সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২৮-০৩-২০১২
বাংলাদেশের
জনগণের নেতারা গণতন্ত্রের প্রবল প্রেমিক। রাজনৈতিক নেতাদের মুখ ও দেশের
মাইকগুলোর মুখ যখন সভা-সমাবেশে নিকটবর্তী হয়, তখন বোঝা যায় গণতন্ত্রকে
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তাঁদের কী সীমাহীন আগ্রহ ও প্রচেষ্টা। মানুষ যেমন
ঘরে বাস করে, গণতন্ত্রেরও একটা ঘর আছে। সেই ঘরের ইংরেজি নাম পার্লামেন্ট।
আমরা বাংলা করেছি জাতীয় সংসদ। তাই নেতারা অব্যাহতভাবে বলেন: তাঁদের সব
কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হবে সংসদ। নেতারা রাশি রাশি কথা বলেন। তাঁদের
কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু যে সংসদকক্ষ হবে, এটা তাঁদের একমাত্র না হলেও
সবচেয়ে সত্য কথা। কোন ভোটারের বাবার সাধ্য এ কথা অস্বীকার অথবা অবিশ্বাস
করে?
গণতন্ত্র বাতাসের মতো। তা চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় এবং গণতন্ত্রের সেই বাতাসের প্রকাশ ঘটে জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড ও বক্তৃতার মাধ্যমে। সংসদকক্ষের বাসিন্দা হলেন জনপ্রতিনিধিরা। সংসদকে আইনসভাও বলা হয়। সেখানে আইনকানুন তৈরি হয়, প্রচলিত অপ্রয়োজনীয় আইন পর্যালোচনা করে তা বাতিল বা সংশোধন করা হয়। আইনকানুন রচনার কাজ না থাকলে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। পার্লামেন্টারিয়ানদের মুখই হলো পুঁজি। সুতরাং তাঁরা সুবক্তাও হন। বক্তার মুখনিঃসৃত যুক্তিসমৃদ্ধ বাণীকেই ভালো বক্তৃতা বলা হয়।
আইনসভাগুলো এখন অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই জনপ্রতিনিধিদের ‘সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু’ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের কথাই ধরা যাক। মুঠোফোনে ‘অশ্লীল ভিডিও’ দেখা, গালিগালাজ করা প্রভৃতি মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে গণ্য। সুতরাং তা শুধু নিজের ঘরের মধ্যে বসে না করে সংসদকক্ষে বসে বা দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে করতে অসুবিধা কি? কিছুদিন আগে ভারতের কর্ণাটকের তিন মন্ত্রী মুঠোফোনে পর্নো ছবি দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের হাতে ধরা পড়েছেন। দলীয় পরিচয়ে অভিযুক্তরা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য।
নরেন বাবুর গুজরাট আইনসভায়ও একই মজাদার ঘটনা ঘটেছে। অধিবেশন চলাকালে পানিসম্পদ বিভাগের জন্য বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখন এক সদস্য তাঁর পাশে বসা আরেক সদস্যকে তাঁর ট্যাবলেট পিসিতে ছবি দেখাচ্ছিলেন। আগে আমরা জানতাম বিজিপি শুধু হিন্দু ধর্ম নিয়ে আছে। এখন জানা গেল তারা ধর্ম, শিল্পকলা ও আদিরস নিয়েও সমান মশগুল। দুই বন্ধু প্রথমে দেখছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, তারপর কার্টুন ছবি এবং সব শেষে শুরু করেন নগ্ন নারী মডেলের অপূর্ব ছবি দেখা।
তাঁদের ওই আনন্দঘন মুহূর্তটি ধরা পড়ে এক সাংবাদিকের ক্যামেরায়। সাংবাদিক স্পিকারের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি প্রথম স্পিকারের পিএকে বিষয়টি জানান। পিএ গিয়ে স্পিকারকে জানান। এরপর আইপ্যাডটি অধিবেশনকক্ষ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘটনাটি তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটিকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। (প্রথম আলো, ২২ মার্চ)
স্পিকার নিজের কক্ষে ভিডিওটি দেখতে চেয়েছেন কি না, তা খবরে জানা যায়নি। মডেলের নগ্ন ছবিটি সত্যি সত্যি অশ্লীল কি না, তা যাচাই করতে চাওয়া দোষের নয়। জনপ্রতিনিধিরই তা করা উচিত।
সংসদকে শুধু সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু নয়, প্রাণবন্তও নাকি দেখতে চায় গণতন্ত্রকামী মানুষ। কোনো কোনো দেশের সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে খিস্তিখেউড়ে। যৌন ছবি চোখ দিয়ে দেখতে হয়। একসঙ্গে দু-চারজনের বেশি দেখতে পারেন না। খিস্তিখেউড় যৌন ছবির মতোই অশ্লীল এবং তা দু-চারজন নয়, বধিররা ছাড়া একসঙ্গে কোটি কোটি মানুষ শুনতে পায়। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের খিস্তি-বিনিময়ে সংসদ হয়ে ওঠে সাংঘাতিক এবং ‘প্রাণবন্ত’, আর জনগণের হয়ে ওঠে দুই কান লাল।
তবে শুধু সংসদে নয়, কোনো কোনো হতভাগ্য দেশে জননেতা ও জনপ্রতিনিধিরা জনসভাগুলোকেও করে তুলছেন প্রাণবন্ত। অনেক রকম বৃত্তান্তের সঙ্গে বংশ-বেত্তান্তও উঠে আসছে। তবে প্রতিপক্ষের নানা-নানি, দাদা-দাদি, খালা-খালু, মাসি-পিসি নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই জনগণের কান কম লাল হয়। আর একটি জিনিস আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে নেতাদের মতো জ্ঞানীরাই ভালো জানেন যে এই জগতে কারও জন্ম হবে আঁতুরঘরে, কারও ম্যাটারনিটি হাসপাতালে, কারও জন্ম চা-বাগানে, কারও রাবার বাগানে, কারও বা গোলাপ-বাগানে। জন্মের জায়গাটি মানুষের জীবনকে সার্থক করে না, মানুষের জীবন সার্থক কর্মে। এক শিশুর জন্ম হয়েছিল দীনতম কাঠের ঘরে। তিনি হলেন সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। সেখানকার কংগ্রেসে তাঁর জন্মলগ্ন ও জন্মের স্থান নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
কোনো কোনো দেশে সংসদে একসঙ্গে এক দল থাকাই ভালো। এক দল থাকলে জনগণের এক কান লাল হয়। দুই দল একসঙ্গে সংসদে থাকলে দুই কান হয় রক্তিম। অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা করা উচিত যেন যেদিন সরকারি দল সংসদে থাকবে, সেদিন বিরোধী দলের থাকার প্রয়োজন নেই। যেদিন বিরোধী দল সংসদে পদধূলি দেবে, সেদিন সরকারি দলের ছুটি। তাতে অন্তত একটি কান বাঁচবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
গণতন্ত্র বাতাসের মতো। তা চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় এবং গণতন্ত্রের সেই বাতাসের প্রকাশ ঘটে জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড ও বক্তৃতার মাধ্যমে। সংসদকক্ষের বাসিন্দা হলেন জনপ্রতিনিধিরা। সংসদকে আইনসভাও বলা হয়। সেখানে আইনকানুন তৈরি হয়, প্রচলিত অপ্রয়োজনীয় আইন পর্যালোচনা করে তা বাতিল বা সংশোধন করা হয়। আইনকানুন রচনার কাজ না থাকলে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। পার্লামেন্টারিয়ানদের মুখই হলো পুঁজি। সুতরাং তাঁরা সুবক্তাও হন। বক্তার মুখনিঃসৃত যুক্তিসমৃদ্ধ বাণীকেই ভালো বক্তৃতা বলা হয়।
আইনসভাগুলো এখন অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই জনপ্রতিনিধিদের ‘সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু’ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের কথাই ধরা যাক। মুঠোফোনে ‘অশ্লীল ভিডিও’ দেখা, গালিগালাজ করা প্রভৃতি মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে গণ্য। সুতরাং তা শুধু নিজের ঘরের মধ্যে বসে না করে সংসদকক্ষে বসে বা দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে করতে অসুবিধা কি? কিছুদিন আগে ভারতের কর্ণাটকের তিন মন্ত্রী মুঠোফোনে পর্নো ছবি দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের হাতে ধরা পড়েছেন। দলীয় পরিচয়ে অভিযুক্তরা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য।
নরেন বাবুর গুজরাট আইনসভায়ও একই মজাদার ঘটনা ঘটেছে। অধিবেশন চলাকালে পানিসম্পদ বিভাগের জন্য বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখন এক সদস্য তাঁর পাশে বসা আরেক সদস্যকে তাঁর ট্যাবলেট পিসিতে ছবি দেখাচ্ছিলেন। আগে আমরা জানতাম বিজিপি শুধু হিন্দু ধর্ম নিয়ে আছে। এখন জানা গেল তারা ধর্ম, শিল্পকলা ও আদিরস নিয়েও সমান মশগুল। দুই বন্ধু প্রথমে দেখছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, তারপর কার্টুন ছবি এবং সব শেষে শুরু করেন নগ্ন নারী মডেলের অপূর্ব ছবি দেখা।
তাঁদের ওই আনন্দঘন মুহূর্তটি ধরা পড়ে এক সাংবাদিকের ক্যামেরায়। সাংবাদিক স্পিকারের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি প্রথম স্পিকারের পিএকে বিষয়টি জানান। পিএ গিয়ে স্পিকারকে জানান। এরপর আইপ্যাডটি অধিবেশনকক্ষ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘটনাটি তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটিকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। (প্রথম আলো, ২২ মার্চ)
স্পিকার নিজের কক্ষে ভিডিওটি দেখতে চেয়েছেন কি না, তা খবরে জানা যায়নি। মডেলের নগ্ন ছবিটি সত্যি সত্যি অশ্লীল কি না, তা যাচাই করতে চাওয়া দোষের নয়। জনপ্রতিনিধিরই তা করা উচিত।
সংসদকে শুধু সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু নয়, প্রাণবন্তও নাকি দেখতে চায় গণতন্ত্রকামী মানুষ। কোনো কোনো দেশের সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে খিস্তিখেউড়ে। যৌন ছবি চোখ দিয়ে দেখতে হয়। একসঙ্গে দু-চারজনের বেশি দেখতে পারেন না। খিস্তিখেউড় যৌন ছবির মতোই অশ্লীল এবং তা দু-চারজন নয়, বধিররা ছাড়া একসঙ্গে কোটি কোটি মানুষ শুনতে পায়। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের খিস্তি-বিনিময়ে সংসদ হয়ে ওঠে সাংঘাতিক এবং ‘প্রাণবন্ত’, আর জনগণের হয়ে ওঠে দুই কান লাল।
তবে শুধু সংসদে নয়, কোনো কোনো হতভাগ্য দেশে জননেতা ও জনপ্রতিনিধিরা জনসভাগুলোকেও করে তুলছেন প্রাণবন্ত। অনেক রকম বৃত্তান্তের সঙ্গে বংশ-বেত্তান্তও উঠে আসছে। তবে প্রতিপক্ষের নানা-নানি, দাদা-দাদি, খালা-খালু, মাসি-পিসি নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই জনগণের কান কম লাল হয়। আর একটি জিনিস আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে নেতাদের মতো জ্ঞানীরাই ভালো জানেন যে এই জগতে কারও জন্ম হবে আঁতুরঘরে, কারও ম্যাটারনিটি হাসপাতালে, কারও জন্ম চা-বাগানে, কারও রাবার বাগানে, কারও বা গোলাপ-বাগানে। জন্মের জায়গাটি মানুষের জীবনকে সার্থক করে না, মানুষের জীবন সার্থক কর্মে। এক শিশুর জন্ম হয়েছিল দীনতম কাঠের ঘরে। তিনি হলেন সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। সেখানকার কংগ্রেসে তাঁর জন্মলগ্ন ও জন্মের স্থান নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
কোনো কোনো দেশে সংসদে একসঙ্গে এক দল থাকাই ভালো। এক দল থাকলে জনগণের এক কান লাল হয়। দুই দল একসঙ্গে সংসদে থাকলে দুই কান হয় রক্তিম। অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা করা উচিত যেন যেদিন সরকারি দল সংসদে থাকবে, সেদিন বিরোধী দলের থাকার প্রয়োজন নেই। যেদিন বিরোধী দল সংসদে পদধূলি দেবে, সেদিন সরকারি দলের ছুটি। তাতে অন্তত একটি কান বাঁচবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন