শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

শেয়ারবাজার বংলাদেশের মূল পুঁজিবাজার নয়



 এবনে গোলাম সামাদ

শেয়ার বলতে সাধারণভাবে বোঝায় যৌথ মূলধনী কোম্পানির সংগৃহীত মূলধনের একটি ক্ষুদ্র অংশকে। ধরা যাক কোনো যৌথ কোম্পানি ১০ কোটি টাকা পুঁজি হিসেবে সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। এর জন্য সে বাজারে এক লাখ শেয়ার ছাড়তে পারে, যার প্রতিটির দাম হতে পারে এক হাজার টাকা। এই শেয়ার ক্রেতারা কিনতে পারে শেয়ারবাজার (স্টক এক্সচেঞ্জ) থেকে। শেয়ারবাজার বলতে সাধারণভাবে বোঝায় এমন জায়গা, যেখানে যৌথ মূলধনী কোম্পানির শেয়ার বা অংশ বেচাকেনা হয়। মানুষ কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনে ওই কোম্পানির কারবারের লাভের অংশ বা ডিভিডেন্ট পাওয়ার জন্য। এর মধ্যে দোষের কিছু থাকে না। কিন' শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচা এমন একটা পৃথক ব্যবস'া হয়ে দাঁড়ায়, যাতে যুক্ত হতে পারে অনেক অনিয়ম আর সেই সাথে দুর্নীতি। শেয়ার কেনাবেচার দালাল (অ্যাজেন্ট) বলতে বোঝায় তাদের, যারা হলেন শেয়ারবাজারের সদস্য, যাদের থাকে শেয়ারবাজারে বৈধভাবে শেয়ার কেনাবেচার অধিকার। শেয়ারবাজারে কেবল সেসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হতে পারে, যাদের শেয়ারবাজারের পরিচালকমণ্ডলী দান করেন অনুমোদন। অননুমোদিত কোনো কোম্পানির শেয়ার কোনো বিশেষ শেয়ারবাজারে বিক্রি হতে পারে না। শেয়ারবাজারের পরিচালকেরা কোনো কোম্পানি সম্পর্কে বিশেষভাবে নিশ্চিত না হলে কোনো শেয়ারবাজারে তাদের শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দেয় না। শেয়ারবাজারের দালাল হতে হলে শেয়ারবাজারের সদস্য হতে হয়। কেবল শেয়ারবাজারের সদস্যরাই পারেন শেয়ার কেনাবেচা করতে। শেয়ারবাজারের সভ্য (দালাল) ছাড়া আর কেউ শেয়ারবাজারে প্রবেশের অধিকারী নন। তবে শেয়ারবাজারের কাছে শেয়ারবাজারের দালালদের অফিস থাকে, যেখানে যেয়ে সহজেই তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায় এবং তাদের মাধ্যমে করা সম্ভব হয় শেয়ার কেনাবেচা। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে প্রবেশ করবার জন্য ৬ মাসমেয়াদি টিকিট কেনা চলে। এভাবে টিকিট কিনেও শেয়ারবাজারের দালালদের সাথে যোগাযোগ করে শেয়ার কেনাবেচা সম্ভব। শেয়ার কেনাবেচা শেষ পর্যন- দাঁড়ায় ফটকাবাজারিতে। ফটকাবাজারি বলতে বোঝায় শেয়ার কেনাবেচা করে লাভবান হওয়ার চেষ্টাকে। শেয়ারবাজার শেষ পর্যন- হয়ে দাঁড়ায় একটা ফটকাবাজারের কেন্দ্র। ফটকা দুই রকমের হতে পারে। এক রকম ফটকা হলো, কম দামে শেয়ার কিনে সেই শেয়ারের দাম বাড়লে বিক্রি করে লাভ করা। আর এক রকম ফটকা হলো, কোনো কোম্পনির শেয়ার পরে কম দামে কেনা যাবে এ কথা ভেবে আগে বিক্রি করা। এ ক্ষেত্রে শেয়ার বিক্রি না করে বাজি ধরা হয়। যদি কোনো কোম্পানির শেয়ার পরে কম দামে বিক্রি না হয়, তবে যে শেয়ার না কিনে আগাম বিক্রি করে তাকে বিপাকে পড়তে হয়। কম দামে শেয়ার কিনে পরে ওই শেয়ারের দাম বাড়লে তা বিক্রি করে যারা লাভবান হতে চান তাদের বলে তেজিওয়ালা। ইংরেজিতে বলে বুল (Bull)। আর যারা ভবিষ্যতে কোনো কোম্পানির শেয়ার কম দামে বিক্রি হবে এটা ভেবে আগাম বিক্রি করে তাদের বলা হয় মন্দিওয়ালা। মন্দিওয়ালাদের ইংরেজিতে বলে বেয়ার (Bear)। শেয়ারবাজার হয়ে দাঁড়ায় তেজিওয়ালা ও মন্দিওয়ালাদের লীলাক্ষেত্রে। শেয়ারবাজারে কেনাবেচা করে খুব বেশি লোক লাভবান হতে পারেন না। শেয়ারবাজার হয়ে দাঁড়ায় কতকটা জুয়া খেলার মতো। জুয়া খেলার মতোই হলো শেয়ারবাজারের শেয়ার কেনাবেচার আকর্ষণ। আমি কখনোই শেয়ার কেনাবেচা করিনি। আমার এক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইংরেজ আমলে কলকাতা শেয়ারবাজারে কেনাবেচা করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমি থেকেছি শেয়ারবাজার থেকে দূরে। শেয়ারবাজার আমার কাছে মনে হয়েছে একটা ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত স'ান। হঠাৎ বড়লোক হওয়ার চিন-া আমার ছিল না। আর এখনো নেই। অনেকে শেয়ারবাজারে ফটকাবাজারি করেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। শেয়ারবাজারে ধস নামলে শোধ হতে পারে না ব্যাংকঋণ। অনেক ব্যাংক ফেল পড়ে এ রকম ঋণ দেয়ার কারণে। বিশেষ করে ছোট ব্যাংকগুলো। তবে বড় ব্যাংকও ফেল পড়তে পারে। আর দেশে দেখা দিতে পারে অর্থনীতিতে মহাবিপর্যয়। ১৯২৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ রকম বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়েছিল মহামন্দা। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবার দেখা দিয়েছে মহামন্দা না হলেও বড় রকমের মন্দা, যার একটা কারণ হলো ব্যাংক কর্তৃক বিষাক্ত ঋণ প্রদান। বিষাক্ত ঋণ বলতে বোঝায়, যে ঋণ শোধ হতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি তৈরির কোম্পানি বাজারে অনেক শেয়ার ছাড়ে। এসব শেয়ার বিক্রি হয় প্রচুর। বাড়ি তৈরির কোম্পানিগুলো চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বাড়ি তৈরি করে ফেলে। বাড়ি বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরির কোম্পানির শেয়ার যারা কিনেছিলেন তাদের পক্ষে ব্যাংক ঋণ শোধ দেয়া সম্ভব হয় না। এটা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান মন্দা সৃষ্টি হওয়ার একটা কারণ। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর ইউরোপের অর্থনীতি বিশেষভাবে নির্ভরশীল, তাই সেখানেও এসে পড়েছে বড় রকমের মন্দার প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকার ২ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সংখ্যায় একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজার হলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই ঝুঁকির মাত্রা কমার কোনো লক্ষণ আপাতত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কারণ, বিশ্বজুড়ে চলছে বাণিজ্যমন্দা। নিকট ভবিষ্যতে যার মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। এর এর ফলে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমতে পারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের চাহিদা। এই চাহিদা কমে যাওয়া বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে করে তুলতে পারে আরো অনেক বেশি অনিশ্চিত। শেয়ারবাজার নিয়ে অনেক দেশেই উঠছে প্রশ্ন। শেয়ারবাজারকে কি আসলেই বলা যায় পুঁজির বাজার? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার অবসি'ত নিউ ইয়র্ক শহরের ওয়াল স্ট্রিটে। একদল মার্কিন নাগরিক এখন চাচ্ছেন এই শেয়ারবাজারের বিলুপ্তি। তারা বলছেন, ওয়াল স্ট্রিট দখল করো। তারা চাচ্ছেন ফটকাবাজারি অর্থনীতির অবসান। আমি শেয়ার কেনাবেচার বিরোধী নই। কিন' একে নির্ভর করে যে ভয়ঙ্কর ফটকাবাজারি সৃষ্টি হতে পারে, আমি তার ঘোর বিরোধী। বাংলাদেশে আগে শেয়ারবাজার ছিল না। এখন হয়েছে। কিন' এই শেয়ারবাজারে দেখা দিয়েছে ক্ষতিকর ফটকাবাজারি।
আমাদের দেশ এখনো মূলত কৃষিনির্ভর। আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনো হয়ে আছে বস'ত কৃষি অর্থনীতি। আমাদের দেশের শেয়ারবাজারকে পুঁজির বাজার হিসেবে যে রকম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে আসলে তার সে রকম গুরুত্ব নেই। কারণ শেয়ারবাজারের টাকা এসে মূলধন হিসেবে খাটতে পারছে না আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে। আমার মনে হয় এ দেশের কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত সমবায় সমিতিভিত্তিক কৃষি ব্যাংক। কৃষিতে উন্নতি ঘটলে বাড়বে কৃষিজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। আর তাই আমরা নানা জিনিস উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারব তাদের কাছে। অর্থাৎ ঘটতে পারবে আমাদের অভ্যন-রীণ বাজারের বিশেষ সম্প্রসারণ, যেটা পাওয়া উচিত আমাদের অগ্রাধিকার। শেষ পর্যন- খেয়ে-পরে বাঁচতে হয় মানুষকে। আর এই খেয়ে-পরে বাঁচা নির্ভর করে একটা দেশের মাটির ওপর।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিষ্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন