ভারতের একটি মানচিত্রে বাংলাদেশকে সে দেশের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এ নিয়ে আপত্তি উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে কেউ জানে না। সমপ্রতি কেরালায় ভারতের আশপাশের সব দেশকে ভারতের অংশ দেখিয়ে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয়েছে। ‘বৃহৎ ভারত’ ও ‘অখণ্ড’ ভারত-ভাবনা থেকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’-এর জন্ম। ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সুযোগ পেলেই দাদাগিরির মাধ্যমে সেটি প্রতিবেশীদের বুঝিয়ে দিতে ভুলও করে না, কার্পণ্যও করে না। আমাদের স্বাধীনতা-ভাবনায় ভারত আসে দু’ভাবে। প্রথম ভাবনায় সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে পড়ে। আবার আমাদের টিকে থাকার প্রশ্নে ভারতের অসহযোগিতায় ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে আজকের লেখা।
ছিটমহলবাসী অনশনে গেল, সরকার কোনো কথা বলল না। প্রশ্ন, ৪০ বছরেও তারা কি স্বাধীন দেশে পরাধীন হয়ে থাকবে? যে ভারত আমাদের স্বাধীনতায় এত সাহায্য-সহযোগিতা করল তারা কেন আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না? আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তাদের কাছে মর্যাদাহীন, বাজারটাই আসল। ভারত নিজের স্বার্থ এক রত্তি ছাড় দিচ্ছে না, আদায় করে নিতে চাচ্ছে ষোলো আনা। ভারতের এত অহমিকার কাছে আমাদের স্বাধীনতা যেন তাৎপর্যহীন।
স্বাধীনতা, ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। বহুমাত্রিক অর্থ ও ধারণা নিয়ে এটি একেকজনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়।
প্রথাগত ক্রীতদাসের কাছে স্বাধীনতা যেভাবে ধরা দেয়, সাধারণ কারাবন্দীর কাছে সেটি কিছুটা ভিন্ন অর্থ বহন করে। অনেক আদিবাসী কিংবা উপজাতি স্বাধীনতা উপলব্ধি করে তাদের মতো করে। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর কাছেও স্বাধীনতা সমান অর্থ বহন করে না। মরুবাসী বেদুইন, অরণ্যবাসী মানুষ স্বাধীনতাকে তাদের মাত্রাজ্ঞান দিয়ে বুঝতে চায়। তবে সমাজবদ্ধ মানুষ যখন রাষ্ট্রাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল- তখন স্বাধীনতা অন্যমাত্রিক ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনা নিয়ে ধরা দিলো।
নানাভাবে মানুষই মানুষের জন্মগত স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়। একশ্রেণীর মানুষ অপর শ্রেণীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে চায়। এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের ভাষাই প্রভুত্ব থেকে উৎসারিত হয়। এখানে একদল শাসক সাজে, অন্যরা শাসিত। একটি গোষ্ঠী প্রভু, অন্যরা ক্রীতদাসতুল্য। শাসন-শোষণ ও অবদমিত করে রাখার অর্থই হলো পরাধীন করে রাখা। সঙ্গত কারণেই ক্রীতদাসের মানস আর মুক্ত মানুষের চিন্তা এক হয় না। স্বাধীনতার ধারণাও জনে জনে মনে মনে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এ কারণেই মানসিক গোলামেরা স্বাধীনতার আবেগ লালন করে কিন' অহম বোঝে না। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে, আত্মমর্যাদা বোঝে না। অস্তিত্ব বিসর্জন দেয় কিন' সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখতে পারে না।
সহজাতভাবে মানুষ প্রভুত্বকামী। মানুষ মানুষের ওপর প্রভুত্ব করার উদগ্র বাসনা লালন করে বলেই মানুষের ভেতর শ্রেণিভেদপ্রথা চালু হতে পেরেছে। এখানে মানুষ দাস ও প্রভুতে রূপান্তরিত হয়। সব ঐশীগ্রনে' মানুষকে সমান মর্যাদার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী ভাবা হয়েছে। মানুষের ওপর মানুষের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব রাখা হয়নি। মানুষের সাথে মানুষের পার্থক্য আছে যোগ্যতার। তারতম্য হয় চেহারায়, অবয়বে। আর থাকে জ্ঞানবুদ্ধির ফারাক, বোধবিশ্বাসের দূরত্ব। সাধারণভাবে মানুষ সৃষ্টির সেরা। এমন ধারণা থেকেই রাষ্ট্র মানুষের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন হিসেবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অর্থ খুঁজে পেয়েছে, নীতি প্রণয়ন করেছে, পররাষ্ট্র নীতির স্বাধীন বৈশিষ্ট্য রচনা করেছে।
ইসলাম স্বাধীনতার একটি সার্বজনীন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা উপস'াপন করেছে। সৃষ্টির সেরা মানুষ। মানুষ মানুষের প্রভুত্ব করবে না। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করার জন্য। এ কারণেই বলা হয়, মানুষ কলেমা পড়ে শুধু ঈমানের ঘোষণা দেয় না, নিজেকে স্বাধীন বলেও ঘোষণা করে। কারণ কলেমা পড়ার পর মানুষ আর মানুষের প্রভুত্বের আওতায় থাকে না। প্রভুত্ব সংরক্ষিত হয়ে যায় একমাত্র সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহর জন্য। অবশিষ্ট দায়দায়িত্ব ও আনুগত্য মানুষ অধিকার ও কর্তব্যজ্ঞান থেকে বিধিবিধান তৈরি করে অনুসরণ করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান স্বাধীনতার একটি রাজনৈতিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। কিছু অধিকার ও দায়বোধ নিয়ে মানুষ সমঝোতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে। রাষ্ট্র একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। এর একটি সরকার থাকবে। নির্ধারিত সীমার ভেতরে এর জনগোষ্ঠী বসবাস করবে। নিজেরা সমঝোতার ভিত্তিতে একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে। গরিষ্ঠের অভিমত বা ভোট নিয়ে সেটি কার্যকর হবে। রাষ্ট্র নামের প্রতীকী প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিনিধিত্ব করবে সরকার। সরকার গঠন করবে এর জনগণ- সেটা প্রত্যক্ষভাবেও হতে পারে, পরোক্ষভাবেও হতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্র মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ। সমাজ ও রাষ্ট্র দুটোই মানুষের জন্য। সৃষ্টিকর্তার দেয়া বিধিবিধানেও মানুষকে সমাজবদ্ধ হয়ে ঐক্য-চেতনায়, ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে, অধিকার ও কর্তব্য-সচেতন থেকে জীবন যাপন করতে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতাকে অর্জনের বিষয় ভাবা হয় দুটো কারণে : প্রথমত, এটি একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে আত্মপ্রকাশ করে; দ্বিতীয়ত, এটি যুদ্ধ করে, কূটনৈতিকভাবে, সমঝোতার ভিত্তিতে কিংবা শাসন-শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত ফসলও হতে পারে।
পাক-ভারত যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে ভিন্নভাবে। একইভাবে দেশে দেশে স্বাধীনতা অর্জনের আলাদা ইতিহাস আছে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। বাঙালি জাতিসত্তা বাংলাদেশী হিসেবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। আমরা বাঙালি কিন' বাংলাদেশী। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বাঙালি রয়েছে- তারা বাংলাদেশী নয়, ভারতের নাগরিক তথা ভারতীয়। তাই রাষ্ট্রাচার ও জাতিসত্তা সব সময় এক লাইনে বা সরলরেখায় সব ভাবের প্রকাশ ঘটায় না।
যেমন ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ব্রিটিশমুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করল। দুটো দেশই বহুভাষী মানুষের জনপদ, বহুধর্মীয় গোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠী উভয় দেশে বসবাস করে। ভারত-পাকিস্তান সেই উত্তরাধিকার বহন করে স্বাধীন। আমরা একাত্তর ছুঁয়ে স্বাধীনতার কথা বলছি। মধ্যখানের ইতিহাস অবশ্যই শোষণ-বঞ্চনার। তার পরও ভারতীয় উপমা সামনে রেখে বিষয়টিকে মনের বড় ক্যানভাসে নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। সে ক্ষেত্রে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আমাদের জাতীয় নেতারা অবদান রেখেছেন, অবিনাশী ভূমিকা পালন করেছেন, তাহলে ’৪৭ সালের অর্জন থেকে আমাদের হিস্যাটুকু ভারত কিংবা পাকিস্তানকে বর্গা বা ছাড় দেয়া হবে কেন! কেন খণ্ডিত ইতিহাসচর্চার এমন বেসাতি!
আজকাল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে শুধু আবেগের বিষয় ভাবা হয় না। কারণ গ্লোবাল ভিলেজের এই যুগে স্বাধীনতাকে আরো জুতসই ব্যাখ্যা করে বোঝার চেষ্টা করা হয়। এখন মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার অনেক বেশি আলোচিত। অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়টিও সমালোচিত। রাজনৈতিক নিপীড়ন নিন্দিত প্রসঙ্গ। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ধর্মীয় অধিকার বঞ্চিত করা, নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংরক্ষণসহ দ্বিরাষ্ট্রিক ও বহুরাষ্ট্রিক সম্পর্কের বোঝাপড়ায় স্বাধীনতার মানদণ্ড নির্ণিত হয়। পৃথিবীর কোনো মানুষ ইরাক-আফগানিস্তানে আগ্রাসন মেনে নেয়নি। ইরাকের পোড়ামাটি ও আফগানিস্তানের ধ্বংসস-ূপ যে নবীন শিশুকে স্বাধীনতার অর্থ শিখিয়েছে- সেটা যুক্তরাষ্ট্রবাসীর বোধগম্যের বাইরে। ফিলিস্তিনি কোনো শিশু কিংবা শরণার্থীশিবির অথবা অধিকৃত অঞ্চলের বাড়ন্ত বয়সের তরুণকে স্বাধীনতা অর্থ খুঁজতে বললে যা বলবে, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের শিশু-কিশোর তা বলবে না। জাতপাতে পিষ্ট ভারতীয় তফসিলি জাতিগুলো স্বাধীনতাকে যেভাবে বুঝছে, কাশ্মির-সেভেন সিস্টার বুঝেছে ভিন্নভাবে। মাওবাদীদের ধারণা একেবারে আলাদা। শাসক ও আর্যসমাজভুক্ত বাবুরা বুঝেছে ভিন্নভাবে। একইভাবে বসনিয়া-চেচনিয়ার শিশুরা স্বাধীনতাকে ছুঁয়ে দেখেছে ভিন্নমাত্রিক উপলব্ধি নিয়ে। প্রাসঙ্গিকতার এত সব উপমা টানার অর্থ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ধারণা যে এখনো তর্কিত প্রসঙ্গ হয়ে আছে সেটা উপলব্ধি করা। পূর্ব তিমুর ও সুদানও এর বড় উপমা হতে পারে। এখানে এসেই আমরা বিবেচনায় নিতে পারি পশ্চিম বাংলার আজকের ভূমিকার। আমাদের স্বাধীনতার বিপরীতে তাদের অবস'ান রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবশ্যই ভেবে দেখতে চাইবে। সেই সাথে দেশে দেশে স্বাধীনতার রূপময়তায় যে ফারাক, সেটাও দায়বোধকে জাগ্রত করবে।
এ জন্যই বলা হয়, স্বাধীনতা ছেলের হাতের মোয়া নয় যে একেবারে সহজলভ্য। আবার অতটা অধরা কিছু নয় যে, একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তার ঐক্য, বাসনা ও স্পৃহা আজীবন না পাওয়ার বিষয় হয়ে থেকে যাবে। আরো একটি ইতিহাসকেন্দ্রিক উপমা টানা যেতে পারে। আমরা একসময় স্বাধীন ছিলাম, এই যুক্তি না মানলে ব্রিটিশরা আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল কিভাবে? আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম, তা না হলে পরাধীনতা কিভাবে দুই শ’ বছর আমাদের গ্রাস করে রেখেছিল। বাহাদুর শাহ জাফর, ইসমাইল শহীদ, তিতুমীর, সিরাজউদ্দৌলা, ফকির মজনু শাহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, হাবিলদার রজব আলীরা কার বিরুদ্ধে কেন লড়েছেন? একাত্তর সাল থেকে ইতিহাস রচনাকারীরা এ প্রশ্নের জবাব দেবেন কিভাবে?
তা ছাড়া জাতীয় কবি নজরুল কোন শিকল ভাঙার গান গাইলেন, কোন কারার লৌহ কপাট ভাঙতে উদ্বুদ্ধ করলেন? নবাব সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরণ নিয়ে আমরা ক্ষুদ্র চিন্তার গণ্ডিবদ্ধ ভাবনায় দোল খাচ্ছি না তো? ইতিহাসের যোগসূত্র খুঁজে পেতে সচেষ্ট না হলে কিংবা ইতিহাসের যোগসূত্রতা হারালে আমরা কূপমণ্ডূক হয়ে যাবো। নিজেদের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করব। হাজার বছরের ঐতিহ্য থেকে আমাদের বৃন্তচ্যুত করে দিতে পারলেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের শত্রুরা খুশি হয়। আমরা সে ধরনের ষড়যন্ত্রের গহ্বরে ডুবে যেতে পারি না।
৪০ বছরে পা দিয়ে আমরা দেখছি আমাদের স্বাধীনতার অহঙ্কারকে পাক-ভারত যুদ্ধের বাইপ্রোডাক্ট বানানো হচ্ছে। স্বাধীনতা পাইয়ে দিতে ভারতের করুণা ও অনুদানের খেসারত দিতে দিতে আমরা সন্ধিজালে জড়িয়ে পড়ছি। আমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ঢুকে পড়েছে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের শত্রুরা। জল-জল্লাদদের কারণে মরুকরণে দেশ ছারখার। অর্থনৈতিক শোষণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হার মানাচ্ছে। আমরা প্রতিবেশী দেশের পণ্য ও সংস্কৃতির বাজারে রূপান্তরিত হয়েছি। স্বাধীনতা দিবসেও ছিটমহলবাসীর আহাজারি থামানোর কোনো প্রয়াস লক্ষ করা গেল না। পাওয়া, না পাওয়ার হিসাব মেলাতেও দেখলাম না। স্বাধীনতাকে পণ্য বানিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যটা কিন' দৃষ্টি এড়ালো না।
যে জাতি বাংলা ভাষার মান রক্ষার জন্য লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে, সে জাতি এখন হিন্দির জোয়ারে ডুবতে বসেছে। পিণ্ডির পরিবর্তে দিল্লি আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে। এ যুগে স্বাধীনতা মানে এক চিলতে জমি নয়; এক খণ্ড কাপড় দিয়ে বানানো পতাকা নয়; অনুশীলন-অযোগ্য একটি সংবিধান নয়; সুরম্য অট্টালিকার অকার্যকর সংসদ নয়; নির্বাচিত কিন' একনায়কতান্ত্রিক মানস-লালিত একটি সরকারও নয়। এখন স্বাধীনতা মানে মৌলিক ও মানবাধিকারের সংরক্ষণ; আইনের শাসনের নিশ্চয়তা; মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা; দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা রক্ষায় দেশ রক্ষাবাহিনীর উন্নত মম শির মানসিকতা; পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সব বিদেশী প্রভুত্ব অস্বীকার করা; দেশের ভেতর সম-অধিকারের ভিত্তিতে অবাধ গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ বজায় রাখা- সর্বোপরি জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা। তবেই না স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়ায় মাথানত না করা। বন্ধুকে প্রভুর আসনে না বসিয়ে সমমর্যাদা নিশ্চিত করা। সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক গোলামিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতে পারা- স্বাধীনতা তুমি আমার অহঙ্কার, অর্জনের সোনাঝরা ফসল, তোমাকে পাবো বলেই এত বিসর্জন মেনে নেয়া।
বাস্তবে ৪০ বছরের মাথায় এসেও আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে, চিন্তার সততা ও স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখন আদালতের কাঠগড়ায়। স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় ও পরিকল্পিতভাবে। সংবিধান এখনো সর্বজনীন দলিলের মর্যাদা পাচ্ছে না। বিতর্কিত সংশোধনী যেন আমাদের নিয়তি। সংসদ নিয়ে উচ্ছ্বাস উবে গেছে। গণতন্ত্র এখনো বোবাকান্নায় গুমরে মরছে। ভিন্ন মত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেন অসহ্য। দুই দিন আগে ২৬ মার্চ পালন করা হলো, অথচ স্বাধীনতাকে পাওয়ার আকুতি, আর কী পাওয়ার ও চাওয়ার ছিল- কী পেয়েছি সেই গান এখনো বাজছে। নীতিনির্ধারকেরা এসব নিয়ে ভাবার গরজই বোধ করছেন না- হায়রে স্বাধীনতা- তোমাকে নিয়ে ছলচাতুরির রাজনীতি আর কত দিন চলবে!
স্বাধীনতা দিবসও আমাদের এক মঞ্চে তুলতে পারে না, জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানোর দায়বোধ করায় না, অবিতর্কিত সংবিধান রচনার তাগিদ দেয় না, গণতন্ত্রের জন্য উদগ্র বাসনা জাগায় না। তাহলে কি ধরে নেয়া হবে আমাদের রাজনীতিবিদেরা শুধুই ক্ষমতান্ধ, ক্ষমতার জন্যই শুধু স্বাধীনতার মতো মহান অর্জনকে অপব্যবহার করেন?
এবার স্বাধীনতার মাসে পরাধীনতার গ্লানিটাও যেন বেড়ে গেল। বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করে দিলো। বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে অশোভন ও অগণতান্ত্রিক আচরণের মধ্য দিয়ে সরকার আবার প্রমাণ করল নির্বাচিত স্বৈরাচার কাকে বলে। সরকারি নির্দেশে রূপসী বাংলায় অনুষ্ঠিতব্য মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই সরকারের বাড়া ভাতে ছাই ছিটায়নি। এর মাধ্যমে বিদেশী বন্ধুদের বিরত করার বদখেয়াল কারো ছিল বলে মনে হয়নি। সরকার কূটবুদ্ধিতাড়িত হয়ে হয়তো চায়নি মিডিয়ায় বিরোধীদলীয় নেত্রীর সরব উপসি'তি। বিদেশী বন্ধুদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর খবরের সাথে বিরোধীদলীয় নেত্রীর খবরটা সবাই জানুক- এটাই যেন অসহ্য বিষয় হলো। স্মৃতিসৌধে যাওয়ার পথে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ‘যাত্রাভঙ্গের’ কারণটাও অসহিষ্ণু আচরণেরই অংশ। ক্রিকেট নিয়ে বিদ্রূপও রুচিবোধ এবং সাধারণ ভদ্রতাকে আহত করে। আমরা জানি না এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম কী সবক পেল, আর ঢাকায় অবস'ানরত বিদেশী বন্ধুরাই বা কী মেসেজ গ্রহণ করল। এসব কর্মকাণ্ডকে কি শুধুই বাড়াবাড়ি বলা হবে! নাকি উসকানিমূলক কাজে উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ভাবা হবে। সরকার কি চাচ্ছে বিরোধী দল বা জোট নো রিটার্ন পয়েন্টে চলে যাক? হয়তো বা সেটাই সরকারের গোপন ইচ্ছা।
প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দাঁড়ায়- সরকার কি নৈতিক পরাজয়ের সাথে সাথে ব্যর্থতার অনুশোচনায় আক্রান্ত? হয়তো বা তাই। নয়তো এত সব অগণতান্ত্রিক ও আত্মঘাতী তৎপরতার ব্যাখ্যা করা কিভাবে সম্ভব। গণতান্ত্রিক পথ ও পন'া রুদ্ধ করে দেয়ার গোপন ইচ্ছা সক্রিয় না থাকলে কোনো সরকারই দেশকে অসি'র ও অসি'তিশীল করতে চায় না। বর্তমান সরকারের অনেক আচরণই গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিচারে অগ্রহণযোগ্য। এর শেষ কোথায়? এভাবে আর কত দিনই বা চলবে- এ জিজ্ঞাসার মধ্যেই জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে।
digantaeditorial@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন