(সৈয়দ আবুল মকসুদ)
অনেক মানুষকেই জীবনে কখনো অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। কেউ উতরায়, কেউ হয় অকৃতকার্য। এ তো গেল জীবনের অগ্নিপরীক্ষা। আসল অগ্নিপরীক্ষা কাকে বলে তা অনেকেই জানে না।
বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হতো যে সে নিরপরাধ। এবং তা প্রমাণ করতে গিয়ে তাকে নানা রকম নৈতিক পরীক্ষার সামনে দাঁড়াতে হতো। সেই নৈতিক পরীক্ষার একটি অগ্নিপরীক্ষা, আরেকটি বিষপরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষায় অভিযুক্তকে আগুনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে হতো অথবা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হতো। যদি তার হাত-পা ও লোম পর্যন্ত না পুড়ত, তা হলে ধরে নেওয়া হতো লোকটি নির্দোষ। আর যদি তার শরীর ঝলসে যেত তা হলে সমাজপতি ও সাধারণ মানুষ রায় দিত: লোকটা দোষী। বিকল্প অগ্নিপরীক্ষাও ছিল। তা হলো: অভিযুক্তের হাতের তালুতে হাঁপরে পোড়া লাল টক টকে এক খণ্ড লোহা রাখা হতো। যদি তার হাত না পুড়ত, তা হলে সে নিরপরাধ। তবে তিন হাজার বছর পরে আমাদের এ কালের মানুষের অভিজ্ঞতা বলে যে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ মানুষটিও যদি আগুনের কুণ্ডলীতে গিয়ে দাঁড়ায় তার শরীর পুড়তে বাধ্য। এবং লাল টকটকে লোহার টুকরো হাতের তালুতে নিলে ওই হাত চিরকালের জন্য অকেজো হয়ে যাবে।
বিষপরীক্ষাটিও ছিল বিপজ্জনক। অভিযুক্তকে এক বাটি বিষ চায়ের মতো ঢক্ ঢক্ করে পান করতে বলা হতো। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উগলে দেওয়াও চলবে না। ওই বিষ পানের পরেও যদি লোকটি বেঁচে থাকত, তা হলে সে নিরপরাধ। তবে এ ক্ষেত্রেও আমরা বলব, বিষ পানের পরে রোবট বাঁচতে পারে, কোনো পূত-পবিত্র চরিত্রের মানুষও বাঁচবে না। দোষী ও নির্দোষ বাছবিচারের শক্তি বিষের নেই।
সে যা-ই হোক, গত ২৯ ডিসেম্বরের পর থেকে আমার মনে হচ্ছে: আওয়ামী লীগের অগ্নিপরীক্ষা শুরু হলো এবং বিএনপি পড়েছে বিষপরীক্ষায়। এই দুই দলের অগ্নিপরীক্ষা ও বিষপরীক্ষা যে শুধু তাদেরই বাঁচা-মরার প্রশ্ন তাই নয়, বাংলাদেশের মানুষেরও আধা-বাঁচা ও আধা-মরার প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডে ঝলসে যেতে পারে জনগণের শরীর আর বিএনপির বিচার-বিবেচনাবর্জিত কাজের বিষক্রিয়ায় মানুষ না মরলেও অসুস্থ হয়ে পড়তে বাধ্য।
কোনো দল যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়, তখন তার অগ্নিপরীক্ষার শুরু। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের বিজয় যেমন একটি মহা আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছে তাদের জন্য, তেমনি তারা না জানলেও আমরা মনে করি, তাদের অগ্নিপরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা পৌনে সাত মাসে আমাদের চোখে ধরা পড়েনি, কোনো কোনো প্রেমময় কলাম লেখক নিজেদের উরুতে থাপ্পর মেরে সরকারকে বাহবা দিয়ে বলতে পারেন: চমত্কার। কিন্তু খুঁতখুঁতে জনগণের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। জনগণের দুটি চোখ দুটি রাডার, ওতে ধরা পড়ে সব।
সরকারের প্রথম অগ্নিপরীক্ষাটি ছিল সত্যি সত্যি অগ্নিপরীক্ষা—আসলেই আগ্নেয়াস্ত্রের পরীক্ষা। সেটি হলো পিলখানার পাশবিকতা, যার নামকরণ হয়েছে বিডিআর বিদ্রোহ। আমরা ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তীতুমীরের বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ প্রভৃতি দেখেছি। তার সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের বইতে যোগ হলো আরেকটি বিদ্রোহ: পিলখানা বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের কথা বাংলার বালক-বালিকারা এক শ বছর পরে পাঠ করবে। মারাঠা বিদ্রোহ দমন করতে মুঘল শাসকদের যে বেগ পেতে হয়েছে, পিলখানার বিদ্রোহীদের দমন করতে সরকারকে তার চেয়ে ঢের বেশি মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে।
এ ছিল এক অনন্য বিদ্রোহ। নজরুলের চেয়ে বড় বড় বীরের সেখানে আবির্ভাব ঘটে। তারা সেদিন ফরাসি বিপ্লবের চেয়ে বড় বিপ্লবই প্রায় ঘটিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশে। সেই বিদ্রোহী ও বিপ্লবীরা দল বেঁধে সরকারপ্রধান ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে চা-নাশতা খেলেন ও সহাস্যে গল্পগুজব করলেন। ওদিকে পিলখানায় সেনা অফিসাররা হলেন বর্বরোচিতভাবে নিহত। যে ডজনখানেকের বেশি বিডিআর কর্মকর্তা বা বিদ্রোহী প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মকর্তাদের দ্বারা পেলেন অভ্যর্থনা, তাদের সেখানে চা-স্যান্ডউইচ শুধু নয়, আরও ভালো মধ্যাহ্নভোজ দিয়ে আটকে রেখে তাদের দিয়েই পিলখানার ভেতরে যোগাযোগ ঘটালে জানা যেত কারা অপরাধী আর কারা নিরপরাধ। তৌহিদ ও তাঁর সহযোগীরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বিদ্রোহী, তাদের তখন ওখানে আটক করে ফেললে এখন আর আসামিদের টর্চলাইট নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে খুঁজে বেড়াতে হতো না। যাই হোক, পিলখানার অগ্নিপরীক্ষায় সরকার উতরে গেছে বটে, কিন্তু সরকারের হাত-পা পুড়েছে ভালোমতোই এবং দেশেরও শরীরে স্যাঁকা লেগেছে ভালোই।
পিলখানা বিদ্রোহের কোন আইনে বিচার হবে—শুধু এই কথাটি সাড়ে চার মাসে অন্তত ৯০ বার ৪৫ ভাবে বলা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় যদি একজন বলেন, সেনা আইনে বিচার হবে; সোমবার সকালে আরেক কর্তা বলেন, প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করা হবে; মঙ্গলবার মধ্যাহ্নে এক মন্ত্রী বলেন, বিডিআর আইনে বিচার হবে। এসব কী? আর বিডিআরের মহাপরিচালক যে কত রকম কথা বলেছেন তার শেষ নেই। তিনি বুঝলেন না এবং আমাদের মিডিয়াও বুঝল না যে বিচার করার বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। ওটার জন্য রাষ্ট্রের অন্য এজেন্সি রয়েছে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আদালত রয়েছে। এ রাষ্ট্রে আজ যার যা খুশি তাই করে ও বলে যায়—কেউ প্রশ্ন তোলে না—চ্যালেঞ্জ করা তো দূরের কথা। এই ঘটনাটি বড় লাট মাউন্টব্যাটেনের সময় ঘটলে এ নিয়ে বাগিবতণ্ডা হতো না, যা হতো তা হলো, বিচার করে হয় অভিযুক্তদের খালাস দিত, না হয় মোম দিয়ে মাজা দড়িতে লটকে দিত।
বাংলাদেশের মতো মাথা গরম মানুষের দেশে কোনো সরকারের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এক শক্ত অগ্নিপরীক্ষা। কোনো রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বাইরে যদি একটি মাত্র মন্ত্রণালয় রাখতে হয় তাহলে সেটি হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উপ-প্রধানমন্ত্রীরাই সাধারণত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। যেমন ভারতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল। পাকিস্তানেও তেমনই ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিপিং মন্ত্রণালয় বা পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় না থাকলে বড় সমস্যা হয় না, কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না থাকলে রাষ্ট্র চলে না। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন দুই-দুইজন মন্ত্রী। জুনিয়র মন্ত্রী বললেন, অপরাধীদের ধরার জন্য প্রয়োজনে আকাশের যত উপরে এবং সমুদ্রের যত নিচে সম্ভব তাঁরা যাবেন। কিন্তু আকাশ ও সমুদ্রে না গিয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি গেছেন আমেরিকায়। সিনিয়র মন্ত্রী অসুস্থ হয়ে গেছেন সিঙ্গাপুর। পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়। জীবন চলে। সুতরাং দেশও চলে। সরকার চেপে গেলেও প্রতিমন্ত্রী বিদেশ থেকে ঘোষণা দিয়েছেন: ‘আমি মন্ত্রিসভায় নেই’।
যেদিন আশুলিয়া হা-মীম গ্রুপের পোশাকশিল্প কারখানা দুর্বৃত্তরা ভস্মীভূত করে সেদিন আমি সেই নারকীয়তা দেখতে যাই। যাওয়ার পথে দেখলাম মোহাম্মদপুরে ট্রমা সেন্টার ক্লিনিকের সামনে ও আশপাশে অসংখ্য পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়ি থেকে নেমে আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী হয়েছে এবং তারা কী করছেন। বললেন, হোম মিনিস্টার আছেন ক্লিনিকে। তাঁরা ডিউটি করছেন। বৃষ্টির মধ্যে আশুলিয়া গিয়ে পোশাক কারখানার ছাইভস্ম দেখলাম, কিন্তু কোনো পুলিশ দেখিনি। কুড়িটির মতো কারখানায় আমি গেছি। ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু কোনো পুলিশ নেই। চৌরাস্তায় একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? এত উত্তেজনা। মালিকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত। পুলিশ কোথায়? তিনি বললেন, সাদা পোশাকে আমাদের লোক আছে।
কর্তব্যে অবহেলা ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি করলেও দোষ, মন্ত্রী করলেও দোষ। অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। কাজ করতে করতেই অভিজ্ঞতা হয়। যোগ্যতার বিকল্প নেই, কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করারও মূল্য রয়েছে। একটি মাঝারি আকারের শিল্প চালানোর চেয়ে একটি মন্ত্রণালয় চালানো কঠিন নয়। দরকার আগ্রহ ও বিষয় সম্পর্কে ধারণা। মন্ত্রিত্বে থাকার সময় পারিবারিক কাজকর্মে একটু কম ব্যস্ত থাকলেই ভালো। গত সাড়ে ছয় মাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে চলেছে তা বিধাতা জানেন আর জানে অপরাধীরা। অন্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও তথৈবচ।
বাংলাদেশ রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আকবর আলী খান দুই দিন আগে বলেছেন, প্রতি ছয় মাস অন্তর মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। আমি দ্বিমত পোষণ করি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা ছাত্র নন যে ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে কাজ করবেন এবং ছয় মাস পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরীক্ষা দিয়ে তাদের পাস করতে হবে। একজন মন্ত্রীর যোগ্যতা পরীক্ষার জন্য একটি ঘটনাই যথেষ্ট। বহু গণতান্ত্রিক দেশে মাত্র একটি ঘটনার কারণে কোনো মন্ত্রী বরখাস্ত হন বা তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ছয় মাসের সেমিস্টারের জন্য বসে থাকলে প্রশাসনের বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। মন্ত্রীদের সস্নেহ প্রীতিবশত কম্পার্টমেন্টালে পাস করাতে গেলে সরকার অগ্নিপরীক্ষায় ফেল করবে।
আধুনিক কালে কোনো জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের অর্থ সব বিষয়ে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। দু-চারটি কম জনসংখ্যাবিশিষ্ট ছোট দেশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। শুধু নিত্যব্যবহার্য পণ্য আমদানির জন্য নয়, আরও বহু ব্যাপারে একটি রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তবে চীনের মতো বিশাল দেশ যা পারে কোনো মাঝারি দেশের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। বিপ্লবের পরে চীন আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে। প্রথম কয়েক বছর শুধু বন্ধুত্ব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। এক পর্যায়ে সে সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায়।
দুই সুপার পাওয়ারের তীব্র মতপার্থক্য এবং ভারত ও চীনের বৈরিতার পটভূমিতে ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়। অর্থাত্ এর জন্মের ইতিহাস অন্য রকম। জন্মলগ্নে এর মিত্রদের মধ্যে ছিল বিলুপ্ত ও বিভক্ত হয়ে যাওয়া সোভিয়েত বলয়ের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রথমে মেনে নেয়নি। আমেরিকা মেনে নেয় এখানে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এক বিশেষ ধরনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কোনো দল স্বীকার করুক বা না করুক, ভারতের আধিপত্য এখানে থাকবেই—একভাবে হোক বা অন্যভাবে হোক। পাকিস্তান এখন ওপরে ওপরে ভাই ভাই যতই বলুক, ভেতরে ভেতরে শত্রুতা করবেই। সুতরাং বৈদেশিক সম্পর্ক বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা।
মুজিব-জিয়া-এরশাদ সরকার যতটুকু বৈদেশিক প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারত, খালেদা-হাসিনার গণতান্ত্রিক সরকার তা পারছে না। বিশ্বপটভূমি পাল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ খুব বেশি। তারা বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন সহযোগী’; প্রভাব খাটাতেই পারে। ভারতের চাপ অন্য রকম। পাকিস্তানের দাঁত-নখ না থাকলেও বাংলাদেশকে ইসলামি মৌলবাদী দেশ বানাতে তার অবিরাম চেষ্টা চলছেই। সবকিছুর ওপরে আছে ‘উন্নয়ন সহযোগী’ নয়া ঔপনিবেশিকদের লগ্নি সংস্থা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আন্তর্জাতিক আমলারা। এদের অসঙ্গত প্রভাব কাটিয়ে চলার জন্য যে মেধার প্রয়োজন তা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী-রাজনীতিক ও আমলাদের নেই। যেসব একাডেমিক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ থিংক ট্যাংকের কাজ করেন তাঁরা বিদেশিদের স্বার্থ রক্ষায়ই বেশি আগ্রহী।
প্রশাসনের অবস্থা জগাখিচুড়ি। ন্যূনতম দক্ষতা নেই। সরকারের নিরপেক্ষতায় আস্থা নেই কোনো কর্মকর্তার। অযোগ্য প্রিয়জনকে দেওয়া হচ্ছে উচ্চাসন ও গুরুদায়িত্ব। কম্পাউন্ডার যত বিশ্বাসীই হোক তাকে দিয়ে দক্ষ সার্জনের কাজ চলে না। প্রশাসনের দুর্নীতিতে ‘উন্নয়ন সহযোগী’রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সরকারি দলের ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দাপট হালাকু খাঁর সৈন্যদের হার মানায়। প্রকাশ্যে রাস্তার ইট পর্যন্ত লুট হচ্ছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন ভাঙচুর হচ্ছে যেন বর্তমান কাঠামো ভেঙে ফেলে ওখানে নতুন বহুতল ভবন বানাবে। অর্থনীতির অবস্থা অক্সিজেন লাগানো রোগীর মতো—নাক থেকে নল খুলে গেলে কী হয় কে জানে। সরকারের জন্য এ সবই অগ্নিপরীক্ষা। এর থেকে উদ্ধারের উপায় হলো উঁচু চিন্তা শক্তিসম্পন্ন ও সত্ মানুষের সমন্বয়ে গঠিত কোনো পরিষদের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
শক্ত বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। বিরোধী দলবিহীন যে গণতন্ত্র তা হয় একদলীয় শাসন, না হয় সামন্তবাদী রাজতন্ত্র বা অন্য কোনো ‘তন্ত্র’। বাংলাদেশের সংসদেও বিরোধী দল আছে। সেই বিরোধী দলের জনসমর্থনও প্রচুর। কিন্তু তারা জানে না তাদের কী কর্তব্য। বর্তমানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের জন্য যা অগ্নিপরীক্ষা, বেগম জিয়ার বিএনপির জন্য তা বিষপরীক্ষা। বিষপরীক্ষার পরে বেঁচে থাকার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যত্।
গত পৌনে সাত মাসে বিএনপির একটি তত্পরতাই আমাদের চোখে পড়েছে, তা হলো প্রায় প্রতিদিনই দলের ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের জিয়ার কবরে গিয়ে ফাতেহা পাঠ। ১৪৪ বছরে রিপাবলিকান দলের নেতা-কর্মীরা যতবার আব্রাহাম লিংকনের কবরে গিয়েছেন, গত ছয় মাসে বিএনপির নেতা-কর্মীরা তার চেয়ে অনেক বেশিবার পার হয়েছেন ক্রিসেন্ট লেকের সাঁকো। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে নেতা-কর্মীদের পদভারে ওই সাঁকো টেকে কিনা সন্দেহ।
দীর্ঘ বাজেট অধিবেশনটি গেল, বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াত সেখানে অনুপস্থিত। কী এক অদম্য অভিমান যা রাজনীতিতে তাদের বৈরাগ্যসাধনে প্ররোচিত করেছে। বিএনপির অবস্থা এখন বাউল সাধকদের মতো। কোনো টেন্ডারজাতীয় অর্থকড়ির ব্যাপারে অংশগ্রহণ করতে না পেরে তারা রাজনীতির প্রতিই বীতশ্রদ্ধ শুধু নয়, বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা বেছে নিয়েছেন অজ্ঞাতবাস— শুধু টিভি চ্যানেলের নাছোড় সংবাদদাতাদের সামনে বসা ছাড়া। তবে তাঁরা সাংসদ হিসেবে যাবতীয় সরকারি সুযোগ বেতন-ভাতা ঠিকই নিচ্ছেন। তাঁদের রাজনৈতিক নিস্পৃহতা দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এখনো জরুরি অবস্থা রয়ে গেছে। তাঁদের এই নিষ্ক্রিয়তা শেখ হাসিনার জন্য আনন্দদায়ক হলেও দেশের জন্য বিপজ্জনক।
সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ সবাই কামনা করে। কিন্তু একজন জাতীয় নেতার কর্তব্য আত্মপ্রেম ও পুত্রপ্রেমের ওপর দেশপ্রেমকে স্থান দেওয়া; পুত্রদের স্বার্থ ও ভবিষ্যতের চেয়ে দেশের ও জনগণের ভবিষ্যত্ ও স্বার্থ অগ্রাধিকার পাওয়া। গত নির্বাচনে বিফল মনোরথ বিএনপি নেতারা এখন যা করছেন তাতে দেশেরই যে শুধু ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, তাঁদের নেতাদের ও দলের ভবিষ্যতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ২৯ ডিসেম্বর তাঁদের জন্য ছিল বিষপরীক্ষা। সেই বিষক্রিয়া কাটানোর জন্য কোনো কোশেশ না করে তাঁরা যেন সরকারকে বলছে: প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আরও আরও আরও দাও বিষ। বিএনপির প্রতিপক্ষরা দেশি ও বিদেশি বিষের নানা রকম শিশি হাতে দাঁড়িয়েই আছে। একটির পর একটি নিয়ে শুধু গিললেই হলো।
গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা চাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অগ্নিপরীক্ষায় ও বিষপরীক্ষায় উতরে যাক। ইতিহাসে একজন রাজনৈতিক নেতার স্থান নির্ধারিত হবে তিনি জনগণের জন্য কী করেছেন তার ওপর, তিনি কতদিন ক্ষমতায় ছিলেন বা রইলেন তার ওপর নয়। নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় ছিলেন অল্প কিছুদিন। ক্ষমতার বাইরেই বহুদিন। সেদিন তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। জোহানেসবার্গ থেকে নিউইর্য়ক পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে উত্সবমুখর প্রার্থনা হয়েছে। শেখ হাসিনার কল্যাণে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে করমর্দনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার হাতে তিনি যে জোরে চাপ দিলেন তাতে তাঁঁর কব্জির জোরের চেয়ে বুকের উষ্ণতার জোরই বেশি পেলাম। জনগণ তাদের প্রিয় নেতাদের হূদয়ের উষ্ণতার উত্তাপ শুধু চায়—আর কিছু নয়। আমরা আশা করব, নেতারা ক্ষমতায় থাকুন আর ক্ষমতার বাইরেই থাকুন, জনগণকে আর বেশি হতাশ করবেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন