শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

সরকারের ভারত নীতিই দায়ী


ফরহাদ মজহার

'Bangladesh has faced dozens of coups, failed or not, in its 40 years. But for an army spokesman to give details of one, on January 19th, was unusual’. -- `Politics in Bangladesh;
Turbulent House. The army claims to have thwarted a coup'.
ECONOMIST. 20 January 2012.
ব্যর্থ হোক আর না হোক, কয়েক ডজন অভ্যুত্থান গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে গত ১৯ জানুয়ারি তারিখে একজন সেনা মুখপাত্রের এক অভ্যুত্থানের বিস-ৃত বর্ণনা দেওয়া খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার (ইকোনমিস্ট, ২০ জানুয়ারি ২০১২)।

গত দিনের এই লেখার প্রথম কিসি-তে বোঝাতে চেয়েছি ‘বিশৃংখলা’ এবং ‘অভ্যুত্থান’ আক্ষরিক দিক থেকে সমার্থক নয়, এটা আমরা সহজেই বুঝি। কিন' সেটা গুর"ত্বপূর্ণ নয়। আসল গুর"ত্ব হ"েছ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধান ও আইনের দিক থেকে উভয়ের পার্থক্যের তাৎপর্য। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টায় বেসামরিক কেউ জড়িত থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি ঠিকই বলেছেন, ‘সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর পরে সংবিধান ও আদালতের বির"দ্ধে সংঘটিত এ ধরনের অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল’ (মানবজমিন, ২৯ জানুয়ারি ২০১২)। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী অপরাধীরা সেই ক্ষেত্রে ‘সর্বো"চ দণ্ডে দণ্ডিত’ হবে, অর্থাৎ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কিছু সময় পরে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস'া বাসস খবর জানায় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে মন-ব্য করেছেন। তিনি সম্ভবত এই সংবাদ সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শনিবারও প্রধানমন্ত্রী আবার ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। শুক্রবার রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং পরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনিসহ মন্ত্রিসভার আরো অনেক সদস্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করবার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করতে থাকেন। অর্থাৎ সেনাসদরের তরফে সংবাদ সম্মেলনে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তারা সেই অভিযোগটাকেই বিএনপির বির"দ্ধে রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করতে শুর" করেন।
জানুয়ারির ২০ তারিখে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে দুটো ব্যাপার খোলাসা হয়ে যায়। তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘উঠেছে খালেদা-পুত্রের নাম : ষড়যন্ত্র হলে হাসিনার পাশেই থাকবে দিল্লি’। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হোল, ‘শেখ হাসিনাকে সরানোর চেষ্টা হলে, তাকে সব রকম সাহায্য করার সিদ্ধান- নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বাংলাদেশ সরকারকেও সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে’। শেখ হাসিনার পক্ষে কোন দেশ থাকুক বা না থাকুক গণতান্ত্রিক ভাবে সরকার পরিবর্তনের যে নির্বাচনী নীতি রয়েছে তার বরখেলাফ করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হোলে বিশ্বের সব দেশই নিন্দা করবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ সেনা অভ্যুত্থান আদৌ সমর্থন করবে কি না সন্দেহ। কিন' আনন্দবাজার বলছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাবার চেষ্টা হলে দিল্লি তাকে ‘সবরকম সাহায্য’ করবার সিদ্ধান- নিয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। তার মানে কি এই যে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য দিল্লি সেনাবাহিনী পাঠাবে?
‘সবরকমের সাহায্য বলতে এটাও বোঝায়। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আনন্দবাজার খোলাসা করে দিয়েছে সেটা হোল- বাংলাদেশে দিল্লির গোয়েন্দা নজরদারি তীক্ষ্ণ। মূলত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'ার সহায়তাতেই সেনা অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিশৃংখলা বা অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেবার ক্ষেত্রে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সহযোগিতা ছিল। তাদের ভাষায়, ‘সেনা অভ্যুত্থান ভেসে- দেওয়ার পিছনে ভারতের তরফ থেকেও গোয়েন্দা তথ্য ছিল’। বলা হয়েছে, ‘হিজবুত তাহরীর, জামাতে ইসলাম ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একজোট হয়ে কাজ করছে। গোটা ঘটনার মাথা হিসেবে উঠে আসছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের নামও।’ এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা সেটা বিচার করা আমাদের কাজ নয়। তদন- চলছে, এই বিষয়ে তদনে-র স্বার্থে আমাদের নীরব থাকাই সমীচীন। কিন' আনন্দবাজারের এই তথ্যের গুর"ত্বপূর্ণ দিক হ"েছ- এই অভিযোগ শুধু বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের নয়। দুই দেশের গোয়েন্দাদেরই যৌথ তথ্য এটা। দুই দেশের গোয়েন্দারা যে একজোট হয়ে কাজ করছে, তারই ভিত্তিতে আনন্দবাজার এই খবর ছেপেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার এই প্রতিবেদনের বির"দ্ধে সেনাসদর থেকে কোন প্রতিবাদ আমার চোখে পড়ে নি।
এবার যদি পুরা ঘটনা প্রকাশ হবার আগে ফিরে যাই তাহলে দেখব বিডিআর হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা, দেশের সামগ্রিক পরিসি'তি এবং পেশাগত স্বার্থের ক্ষোভের কথা বাদ দিলে সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অসি'রতা ও ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির প্রধান কারণ। তা ছাড়া বাংলাদেশ সীমানে- ক্রমাগত বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন তো আছেই। সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনের পরদিনই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন পরিসি'তি অনুধাবন করতে আমাদের খুব কাজে আসে।
আমরা জানি, মেজর জিয়াউল হক নিজেকে ৪১ বিএমএ লং কোর্সের একজন অফিসার দাবি করে ফেসবুক ও ইন্টারনেটে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। ফেস বুক ও ইন্টারনেটে প্রচারিত মেজর জিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী তাঁকে একটি গোয়েন্দা সংস'ার সদস্যরা অপহরণ করেছিল। দুই দিন দুই রাত আটক রাখার পর কৌশলে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এটা তাঁর দাবি, কিন' ঘটনার জটিলতা এখান থেকেই শুর"। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কোর্স শেষে বদলিকৃত রেজিমেন্টে যোগদানের পথে তিনি অপহৃত হন বলে তিনি তার লেখালিখিতে দাবি করেন। তুলে নেয়ার পর অজ্ঞাত স'ানে রেখে চোখ বেঁধে তাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার প্রকাশিত বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি পাশের একটি দেশের গোয়েন্দা সংস'ার সদস্যও উপসি'ত ছিল সেখানে। দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাশের রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস'ার সদস্যরা এমন কিছু তথ্য মেজর জিয়ার কাছে জানতে চেয়েছে, যা একটি স্বাধীন দেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন- সংবেদনশীল বলে মেজর জিয়া তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। তার প্রকাশিত লেখায় তিনি আরো বলেন, লে. কর্নেল যায়ীদ, লে. কর্নেল হাসিন ও লে. কর্নেল এহসান ইউসুফ নামে আরো তিন সেনা অফিসারকে গ্রেফতার দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
এই লেখা ইন্টারনেটে ছড়াতে থাকে। দৈনিক আমার দেশ ৩ জানুয়ারি তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঘটনাটির সত্যতা নির্ণয় করবার জন্য তারা সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে ও মেজর জিয়ার লেখায় উল্লিখিত বাসার ঠিকানায় যাবার চেষ্টা করে বিফল হয়। গেটে বসিয়ে রেখে তাদের বলা হয়, সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ। জানানো হয়, ওপরের কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি ছাড়া যাওয়া যাবে না। পত্রিকাটি ২ জানুয়ারি বিকাল ৩টা ৪৭ মিনিটে আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগেও মেজর জিয়ার অভিযোগগুলোর সত্যতা জানতে ফোন করে। তখন পত্রিকাটিকে জানানো হয়, আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগ থেকে কিছুই বলা যাবে না। সেনা সদর দফতর বা সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতর মেজর জিয়ার বিষয় জানাতে পারবে বলে জানানো হয়।
সেনা অফিসারদের বিনা বিচারে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বন্দি করে রাখা প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ সাবেক সেনাকর্মকর্তা এবং এখন সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের কাছে তাঁর মতামতও জানতে চায়। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘১৫০ দিনের বেশি সময় ধরে লে. কর্নেল পদমর্যাদার দুই অফিসার আটক আছেন বলে তিনিও জানতে পেরেছেন। তিনি আরো বলেন, যতটুকু জানি এদের একজন গত ৯ জুলাই ও আরেকজন ১২ জুলাই কর্মরত অবস'ায় গ্রেফতার হন। তবে তাদের বির"দ্ধে কোনো বিচার শুর" হয়নি। সেনা বিধান অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়া এবং সেই বিধান ও প্রক্রিয়ার অধীনে প্রযোজ্য মানবাধিকার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হ"েছ, ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্টের ৭৫ ধারা অনুযায়ী, অভিযোগের ভিত্তিতে সেনা অফিসারদের গ্রেফতার করা যায়। এ ধারায়ই বলা আছে, গ্রেফতারের ৮ দিনের ভেতর কোর্টমার্শাল গঠন করতে হবে। ৮ দিনের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব না হলে উপযুক্ত কারণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। তিনি বলেন, আইনেই বলা আছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠন করতে না পারলে আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করে দিতে হবে। ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, ১৫০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের বির"দ্ধে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। এতে অনুমান করা যায় প্রমাণ করার মতো কোনো অভিযোগ এ অফিসারদের বির"দ্ধে নেই। প্রমাণের মতো অভিযোগ থাকলে কোর্ট মার্শাল গঠন হয়ে যেত।’
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা সত্যতা নির্ণয়ের এই অভিজ্ঞতা এবং সেনা অফিসারদের গ্রেফতারের পর ১৫০ দিন পেরিয়ে যাবার পরেও কোন কোর্টমার্শাল গঠিত না হওয়া সম্পর্কে ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের বক্তব্য প্রতিবেদন হিশাবে প্রকাশ করার পরই গত ৪ জানুয়ারি আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে, ই-মেইলে অপহরণের অভিযোগকারী মেজর জিয়ার বির"দ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর আগে তারা কিছু বলেন নি। ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমআইএসটি থেকে কোর্স সম্পন্ন শেষে বদলিকৃত ইউনিট ৩ই বেঙ্গলে যোগদানের জন্য মেজর জিয়াকে যাবার আদেশ দেয়া হয়। পরে সেনা শৃঙ্খলাপরিপন'ী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে তখন সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়া, ঢাকা সেনানিবাসে সংযুক্তি আদেশ প্রদান করা হয়। এই আদেশ অনুযায়ী মেজর জিয়া সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়ায় যোগদান না করে পলাতক রয়েছেন; এই কারণেই সেনা আইন অনুযায়ী এরই মধ্যে তার বির"দ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল যায়ীদ ও লে. কর্নেল হাসিনকেও শৃঙ্খলাপরিপন'ী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে সেনা আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপরই গত ১১ জুলাই ২০১১ তারিখে একটি উ"চপর্যায়ের তদন- আদালত গঠন করা হয়। আদালত সুষ্ঠু তদন- শেষে তাঁদের বক্তব্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন এবং উক্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে লে. কর্নেল হাসিনের বির"দ্ধে ১১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে একটি ফিল্ড জেনারেল কোর্টমার্শাল গঠন করা হয়; তার বিচারকার্যক্রম চলছে। এই বক্তব্যে দেখা যায়, আট দিনের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠনের বিধান পালিত হয়েছে কি না সেই মৌলিক প্রশ্নটা উহ্য। এই বিধান পালিত না হলেও আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পত্রিকায় উল্লিখিত ‘অভিযুক্ত অফিসারদের বির"দ্ধে কোনরূপ বিচারকার্যক্রম শুর" হয়নি এবং ১৫০ দিন পার হওয়ার পরও তাদের বির"দ্ধে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি’ মর্মে প্রকাশিত বক্তব্য সঠিক নয়।
এরপর গত ৫ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশে আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের বরাত দিয়ে ‘মেজর জিয়ার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে’ শীর্ষক আইএসপিআরের বক্তব্যের একাংশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন লে. কর্নেল যায়ীদের ছোট ভাই আ. আ. জাবিদ। এক প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি জানান, তার ভাই যায়ীদ পিএসসি, এমডিএস, এসএ, বিএসবিএএ (এমআইএস, টি.আইবিএ)-কে গত ১০ জুলাই ২০১১ তারিখে ছুটিতে থাকা অবস'ায় পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের সরকারি বাসভবন থেকে তুলে নেয়া হয়। তিন-চার দিন পর পরিবারের লোকজন বিষয়টি জানতে পারেন। সেই থেকে প্রায় ছয় মাস বা ১৮০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অদ্যাবধি তার ভাইয়ের বির"দ্ধে কোনো চার্জ বা অভিযোগ আনতে পারে নাই। তাই যায়ীদ সম্পর্কে আইএসপিআরের বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য ও বিভ্রানি-মূলক। আ. আ. জাবিদ তার প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলেন, সামরিক কর্মকর্তাকে তদনে-র জন্য আটক করার প্রয়োজন পড়ে না। তাকে শুধুমাত্র লগ এরিয়াতে অ্যাটাচমেন্ট করলেই হয়। একটি কক্ষে বহুসংখ্যক সৈনিক দ্বারা তালাবদ্ধ অবস'ায় কেন লে. কর্নেল যায়ীদকে আটক রাখা হয়েছে- এর ব্যাখ্যা চান তিনি।
পত্রিকায় আমি যেভাবে পড়েছি সেভাবেই বিষয়গুলো হাজির করছি। আমরা দেখছি পুরা ঘটনাঘটনের মধ্যে মূল বিষয় হ"েছ- এক. সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সক্রিয় ভূমিকা আনন্দবাজার পত্রিকার বক্তব্যের সঙ্গে যার কোন অসঙ্গতি নাই; দুই. সেনা আইনের অধীনে সৈনিকদের সামরিক আদালতে সুবিচার পাবার অধিকার- যা মানবাধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত এবং তিন. বিচার ছাড়া আটক রাখা এবং আটক রাখার পরেও অভিযুক্তের আত্মীয়-স্বজনদের তা না জানতে দেওয়া বা অস্বীকার করা।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের ভূমিকা শুধু সেনাবাহিনীর উদ্বেগের বিষয় নয়, বাংলাদেশের যেকোন নাগরিকেরই উৎকণ্ঠার বিষয়। গুজব মাত্রই সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষতিকর। দৈনিক আমার দেশ সকল প্রকার গুজব নিরসন করবার জন্যই আসলে সেনাবাহিনীতে কী ঘটছে তা সেনাবাহিনীর কাছেই জানতে চেয়েছে। কিন' নাগরিকদের উৎকণ্ঠা নিরসন করবার জন্য দৈনিক আমার দেশের ভূমিকাকে দমন করবার জন্য প্রথমে যে কাজটি করা হয় সেটা হোল- মামলা। গত ৮ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি খর্ব ও সম্মানহানির অভিযোগ এনে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, প্রকাশক আলহাজ মো: হাসমত আলী ও বিশেষ প্রতিনিধির বির"দ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন একজন সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর (অব:) শাহ আলম তালুকদার। মামলায় তার অভিযোগ হ"েছ- ৩ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘মেজর জিয়াকে নিয়ে রহস্য’ শিরোনামের সংবাদে বলা হয়েছে, মেজর জিয়া সম্পর্কে জানতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে দৈনিক আমার দেশকে বলা হয়, পরিচালক সাহেব মিটিংয়ে আছেন। মেজর জিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয়, ‘মেজর জিয়া সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া যাবে না’। সাবেক এই সেনাকর্মকর্তার দাবি হ"েছ- দৈনিক আমার দেশের এই সংবাদটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও মানহানিকর। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকা অফিস থেকে জানতে চাইলে সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘নিয়ম মোতাবেক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আনুষঙ্গিক দাপ্তরিক কার্য সম্পাদন অনে- অফিসিয়ালি যাবতীয় তথ্য জানানো হবে। মেজর জিয়া সংশ্লিষ্ট কর্মস'লে যোগদান না করায় তাঁর বির"দ্ধে সেনা আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে’। খেয়াল রাখতে হবে দৈনিক আমার দেশের বির"দ্ধে মামলা সেনা কর্তৃপক্ষ করছে না, করছে একজন সাবেক সেনা অফিসার। কিন' তিনি জানেন সেনা কর্তৃপক্ষ দৈনিক আমার দেশকে কী বলেছে। এখন অভিযোগ হ"েছ যে- বিবাদিরা তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে আমার দেশ তা উল্লেখ করায় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন এবং এতে বাদি একজন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা হওয়ায় তার মর্যাদা/সম্মানহানি হয়েছে।
সেনা সদরের তরফে যে সংবাদ সম্মেলন হয় সেখানে দৈনিক আমার দেশের বির"দ্ধে এই মামলার প্রসঙ্গ ওঠে নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে ৩ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে দৈনিক আমার দেশের প্রতিবেদনটিকে ‘হলুদ সাংবাদিকতার অংশ’ হিশাবে অভিযুক্ত করা হয়। দৈনিক আমার দেশ অবশ্য তার পরদিনই এই অভিযোগের জবাব দেয়। এরপর সেনা সদর থেকে কোন উত্তর এসেছে বলে আমি দেখি নি।
এই তথ্যগুলো পাঠকদের আবার বলবার কারণ হ"েছ- সেনাবাহিনীর তরফে যারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন তারা নাগরিকদের উৎকণ্ঠার মূল জায়গা এবং সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের মৌলিক প্রশ্নগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পুরা ব্যাপারটিকেই ‘প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের ইন্ধনে অবসরপ্রাপ্ত এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা কর্তৃক অন্যান্যদের ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিশঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার একটি বিফল প্রয়াস’ হিশাবে হাজির করেছেন। পুরা ব্যাপারটি আরো প্রশ্নবোধক হয়ে পড়েছে ইকোনমিস্টকে দেওয়া সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টায় অভিযুক্ত বেসামরিক ব্যক্তি প্রবাসী ইশরাক আহমেদের সাক্ষাৎকারে। ইশরাক আহমেদ ইকোনমিস্টকে বলেছেন- তিনি ধর্মান্ধ মৌলবাদী নন। ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দায়িত্বের সঙ্গে নিজের দেশকে স্বাধীন করতে তিনি লড়েছেন। তার বাড়ি থেকে মদ, ব্র্যান্ডি ও হুইস্কি জব্দ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অস্ত্র নয়। ইকোনমিস্ট বলছে- ইশরাক অনেক কথাই বলেছেন। তবে খুবই সম্ভব ও সুনির্দিষ্ট যে তথ্য তিনি জানিয়েছেন সেটা হোল- ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'া রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের সদস্যরা বাংলাদেশে তৎপর। এই সংস'ার সদস্যরা প্রায় দুই বছর থেকে বাংলাদেশী গোয়েন্দা সংস'ার কার্যালয়ে অফিস করছে এবং সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগব্যবস'াও কার্যকর রয়েছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক নজরদারি চালায় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর থেকে তাদের সন্দেহভাজনদের অপহরণ করে। ইশরাক আহমেদ আরো বলেছেন, সরকার সেনা অভ্যুত্থানের কথা বললেও কোনো ট্রুপস ও গান মুভমেন্ট দেখাতে পারে নি।
ইকোনমিস্ট এই সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে জানান দিতে চেয়েছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ সেনা সদর তুলেছে এবং ভারতের আনন্দবাজারের মতো পত্রিকা রটনা করে যা"েছ তার ভিত্তি দুর্বল। এই দিকটা প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে। আসলে কী ঘটেছে তা প্রকাশ ও প্রমাণের দায় সরকারের। আমরা আশা করব সেনাবাহিনী দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না। আমরা চাই বা না চাই এটা পরিষ্কার যে বাস-ব কারণেই দিল্লির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরোধিতা বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান নির্ণায়ক হয়ে উঠতে বাধ্য। এর জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ভারত নীতিই দায়ী। মৌলবাদ বা ধর্মান্ধ জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
৩০ জানুয়ারি ২০১২। ১৭ মাঘ ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com
( লেখার তৃতীয় কিস্তি পড়-ন আগামী বৃহস্পতিবার)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন