শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

একুশে ও বইমেলার একাল-সেকাল



সৈয়দ আবুল মকসুদ
আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে প্রকৃত ঘটনা ও সত্য তথ্য মানুষকে আকর্ষণ করে না। সবাই যেন শুনতে চায় বানানো ও মনগড়া কথা। নিজের চোখে যা দেখেছি, নিজের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, অভিজ্ঞতা থেকে যা জানি, তাতে অবিশ্বাস করতে বাধ্য করছে এই সমাজ। জীবনের চারদিকে যা ঘটছে, তা দেখে এক ধরনের বিবমিষা বা অভক্তির সৃষ্টি না হয়ে পারে না।
এখানে যে কারও যেকোনো কথাই কোনো রকম প্রশ্ন না করে বিশ্বাস করতে হবে। তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি কেউ যদি বলে যে বায়ান্নর ২২ ফেব্রুয়ারি আমি একটি কৃষ্ণচূড়ার গাছে উঠে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম—তৎক্ষণাৎ তা বিশ্বাস করবে সাড়ে সাত কোটি মানুষ। যাঁর সমর্থনে জনা ১৫ লোকও পাওয়া যাবে, যাঁদের একজন দাবি করবেন, গাছে উঠতে তলা থেকে তাঁর পেছনে আমিই সজোরে ধাক্কা দিয়েছিলাম। কেউ প্রশ্ন করবে না যে কৃষ্ণচূড়া গাছে আরোহণকারীর বয়স ছিল তখন আট এবং তাকে ঠেলা দিয়ে ওপরে তোলার লোকটির আড়াই। মহৎ কোনো কাজের কৃতিত্ব নেওয়া এবং তাকে পুঁজি করার প্রতিভা বাঙালির সীমাহীন।
এখানে সত্য ঘটনা নয় উপকথা, ঘটনার নায়ক নয় পার্শ্বচরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ, সেনাপতির চেয়ে সেপাইয়ের দাপট বেশি। এখানে রাতারাতি ও পক্ষকালের মধ্যেই খ্যাতি ও প্রতিপত্তি রোজগার করা খুবই সহজ। কোনো ব্যাপারে যাঁর ভূমিকা ও কাজ নগণ্য, তিনি সেই ঘটনার নায়ক সেজে মঞ্চ আলোকিত করে বসেন। যাঁদের অবদান অসামান্য, তাঁরা অবহেলিত হয়ে ঘুরে বেড়ান এদিক-ওদিক। যা সত্য নয়, তাকেই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণপণ চেষ্টা চলে। যা সত্য তাকে দেওয়া হয় মাটিচাপা।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা এবং বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে একুশের বইমেলা নিয়ে কয়েক বছর ধরে যা হচ্ছে, তা দেখেই ওপরের কথাগুলো মনে হয়েছে। সেকালে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল একটি মহাশোকের দিন। এখন তা এক উৎসব। বইমেলা এখন আর গাম্ভীর্যপূর্ণ কোনো ঘটনা নয়, প্রাণের মেলা। গ্রামীণ মেলা বা গ্রন্থমেলার একটা সংজ্ঞা আছে, কিন্তু প্রাণের মেলার কোনো ডেফিনেশন নেই। প্রাণ যা চায়, তা-ই নির্বিচারে করে যাওয়াই প্রাণের মেলা। কেউ নাম দিয়েছেন মিলনমেলা। কার সঙ্গে কার মিলন, তা বলেন না।
ইউরোপে উৎপাদিত প্রতিটি দ্রব্য আমরা অতি আনন্দে এস্তেমাল করি। ইউরোপের আঠারো শতকের এনলাইটেনমেন্টের যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকের ছিটেফোঁটাও আমাদের গায়ে লাগেনি। আমরা শিক্ষা ও দীক্ষা, দুটোই নিয়েছি আমাদের দেশের পীর-ফকিরদের কাছ থেকে। ফেব্রুয়ারিকে আমরা নাম দিয়েছি ভাষার মাস। দুই হাজার বছর পর দ্বিতীয় মাসের এই নতুন নামকরণের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টি পত্রিকায় ৪২০টির মতো রচনা-প্রতিবেদন পাঠ করেছি। পাঠ করে ক্লান্তি বোধ করিনি, হতাশ হয়েছি। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো নতুন স্বপ্ন জাগেনি। স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধ পড়েছি বায়ান্নর ভাষাসেনাদের, যাঁদের সংখ্যা জনসংখ্যার মতোই ক্রমবর্ধমান। পড়েছি প্রকাশকদের ৭৫টির মতো সাক্ষাৎকার ও পরামর্শমূলক বক্তব্য। পাঠ করেছি খ্যাতিমানদের অমূল্য কালজয়ী রচনা। কোনো সন্দেহ নেই, আগামী বছরগুলোয় এ ধরনের স্মৃতিসম্ভারের ঝাঁপি আরও বেশি খোলা হবে এবং কনফুসীয় উপদেশের পরিমাণ বহুগুণ বাড়বে। কারণ, এ দেশে কোনো কিছু শুরু হলে আর থামে না, বাড়ে। যে কাগজ ওসব যত বেশি ছাপবে, সে কাগজ তত বেশি প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক ও ভাষাপ্রেমিক বলে প্রতিপন্ন হবে। 
একদিন যা ছিল শুধু একুশ, আজ তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বই ও বইমেলা। আগের একুশ আর আজকের একুশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির এক-দেড় মাস পর আমি জীবনে প্রথম ঢাকায় আসি। সেই ঢাকাও আজ নেই, সেই একুশের মহিমাও নেই।
সেকালে আমরা আরিচা (তখন নাম শিবালয়) থেকে ঢাকা আসতাম স্টিমার বা লঞ্চে। সারা বছর নদী থাকত পানিতে টইটম্বুর। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যায় ছিল উত্তাল ঢেউ। বুড়িগঙ্গাও তখন বুড়ি হয়নি। প্রথম দিন ঢাকায় পদার্পণের কথা আমার মনে আছে। সন্ধেবেলা আমাদের স্টিমার যখন ফতুল্লার কাছে এল, তখন দেখতে পেলাম, আকাশের অধিকাংশ নক্ষত্র মাটিতে পড়ে গেছে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, অত আলো কিসের? তিনি বললেন, ওটাই তো ঢাকা। ফরাশগঞ্জ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রজ্বলিত বৈদ্যুতিক বাতিগুলোকে দূর থেকে মনে হচ্ছিল একেকটি নক্ষত্র।
বাদামতলী ঘাটে নেমে উঠি রিকশায়। সেদিন রিকশাকেই মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গাড়ি। উঠেছিলাম টিপু সুলতান রোডে, আমাদের এক আত্মীয়র বাড়িতে। আমার বাবার সেবার ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য ছিল দুটো: আমার হাড়সর্বস্ব শরীরকে ডাক্তার দিয়ে দেখানো এবং একটি পুস্তিকা ছাপানো। পরদিন র্যাংকিন স্ট্রিটে ডাক্তার এম এন নন্দীর চেম্বারে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমার নাড়ি দেখেন, হাড়-ওঠা বুকে-পিঠে স্টেথিসকোপ বসিয়ে হূৎপিণ্ডের শব্দ শোনেন, পেট টেপেন, জিভ দেখেন, তারপর মল ও রক্ত পরীক্ষার নির্দেশ দেন। দুটোই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মল বোতলজাত করা চরম বিরক্তিকর, রক্তের জন্য সুঁই ফোটানো ভীতিকর।
যে কয়দিন ঢাকায় ছিলাম, যেখানেই গেছি বড়দের আলোচনার বিষয় ছিল একটিই: রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ও একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের কথা। সব মানুষের চোখে-মুখে এক গভীর বেদনা ও বিমর্ষতা। একটি ঘটনা সারা দেশের সব মানুষের চেতনায় কতটা অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে, তা উপলব্ধি করার বয়স আমার ছিল না, কিন্তু মানুষের শোকের মুখচ্ছবি আমার ঠিকই মনে আছে।
শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন আমাদেরই এলাকার মানুষ। তাঁকে নিয়ে পল্লিকবিরা তৎক্ষণাৎ গান বেঁধেছিলেন। হাটবাজারে সে গান গীত হতো। আমার বাবাও তাঁর উদ্দেশে কয়েকটি শোকগাথা লিখেছিলেন। সেগুলো এবং নজরুলের ‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও’, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ‘স্বদেশ স্বদেশ কর্চ্ছ কারে এ দেশ তোমার নয়’ ও মুকুন্দ দাশের দু-একটি গান নিয়ে তিনি একটি পুস্তিকা ছাপান। ১৫-২০ পৃষ্ঠার মতো পুস্তিকা। পাতলা খান লেনের একটি প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। কীভাবে একটি একটি করে টাইপ সাজিয়ে ট্রেডল মেশিনে কাগজ ছাপা হয়ে বাঁধাই হয়ে বই হয়, তা তখনই দেখি। আশির দশকে আমার বাবা যখন মারা যান, তখনো ভাষাসৈনিক অভিধাটি আবিষ্কার ও চালু হয়নি। তাঁর মৃত্যুসংবাদে ওই খেতাবটি যোগ করার মওকা পাওয়া যায়নি।
পরের বছর তিনি জিন্দাবাহার গলির ভেতর এক বাঁধাইখানা থেকে একটি বই সংগ্রহ করেন। বইটি অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে আলমারিতে সাজিয়ে না রেখে শক্ত কাগজ দিয়ে জড়িয়ে একেবারে ঘরের সিলিংয়ে অপ্রয়োজনীয় বইপত্রের মধ্যে রেখে দেন। পঞ্চাশের শেষ দিকে সে বইয়ের রহস্য আমি উদ্ঘাটন করি এবং শিহরিত হই। আশির দশকে বাংলা একাডেমী যখন মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশিত ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারীর ফ্যাক্সিমিলি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়, তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও তার একটি কপি কারও কাছে পাওয়া যায়নি। আমার কাছ থেকে নিয়েই ফটোকপি করা হয়। মূল বইটি আমার কাছে আছে।
স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল এক মহিমান্বিত ও সত্যি সত্যি শোকের দিবস। পঞ্চাশের দশকের কয়েকটি এবং ষাটের দশকের সব একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি ঢাকায় ছিলাম। কেমন ছিল সেসব একুশে ফেব্রুয়ারি পালন? তখন মানুষের মধ্যে চক্ষুলজ্জা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের ওপর কালো কাপড় সেঁটে দেওয়া হতো। কেউ কেউ দোকানের নাম বাংলায় কাপড়ে লিখে ঝোলাতেন। এ কাজটি অবাঙালিরাও করতেন।
মধ্যরাতের আয়োজন ও উন্মত্ততা সেকালে ছিল না। তবে অন্ধকার থাকতেই সাধারণ মানুষ বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। হাজার হাজার মানুষ। সবার পা খালি। সম্ভব হলে একটি ফুল, না হলে খালি হাতেই প্রভাতফেরির মানুষজন অতি সুশৃঙ্খলভাবে দুটো লাইন করে আজিমপুর কবরস্থানে যেত শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে। অগণিত মানুষ, কিন্তু একটু শব্দ নেই। চোখ বন্ধ করে রাখলে মনে হতো এই শহরে কোনো মানুষজন নেই। কবরে ফুল দিয়ে আবার লাইন ধরে মানুষ যেত শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সেখানেও থাকত না কোনো হট্টগোল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোনো মানুষের পায়ে জুতা-স্যান্ডেল দেখা যেত না। খুব সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারাও স্যান্ডেল জোড়া কাগজে মুড়ে খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নিতেন।
জাতীয়তাবাদী শিল্পীরা শোকসংগীত ও দেশপ্রেমের গান পরিবেশন করতেন। একসময় শুরু হয় পল্টন ময়দানে গণসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি শহীদ দিবসে আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমানসহ সেকালের সংগীতশিল্পীরা গান গাইতেন। বাংলা একাডেমীর বটমূলে হতো কবিতা পাঠের আয়োজন। অতি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ছিল সেই অনুষ্ঠান। প্রধান কবি শামসুর রাহমান থেকে আমাদের মতো তরুণেরাও তাতে অংশ নিতেন। কবিতা পাঠের আসরে শ্রোতা হিসেবে প্রায় অবধারিতভাবে দেখা যেত ডা. এম এন নন্দী, ধীরেন দত্ত, অজিত গুহদের। ষাটের দশকের মহিলা কবি মেহেরুন্নেসা ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে কিছু বড়। তাঁকে ভালো লাগত। তাঁর কবিতাও। তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রমনার অল্প ফুলওয়ালা কৃষ্ণচূড়ার গাছটিকেও মনে হতো ফুলে ফুলে ভরে গেছে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন মানেই একুশের সংকলন প্রকাশ। দু-চার টাকা চাঁদা তুলে বা দোকান-প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য বিজ্ঞাপন নিয়ে সেই সংকলন প্রকাশের যে আনন্দ, তা এখনকার ভাগ্যবান তরুণদের বোঝানো যাবে না। সেই সংকলন প্রকাশে প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীরা জড়িত থাকতেন। প্রতিটি সংকলন থেকে বিচ্ছুরিত হতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন:
‘...প্রতি একুশেতে শত শত সংকলন প্রকাশিত হতো লেখা ও আঁকা নিয়ে সারা বাংলাদেশ থেকে। শহীদ মিনারের পাদদেশে, সামনের ফুটপাতে [চাটাই] বিছিয়ে সেই সংকলনগুলো বিক্রি হতো। ...এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম সমসাময়িক সবাই। নান্দনিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচ্ছদ, ভেতরের সজ্জা, হরফ নির্বাচন—সবই করে দিতাম একটি সুন্দর সংকলনের জন্য। এই সংকলনগুলো শহীদ মিনারের পাদদেশে বিক্রি হতো। আমার ধারণা, এটাই ছিল একুশের বইমেলার প্রথম বীজ রোপণ।’
[প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১]
এটা শুধু কাইয়ুম চৌধুরীর ধারণা নয়, এটাই বাস্তবতা ও সত্য। তবে এর সঙ্গে আমি আরেকটু যোগ করতে চাই। শুধু একুশের সংকলন নয়, ১৯৬৭-৬৮ থেকে শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় বইও বিক্রি হতো। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের মালিক রুহুল আমিন নিজামী সোভিয়েত ইউনিয়নের বইপত্রের আমদানিকারক ছিলেন। তখন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাংলাদেশে তুঙ্গে। সোভিয়েত বইয়ের ছাপা-বাঁধাই ছিল উন্নত, দাম কম, তবু অনেক বই-ই অবিক্রীত থাকত। তা ছাড়া নিজামী সাহেবেরই ঝিনুক প্রকাশনী থেকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের রচনাবলি প্রকাশ করা হয়। সেসব বইয়ের সস্তা সংস্করণও অল্প সময়ে শেষ হতো না। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা ও নিজার সাহেবের প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বই বিক্রির জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের সামনের ফুটপাতে দোকান খোলা হতো। ’৬৯-৭০-এ স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও ঝিনুক প্রকাশনার সঙ্গে আরও দু-একটি প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা শিশুদের বই ভালোই বিক্রি হতো। ’৭২ থেকে বাংলা একাডেমীর সামনে ঝিনুক, মুক্তধারা প্রভৃতি প্রকাশনা সংস্থাও বই বিক্রি শুরু করে।
মুক্তধারার প্রধান নির্বাহী জহরলাল সাহার ভাষায়, ‘১৯৭২ সালে মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহাই প্রথম একাডেমী চত্বরে সবুজ ঘাসের মধ্যে চট বিছিয়ে বই বিক্রির সূচনা করেন।’ তাঁর ওই লেখায় কিছু ভুল ও কিছু তথ্যবিকৃতি ঘটেছে। তিনি বলেছেন, চিত্তবাবু ‘সৃজনশীল সাহিত্যের অগ্রপথিক’। প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন, তিনি নোটবই প্রকাশের অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন আমাদের অগ্রজের মতো ঘনিষ্ঠ, আমার কয়েকটি বইয়েরও প্রকাশক, কিন্তু কোনো দিন এমন দাবি করতেন না।
পূর্ব বাংলায় সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পের সূচনা রবীন্দ্রনাথের জন্মেরও এক বছর আগে: ১৮৬০ সালে। সূচনা করেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও হরিশ্চন্দ্র মিত্র। সেটা বাদ দিলেও চল্লিশের দশকেই ঢাকায় গড়ে ওঠে আধুনিক প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্প। ’৪৭-এর পর ঢাকার দুজন আধুনিক প্রকাশক হলেন প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির অনিল চন্দ্র ঘোষ ও নওরোজ কিতাবিস্তানের মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। অনিল বাবুর বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জে। তিনি ছিলেন আমার বাবার বাল্যবন্ধু। চিত্তদা বলতেন, অনিল বাবু আমার গুরু। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামী ও গান্ধীজির অনুসারী। বহুবার জেল খেটেছেন। নিজেও লেখক ছিলেন। রবীন্দ্র শতবর্ষে পূর্ব বাংলা থেকে প্রকাশিত কবির সম্পর্কে প্রথম বই রবীন্দ্রনাথ-এর তিনিই লেখক।
পঞ্চাশের দশকের সাহিত্যের বইয়ের প্রকাশকদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার হয়েছিল। আজ যে আমি বাংলা ভাষার একজন ক্ষুদ্র লেখক হতে পেরেছি, তাতে তাঁদের প্রভাব রয়েছে। তাঁদের প্রকাশিত বই শৈশব-কৈশোরে পড়েছি। সেসব পাঠ করে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ লেখার আকাঙ্ক্ষা জেগেছে। পঞ্চাশের দশকেই ঢাকায় প্রাণবন্ত প্রকাশনাশিল্প গড়ে ওঠে। ষাটের দশকে তা বিকশিত হয়।
বাবুপুরা ব্রিজের নিচে একটি উঁচু জায়গায় ছিল মখদুমী অ্যান্ড আহসানুল্লাহ লাইব্রেরি। শাহাদৎ হোসেনের রূপচ্ছন্দা ওখান থেকেই কিনি। আরও বহু সাহিত্যের বই সেখান থেকে প্রকাশিত হয়। ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, বাংলাবাজার, প্যারীদাস রোড ছিল বইপাড়া। ইসলামপুরের কথা প্রকাশ থেকে কিনেছিলাম আহসান হাবীবের রানীখালের সাঁকো। কোহিনূর লাইব্রেরি ছিল বহু মূল্যবান সাহিত্য বইয়ের প্রকাশক। পাটুয়াটুলীর পাকিস্তান বুক করপোরেশনও তা-ই। নয়াপল্টনে কাজী আফসার উদ্দিন আহমদের ছিল মৃত্তিকা সাহিত্য সদন। শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসানদের বই প্রকাশ করেছেন তিনি। শান্তিনগরে মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের হাসি প্রকাশনী, পাটুয়াটুলীতে বোরহানউদ্দিন আহমদের ইস্ট বেঙ্গল বুক সিন্ডিকেট, ইসলামপুরের ইসলামিয়া লাইব্রেরি, ওসমানিয়া বুক ডিপো, আদিল ব্রাদার্স, সোবহানিয়া লাইব্রেরি, লিয়াকত পাবলিশিং হাউস, রশীত পাবলিশিং হাউস, বাংলাবাজারে স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স, প্যারাডাইজ লাইব্রেরি, জিন্না (বঙ্গবন্ধু) এভিনিউয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রভৃতি ছিল বড় প্রকাশনী। মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশনীর মধ্যে ছিল আহমদ পাবলিশিং হাউস, পপুলার পাবলিকেশনস, প্রভিন্সিয়াল বুক ডিপো প্রভৃতি।
ইত্তেফাক-এর কাছে শ্রাবণী, ইন্দিরা রোডে কপোতাক্ষী, পাটুয়াটুলীতে লিবার্টি, কাঠের পুল লেনে কথাবিতান, বর্ণমিছিল, নিউমার্কেটে নলেজ হোম, বুক ভিলা প্রভৃতি আধুনিক বইয়ের প্রকাশক। শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রামের বইঘর ছিল আধুনিক কবিতা ও কথাসাহিত্যের প্রকাশক। তা ছাড়া কুমিল্লা, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহেও কিছু সৃজনশীল প্রকাশনী ছিল। আজ যে বাংলাদেশে প্রাণবন্ত প্রকাশনাশিল্প গড়ে উঠেছে, তার পূর্বসূরিদের ভুলে গেলে চলবে না। তাঁরা সংখ্যাকে গুরুত্ব দেননি, মানকে মূল্য দিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন, একুশে, বইমেলা নিয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। বস্তুনিষ্ঠতা থেকে যদি আমরা বিচ্যুত হই, তা জাতির কোনো কল্যাণ করবে না—সর্বনাশই ডেকে আনবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন