাবনার কথা বলার মধ্যেও কোনো দোষ নেই। তাছাড়া সব ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হবে, এমন কোনো কথাও নেই। তো যদি আল মাহমুদ সৌভাগ্যক্রমে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান তাহলে কী হবে? এই কী হবের কোনো শেষ নেই। তার চেয়ে আমরা বরং ‘আল মাহমুদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি-উত্তর প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে কিছু অগ্রিম বাক্যাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখি। এই সব কাল্পনিক প্রতিক্রিয়া সত্য হোক, তা আমি চাই না। মিথ্যা হলে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেব।
প্রতিক্রিয়া ১ : সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ সামাদ, খন্দকার আশরাফ হোসেন, রবীন্দ্র গোপ, তসলিমা নাসরিন, সালাম আজাদ, মিনা ফারাহ, মাসুদা ভাট্টি, আসলাম সানি, লুত্ফর রহমান রিটনসহ আরও অনেকে নোবেল কমিটিকে চিঠি লিখবেন—মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে থাকা একজন মৌলবাদী কবিকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে মূলত বাংলাদেশকেই অপমান করা হয়েছে। অবিলম্বে এই পুরস্কার প্রত্যাহার করা হোক।
প্রতিক্রিয়া ২ : কবি মোহন রায়হান, নাসির আহমদ বলবেন—নোবেল পুরস্কার পান আর যাই পান, তিনি স্বৈরাচারী এরশাদের দালাল ছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ৩ : সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলবেন—এর ফলে দেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতা বৃদ্ধি পাবে। তাদেরই আশকারা দেয়া হলো। আমরা জানি কীভাবে নোবেল দেয়া হয়। আগে মদ খেতে হতো। এখন শরাব খেলেই পাওয়া যায়।
প্রতিক্রিয়া ৪ : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলবেন—নোবেল পুরস্কার পেলেই কেউ একজন কবি হয়ে যায় না। কবি হতে হলে রবীন্দ্রনাথের মতো ৮০ বছর বাঁচতে হয়। সংবিধানকে বুঝতে হয়।
প্রতিক্রিয়া ৫ : আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা আসবে তার কলামে—‘হাসান হাফিজুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, শামসুর রাহমান মরার আগে আমাকে বলে গেছেন, তাদের মৃত্যুর ২০ বছর পর যেন আমি বলি ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদের লেখা নয়। এটার একটা অংশ লিখেছিলেন শহীদ হুমায়ুন আজাদ এবং অন্য অংশ লিখেছিলেন আর একজন মরহুম এতাজ ইউসুফী।
প্রতিক্রিয়া ৬ : আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলবেন—নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটিতে মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ঢুকে পড়েছে।
প্রতিক্রিয়া ৭ : মতিয়া চৌধুরী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানাবেন—আল মাহমুদ তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা নির্মলেন্দু গুণের ধারে-কাছে যাওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না। সে আবার কিসের কবি।
প্রতিক্রিয়া ৮ : মাহবুব উল আলম হানিফের কথা—একজন মুক্তিযোদ্ধা যত বড় ত্যাগই স্বীকার করেন, তিনি যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাই হতে পারেন না, যদি না তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন। একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকই যেমন সঠিক মুক্তিযোদ্ধা, তেমন একজন কবি তখনই যথার্থ কবি এবং নোবেল পাওয়ার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন, যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হন।
প্রতিক্রিয়া ৯ : সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলবেন—দেশে এত ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’র সৈনিক থাকতে কেন আল মাহমুদের মতো লোকেরা নোবেল পায়, তা উদ্বেগের বিষয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার দিকটি আমার পুলিশ ও র্যাব খতিয়ে দেখছে।
প্রতিক্রিয়া ১০ : ড. সনজিদা খাতুন, শাহরিয়ার কবির কিংবা মুনতাসির মামুন বলবেন—তিনি মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধ চাননি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন।
প্রতিক্রিয়া ১১ : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং ড. আবুল বারাকাত বলবেন—আল মাহমুদের নোবেল প্রাপ্তির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মোটেও বাড়বে না, বাড়বে না জিডিপি। তা হলে এ পুরস্কার ধুয়ে কি পানি খাব?
প্রতিক্রিয়া ১২ : ‘তিনি জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাসাসের সভাপতি ছিলেন। সে সময় তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করেছিলেন কিনা তা দেখার জন্য মহামান্য আদালতের কাছে রুলনিশি জারির আবেদন করছি।’ এই আবেদনকারী হয়তো হবেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
প্রতিক্রিয়া ১৩ : ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, কিছু সাহিত্য সংঘের মাধ্যমে হয়তো গড়ে উঠবে একটি ‘আল মাহমুদের নোবেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে সামনে টানা কয়েকদিন মানববন্ধন করবে। সেখানে বক্তারা বলবেন—দেশে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। ড. ইউনূসের পর এবার যারা কবি আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন তারা দেশদ্রোহী। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা ‘র’-এর ভাড়াটে চর। এদের আক্কেলদাঁত উপড়ে ফেলা আজ জাতীয় কর্তব্য। দাঁত ওঠাতে সমস্যা থাকলে প্রত্যেকের একটি করে ঠ্যাং ভেঙে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নিন।
প্রতিক্রিয়া ১৪ : মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলবেন—আই অ্যাম একদম ফেড আপ। অল আর রাবিশ। নোবেল কমিটি এখন দুষ্টু কমিটি, ওটা একটা ফটকা বাজার।
প্রতিক্রিয়া ১৫ : হাসানুল হক ইনু বলবেন—আল মাহমুদের সঙ্গে মৌলবাদী মানবতাবিরোধীদের সম্পর্ক আছে। সেজন্য তাকে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলা সাহিত্য থেকে মাইনাস করতে হবে। তিনি যদি নিজে নিজে মাইনাস না হন, তাহলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে আমরাই তাকে মাইনাস করে দেব। কাউকে মাইনাস করার ক্ষেত্রে আমাদের যে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, তার পুরোটাই এক্ষেত্রে প্রয়োগ করব আমরা।
প্রতিক্রিয়া ১৬ : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হয়তো হাসতে হাসতে বলবেন—আল মাহমুদ নোবেল পেয়েছে তো কী হয়েছে? আগে পেয়েছিলেন একজন সুদখোর এবং এবার পেয়েছেন একজন ধর্মখোর।
প্রতিক্রিয়া ১৭ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলবেন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নোবেল পুরস্কার শোভা পাবে। আল মাহমুদের নোবেল পাওয়ার ভেতর দিয়ে সেই স্বপ্নই কিছুটা পূরণ হলো। এই নোবেল প্রাপ্তি দেশরত্ন বিশ্বনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারেরই একটি সাফল্য। আমরা এর আগে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বিজয় অর্জন করেছিলাম। তারপর চ্যাম্পিয়ন হয়েছি সমুদ্রবিজয়ে। এই চ্যাম্পিয়ন লাভের ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
প্রতিক্রিয়া ১৮ : কবি আল মাহমুদ যেসব বাড়িতে গেছেন, যাদের সঙ্গে মিশেছেন, তারা তড়িঘড়ি আল মাহমুদের সঙ্গে তোলা ছবি ড্রইং রুম ও অফিস কক্ষে বাঁধাই করে রাখবেন।
আর যেসব কবি-লেখক আল মাহমুদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পেরেছিলেন, তারা সেইসব সার্টিফিকেট ও ছবি নিয়ে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় বিপুল বেগে নাজিল হবেন।
সাত
এই ডামাডোলের মধ্যে কষ্টে কঁকিয়ে উঠবে দেশের আত্মা। সাধারণ মানুষ আহত হবেন, হবেন ক্ষুব্ধ। যারা সত্যিকার অর্থে সাহিত্যনিষ্ঠ, যারা সাহিত্যকে সাহিত্য দিয়েই বিচার করেন, তারা হবেন হতবাক। হবেন মহা বিরক্ত। কেউ কেউ হয়তো স্মরণ করবেন জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর কথা। তারপর ভেবে কূল পাবেন না, আমাদের এরা কোন ফার্মের বাসিন্দা।
শুধু কবি আল মাহমুদ থাকবেন নির্বিকার। কণ্ঠে হয়তো বড় জোর বাজতে পারে নিজেরই কয়েকটি চরণ—
‘বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য জাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাত্ পাল্টে গেল। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃণ্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনাজুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার?’
a_hyesikder@yahoo.com 

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

সেতু নয়, আগে মানসম্মান বাঁচান



আসিফ নজরুল

আশির দশকে বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার লাল কার্ড প্রাপ্তিতে ক্ষুব্ধ ফুটবলপাগল দর্শক ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দিয়েছিল—ফিফার চামড়া তুলে নেব আমরা। সে তুলনায় বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল আরও ভয়ংকর বিষয়। আগের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাংকের চামড়া তুলে ফেলার স্লোগান তাই হয়তো শোনা যেত ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মিছিলে। তাদের ‘অমার্জনীয় ব্যর্থতা’ অবশ্য কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছেন মতিয়া চৌধুরীসহ আমাদের কয়েকজন মন্ত্রী এবং কিছু বিশ্লেষক। তাঁদের বক্তব্য, বিশ্বব্যাংকের নিজের কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ, অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে ১৬ কোটি মানুষকে অপমান করেছে বলে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বরং সোচ্চার হওয়া উচিত আমাদের। ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন।
এমন কথা সিপিবি, বদরুদ্দীন উমর বা আনু মুহাম্মদ বললে তা আদর্শিক অবস্থান থেকে বলা ধরে নিতে হবে। অন্য অনেকে এসব বলেন সম্ভবত দলকানা হওয়ার কারণে, কিংবা বিশ্বব্যাংক আর সরকারের পারস্পরিক মাপ বোঝার অক্ষমতার কারণে বা নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য। তাঁদের বক্তব্য অসত্য নয়, কিন্তু এসব বক্তব্যের কার্যকরণের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য লবিং করে থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের কেউ দুর্নীতি করে থাকতে পারে, বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ, বিশ্বব্যাংক দেশের সম্পদকে আন্তর্জাতিক পুঁজির অধীন করে ফেলে, উন্নয়ন সাহায্যের নানা শর্ত জুড়ে দেয়, তাদের শর্ত (বিশেষ করে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও পরিবেশবিরোধী বড় অবকাঠামো নির্মাণ) পালন করতে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশকে বিপদে পড়তে হয়েছে।
এসব সমালোচনা সত্যি হলেও বাংলাদেশের যেসব শাসকগোষ্ঠী যুগের পর যুগ বিশ্বব্যাংক ও সমগোত্রীয়দের নির্দেশনা মেনে দেশ চালিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে করা যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ঋণ বাতিল করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব সমালোচনা সময়োপযোগীও নয়। সরকারের পক্ষ থেকে এমন সমালোচনা আরও মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বিশ্বব্যাংক এখনো বাংলাদেশে বহু প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, বিশ্বব্যাংকের অনুজপ্রতিম প্রতিষ্ঠান এডিবি এবং এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যেসব উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে, তাদেরও বহু প্রকল্প আছে বাংলাদেশে। একজন আবুল হোসেনের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগ শুনতে হয় স্বয়ং সরকারপ্রধানের কাছ থেকে, তাহলে দাতাগোষ্ঠীকে আরও বড়ভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে।
সেই সামর্থ্য কি আছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের?

২.
বিশ্বব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় চীন বা ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ চীন বা ভারত নয়। এ দুটো দেশেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে, কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় তা অনেক কম। তা ছাড়া চীন বা ভারতে ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরা পর্যন্ত দুর্নীতি প্রমাণিত হলে চাকরি হারান, বিচারের সম্মুখীন হন, বাংলাদেশে তা কখনো হয় না। চীন-ভারতের অর্থনীতি, সরকারি ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত সক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়ে বহু গুণে মজবুত। নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর চেয়েও অনেক বড় প্রকল্প করার ক্ষমতা আছে তাদের। এরা বিশ্বব্যাংককে ঋণচুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়ে ঋণের শর্তাবলি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। চীন বা ভারতের তুলনায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা নগণ্য বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের যদি পর্যাপ্তভাবে এই ক্ষমতা থাকত কিংবা সরকার যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের খবরদারি অগ্রহণযোগ্য বলে জনগণের কাছে প্রমাণ করতে পারত, তাহলে সরকার ব্যাংকটির সমালোচনায় মুখর হলে তা মানানসই হতো। কিন্তু সে ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। সরকার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায়ও নেমেছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে সমালোচনা করছেন দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ার পর। কাজেই এখন বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে নায়কোচিত কোনো ইমেজ গড়ে তোলা দূরের কথা, দেশে এবং বিদেশে নিজের সম্মান বাঁচানোই কঠিন হবে সরকারের জন্য।
বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের আগেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করলে সরকারের এমন সম্মানহানি হতো না। এ ধরনের তদন্ত যে হয়নি তার বিভিন্ন আলামত রয়েছে। তদন্ত চলাকালে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কর্তৃক দুর্নীতি হয়নি বলে হাঁকডাক প্রদান, তড়িঘড়ি তদন্ত করে দুদক কর্তৃক মন্ত্রীকে দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট প্রদান, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আরও তথ্য প্রদানের পর নজিরবিহীনভাবে দুদকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তথ্য গোপনের চেষ্টা, ঘুষ গ্রহণের প্রস্তাব কোনো অপরাধ নয় বলে অসত্য প্রচারণা (পেনাল কোডের ১৬২ ও ১৬৩ ধারায় এটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ) পদ্মা সেতু প্রকল্পে তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে।
তা ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কমিটমেন্ট নিয়ে এমনিতেই সন্দেহ পোষণ করার নানা কারণ রয়েছে। সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে আগের আমলে করা দুর্নীতির অসংখ্য মামলা ঢালাওভাবে প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী প্রকাশ না করা, শেয়ার মার্কেটে লুটপাট ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিচার না করা, কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায়মুক্তি আইন পাস করা, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা বিবেচনায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করা, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার সুযোগ দেওয়া, দুদককে ক্রমাগতভাবে দুর্বল ও পরাধীন করার প্রচেষ্টাসহ নানা দুর্নীতিবান্ধব পদক্ষেপ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ সরকার নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে, তা বিশ্বাস করাই ছিল কষ্টকর। সরকার সেই বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

৩.
সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন অতিবিতর্কিত ব্যক্তিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানও দুর্নীতিবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করার কারণ রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী থেকে আবুল হোসেন প্রায় রাতারাতি অর্থের পাহাড় গড়েছেন, অসাধুতার কারণে শেখ হাসিনার প্রথম আমলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির গোপন তারবার্তায় সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে তাঁর সততা প্রশ্নবিদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এমন একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে ধারণাকৃত ব্যক্তিকে কেন হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের কাজ হবে এমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কেন এসব প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের সংশ্লিষ্ট রাখা হয়েছিল, স্বার্থসংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) রয়েছে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামের সেই প্রতিষ্ঠান তার পরিবারের মালিকানাধীন থাকা অবস্থায় কীভাবে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আগে থেকেই ছিল। পরে তাঁকে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর বেশি অর্থ রয়েছে, এমন একটি খাতের (টেলিযোগাযোগ খাত) সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগও ছিল সন্দেহজনক।
সরকার তাঁর বিভিন্ন সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড আড়াল করার জন্য বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একধরনের সমালোচনার জিহাদে নেমেছে এবং একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিয়ে প্রয়োজনে নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের আবেগকম্পিত ঘোষণা দিচ্ছে। ৩২ কোটি হাত দিয়ে বা এক বেলা বাজার করার অর্থ বাঁচিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলা হচ্ছে। এসব আহ্বান দিচ্ছেন এমন সব মন্ত্রী বা নেতা, জনগণের কাছে যাঁদের নিজস্ব সততাই প্রশ্নবিদ্ধ। নানা কারণে দেশে-বিদেশে সমালোচিত সরকারের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানও আগের তুলনায় অনেক দুর্বল এখন।
সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় না, সরকারের আহ্বানে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের জনগণ বা প্রবাসীরা অংশ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই অবস্থা রয়েছে দেশে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন দূরের কথা, দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত সরকারের মানসম্মান বাঁচানোই বরং কঠিন হয়ে পড়ছে এখন। বিশেষ করে, আবুল হোসেনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ একজন ব্যক্তি কেন এত অপরিহার্য এবং মূল্যবান সরকারের কাছে—এই অমোঘ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না সরকারের পক্ষে। তাঁর মতো একজন ব্যক্তি তখনই অপরিহার্য হতে পারে, যদি তাঁর অপসারণ আরও বড় দুর্নীতিবাজদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কা থাকে বা যদি মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান দুর্নীতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে খুব প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়।

৪.
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে ভবিষ্যতে আরও বহু অস্বস্তিকর তথ্য ও বিশ্লেষণ আমরা পেতে পারি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, কানাডা সরকারসহ আন্তর্জাতিক মহল জড়িত হয়ে পড়ায় এই প্রকল্প নিয়ে তথ্য গোপন করা সম্ভব হবে না কারও পক্ষে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকও তার শক্তিশালী প্রচারণা কাঠামোকে থামিয়ে রাখবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে যাওয়ার আগে সরকারকে ধীরস্থিরভাবে বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। আবুল হোসেনকে নিজে থেকে পদত্যাগ করার মেসেজ দিয়ে সরকার নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ইতিবাচক সূচনা করতে পারে।
সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এখন নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত প্রমাণ করা এবং এভাবে নিজের মানসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সেটি করা সম্ভব হলে বিশ্বব্যাংক না থাকলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে সমস্যা হবে না। সরকারকে বুঝতে হবে, এই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আর।
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশী মহাসম্মেলন দেখে এলাম নিউ ইয়র্কে

বাংলাদেশী মহাসম্মেলন দেখে এলাম নিউ ইয়র্কে


॥ সিরাজুর রহমান ॥

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বছর যাওয়া হয়নি। একটা কারণ অবশ্যই ছিলÑ জর্জ ডব্লিউ বুশের আট বছরের শাসন। একঝুড়ি মিথ্যা কারণ দেখিয়ে তিনি ও তার আজ্ঞাবহ বন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। বারো-তেরো লাখ মানুষ নিহত হয়েছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত আর স্থিতিশীল দেশটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর জীবনযাত্রার সঙ্কট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি স্থির করেছিলাম, বুশ যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন আমি সে দেশে যাবো না। তারপর অবশ্য আরো বহু কারণ অন্তরায় ঘটিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানা নিয়মিত আমার কলাম ছাপে। বিদেশে আজকাল বহু বাংলা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। সেটা বাংলাভাষীদের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তির একটা বড় অবদান। ঠিকানা তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। এ পত্রিকার বয়স ২৩ বছর পেরোল এবং নিয়মিত পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০।
সাপ্তাহিক ঠিকানার কর্তৃপক্ষ (তারা বলেন ঠিকানা পরিবার) এবার নিয়ে পরপর তিনবার উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশীদের মহাসম্মেলন উদ্যাপন করলেন। তাদের আমন্ত্রণে স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক ঘুরে এলাম। কর্তৃপক্ষ মহাসম্মেলনের নাম দিয়েছে এবিসি (আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা) কনভেনশন। সঠিক কত লাখ কিংবা কোটি হবে বলতে পারব না, তবে উত্তর আমেরিকায় এখন বহু বাঙালির অধিবাস। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বাংলাদেশী অভিবাসীর সাথে তাদের অনেক তফাৎ। বাংলাদেশীরা ইউরোপে প্রথম এসেছিলেন অর্থনৈতিক ভাগ্য ফেরানোর আশায়। অন্য দিকে সাধারণত উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাজীবীরাই উত্তর আমেরিকায় এসেছেন। 
অনেকে এসেছিলেন প্রযুক্তি-প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং মানবিকবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাসমাপন করে অনেকেই দেখলেন, তাদের শিক্ষা ও যোগ্যতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করার আয়োজন দেশের নেতারা এখনো করে উঠতে পারেননি। একই সাথে উত্তর আমেরিকায় খুবই সহজে এবং উঁচু বেতনে চাকরি পেতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এই মহাদেশের দেশগুলো উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নতিকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আরো বহু দক্ষ ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন। বহিরাগত ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা পেয়ে সে চাহিদা পূরণ করেন। 
প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দশ-বারো হাজার মাইল দূরে থাকেন বলেই বোধ করি স্বদেশকে তারা এমন গভীরভাবে ভালোবাসেন। দেশের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে, দেশবাসীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এবং দেশের উন্নতি-প্রগতির পন্থা নিয়ে ভাব-বিনিময়ে তাদের আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশাল-বিস্তীর্ণ দু’টি দেশ। কেউ কেউ দুই কিংবা তিন হাজার মাইল দূর থেকেও স্বদেশীদের সভা-সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। সৌভাগ্যবশত আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে তারা ভোগেন না। এবিসি কনভেনশনের মতো মহাসম্মেলনগুলো সে কারণেই খুবই জনপ্রিয় এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর আমেরিকায় ফোবানা (ফেডারেশন অব বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) নামে আরো একটা সংস্থা আগে এ জাতীয় সভা-সম্মেলন করত। বেশ কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে তাদের একটা মহাসম্মেলনে যোগদানের সুযোগ আমারও হয়েছিল। কিন্তু ফোবানা এখন বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নির্জীব হয়ে পড়েছে। শুনেছি বাঙালিদের স্বভাবজাত পরশ্রীকাতরতা এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে অর্থহীন দলাদলি এর কারণ। এবিসি মহাসম্মেলনে উপস্থিত দু-একজন বলছিলেন, এ সম্মেলন ফোবানার শূন্যতা অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছে।
এবিসি সম্মেলন সম্বন্ধে প্রথমেই বলতে হয় তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। এই সুদূর থেকে প্রকাশিত একখানি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পূর্ণ নিজেদের আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য দিয়ে এত বড় একটা আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন করলেন সেটাই এক বিস্ময়। তাও শুধু একবার নয়। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আগের দুটো বার্ষিক সম্মেলনও সমানেই সফল হয়েছিল।
বিদেশে ভালো আয়-উপার্জন এবং উন্নত জীবন সত্ত্বেও পেছনে ফেলে আসা মাতৃভূমির সমস্যাগুলোর সমাধান করে বাংলাদেশটাকে সুদিনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে তাদের চিন্তাভাবনার কতখানি জুড়ে আছে, সম্মেলনের সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচনে সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু’, ‘আউট সোর্সিং : বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের উন্নয়ন পরিকল্পনা’, ‘পানি আগ্রাসন : ভাটি অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ে কতটা হুমকি’; ‘করপোরেট আমেরিকায় ভাগ্য গড়–ন : মেধার আর অপচয় নয়’; ‘দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা : স্বাধীন না পরাধীন’; ‘বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোথায়?’ এবং ‘বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন বাংলা ভাষার জন্য কতটুকু হুমকি?’; ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি কি না’; ‘বাংলাদেশে কোন তন্ত্র বিদ্যমানÑ গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র না পরিবারতন্ত্র?’ ইত্যাদি।
সেমিনার এবং টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচন থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা-সঙ্কটগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের চিন্তাভাবনার অনেকখানি জুড়ে আছে। এসব আলোচনায় অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখেছেন প্রবাসী ও আমন্ত্রিত চিন্তাবিদরা। প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. খলিলুর রহমান. ড. আলী রিয়াজ প্রমুখ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান অধ্যাপকরা। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কলামিস্ট ফরহাদ মজহার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। লন্ডন থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান, বিবিসি বাংলা বিভাগের বর্তমান প্রধান সাবির মোস্তাফা ও আমি (সিরাজুর রহমান)।
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আসবেন বলে বিশেষ প্রচার চালানো হয়েছিল। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হবে মনে করে আমিও প্রীত ছিলাম। তিনি আসবেন বলে সম্মতি দিলেও মাত্র দুই দিন আগে কোনো অজ্ঞাত কারণে আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। মহাসম্মেলনে কানাঘুষা শুনলাম, আমাদের কারো কারো উপস্থিতির প্রতিবাদে উত্তর আমেরিকার আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা এ সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। বুড়ি-ছুঁই গোছের মতো করে নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন এবং একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আলোচনা ইত্যাদিতে আওয়ামী লীগপন্থী আর যাদের অংশগ্রহণের কথা ছিল, তারা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। অবশ্য তাই বলে সম্মেলনের অঙ্গহানি হয়নি। দুই দিনে দীর্ঘ অধিবেশনের প্রায় সময়ই বিশাল সম্মেলনকেন্দ্রে প্রচুর জনসমাগম দেখেছি। 

শূদ্রদের দেববাক্য শোনা নিষিদ্ধ
আপনারা কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানি না, আওয়ামী লীগের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সমর্থকদের ভিন্ন মতবাদ শোনা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার ধর্মগ্রন্থগুলো সীমিত রেখেছিল। সেসব গ্রন্থের বক্তব্য, এমনকি সংস্কৃত ভাষা শোনাও অব্রাহ্মণ্যদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বিধান দিয়েছিলেন, কোনো অব্রাহ্মণ দেব-ভাষা সংস্কৃত শুনে ফেললে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিতে হবে। বোধ করি ব্রাহ্মণরা ভেবেছিলেন, অব্রাহ্মণরা সংস্কৃত শিখে ফেললে তাদের বহু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারাও নিশ্চয়ই মনে করেন, ভিন্ন মতামতের ছোঁয়াচ লাগলে তাদের সমর্থকরা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ভিন্ন মতবাদের কাউকে তাদের ধারে-কাছেও ভিড়তে দেয় না। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ রীতি নিন্দনীয় হবে।
এতক্ষণ যা বলছিলাম তার থেকে মনে হতে পারে যে, নিরস-নিকষ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নিউ ইয়র্কের এবিসি মহাসম্মেলন। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। উভয় দিনের অনুষ্ঠানই শেষ হয়েছে নৃত্য ও সঙ্গীতের দীর্ঘ আসর দিয়ে। তা ছাড়া কয়েকটা আলোচনা অনুষ্ঠানের পরপরই আরো ছোট আকারে গান-বাজনা ও সঙ্গীত দিয়ে দর্শকদের বিনোদন করা হয়। বাংলাদেশের শিল্পী শবনম মুশতারী ও বেবী নাজনীনরা উত্তর আমেরিকা নিবাসী শিল্পীদের সাথে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন। উদ্যোক্তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুষ্ঠানগুলোকে সবিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলেন। ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কলকাতা থেকে আগত আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা মনোজ্ঞ আবৃত্তি দিয়ে সকলকে সম্মোহিত করেন। প্রবাসীদের লিখিত গ্রন্থের একটা প্রদর্শনীও ছিল মহাসম্মেলনে।
বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এবং ক্রীড়া সম্বন্ধেও একাধিক আলোচনা বৈঠক হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক বদহজমের ভয়ে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। উদ্যোক্তাদের একটা মহতী আয়োজন ছিল উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন পেশায় অসাধারণ প্রতিভা ও কৃতিত্বের অধিকারী বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান। কয়েকজনকে ক্রেস্ট দিতে পেরে আমি সম্মানীত বোধ করেছি।
মহাসম্মেলনের অলিখিত এবং অনুচ্চারিত বিরাট লাভজনক দিক ছিল পুরনো ও নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতা ও মতামত বিনিময়। আমি নিজেও ইকবাল বাহার চৌধুরী, কাফি খান, দিলারা হাসেম, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, সরকার কবীরুদ্দিন প্রমুখ সহবেতারকর্মী বন্ধুদের সাথে দীর্ঘকাল পরে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে প্রীত হয়েছিলাম। রাষ্ট্রদূত রফিক আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর সাথেও দেখা হলো বহু বছর পরে। সত্তরের দশকের বিবিসি শ্রোতাসঙ্ঘের কর্মকর্তা আকবর হায়দার কিরণের সাক্ষাৎ পেলাম মহাসম্মেলনে। নিউ ইয়র্কের ‘ব্রিক লেন’ জ্যাকসন হাইটস দেখালেন তিনি, বাঁশপাতারি ইলিশ ও বেলে মাছ সহযোগে ডাল-ভাত খাওয়ালেন।
সবশেষে ঠিকানা পরিবারের সদস্যদের কথা বলতেই হয়। এর পরিবারের প্রধান সাইদুর রবের নেতৃত্বে ফজলুর রহমান, দেওয়ান শামসুল আরেফিন, মঞ্জুর হোসেন, মিজানুর রহমান প্রমুখরা যেমন কঠোর পরিশ্রম ও গঠনমূলক কল্পনাশক্তি দিয়ে এমন মনোজ্ঞ মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেটা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কোনো সন্দেহ নেই, তাদের ভবিষ্যৎ আয়োজনগুলোও সমানেই সার্থক হবে। 
লন্ডন, ০৩.০৭.১২
serajurrahman34@gmail.com

আওয়ামী লীগের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে?

সোহরাব হাসান


পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ার পর জনদরদি মহাজোট সরকার বিশ্বব্যাংক যে কত বড় দুর্নীতিবাজ, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। পৃথিবীর কোন দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন, কোন পত্রিকা কী প্রতিবেদন করেছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন মন্ত্রীরা। বিশ্বব্যাংক যদি এত খারাপ প্রতিষ্ঠানই হয়ে থাকে, তাহলে ঋণচুক্তি করার আগে কেন দেশবাসীকে সে সম্পর্কে কিছু জানানো হলো না? কেন জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হলো না, এই বদনামি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা ঠিক হবে কি না? ঋণচুক্তি বাতিলের পর জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন, ‘এক বেলা বাজার না করে সেই পয়সা দিয়ে পদ্মা সেতু করবেন।’ কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের আগে কেন এ আহ্বান জানালেন না তিনি? তখন যদি এক বেলা বাজার না করে (মাননীয়ার কাছে জানতে চাই, বাংলাদেশের কতজন মানুষ দিনে দুই বেলা বাজার করে?) নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলতেন, মানুষ বিশ্বাস করত। এখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বদেশপ্রেমের মশাল জ্বালালে তাতে ঘর আলোকিত হওয়ার চেয়ে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে যাঁরা আছেন, তাঁদের ধারণা, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল হওয়ায় দেশের মহাসর্বনাশ হয়ে গেছে। দেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কথাটি ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বব্যাংককে মানুষ একটি বেনিয়া প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিছু দেখে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের চিঠি গোটা দেশের জন্য অপমানকর। বিশ্বব্যাংকের চিঠি যদি অপমানকর হয়ে থাকে, চুক্তি সই করেও যাঁরা টাকা আনতে পারেননি, তাঁদের জন্য অপমানকর। সারা দেশের মানুষের জন্য নয়। এ অপমান তাঁদেরই প্রাপ্য, যাঁরা দুষ্কর্ম করেছেন বা করতে চেয়েছিলেন এবং যাঁরা তাঁদের রক্ষা করতে চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী জাতীয় সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা স্ববিরোধিতাপূর্ণ। একদিকে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যেহেতু এক পয়সাও দেয়নি, সেহেতু দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। বিশ্বব্যাংক কখনোই বলেনি যে ঘুষের লেনদেন হয়েছে। তারা বলেছে, কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে। আর ঘুষ যদি না-ই চাওয়া হবে, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবকে কেন সরালেন? প্রকল্প পরিচালককে কেন সরালেন? প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, যদি প্রমাণিত হয় মন্ত্রী দায়ী, তাঁকে অপসারণ করা হবে। তদন্তের পরই প্রমাণ পাওয়া যাবে মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন কি না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন। অতএব, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখুন। যদি তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আবার পুনর্বহাল হবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রীর পদে রেখে (তা যে মন্ত্রণালয়েই হোক না কেন) সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে না। এ কথাটি কেবল বিশ্বব্যাংকের নয়, বাংলাদেশের মানুষেরও। রেলওয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য যদি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে পারেন, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী পারবেন না কেন? মহাজোটের শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, সৈয়দ আবুল হোসেনের সরে দাঁড়ানো উচিত। তাঁরাও কি বিশ্বব্যাংকের দালাল?
তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পেলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যেসব দেশে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, সেসব দেশ ধ্বংস হয়ে যায়নি; বরং বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে, এ রকম উদাহরণই কম। তারা অনেক সময় এমন সব প্রকল্প চাপিয়ে দেয়, যা মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে। তাই বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করা নিয়ে বিরোধী দলের শোরগোল তোলার যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সেই ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠানটি যখন আমাদের সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে, তখন লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলেও সেতু নির্মাণের কাজ ঠেকে থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষের জন্য দরদ উথলে ওঠার জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, তারা ঋণ দেয় ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। বিশ্বব্যাংকের ঋণের পেছনে যে বড় রাজনীতি আছে, তাও ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের সরকারগুলো কখনোই মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারে না, তারা নির্দ্বিধায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ন্যায্য-অন্যায্য সব শর্তই মেনে নেয়।
সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলছেন। আমরা এ-ও জানি, এই সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি নিজস্ব অর্থায়নেও এ রকম একাধিক পদ্মা সেতু করতে পারেন। দেশি-বিদেশি ব্যাংকে সেই পরিমাণ অর্থ তাঁদের জমা আছে। কিন্তু তাতে বিশ্বব্যাংক সরকারের গায়ে যে কালিমা লেপন করল, তা মুছে যাবে না। অতএব, বিশ্বব্যাংক নয়, সরকার ও জনগণের স্বার্থেই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। 
২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষ যে দলটিকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই দলটিই এখন মহাজোট সরকারকে মহাদুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছে। সরকারের পদত্যাগ চাইছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির মস্ত বড় ট্র্যাজিডিও বটে।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি বলে দাবি করেছেন। দুর্নীতি বলতে তিনি কি ঘুষের টাকার লেনদেন বোঝাচ্ছেন? বিশ্বব্যাংকও বলেনি যে ঘুষের টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের দাবি, ঘুষ চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো ভিত্তিই নেই, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, তাঁর সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরালেন কেন? এর মাধ্যমে নিশ্চয়ই তিনি বিশ্বব্যাংক-উত্থাপিত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, একজন মন্ত্রীকে স্বপদে (যে মন্ত্রণালয়েই তাঁকে বদলি করা হোক না কেন) বহাল রেখে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা যায় না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত খুব কম মন্ত্রী-আমলাই দুর্নীতির দায়ে শাস্তি ভোগ করেছেন। তাই বলে তাঁরা সৎ লোক হয়ে যাননি। সবার সততা আদালতেও প্রমাণিত হতে হয় না। বর্তমান সরকারে এমন মন্ত্রীও আছেন, যাঁর সম্পর্কে চরম শত্রুও দুর্নীতির অভিযোগ আনবেন না। আনলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রী হলফ করে বলতে পারেন না তাঁর মন্ত্রিসভার সবাই সাধু।

২.
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যখন বিপুল ভোটে জয়ী হলো, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থক তো বটেই, আওয়ামী ঘরানার বাইরেরও অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, দেশ এবার জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হবে। দুর্নীতি একেবারে উচ্ছেদ না হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসবে। স্বাধীনতার পর যাঁরা কখনোই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেননি, তাঁরাও সে সময় আওয়ামী লীগকে মন্দের ভালো বলে মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মহাজোটে বামপন্থীদের অবস্থান যত দুর্বলই হোক, সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, দেশটি প্রগতির ধারায়ই চলবে। এরপর শেখ হাসিনা যখন পুরোনোদের বাদ দিয়ে নবীনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখনো তাঁদের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে অভিজ্ঞতায় এঁরা কমতি হলেও সততা ও আন্তরিকতায় উতরে যাবেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই দেশবাসী হোঁচট খেতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত মিত্রদের দূরে ঠেলে দেওয়ার নীতি নেয়। দল ও জোটের মধ্যে যাঁরা এক-আধটু বাম চিন্তা করতেন, তাঁদের নানাভাবে অপদস্থ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছেন, যতই গালমন্দ করা হোক না কেন, তাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই। কেননা, আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি এবং তার ছায়াসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। প্রগতিশীল চিন্তার কোনো মানুষ তাদের সমর্থন করতে পারে না। গত সাড়ে তিন বছরে দলটি মুখে জনকল্যাণ ও প্রগতিশীলতার বুলি আওড়ালেও কাজে তার প্রমাণ দিতে পারেনি। ক্ষমতায় এসে বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি দুই দলের মধ্যে চরম বৈরিতা সত্ত্বেও দুই দলের সমর্থক অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে গভীর আঁতাত লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নামে তারা এমন এক সোনার পাথরবাটি তৈরি করেছে, যাতে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। তাহলে নূর হোসেন-তাজুলদের রক্তদান কি বৃথা গেল!
২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এল, তখন মানুষ আশা করেছিল, এবার আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও বদলাবে। সেই ধারণার অন্যতম কারণ ছিল, নির্বাচনে বিতর্কিত কোনো নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়া, বিশেষ করে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে যাঁরা দলের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছিলেন, সেই হামবড়া নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে শেখ হাসিনা দলের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। এখন আবার তাঁদের কেউ কেউ নাকি দলীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ পেতে শুরু করেছেন।
বিএনপির আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মহোৎসবের কারণে আওয়ামী ঘরানার বাইরের অনেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলেন এই আশায় যে ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। বাংলা ভাই বা শায়খ আবদুর রহমানের দৌরাত্ম্য কমবে, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফাালন দেখতে হবে না। 
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির কতিপয় সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দলটিকে প্রায় একঘরে করে তুলেছিল, বিশেষ করে জঙ্গি উত্থানের ব্যাপারে তারা গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক পশ্চিমা দেশই বিএনপিকে গণতন্ত্রের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করত। ‘মধ্য ডান’ বিএনপি থেকে ‘মধ্য বাম’ আওয়ামী লীগই তাদের পছন্দের দল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অতি আস্থাশীল নেতৃত্ব এবং শেখ হাসিনার ‘পরিচ্ছন্ন মন্ত্রিসভা’ উল্টোরথে চলে। দেশের ভেতরে ও বাইরে যারা তাদের বন্ধু-সুহূদ ছিল, তাদের অনেকেই এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগ একটি কাজই সুচারুভাবে করেছে তা হলো, মিত্র-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের খেপিয়ে তোলা এবং বিএনপির ম্রিয়মাণ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net