সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক বিতর্কের অবসান হচ্ছে আদালতের পূর্ণ রায়ে!


হারুন জামিল ও হাবিবুর রহমান
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সব ধরনের বিতর্ক অবসানে সুপ্রিম কোর্টের রায় লেখা শেষ হচ্ছে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তার অসমাপ্ত রায় আগামী মাসেই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। প্রাথমিক রায়ে যেসব বিষয় উল্লেখ ছিল তার অনেক কিছুই থাকছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে গত বছর মে মাসে তিনি যে রায় দিয়েছিলেন,পূর্ণাঙ্গ রায়ে তার অনেক পরিবর্তন থাকবে। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আরো কমপক্ষে দুই টার্ম রাখার যে কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ রায়ে তার ব্যাখ্যা থাকবে। একই সাথে উপদেষ্টা পরিষদে কারা থাকতে পারবেন তার একটি নির্দেশনাও থাকবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতি অথবা স্পিকারের কথা উল্লেখ থাকতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদের আকার ১০ সদস্য এবং তা সরকারি ও বিরোধী দল থেকে সমানসংখ্যক সদস্যের ভিত্তিতে রাখার নির্দেশনা দেয়া হতে পারে। রায় প্রকাশের পর এ বিষয়ে সংসদের আগামী বাজেট অধিবেশনেই সংবিধান সংশোধনীর জন্য নতুন বিল আনার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গত বছর মে মাসে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে তা সংবিধানের পরিপন'ী বলে উল্লেখ করা হয়। তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আরো দুই টার্ম সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে আদালত রায়ে মন্তব্য করেন। কিন' পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বিরোধী দলগুলোর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সরকার একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়কব্যবস'া বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে। ছয় মাসের মধ্যে এই রায় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশের কথা থাকলেও তা দীর্ঘায়িত করা হয়। বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দল বড় ধরনের আন্দোলনের প্রস'তি নেয়ায় সরকারের পক্ষ থেকেই এখন রায়টি দ্রুত লেখার তাগিদ দেয়া হয়েছে। রায়ে যাতে সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন থাকে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস'াও নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সংক্ষিপ্ত রায়ে যেসব কথা উল্লেখ করা হয়েছিল বিস্তারিত রায়ে তার বাইরে অনেক কথাই থাকবে। বিস্তারিত পর্যবেক্ষণও উল্লেখ করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওই রায়টি বিভক্ত রায় হলেও প্রধান বিচারপতিসহ বেঞ্চের অপর তিনজন একমত হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই তা চূড়ান্ত হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়ার পরপরই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসরে যান। এরপর এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
জানা গেছে, আপিল বিভাগের প্রিজাইডিং বিচারক হিসেবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায়টির মূল অংশ লেখা ও সমন্বয় করলেও দ্বিমত পোষণকারী বিচারপতিদের বক্তব্যও সেখানে উল্লেখ থাকবে। ইতোমধ্যে রায়ের বেশির ভাগ অংশই লেখা শেষ হয়েছে এবং বর্তমানে পরিমার্জনের কাজ চলছে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি ও দেশের একজন শীর্ষ স'ানীয় আইনজীবী গতকাল জানান, জনগণ রায় চান, পলিটিক্যাল থিসিস চান না। রায় মামলার বিষয়বস' ও ঘটনা-প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। আদালত বিষয়বস' ও ঘটনার বাইরে রায় দিতে পারেন না। এ মামলার শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দেশের শীর্ষ আইনজীবীরাই রায় চেয়েছেন, কোনো পলিটিক্যাল থিসিস চাননি।
খ্যাতনামা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় দেখে সংবিধান সংশোধন করা উচিত ছিল। রায়ে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলা হলেও এ বিধান বাতিল করা ঠিক হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া গেলে সমস্যার সমাধান হতে পারে কি না- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী রায় দেয়া হবে তার ওপর নির্ভর করবে সমস্যার সমাধান হবে কি না।
রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প থাকতে পারে কি না- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পরেই এ বিষয়ে বলা যাবে। গত ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় প্রদানের দিন প্রবীণ এই আইনজীবী বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়কব্যবস'া সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায় স্ববিরোধী। রায়ে বলা হয়েছে, এখন থেকে রায় কার্যকর হবে। আবার বলা হয়েছে দশম ও একাদশ এই দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে। এটা সম্পূর্ণ স্ববিরোধিতাপূর্ণ।
প্রবীণ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা চাই দেশে নিরপেক্ষ সংস'ার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক। তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য যেকোনো নামে হতে পারে। আপিল বিভাগ এই বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। এ জন্য রায়ে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন' বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে যে বিধান করা হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে থেকে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন হবে। কিন' বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা অসম্ভব। আমরা মনে করি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। তা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আমরা নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে দেখেছি নির্বাচন কমিশন একটি দন্তহীন বাঘ। নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। সরকার নির্বাচন কমিশনের চিঠির জবাব দেয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। অথচ সরকারকে প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করার বিধান রয়েছে। আর এত বড় ঘটনার পরও নির্বাচন কমিশন সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে কোনো ব্যবস'া নেয়নি।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দেশের শীর্ষ আইনজীবী ও সুশীলসমাজ মনে করে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে তাদের অধীনে যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তবে তা হবে একটি প্রহসন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেশকে সঙ্ঘাতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বে। এ জন্য যত দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে তা দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা না করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কব্যবস'া তুলে দেয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আর এত দিন পর আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার সম্পর্কে কিছু বলা হবে, এটাও প্রহসনের মতো এবং দেশকে সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে সংসদকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর অর্থ সংসদ সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে। সংসদ আপিল বিভাগের ওপর নির্ভরশীল হোক এটা কাম্য নয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের মে মাসে সংক্ষিপ্ত আদেশে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে আপিল মঞ্জুর করা হলো। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন ১৯৯৬ এখন থেকে বাতিল ও সংবিধানপরিপন'ী ঘোষণা করা হলো। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে হতে পারে। আইনের অনেক পুরনো নীতি হচ্ছে এই- কোনো কিছু বেআইনি হলেও প্রয়োজনের তাগিদে তা বৈধ হতে পারে। একই সাথে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগের বিধান বাতিলে আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের স্বাধীনতা থাকবে। ওই মামলার শুনানি শুরু হয় গত বছরের ১ মার্চ। রায় ঘোষণা করা হয় ১০ মে। সুপ্রিম কোর্ট আটজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। এর মধ্যে মাত্র একজন তত্ত্বাবধায়কব্যবস'া বাতিলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। অন্যরা এই বিধান রাখার পক্ষে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন। কিন' আদালত অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য গ্রহণ করেননি।
তত্ত্বাবধায়কব্যবস'ার অন্তর্ভুক্তি ও রিট দায়ের : ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়কব্যবস'া অন-র্ভুক্ত হয়। ষষ্ঠ সংসদে গৃহীত এ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি জানান ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এ অবস'ায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিমউল্লাহসহ কয়েকজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়কব্যবস'া বা পদ্ধতি গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার পরিপন'ী। এটা সংবিধানেরও পরিপন'ী। ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিলেন। পরে রুলের শুনানি গ্রহণ করে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস'াকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন, বিচারপতি মো. আওলাদ আলী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে ওই শুনানি হয়। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস'াকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন মূল রায় লিখেন। অন্য দুই বিচারপতিও তার সাথে একমত পোষণ করেন।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ও সংবিধান সম্মত। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস-াবনা ৪৮ এবং ৫৬ অনুচ্ছেদে কোনো সংশোধন আনা হয়নি। এ কারণে কোনো গণভোটের প্রয়োজন ছিল না। এই সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেনি, বিশেষ করে গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন হাইকোর্ট। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো মামলায় হাইকোর্ট যদি মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত রয়েছে তাহলে সার্টিফিকেট দেয়া হয়। এতে আর লিভ টু আপিল করতে হয় না। সরাসরি আপিল হয়ে যায়।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান আবেদনকারীরা। মূল রিট আবেদনকারী এম সলিমউল্লাহ মারা যাওয়ায় এবং অন্য আবেদনকারী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস বাবু হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় আপিলটি মো. আব্দুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ সরকার নামে কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং এর ওপরই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন